বৈশাখের ঠিকঠাক লগ্নে জন্মাতে পারলে যে কী মারাত্মক ব্যাপারস্যাপার ঘটতে পারে, সেটা বাঙালি ছাড়া হাড়ে হাড়ে কেউ টের পায় না। কারণ আর কিছুই নয়, বাঙালির হাড়ে, মজ্জায়, ধমনিতে, ক্যালেন্ডারে, উৎসবে যিনি প্রবলতম ভাবে বিদ্যমান, তিনি এই বৈশাখেরই মহাজাতক, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এমনিতে আম বাঙালিকে বাংলা দিনপঞ্জি থেকে তারিখ উল্লেখ করলে থতমত খাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না, কিন্তু এ-কথা মানতেই হবে যে, নতুন বছরের গোড়ার দিনটি, অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ ছাড়া সে যদি আর একটিও তারিখকে নামডাকে বা ডাকনামে চেনে, সে হল গিয়ে পঁচিশে বৈশাখ। হ্যাঁ, বাইশে শ্রাবণকেও মোক্ষম চেনে বটে, কিন্তু বৈশাখের পঁচিশে অমনটা ঘটে না-গেলে শ্রাবণের বাইশেরও কোনও মাহাত্ম্য বাঙালির ডায়েরিতে থাকত না। অতএব, বৈশাখ যুগ যুগ জিও।
আমাদের স্কুলবেলায় জয় গোস্বামীর কবিতার শেষ পঙক্তিতে যখন পড়ছি, ‘কে জন্মায়, হে বৈশাখ? কে জন্মায়?’ তখন তার উত্তর আমাদের আগে থেকেই জানা। কোথাও কিন্তু সেই জাতকের নাম লেখা নেই। কিন্তু বাঙালি জানে, বৈশাখে ওই একজন মানব না-জন্মালে তাদের সর্বনাশ হয়ে যেত। জন্মেও যে সর্বনাশ কিছু কম হয়েছে তা নয়, কিন্তু ব্যাপারটা আরও খারাপ দিকেই যেতে পারত নেহাত। এবং বাঙালি এও জানে, বৈশাখে না-জন্মালে রবি ঠাকুরের প্রতিভা এমন সূর্যের মতো বিচ্ছুরিত হতো কিনা সন্দেহ। অর্থাৎ, বাংলা বছরের প্রথম মাসে প্রথম রবিকিরণের ছটা ছড়িয়ে পড়তেই হতো, এ খোদ বিধাতা লিখিত চিত্রনাট্য। তাই মাথা-ঘোরানো-গরমের প্রতি যতই ক্ষোভ বাঙালির থাক, এই একটি কারণে সে গ্রীষ্মকে মন থেকে ক্ষমা করে দিয়েছে। ক্ষমা না-করলে প্রবল রোদ্দুর আর গুমোট মাথায় করে সেজেগুজে ১৫ দিনব্যাপী কবিপক্ষ পালন করতে তার বয়েই গেছিল।
আরও পড়ুন : কলকাতার চড়ক কি এখনও সরগরম? লিখছেন অর্পণ ঘোষ…
এইখানে বলি, এ-বিশ্বাস যে কেবল ঘরের মানুষ রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা কিন্তু নয়। বহু বাঙালিকে চিনি, যাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, বৈশাখে জন্মানো আর চূড়ান্ত প্রতিভার অধিকারী হয়ে নামডাক করে ফেলার মধ্যে একখানা আত্মিক যোগ আছেই। এখন, ব্যাপারটা কিন্তু একেবারে ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। এইখানে একটা ঘটনার কথা বলি। কোনও এক অনুষ্ঠানে একবার হাজির হয়েছি একটু আগে আগে, সাজঘরে সৌমিত্রবাবু, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বসে আছেন। তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে বিকেলেরও আগে, কিন্তু সন্ধে পেরিয়ে যাওয়ার পরেও মঞ্চে তোলা হয়নি। স্বভাবতই, তিনি অধৈর্য হচ্ছেন। আমাকে দেখে ওই বিরক্তির মধ্যেও একগাল হাসি ফুটে উঠল, পাশের চেয়ারটিতে বসতে বললেন। এমনিতে বসতে ভয়ই পেতাম, কিন্তু ওঁর সঙ্গে এক মিনিটের আড্ডা মানেও বহু জন্মের সৌভাগ্য, এই মনে করেই বসলাম।
দুম করে একখানা প্রশ্ন দেগে বসলেন। ‘আচ্ছা, বলো তো, পৃথিবীতে আর কোন মানুষকে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ মনে হয় প্রতিভায়?’
