আজ এক বিশেষ দিন, বিশ্ব শিল্প দিবস। শহরের পথঘাট সেজে উঠেছে, শিল্পীরা মেতে উঠেছে অনাবিল আনন্দে। ভেবে দেখলে, শিল্পের জন্য কি সত্যিই কোনও বিশেষ দিন-ক্ষণ, মুহূর্ত চিহ্নিত করা যায়? সে আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে আছে। বাগানের বেড়ার ধারে রক্তকরবী ফুলের যে গাছটা ফুলে ছেয়ে আছে, সে নিজেই যেন পটে আঁকা ছবি। তার সবুজ পাতার থোকায় আবির-রঙা ফুলের গুচ্ছে আলো এসে পড়ে প্রতিদিন তাকে বিনোদবিহারীর ছবি করে তোলে। চেয়ে চেয়ে আশ মেটে না। আবার খুব সকালবেলায় নীলচে-বেগুনি আভায় মোড়া আকাশের গায়ে যখন সোনালি সূর্য দেখা দেয়, মন বলে ওঠে, ‘আহা কী সুন্দর, কী অপূর্ব!’
অথচ, রোজই কি এমনটা ঘটে না? আমাদেরই দেখা হয় না তার সে সৌন্দর্য। যেদিন চোখে পড়ে এমনি রঙের ছবি, সেদিন মন ভরে যায়। পুব আকাশের অমন বিরাট ক্যানভাসের গায়ে এমন আশ্চর্য ছবি আঁকতে প্রকৃতি ছাড়া আর কে-ই বা পারে! সেদিক থেকে প্রত্যেক মুহূর্তই কি আমাদের কাছে শিল্প দিয়ে বুনে চলা নয়?
আরও পড়ুন : বৈশাখ মাসে কি কেবল বাঙালি কিংবদন্তিরাই জন্মেছেন? লিখছেন শ্রীজাত…
তবে আমরা উপলক্ষ তৈরি করে উৎসবে মেতে উঠতে ভালবাসি। যেমন আমাদের জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীর মতো জীবনের বিশেষ দিন ঘিরে রচিত হয়, তেমনই অন্যভাবেও তাকে ফিরে দেখতে চাই। এমনি করে আমরা ঠিক করে নিয়েছি ‘ভালবাসার দিন’, ‘শিল্পের দিন’— আরও কত কী! এভাবে দেখতে গিয়ে আলোর পাশাপাশি খানিক ছায়াও এসে ভিড় করে, হয়তো। তবে সে-কথা এখন থাক, ছায়া সরিয়ে আপাতত আলোর দিকে চোখ রাখি। এ কোনও নতুন কথা নয় যে, শিল্প-সাহিত্য আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন, জীবনের আনন্দপথটুকু সেই খনন করে জাগিয়ে রাখে আমাদের। সে যেমন দর্শক-পাঠকের দিক থেকে, তেমনই শিল্পীর নিজের পক্ষেও। চিত্রী বা ভাস্কর যখন স্টুডিওতে তাঁর কাজে একান্ত মগ্ন– তখন বাইরের কোনওদিকে তাঁর খেয়াল থাকে না। রঙের পরত, তুলির আঁচড়, আকারের গড়ন, কাঠে-পাথরে ছেনি-হাতুড়ির আঘাত ছাপিয়ে স্রষ্টার কাছে বড় হয়ে ওঠে শিল্পের সার্বিক অভিব্যক্তি, তাঁর অন্তরের প্রকাশ। যদিও কাজ সারা হলে, সে কেবল স্রষ্টার একলার নয়। রচনার শেষে ছবি বা ভাস্কর্য উপভোক্তা হিসেবে একাধারে যেমন দর্শকের, তেমনই যিনি কাজটি সংগ্রহ করেন, সেই সংগ্রাহকের।
