প্রথম মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি কোনো সময়ে লন্ডনে একবার এউরিপিদেসের ত্রোয়াদেস নাটকের অভিনয় হয়েছিল। নাটকটির অনুবাদ করেছিলেন গিলবার্ট মারে। তখন ইংল্যান্ডের সর্বত্র যুদ্ধের বিভীষিকা। প্রত্যহই ঘরে আসছে দুঃসংবাদ। এমন একটা সময়, যখন উইলফ্রেড ওয়েন লিখেছেন what passing bell for these who die as cattle? Only the monstrous anger of the guns… নাটক শেষ হওয়ার পরে একদল বিমূঢ় দর্শক চিৎকার করে উঠেছিল। ‘নাট্যকার! নাট্যকার! নাট্যকারকে দেখতে চাই।’ কে সেই নাট্যকার যিনি এমন করে তাদের জীবনের তীব্র অভিজ্ঞতা ফুটিয়ে তুলেছেন ট্রয়ের রূপকে? পরিচালকের অনুরোধে গিলবার্ট মারে রঙ্গমঞ্চের ওপর এসে দাঁড়ালেন। আবেগমুখর দর্শকদের সামনে এসে তিনি একটিমাত্র বাক্য উচ্চারণ করলেন, ‘এই নাটকের লেখক আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে মারা গেছেন।’’
(‘উত্তরলেখ’, ‘বন্দিনী’, শিশিরকুমার দাশ)
আরও পড়ুন: অভিমানে ঘর ছেড়েছিলেন একদিন, নিজের হাতে টমেটো ফলিয়ে পৌষমেলায় দোকান দিয়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র! লিখছেন আশিস পাঠক…
সময়কে নিয়ে এক জাতের ‘অলৌকিক সংলাপ’-এ মেতে ওঠার নেশা ছিল শিশিরকুমার দাশের। এক ধরনের জাগলিং যেন-বা। গ্রিক সাহিত্য তথা ধ্রুপদী সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের কথা পাঠকমাত্রেই জানেন। সেই অনুরাগ কিন্তু ঠিক রোম্যান্টিক ধাঁচার ধ্রুপদীপ্রেম নয়। শিশিরকুমার গ্রিক সাহিত্যর কাছে বারবার ফিরে যান, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, ‘চিরকালের বীজ তার মধ্যে সুপ্ত’। সেও এক জাতের সময় নিয়ে খেলা। দুই বা ততোধিক ভিন্ন সময়, ভিন্ন দর্শন, ভিন্ন পুরাণ, ভিন্ন আততি। আর, এর ভিতরে পেঁচিয়ে-জাপটে বয়ে চলা একটা সত্য। যে-সত্য চিরন্তন। যে-সত্যের স্বাদ পেলে নিজেকে স্বেচ্ছায় অন্ধ করে দিতে পারেন রাজা অয়দিপউস। তাঁর পাশাপাশি আমরাও দিব্যি বুঝতে পারি, জ্ঞান ভয়ংকর, তা পাশবিক দৃষ্টির অন্ধত্ব ঘুচিয়ে দিতে পারে। ‘আন্তিগোনে’ নাটকে যেভাবে ক্রেয়ন শেষ অবধি বুঝতে পারেন অগণতান্ত্রিক আর বাক্স্বাধীনতা-বিরোধী হওয়াই তার সবচেয়ে বড় ত্রুটি, হুব্রিস। যে-অগণতন্ত্র আসলে মানবের বিশেষ সেই নিয়মেরই বিরোধিতা করছে। যে-নিয়মের দ্যোতনা ‘আন্তিগোনে’ নামের অর্থে। ‘পশুত্বের নিয়ম নয়, মানুষের নিয়ম’।
‘জ্ঞান দুঃখ? অজ্ঞানতা? অজ্ঞান আঘাতে
পিতাকে করেছ হত্যা, মা-কে কলঙ্কিত!
