থ্যাঁতলানো রাফা শহরের ছবি দেখে শীত করেছিল খুব। তলপেট যেন খিমচে ধরেছিল কেউ। উগরে দিতে চেয়েছি বমি। বহুবার। একদিন ঘুম আসেনি। দুই, তিন… চারদিন পরে পাশবালিশ জাপটে দিব্য ঘুমিয়েছি। এটুকুই। ঘুম থেকে উঠে দেখেছি, চাঁই চাঁই বরফের মতো ফিলিস্তিনি লাশের নীচে আমার সহনাগরিকের হাসির ইমোজি আর সহপাঠীর কুৎসিত উল্লাস। একটা আশ্চর্য স্থিতি, যে স্থিতির কোনও স্যাচুরেশন পয়েন্ট নেই, লিমিটিং ভ্যালু ইনফিনিটি। এ-হেন ভাষ্য সুচিন্তিত মস্তিষ্কে নির্মাণ করেছে রাষ্ট্র। তাই শহরের দেওয়াল থেকে অবলীলায় মুছে গেছে: ফ্রি প্যালেস্তাইন। অথচ রেজিস্ট্যান্স, এইভাবে, রাতারাতি, উথলানো ভক্তির চক্করে মুছে-টুছে যায় না। হারবার্ট উপন্যাসে নবারুণ ভট্টাচার্য লিখছেন: ‘…গত দুই দশক ধরে এই বিস্ফোরক সমাহার তোষকের মধ্যে শীতঘুম ঘুমোচ্ছিল যা চুল্লির উত্তাপে জেগে ওঠে। …হারবার্টের রক্তহীন মৃতদেহ দাহ করার সময় জঘন্য ঘটনা ঘটেছিল তা অবধারিত ভাবে এই ইঙ্গিতই দিয়ে চলে যে কখন, কোথায়, কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে।’
তেমনই এক বিস্ফোরণের কথা বলি। কোথায় ঘটেছিল? ফুটবল স্টেডিয়ামে। গ্যালারিতে।
১২ ফেব্রুয়ারি। ২০২৫। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বের ম্যাচ। বায়ার্ন মিউনিখ বনাম সেল্টিক এফসি। সেল্টিক গ্যালারিতে অকস্মাৎ জ্বলে উঠল একটি টিফো: SHOW ISRAEL THE RED CARD। বিস্ফোরণ বলতে এটাই। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মতো জাঁকজমক ফুটবল-মঞ্চে, সে ফেটে পড়ল। নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখা অনুযায়ী, রাষ্ট্রযন্ত্রের অজান্তেই। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, প্রায় এক বছর ধরে যে গণহত্যায় নিবিড় ও মগ্ন, তার বিরুদ্ধে একটা সম্মিলিত রেড কার্ড! ফুটবল এটুকুই পারে। এটুকুই ফুটবলের জোর।
এই মুহূর্তে, যে বিষয়টি আলোচনা-সাপেক্ষ, সেটি হল সেল্টিক এফসি ক্লাব এবং ক্লাবের ফ্যানবেস। বরাবর যেন সংখ্যালঘুর পক্ষে! ক্লাবের ইতিহাস ঘাঁটতে ঘাঁটতে জানতে পারি, সেল্টিক ক্লাবের জন্ম গ্লাসগো শহরের পূর্বপ্রান্তের দরিদ্র-শ্রেণি ও অভিবাসীদের রক্তে, ঘামে। অর্থাৎ শিকড়ে, প্রতিরোধের বীজ লুকনো আছে। সেল্টিক গ্যালারিতে প্যালেস্তাইন পতাকা উড়েছে, উড়ছে এবং উড়বে আরও। কী আশ্চর্য স্লোগান তৈরি করেন তারা! টিফোয় লেখা থাকে: MANY HOMES ARE SAD TONIGHT/ THEY WHISPER SOMEONES NAME BY THE CANDLE LIGHT. মশাল হাতে, কখনও-বা ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে সেল্টিকের সমর্থকেরা দাঁড়িয়ে থাকেন। সর্বশেষ টিফোয় লেখা: 20000+ KILLED-8000+ CHILDREN। তারপরেই, একটা সম্মিলিত সুর, যেন সংহতির, গেয়ে ওঠেন সকলে। ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন… এ-গান শোনা যায় অ্যানফিল্ডে। গ্যারি অ্যান্ড দ্য পেসমেকার্স-এর এই গান, লিভারপুলের ক্লাব অ্যান্থেম। এ-গান যেন যৌথখামারের। যৌথ উড়ানের। কোনও ঈশ্বর অথবা অপার্থিব শক্তি, এ-গানে গানে জুড়ে দেয়নি সেল্টিক ও লিভারপুল— উভয় ক্লাবের সমর্থকদের। খানিকাংশে আইডেন্টিটিকেও।
Many homes they are sad tonight.
— Tarik Sammour (@tarik_sammour) December 23, 2023
They whisper someone’s name by the candlelight.