এসব প্রশ্ন কলেজ সিনিয়ররা করলে দুমদাম পছন্দের নাম বলে দেওয়াই যায়, কিন্তু প্রশ্নটা আসছে এক এবং অদ্বিতীয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। আমি সবদিক ভেবে সমর্পণ করেই বললাম, ‘আপনি বলুন, এ-প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে তো আগে আপনার মতো করে রবীন্দ্রনাথকে জানতে হবে, সে তো আমি কখনও পারব না।’
উনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বললেন, ‘আমি অনেক ভেবেছি এ নিয়ে, জানো। কেবল একজনের কথাই মনে হয়েছে। লিওনার্দো। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি।’
এ-কথা বলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, যদিও আমি বুঝলাম, তাঁর দৃষ্টি তখন অনেক দূরে, লিওনার্দো-র অবিস্মরণীয় কাজগুলোর ওপর দিয়ে ঘুরে আসছে এক পাক। ততক্ষণে ওই গরম সাজঘরে অপেক্ষার সমস্ত বিরক্তি উধাও হয়ে গেছে তাঁর মুখ থেকে, বরং রবীন্দ্রনাথের পাশে লিওনার্দোকে বসাতে পারার এক আশ্চর্য প্রশান্তি ছেয়ে আছে যেন।
আমার মনে হল, সত্যিই তো! বহুমুখী প্রতিভায়, চিন্তনে, কারিগরিতে, পরিশ্রমে, বনপ্তিতে লিওনার্দো একেবারে আমাদের রবি ঠাকুরের মতোই অতুলনীয়। অথচ, এ-দুটো নাম পাশাপাশি বসানোর কথা আগে মাথায় আসেনি কখনও। বুঝলাম, অন্ধ রবীন্দ্রানুরাগী সৌমিত্র এই নিয়ে বিস্তর ভেবেছেন, তবেই এমন সিদ্ধান্তে এসেছেন।
আমার ততক্ষণে স্পর্ধা হয়েছে খানিক। তাই বললাম, ‘এঁদের পাশাপাশি না হলেও, ঠিক পরে পরেই একজনকে রাখা যায় বলে মনে হয়।’ তিনি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকায় বললাম, ‘শেক্সপিয়র। যায় না?’
দু’চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর। আমার কাঁধে আলতো হাত রেখে বললেন, ‘একেবারে ঠিক বলেছ, ওঁর মতো প্রতিভাও তো আর দুটো আসেনি।’
আমি আর সৌমিত্রবাবু, দু’জনেই তখন ওই সাজঘর থেকে অন্য পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছি, কেবল মনে হচ্ছে, মঞ্চে আর না-ডাকলেই বাঁচি। এই আড্ডা যতক্ষণ গড়ায় গড়াক। আমি আরেকটু সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি তো আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ কিছু ছবিতে কাজ করেছেন। ওই যে সময়টা, সারা পৃথিবী জুড়ে সিনেমার নতুন ভাষা তৈরি হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে কাকে আপনি এগিয়ে রাখবেন?’ প্রশ্নটা করার সময়ে আমি ধরেই নিয়েছিলাম, উনি সত্যজিৎ রায়ের নামই করবেন। আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘তুমি ভাষার কথা বললে না? যে-মানুষ ভাষার ব্যবহার না-করেও সব কিছু স্পষ্ট বুঝিয়ে দিতে পারে, তার চেয়ে বড় শিল্পী আর হয় না। আমি যে-সময়টায় কাজ করেছি, তখন ওয়ার্ল্ড সিনেমায় প্রতিভার ছড়াছড়ি। কিন্তু যদি বলো ফাদার অফ অল, তাহলে আমি বলব, চ্যাপলিন। ওরকম সিনেম্যাটিক ল্যাঙ্গুয়েজ আর কেউ তৈরি করতে পারেনি। কেউ না।’
এই আদানপ্রদান আরও খানিক চলত, যদি-না উদ্যোক্তারা আমাদের ধরে নিয়ে যেতেন।
কিন্তু এই লেখায় হঠাৎ এই ঘটনার উল্লেখ করলাম কেন? কারণ, অনেক পরে মিলিয়ে দেখেছি, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং উইলিয়ম শেক্সপিয়র জন্মেছেন এই বৈশাখেই। লিওনার্দো তো দেখেশুনে পয়লা বৈশাখ, কেননা পৃথিবীর পয়লা নম্বর শিল্পী জন্মানোর জন্য আর কোন তারিখই বা বেছে নিতেন! ৯ বৈশাখ জন্মেছেন শেক্সপিয়র। এই অবধি তবু মেনে নেওয়া যেত, কিন্তু এমনকী চ্যাপলিনও জন্মেছেন দোসরা বৈশাখ।
তা এইসব বাঘা বাঘাদের একই মাসে জন্মদিন হলে বাঙালির বিশ্বাসের আর দোষ কী? সে বরং দু’হাত তুলে চেঁচিয়ে বলতে পারে, ‘বৈশাখ যুগ যুগ জিও!’