এসো জ্ঞান, দুঃখময়, প্রলয় বিদ্যুতে।’
(৯৫ সংখ্যক, ‘অবলুপ্ত চতুর্থ চরণ’)
আমাদেরকে এই সবই সযত্নে বুঝিয়ে দেন শিশিরকুমার দাশ। কখনও অনুবাদের শুরুতে ভূমিকায়, কখনও শেষে ‘উত্তরলেখ’ অংশে, কখনও-বা অন্যত্র। তিনি সুপণ্ডিত মানুষ, দক্ষ অনুবাদক, বন্দিত সাহিত্য-সমালোচক। কিন্তু এই যে, গ্রিক ট্র্যাজেডি অনুবাদের পরেও ‘উত্তরলেখ’ জুড়তে হয়, সে নিছক অনুবাদক বা সাহিত্য-সমালোচকের দায় থেকে নয়। আরও বড় দায় থেকে। কতকটা দার্শনিকের দায়। দুটো ভিন্ন সময়কে মিলিয়ে-মিশিয়ে পড়ার ওই তাগিদ এখানেও মুখ্য ভূমিকায় ক্রিয়াশীল। একটা সময়ের মধ্যে আরেকটা সময়কে ঢুকিয়ে দিয়ে দেখা। ক্লাসিকলগ্ন হয়েও তীব্রভাবে সমসাময়িক থাকার দায়। ভীষণভাবে রাজনৈতিক একটা দায়। কয়েকটা উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদ দিলে ‘একাডেমিক’ তথা পণ্ডিত শিশিরকুমারের বাইরে যে সাহিত্যিক শিশিরকুমার তুলনায় কম আলো পান এ-যাবৎ, তাঁকে পাঠ করতে গেলে, বুঝতে গেলেও এই রহস্যটা সম্ভবত বোঝা প্রয়োজন।
‘সক্রেটিসের জবানবন্দি’ নামের একটা নাটক লিখেছিলেন শিশিরকুমার। অনুবাদ নয়, মৌলিক নাটক। কিন্তু হ্যাঁ, পটভূমি সেই গ্রিস। বর্তমানের সঙ্গে সুদূরবর্তী এক সময়। সেই নাটকেরই কয়েকটা সংলাপ পড়ে দেখা যাক—
থেরামেনেস। …আমি একাদশচক্রের রূপ দেখে ভীত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তুমি লড়েছ ঠিকই, কিন্তু দলের লোক যখন অন্যায় করেছে, তখন? যে-দোষের জন্য গণতান্ত্রিকদের হেমলক দিয়েছ, তার চেয়ে বেশি দোষ করেও দলের লোকেরা দিব্যি নিরাপদে আছে।
দ্রাকোনতিদেস। সেটা রাজনীতি। দলের ওভাবে বিচার করা চলে না।
থেরামেনেস। মানে রাজনীতিতে ন্যায় নেই, নীতি নেই।
ক্রিটয়াস। দ্যাখো, এখন এত সূক্ষ্ম তর্কের সময় নেই। আমি স্বীকার করছি, থেরামেনেস, দলের লোককে আমরা প্রশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু বল, পথ কী? দলের লোকের সবচেয়ে বড়ো গুণ আনুগত্য।
(মূলের বানান অপরিবর্তিত)
বুদ্ধিমান পাঠকমাত্রেই এই নাটকের আসল সময়টা ধরে ফেলবেন। কিন্তু একটা আড়াল আছে। কখনও এই আড়ালটা ইতিহাসের, কখনও পুরাণের, কখনও রূপকথার, কখনও মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যের। ‘বাঘ’ নাটকে আহমেদাবাদের দাঙ্গা পরিস্থিতির মধ্যে রাজস্থানের ‘বাঘ’ পুরাণকথা যেভাবে মাথা গলিয়ে দেয়। দাঙ্গা-বিধ্বস্ত আহমেদাবাদের একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে বুর্খা পরিহিত মহিলার সঙ্গে দেখা হয় শাড়ি পরিহিত এক মহিলার। একজন গুন্ডার ভয়ে, অন্যজন বাঘের ভয়ে এসে একই বাড়িতে লুকিয়েছে। একজন শিক্ষিতা, অন্যজন গাঁয়ের মজুর। আলাদা ধর্ম, আলাদা শ্রেণিচরিত্র। সেই আদিম অন্ধকারে গাঁয়ের মেয়েটি শহরের মেয়েটিকে শোনায় বহুদিন আগেকার এক পুরাণকথা— এক বাঘের নাটক। সেই প্রাচীন স্মৃতি আর আজকের অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে এক হয়ে যায়। দুই মহিলা চরিত্রের মধ্যেও পার্থক্য থাকে না। দুটো আপাত-আলাদা বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য থাকে না। শিক্ষিত-মজুর-শাড়ি-বুর্খার কোনও পার্থক্য থাকে না। পার্থক্য থাকে না বাঘের আক্রমণ আর দাঙ্গাবাজদের আক্রমণে। জঙ্গলের নিয়ম এখানেও খাটে। মানুষই বাঘ, তার শিকারিও মানুষ। বাঘ শিকার করবে কে? ইউসুফ, মোহন না মিলিটারি?