20,000+ killed – 8,000+ children.@CelticFC 😥 pic.twitter.com/WhIIq6jafT
কারণ আমরা জানি, লিভারপুল ক্লাবের নির্মাণ হয়েছিল ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণির হাতে। এবং স্বাভাবিকভাবেই, লিভারপুল গ্যালারি থেকে গত বছর, অক্টোবর মাসে যে টিফো প্রদর্শিত হয়েছিল, তাতে লেখা: FOR GOD’S SAKE SAVE GAZA। প্রচুর ফিলিস্তিনি পতাকা উড়ছিল সেদিন। সকলেই গাইছিলেন, ওয়াক অন থ্রু দ্য উইন্ড, ওয়াক অন থ্রু দ্য রেইন অর ইয়োর ড্রিমস বি টসড অ্যান্ড ডাউন…
স্বপ্ন কি মুক্ত প্যালেস্তাইনের? স্বপ্ন কি প্রতিরোধের? স্বপ্ন যখন নিপীড়িতের চোখের মহাকাশ থেকে টুপটাপ খসে পড়ে তারার মতো, শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে ছেয়ে যায়। মনে পড়ে, সত্যজিৎ রায়ের ‘জন-অরণ্য’ ছবির একটি দৃশ্য। সোমনাথ রাস্তায় হাঁটছে। ক্যামেরা সমান্তরালে। আমাদের চোখ তখন পড়ে নিচ্ছে: বন্দুকের নলই শক্তির উৎস। অন্য দেওয়ালে, চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান। সময়ের আখ্যান বলে চলা, ইতিহাসের ডকুমেন্টেশন যেমন এ-শহরের প্রতিটি দেওয়ালের কর্তব্য; ফুটবলের ক্ষেত্রে, টিফোও তাই!
লিভারপুল ক্লাবের নির্মাণ হয়েছিল ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণির হাতে। এবং স্বাভাবিকভাবেই, লিভারপুল গ্যালারি থেকে গত বছর, অক্টোবর মাসে যে টিফো প্রদর্শিত হয়েছিল, তাতে লেখা: FOR GOD’S SAKE SAVE GAZA। প্রচুর ফিলিস্তিনি পতাকা উড়ছিল সেদিন। সকলেই গাইছিলেন, ওয়াক অন থ্রু দ্য উইন্ড, ওয়াক অন থ্রু দ্য রেইন অর ইয়োর ড্রিমস বি টসড অ্যান্ড ডাউন…
দেওয়াল অথবা টিফো— মুছে অথবা ছিঁড়ে দিলে, অস্বীকার করা হয় সময়। ইতিহাস। আর ইতিহাসকে অস্বীকার করতে চায় ডোনাল্ড ট্রাম্প। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু বিস্ফোরণ যে কখন, কীভাবে হয়ে যায়! সিএএ-এনআরসি আন্দোলনে কলকাতা উত্তাল। রাষ্ট্রের নতুন ফিকির, কাগজ দেখাতে হবে। তুমি যে ভারতের মানুষ, তা প্রমাণ করো। নইলে ডিটেনশন ক্যাম্প। দু’মিনিটে উদ্বাস্তু। ঠিক সেই সময়, বিভ্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল ফুটবল। দৃঢ়, সটান, স্পষ্টবাক। কলকাতা ডার্বিতে, ইস্টবেঙ্গল গ্যালারি থেকে নেমেছিল একটি টিফো। লাল কালিতে লেখা: রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়। কী মারাত্মক এ-উচ্চারণ! ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ইতিহাসে, উদ্বাস্তু শব্দের যে অভিঘাত, তারই প্রতিফলন ওই টিফো। সঙ্গে কাতারে কাতারে হঠাৎ অসহায় মানুষের আবেগ। প্রতিরোধ। সম্প্রতি, আরজি-কর আন্দোলনে যখন কলকাতা-সমেত পশ্চিমবঙ্গ ফের উত্তাল, ইন্ডিয়ান সুপার লিগের একটি ম্যাচে, মোহনবাগান গ্যালারি থেকে নেমেছিল: হাতে হাত রেখে এ লড়াই, আমাদের বোনের বিচার চাই! আবিশ্বে, ফুটবলের উন্মাদ সমর্থক, আলট্রাস গ্রুপ, সকলে মিলেই টিফোকে পরিণত করেছে একটি শিল্পে। শিল্প যেমন প্রতিরোধের, তেমনই উৎকর্ষের।
বুন্দেশলিগা-র একটি জায়ান্ট ক্লাব, বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের একটি পপুলার টিফোর কথা বলি। হলুদ-কালো গ্যালারিতে, যে টিফোটি প্রায়শই চোখে পড়ে। প্রকাণ্ড এক পুরুষের মুখ, মাথায় হলুদ টুপি, চোখে দূরবীন, দাঁত বের করে হাসছে। সে হাসি ভয়ানক। নিচে লেখা: AUF DEN SPUREN DES VERLORENEN HENKELPOTTS। অর্থ হয়, হারিয়ে যাওয়া ট্রফির রাস্তায়… বরুসিয়া ডর্টমুন্ড এবং ক্লাবের সমর্থক, দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে বসে আছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফির জন্য। তাই এ-হেন উক্তি। প্রতিপক্ষ খানিক বেকুব। খানিক বুক দুরু দুরু। খেলার শুরুয়াতেই।
তুরস্কের ক্লাব, ‘গালাতাসারে’-এর গ্যালারি থেকে এমন একটি ধ্বংসাত্মক টিফোর কথা বলে, দ্য এন্ড করি এই টিফো-কাহিনি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মুখোমুখি গালাতাসারে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। ম্যানচেস্টারের অ্যাওয়ে ম্যাচ। তাই চাপও বেশি। শক্তিতে গালাতাসারে তুলনায় দুর্বল। কিন্তু সেইদিন, গালাতাসারে গ্যালারিতে ঘন লাল আর উজ্জ্বল হলুদ রঙের একটি বৃহৎ টিফো দেখা যায়। চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল প্রায়। লেখা: WELOCOME TO HELL।
সেই ম্যাচে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দু’গোলে এগিয়ে থেকেও ড্র করে ফিরেছিল ইংল্যান্ডে।