শিল্পীর কাজ কেবল দৃষ্টিনন্দনের জন্য নয়, সে-কাজ আমাদের ভাবায়, চেতনার গভীর স্তর স্পর্শ করে যায়। বিখ্যাত শিল্পীর কাজের কথা সবার মুখে মুখে ফেরে, তাঁর খ্যাতি-প্রতিপত্তি ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে। এভাবে নামী শিল্পীর কাজ নিয়ে গড়ে ওঠে ‘বাজার’, আজকের ভাষায় ‘আর্ট-মার্কেট’, আর বাজার বলতে অবশ্যই রয়ে যায় বাজারের ওঠাপড়ার দিকটাও। আর্ট যখন ইনভেস্টমেন্ট, তখন তাকে ঘিরে একাধিক বৃত্ত গড়ে উঠতে বাধ্য। দর্শকের ভাললাগার চেয়েও এখানে বাণিজ্যের দিকটা ক্রমশ অগ্রাধিকার পায়। বিখ্যাত শিল্পীর কাজের নিলাম হয়, কোন সংগ্রাহকের এক্তিয়ারে অন্তর্ভুক্ত হল সে-কাজ— তা নিয়ে খবরের হেডলাইন ইত্যাদির আরেকটা চেহারা। ছবির নিলাম এক বিচিত্র জগৎ, যেখানে দামি অকশন হাউসের হাতে চলে যায় নামী শিল্পীর কাজ সংগ্রহ করবার প্রধান চাবিকাঠি। সাধারণের হাত ছাড়িয়ে ছবি তখন অনেক দূরে।
কারা আঁকেন এই নকল ছবি? সে কি কারও নির্দেশে? দেশজুড়ে জাল ওষুধের মতো এও কি এক মহা কারবার? শুনেছি, কলকাতা শহরে বা তার আশেপাশে ছড়িয়ে আছে এমন একাধিক ‘ফেক ছবি’ তৈরির কারখানা। যেখানে অনেক সময় বিভিন্ন আর্ট কলেজের ছেলেরাও পয়সার অভাবে কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়। শোনা যায়, কোনও কোনও কারখানা বিখ্যাত শিল্পীরাও আড়ালে আবডালে চালিয়ে থাকেন, অধিক মুনাফার আশায়।
এর আবার অজস্র স্তর, নামী শিল্পীর কাজ নিয়ে কৃত্রিম ক্রেজ তৈরি করে ফায়দা তোলেন গ্যালারিওয়ালারা, বাজারের অন্যান্য ব্যবসার মতোই তাঁদের ভাঁড়ারে অধিক মুনাফা এসে জমা হয়। ক্রমে শিল্পীর সেই বিশুদ্ধ আনন্দ আর সাধারণ দর্শকের মুগ্ধতার সীমানা পেড়িয়ে বহু যোজন দূরে পাড়ি দেয় প্রিয় শিল্পীর কাজ। এর ফাঁকেই জন্ম হয় জাল ছবির বাজার। শিল্পকলার বহুস্তরীয় পর্বের মধ্যে সবচেয়ে অন্ধকার এলাকা বুঝি এই ‘জাল ছবি’-র ভুবন। শিল্পীর জীবদ্দশায় চিত্রকরের কাজ ঘিরে এই বাজার তেমন ডালপালা ছড়াতে পারে না। তবে শিল্পীর অবর্তমানে তাঁর কাজ ঘিরে ‘ফেক ছবি’-র বাজার বিস্তৃত হতে সময় লাগে না। এর অন্যতম কারণ তাঁর ছবির অপ্রাপণীয়তা, যে কাজের দাম আছে, অথচ তা বাজারে মেলে না। সম্প্রতি আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, রামকিঙ্কর বা যামিনী রায়ের মতো শিল্পীর নকল ছবিতে বাজার ছেয়ে গিয়েছে। এর নেপথ্যে একাধিক কারণ কাজ করে। ছবির অত্যধিক অর্থমূল্য ছাড়াও অনেক সময়ে অধিক খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা বা চমকের জন্যে নামী আর্ট গ্যালারি বা প্রতিষ্ঠান জাল ছবির দিকে অনায়াসে ঝুঁকে পড়েন।
এ-প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা না বললেই নয়।