‘ম্লেচ্ছ কাফের মারামারি গঙ্গাতীরে ষাঁড়াষাঁড়ি
অযোধ্যাতে বুড়োধাড়ি তরোয়ালে কামায় দাড়ি
বিশ হাজারি তিশ হাজারি মামলা মক্কেল কোর্ট কাছারি
শান্ত্রী মন্ত্রী গণতন্ত্রী উকিল বদ্যি ট্রেনের যাত্রী
ইস্কুল কলেজ ছাত্রছাত্রী জন্ম মৃত্যু পাত্রপাত্রী’
হাবিব তনবীর অযোধ্যায় দাঁড়িয়ে এই নাটকের অভিনয় করেছিলেন ১৯৯৩ সালের ১৫ আগস্ট, মাঝরাতে। সেই অযোধ্যা অত কিছুর মধ্যেও আজকের অযোধ্যা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু, তিন দশক পার করেও এই নাটক আজকেরই নাটক।
যে-নাটকের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, এউরিপিদেসের ‘ত্রোইআদেস’ (দু-এক জায়গায় ‘ত্রোয়াদেস’ বানানও দেখতে পাই), তার অনুবাদের ভূমিকাতে শিশিরকুমার লিখেছিলেন, ‘এই নাটকটি আমাদের আকর্ষণ করে, এর মধ্যে আমরা খুঁজে পাই আমাদের যুগের ছবি, যুদ্ধ ও যুদ্ধশেষের ক্ষয় ও অপচয়।’ এই ‘আমাদের’ শব্দটা ভাববার মতো। এই অনুবাদ গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৮৩-তে। আর তখন শিশিরকুমার সমসময় থেকে খুঁজে পাচ্ছেন ‘যুদ্ধ ও যুদ্ধশেষের ক্ষয় ও অপচয়’। খুঁজে পাচ্ছেন ‘যুগের ছবি’। সেই ছবি কেমন? ‘যখন নাটক শুরু হয়েছিল তখন আকাশে অন্ধকার, যখন শেষ হলো তখন আগুনের রক্তপ্লাবন।’ উত্তাল সত্তরের পর আপাত শান্তিকল্যাণে থিতু আটের দশকে ক্ষয় আর অপচয়ের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ‘অন্ধকার’ আর ‘আগুনের রক্তপ্লাবন’! ‘যুগ’ শব্দটার একটা বিস্তার আছে। সেই কারণেই, কথাটা আরও বিশেষভাবে ভাবায়। আজ, এই লেখা লিখতে বসে কেন জানি না মনে হচ্ছে, সেই যুগ কি এখনও স্থায়ী নয়?
২
‘সাইকেলটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল একেবারে গায়ের উপর
কিন্তু লোকটার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই
মাথার চুল নেই একটাও, চোখ ট্যারা, হাত দুটো প্যাঁকাটি
কী ছিরি!
এমন তালপাতার সেপাই গম্ভীরভাবে বললে:
এ রাস্তায় চলার অধিকার নেই তোমার। গো ব্যাক
আমি বললাম, ‘কেন শুনি? আর তুমিই বা কে হে!
আমি আজ সতেরো বছর ধরে মর্নিং ওয়াক করছি এই রাস্তায়।’
মুখ ভেংচে লোকটা বললে। মর্নিং ওয়াক করছ তো মাথা কিনে নিয়েছ
সব বে-আইনি।
এ রাস্তায় শুধু ময়ূর-ময়ূরীরা ঘুরতে পারে—
ঐ যে জঙ্গল দেখছ। ওখানে এখন সৈন্যদের ছাউনি—
বললাম, সে তো জানি
আমাদের রাজনীতি শাস্ত্রের অধ্যাপক কেরালানিবাসী
করুণাকরণ সস্তায় বীয়ার কেনে ওদের ক্যান্টিন থেকে।
‘চুপ’, ধমক দিল লোকটা, ‘সব খবরই রাখো দেখছি
যাও এখুনি ফেরো, নইলে—
‘নইলে কি?’— আমি বলি
‘নইলে কি? এত আস্পর্ধা!’— লোকটা হাততালি মারলে
আর পাশের জামগাছ থেকে নেমে এল একটা
শিকারি বাজ।
লোকটা বললে, ‘বন্জা কবুতর—
আমি সত্যি সত্যি বদলে গেলাম পায়রায়’
(‘আগের দিন’, ‘বাজপাখির সঙ্গে কিছুক্ষণ’, শিশিরকুমার দাশ)
‘কত কথা হয়েছে ওর বিদেশী নাটকের বা কবিতার অনুবাদ নিয়েও। কিন্তু এতসব আলোচনা-প্রত্যালোচনার মধ্যে কখনোই কি শিশিরের কবিতা নিয়ে, কবিতা লেখা বা না-লেখা নিয়ে কোনো কথা বলেছি আমি? মনে পড়ে না ঠিক। শিশিরও তা বলেনি কখনো।’
শিশিরকুমার দাশের ‘কবিতাসংগ্রহ’-র ভূমিকা লিখতে গিয়ে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ১৯৯২-তে প্রকাশিত ‘বাজপাখির সঙ্গে কিছুক্ষণ’ বইটা তিনি পড়েছেন প্রকাশের পঁচিশ বছর পরে। শিশিরকুমার ততদিনে মৃত। লিখেছিলেন, ‘আরো একটা কথা মনে হয় আজ। শিশির কী ভাবত আমার বা আমাদের কারো কারো এই নীরবতা নিয়ে?’
শিশিরকুমার কী ভাবতেন সে-সম্পর্কে একটা স্পষ্ট আভাস আমরা পাই অধ্যাপক চিন্ময় গুহকে দেওয়া তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। উজ্জ্বল, মেধাবী একজন মানুষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেকর্ড নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। এমএ পাশ করার দু’বছরের মধ্যেই সরকারি কলেজে অধ্যাপনার চাকরি। সেই চাকরি করতে-করতেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে অধ্যাপনার সুযোগ। তারপর তিন বছর পরে দেশে ফেরা বাংলা পড়ানোর তাগিদে। কিন্তু নিজের শহরের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়েই আর জায়গা হল না। ‘প্রায় কুড়ি বছর লাগল সত্যটাকে বুঝতে। বুঝতে পারলাম কলকাতা ফেরা আর হবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে জায়গা নেই।’
কোনও এক অজ্ঞাত কারণে নিজের শহর তাঁকে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানোর সুযোগ দেয়নি। অভিমান অত্যন্ত সংগত। অতএব, এরপর তাঁর যে বিপুল রচনাসম্ভার জন্ম নেবে, তার প্রায় নব্বই ভাগই কলকাতার বাইরে বসে লেখা। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভারতীয় ভাষা বিভাগে কর্মরত অবস্থায়। সংখ্যায়, বিষয়বৈচিত্রে বিপুল এক রচনাসম্ভার। সবটা একসঙ্গে দেখলে চমকে উঠতে হয়। ত্রিশটির বেশি মৌলিক নাটক, চারটি কবিতার বই, ছোটদের জন্য লেখা একাধিক গদ্য-গল্প-ছড়ার বই, আরিস্ততলের ‘পোয়েটিক্স’-সহ নানা ভাষা থেকে নাটক ও কবিতার অনুবাদ, বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে প্রায় পঁচিশটা সাহিত্য-সমালোচনা ও প্রবন্ধের বই, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য প্রবন্ধ, সম্পাদনা। এরই