বছর বারো-তেরো আগের কথা। রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবর্ষে চারিদিকে অজস্র অনুষ্ঠানের আয়োজন চলেছে। সাহিত্যের পাশাপাশি তাঁর চিত্রকলার প্রতি এবারে নতুন করে নজর পড়েছে আমাদের। দেশ-বিদেশে চলেছে তাঁর ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা, আলোচনা সভা ইত্যাদি ইত্যাদি। কলকাতাও পিছিয়ে নেই মোটে, শহরের এক নামী শিল্প-প্রতিষ্ঠানে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। বেশির ভাগই না-দেখা ছবি, তবে সামান্য কয়েকটা এসেছে ইন্ডিয়ান মিউজিয়মের সংগ্রহ থেকে। বাকি না-দেখা ছবি পাওয়া গেছে জামশেদপুরের জনৈক ব্যক্তির নিজস্ব সংগ্রহ থেকে, আর ধোঁয়াশা সেখানেই।
এই আর্ট কলেজে কেবল ছবির একজিবিশন নয়, রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে প্রদর্শিত হয়েছে একাধিক আধুনিক কবির সাম্প্রতিক কবিতা– যেগুলো তাঁরা রবীন্দ্রচিত্রের আবহে সদ্য রচনা করেছেন। প্রতিষ্ঠানের প্রধান বেশ ঘটা করে কলকাতার বিশিষ্ট নাগরিকদের দিয়ে সুচারুভাবে সমাধা করেছেন উদ্বোধনের পর্ব। রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি দেখার সুযোগ সহজে মেলে না, তখনও চার খণ্ডের ‘রবীন্দ্র চিত্রাবলী’ মুদ্রিত হয়নি। ফলে সকলেই উন্মুখ সেই প্রদর্শনী দেখার জন্য।
শুরুটা ভাল হলেও হঠাৎ খবর এল, একজিবিশনের প্রায় সব ছবিই নাকি জাল, অর্থাৎ ‘ফেক-পেইন্টিং’। চারিদিকে হইচই পড়ে গেল, প্রায় সমস্ত খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ফলাও করে ছাপা হল সেইসব জাল ছবির ইমেজ। এক নজরেই বুঝতে বাকি রইল না যে, ছবিগুলো ঠিক নয়, বেশ গোলমেলে। রবীন্দ্রনাথের ছবির আদলে তৈরি, তবে রবীন্দ্রনাথের রেখার সেই প্রাণময়তা, রঙের দীপ্র উজ্জ্বলতা, ফর্মের ঋজু বলিষ্ঠ ভাবের চিহ্নমাত্র এখানে নেই, কী এক নিস্পৃহ, নিরুত্তাপ দুর্বল ছবি সার দিয়ে দেওয়ালে ঝুলে আছে।
সে এক ভয়ানক ব্যাপার, গর্জে উঠল ছাত্ররা, সেইসঙ্গে শিল্পরসিকের দল। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সামনে ধরনা, মিছিল, কুশপুত্তলিকা দাহ— কিছুই বাদ গেল না। অবাক করার মতো বিষয়, যেখানে দেশজুড়ে মহাসাড়ম্বরে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের আয়োজন চলেছে, সেখানে খোদ কলকাতার বুকে এমন এক অনুষ্ঠানের আয়োজন হল কোন স্পর্ধায়?
এখন প্রশ্ন, এই আয়োজন কি ছবির সঠিক তথ্য না-জেনেবুঝেই নিতান্ত সরলচিত্তেই করা হয়েছে? না কি এর আড়ালে ওঁত পেতে আছে জালছবির বিরাট চক্র– যা প্রদর্শনীর শেষে বিপুল বাণিজ্যের চেহারা নেবে? এখানে কি সচেতনভাবেই জাল ছবি সাজিয়ে দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কৌশলে সেই জাল ছবির গায়ে ‘সঠিক’ লেবেল লাগিয়ে দেওয়ার সুচতুর প্রয়াস? না কি আরও গভীরতর অধ্যায় লুকিয়ে আছে এর আড়ালে?