মধ্যে রয়েছে তিন খণ্ডে প্রকাশিত ‘আ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান লিটারেচার’ লেখা এবং রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি লেখার সংকলন সম্পাদনার মতো অতিকায় সব কাজ। এবং রয়েছে, সারা জীবন বহন করে চলা একটা তস্য অতিকায় খেদ। ‘একজন লেখকের পক্ষে তাঁর ভাষা-জগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতা একটা বড়ো ক্ষতি। সে-ক্ষতি আমার হয়েছে।’
ক্ষতি— ক্ষেত্রবিশেষে বড় রহস্যময় একটা শব্দ। অন্তত শিশিরকুমারের ক্ষেত্রে সেটা আরও বেশি করে মনে হয়। নানা কারণেই। চিন্ময় গুহকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে শিশিরকুমার বলেছিলেন, বাংলায় থাকলে বাংলাভাষায় লেখাপত্র বেশি হত। বলেছিলেন, প্রবাসজীবনে বাধ্য হয়ে ইংরেজিতে লিখতে হয়েছে বেশি। বাংলায় থাকলে বিষয় নির্বাচনও হয়তো অন্য খাতে বইত। কিন্তু, সেসব অনুমান বা পরিমাপ করা এখন বাতুলতা। ক্ষতি তো হয়েইছে, বহুমাত্রিক ক্ষতি। বিশেষ করে, তাঁর কবিতা লেখায় ছেদ ঘটেছে। প্রায় তিন দশকের বিরতিতে প্রকাশ পেয়েছে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। ‘অবলুপ্ত চতুর্থ চরণ’ বাদ দিলে কবি শিশিরকুমার এখনও সেভাবে পঠিত বা চর্চিত নন। সেও এক দুর্ভাগ্য।
কিন্তু শুধুই ক্ষতি হয়নি, এ-কথাও বলতে হয়। দিল্লিতে না থাকলে হয়তো ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস লেখা হত না শিশিরকুমারের। কিংবা ভাষাতত্ত্ব বা তুলনামূলক সাহিত্য নিয়েও এমন চর্চা সম্ভব হত না। বলা ভাল, এমন বিবিধ চর্চা। যে-চর্চার অভিমুখটাই তুলনামূলক। ভাষাতত্ত্ব আর সাংস্কৃতিক তত্ত্ব যেখানে মিলেমিশে যাচ্ছে বারবার। ভিন্ন-ভিন্ন সময়ের প্রেক্ষিত পাশাপাশি বসছে, ভাব বিনিময় করছেন। চিন্ময় গুহকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারেই তিনি বলছেন, ‘সাহিত্যের বিভাগগুলি বিভিন্ন সাহিত্যের মধ্যে দেয়াল তুলেছে। এই দেয়াল ভেঙে ফেললে তবেই নতুন চিন্তার হাওয়া খেলবে… একদিন হয়ত একটাই বিভাগ হবে, যার নাম সাহিত্য বিভাগ।’
এক দশকেরও বেশি আগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার একজন অধ্যাপক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘শিশির দাশকে নিয়ে কাজ করতে চাও! কী আছে শিশির দাশে?’ সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি খানিক থই হারিয়ে ফেলেছিলাম। একটা মানুষ ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস লিখছেন, রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি রচনার সংকলন সম্পাদনা করছেন, মালতো ভাষার ব্যাকরণ লিখছেন, ঔপনিবেশিক ভারতে হিন্দুত্ব ও খ্রিস্টধর্মের সম্পর্ক নিয়ে বই লিখছেন, শঙ্করদেবকে নিয়ে বই লিখছেন, ভাষাতত্ত্বের বই লিখছেন, ‘অলৌকিক সংলাপ’-এর মতো আশ্চর্য নাটকের বই লিখছেন, পাঠ্যক্রম নিয়ে বই লিখছেন, আর তাঁকে নিয়ে কাজ করার কোনও যথাযথ কারণ নেই! তিনি সবটা শুনে ফের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এত-এত বিষয় নিয়ে লিখেছেন বলে ওঁকে নিয়ে কাজ করবে, না কি বিশেষ কোনও তাগিদ আছে?’
আজ, এক দশকের বেশি সময় পার করে, সেই কাজ থেকে বারবার ছিটকে গিয়ে এবং জুড়তে-জুড়তে ক্রমে বুঝেছি, শিশিরকুমার দাশকে নিয়ে এত আকর্ষণের প্রধান কারণ হল, তাঁর চৈতন্যের, বিশ্বাসের, আধুনিকতার এবং একইসঙ্গে ঐতিহ্যলগ্নতার ওই বিচিত্র, মুক্ত ও অনেকান্ত সম্মিলন। যে-কারণে, তাঁর এত-এত বিষয় নিয়ে চর্চা অগভীর পল্লবগ্রাহিতায় পরিণত হয় না। কারণ, ওই সন্ধান। এক নিবিড় বহুস্বরিক সন্ধান। সেটাই শিশিরকুমার দাশকে তীব্রভাবে প্রাসঙ্গিক করে রাখে আজও। সে-প্রাসঙ্গিকতা রসসাহিত্যের পরিসরভিত্তিক হোক, ভাষার রাজনীতি নিয়ে চর্চাতেই হোক কিংবা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে চর্চায়।
বহুভাষিকতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শিশিরকুমার খুঁজে পান, বাংলার মিশ্রভাষা-বর্জিত ‘শুদ্ধ’ সমাজতত্ত্ব, দর্শন বিষয়ক প্রবন্ধসাহিত্য, এমনকী পদ্যও প্রবলভাবে ইংরেজি আক্রান্ত। ‘এখানে ভাষা-মিশ্রণ নেই, ভাষা-মিশ্রণ যাতে না হয় তার সচেতন প্রচেষ্টাই থাকে এখানে, কিন্তু দ্বিভাষিকতার আগ্রাসী রূপ সবচেয়ে স্পষ্ট এখানেই। ভাষা আপাতদৃষ্টিতে বাংলা কিন্তু মগ্নস্তরে আছে ইংরেজি।’ (‘আলেকজান্ডার ও পুরু’, ‘মোদের গরব মোদের আশা’) এই বইতেই রবীন্দ্রনাথকে লেখা ‘একটি খোলা চিঠি’-তে শিশিরকুমার দেখান, ওড়িয়া আর অহমিয়া ভাষার ওপর বাংলার প্রভাবকে মান্যতা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথও কীভাবে ভাষা আধিপত্যের সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। কীভাবে চেয়েছিলেন, বাংলা-ওড়িশা-অসম ভূখণ্ডের প্রধান ও ‘লিখন পঠনের ভাষা’ হয়ে উঠুক। স্বাধীন ভারতের এই তিন অঙ্গরাজ্য তথা ভাষার সাম্প্রতিক সম্পর্ক এবং টানা-পড়েনের রাজনৈতিক ইতিহাস খুঁজতে ও বুঝতে গেলে এই লেখা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
আর, ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস (উল্লেখ্য, ‘আ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান লিটারেচর’, দ্য হিস্ট্রি নয়) রচনায় নেতৃত্ব দেওয়া তো তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম কাজ। ভারতীয় সাহিত্যের প্রকৃতি সন্ধান করতে গিয়ে ভারতীয়ত্বর যে-বহুস্বরিক আত্মা খুঁজে পান শিশিরকুমার দাশ, আজকের এই চরমপন্থী জাতীয় রাজনীতির জগতে, এই ক্রমে একমেরু হতে চাওয়া রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতীয় সাহিত্যের ওই তিন খণ্ডে অসমাপ্ত ইতিহাস-ই হয়ে উঠতে পারত পালটা প্রতিরোধের হাতিয়ার। পারত, হয়তো বা আজও পারে। শিশিরকুমার একাধিক লেখায় ফিরে-ফিরে বলেছিলেন ‘ভাবগত আধুনিকতার’ কথা। যে-আধুনিকতা চরিত্রগতভাবে ঔপনিবেশিক নয়। যে-আধুনিকতা নিছক পাশ্চাত্যমুখীও নয়। যে-আধুনিকতার মধ্যে যুগ থেকে যুগান্তরে এক জাতের বহমানতা আছে। যে-আধুনিকতা বিশ্বজনীন। এই ভুলিয়ে দেওয়া ইতিহাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে, এই বদলাতে থাকা ভাষা-সংস্কৃতি-বানানো ইতিহাসের দুনিয়ায়, এই বদলাতে থাকা দেশের চরিত্রে শিশিরকুমারকে বেশি করে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। বিদ্যাচর্চারও তো নিজস্ব অন্তর্লীন প্রতিরোধ আছে। জ্ঞানের প্রতিরোধ। যে জ্ঞান অন্ধত্ববিনাশী, তিমিরবিনাশী। অন্তত সেই প্রতিরোধে শিশিরকুমার চিরকাল প্রাসঙ্গিক থাকবেন। প্রতিরোধে শুধু নয়, উন্মোচনেও।
‘সন্ধ্যাবেলা সভা ডাকে কশাই-র দল
যাতে পক্ষপাতশূন্য হয় এ বিচার
একটি গরুকে তারা করে সভাপতি।’
(৬৭ সংখ্যক, ‘অবলুপ্ত চতুর্থ চরণ’)