এমন সন্দেহ অমূলক নয় একেবারেই। কারণ ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ছবি বা অন্যান্য শিল্পকলা এলে তাকে একটা উপযুক্ত কমিটির মধ্য দিয়ে যাচাই করে নেওয়া জরুরি, তা দস্তুরও বটে। কিন্তু এখানে সে সবের কোনও বালাই ছিল না। যাই হোক, অবশেষে আইনের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে গেল এই প্রদর্শনী। এমন এক হঠকারী কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে দায়িত্ব ত্থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। তারপর দীর্ঘকাল ধরে চলতে লাগল আইন-আদালতের কাজ। একসময় লখনউয়ের জাতীয় শিল্প সংরক্ষণের ল্যাবরেটরি থেকে বিশেষজ্ঞরা এলেন, প্রদর্শিত ছবির রং নিয়ে পরীক্ষা হল। কেবল বিশেষজ্ঞদের চোখের দেখায় নয়, রসায়নাগারে প্রমাণিত হল, এর রঙের কোয়ালিটি কবির ব্যবহৃত রঙের থেকে একেবারে আলাদা।
এই প্রসঙ্গে সহজেই প্রশ্ন জাগে, কারা আঁকেন এই নকল ছবি? সে কি কারও নির্দেশে? দেশজুড়ে জাল ওষুধের মতো এও কি এক মহা কারবার? শুনেছি, কলকাতা শহরে বা তার আশেপাশে ছড়িয়ে আছে এমন একাধিক ‘ফেক ছবি’ তৈরির কারখানা। যেখানে অনেক সময় বিভিন্ন আর্ট কলেজের ছেলেরাও পয়সার অভাবে কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়। শোনা যায়, কোনও কোনও কারখানা বিখ্যাত শিল্পীরাও আড়ালে-আবডালে চালিয়ে থাকেন, অধিক মুনাফার আশায়। আজকের নকল ছবির কারিগররা যথেষ্ট সচেতন। খুঁজে খুঁজে পুরনো কাগজ, রং সংগ্রহ করেন, যাতে সে রং অথেন্টিক বলে মনে হয়, পরীক্ষাতেও ধরা না-পড়ে। এই কারণেই মূল্যবান শিল্পসামগ্রীটি কোথা থেকে পাওয়া গেল, তার উৎস, ইংরেজি পরিভাষায় যাকে বলে ‘প্রভেনান্স’, সেইটে খুব বড় কথা।
মনে পড়ে, কলকাতার সেই জাল ছবির প্রদর্শনীর পাকে আমাকেও একদা গভীরভাবে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল– সেগুলো সঠিক না বেঠিক, এই বিচারের জন্য। সেই আবহে আজও অজস্র মেল পাই, হোয়াটস-অ্যাপে কত যে ইমেজ ভেসে ওঠে, অনুরোধ আসে, যাচাই করে দেওয়ার জন্য। তবে বলতে বাধা নেই, এর বেশিরভাগই জাল, এবং সে-কথা অনেকে স্বীকার করতে চান না, অথেনটিক সার্টিফিকেট লিখে দেওয়ার জন্যে জোরাজুরি করতে থাকেন। তার মধ্যে মৃদু ধমকের সুরও যে থাকে না, তা নয়। কখনও-সখনও বেনামী টেলিফোনের অপর প্রান্তে ভয়-দেখানো বার্তা ভেসে আসে বইকি। একবার বেঙ্গালুরুর প্রখ্যাত এক অকশন হাউসের পক্ষ থেকে উকিলের চিঠিও পেয়েছি, তবে সেসব উপেক্ষা করা ছাড়া পথ নেই।
এখন সমস্যা হল, এ-বিষয়ে আমাদের দেশে আইনের দিকটাও তেমন জোরালো নয়, তাই সবাই সহজে পার পেয়ে যান। কিছুকাল আগে কলকাতার প্রতিষ্ঠিত গ্যালারিতে যামিনী রায়ের একগুচ্ছ বেঠিক ছবি দেখানো হল, কাগজের লেখালিখিতে মাঝপথে বন্ধ হলেও শহরের কোনও এক বনেদি গ্যালারিতে একঝাঁক নন্দলালের ছবি প্রদর্শিত হলে দেখা গেল, তার সবগুলোই নকল। শিল্পকলা নিয়ে আমাদের দেশের সাধারণের হয়তো তেমন তাপ-উত্তাপ নেই। কিন্তু এমনটা চলতে থাকলে, শিল্পের দিকেই সকলে সন্দেহের চোখে তাকাতে চাইবে। শিল্প-সাহিত্য মানব-ইতিহাসের গৌরবময় চিহ্ন বহন করে, সেখানে এমন আঘাত এসে পড়লে ব্যাহত হবে শিল্পকলার সুষ্ঠু পরিবেশ, সাংস্কৃতিক বিনিময়। তাই চোখ-কান খোলা রাখতে হয় অনুভূতিশীল শিল্পরসিককে, আর যিনি তা সংগ্রহ করতে চান, সতর্ক হতে হবে তাঁকেও।