সাফল্য
প্লেনের জানলার ধারে সিটে বসে নীলা একটা বই পড়ছিল। প্লেন তখনও দমদম বিমানবন্দর ছাড়েনি। একটা চেনা কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েই বই থেকে মুখ তুলে তাকাতে বাধ্য হয় নীলা।
নীলা: এখানেও তুমি?
নীলাব্জ: আমার সিট 4C ছিল। ওই ভদ্রলোককে একটু পটিয়ে-পাটিয়ে তোমার পাশের 10Bটা করে নিলাম। বেশ একসঙ্গে পাশাপাশি বসে যাওয়া যাবে।
নীলা: ধারের সিট ছেড়ে দিলে?
নীলাব্জ: তোমার জন্য এটুকু তো করাই যায়, তাই না?
পড়ুন: মেদওয়ালা মানুষ কুৎসিত আর মেদহীন মানুষ সুন্দর? কী বলছে নীলা-নীলাব্জ? লিখছেন অনুপম রায়…
নীলা: বাজে বোকো না তো! এখুনি ট্যারা-বাঁকা কথা শুরু হবে তোমার।
নীলাব্জ: ধ্যাত, কী যে বলো! চকোলেট খাবে?
নীলা: না, জানো না, আমি এইসব খাই না।
নীলাব্জ: ও হ্যাঁ, সরি, সরি। এটা অবশ্য সুগার ফ্রি, স্বাস্থ্যকর…
নীলা: রাখো তো! ঢপের কথা যত, চকোলেট নাকি স্বাস্থ্যকর!
নীলাব্জ: যাক গে, বলছি যে বম্বে যাচ্ছ?
নীলা: না, চাঁদিপুর যাচ্ছি, বম্বে হয়ে। প্লেন কি আকাশে প্যাসেঞ্জার নামাতে-নামাতে যাবে? সবার তো একটাই গন্তব্য।
নীলাব্জ: না, তুমি তো মাঝে মাঝে গোয়া যাও, তাই ভাবছিলাম…
নীলা: গোয়া গেলে ডিরেক্ট ফ্লাইটে যেতাম।
নীলাব্জ: পুনা বা নাসিকও যাচ্ছ না, তাহলে…
নীলা: গায়ে পড়ে এরকম ঝামেলা করো কেন বলো তো?
নীলাব্জ: কী বই পড়ছ? ইংরাজি?
নীলা: এই তুমি যাও তো এখান থেকে… আমি এখুনি এয়ার-হোস্টেসকে নালিশ করব।
তখনই ফ্লাইট আকাশে উড়তে শুরু করে। দুজনেই সিটবেল্ট বেঁধে চুপ করে বসে থাকে।
নীলাব্জ উঁকি মেরে বইয়ের নামটা ধীর লয়ে উচ্চারণ করে পড়ে: ‘হাউ টু বি সাক্সেসফুল ইন লাইফ’।
নীলা: কী হলটা কী? পড়বে বইটা?
নীলাব্জ: পাগল? এই বই কেউ পড়ে?
নীলা: কেউ পড়ে মানে? এটা একটা আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার, জানো তুমি?
নীলাব্জ: তাহলে তো গোটা দুনিয়ার সবাই সাক্সেস পেয়ে গেছে এতদিনে।
নীলা: পড়লেই যে বুঝতে পারে এমন নয়, আর বুঝলেও যে কাজে লাগাতে পারবে থিওরিগুলো তাও নয়।
নীলাব্জ: তার মানে এই বইটা পড়ার আগে আর একটা বই পড়তে হবে, হাউ টু রিড আ বুক সাক্সেসফুলি!
নীলা: এত বাজে বকতে পারো না তুমি!
নীলাব্জ: যা! তোমার কাছে সাফল্যের মানে কী নীলা?
নীলা: সাফল্যের আবার কী মানে? সফল মানে সফল।
নীলাব্জ: একজন কৃষক সফল, না একজন ব্যবসাদার?
নীলা: কৃষকের চাষ ভাল হলে সে সফল, ব্যবসায়ীর ব্যবসা ভালো হলে সে সফল।
নীলাব্জ: ভাল বলে কিছু হয়? তুমি তো প্যারামিটারে ওস্তাদ। একটা প্যারামিটার বলো।
নীলা: বেশ, এক বছরের আর্থিক লাভ। মানে, তর্কের খাতিরে ধরা যাক ১০-১২%-এর উপর লাভ করতে পারল কি না।
নীলাব্জ: ধরা যাক এক বছরে ব্যবসায়ী ২০% লাভ করল আর কৃষক করল ১০%, তাহলে এই আলোচনায় ব্যবসায়ী বেশি সফল। ঠিক?
নীলা: ঠিক।
নীলাব্জ: কিন্তু দেখা গেল, প্রথম দু’বছরে একটু কম লাভ হলেও, কৃষক চার বছর বাদে ৪০% লাভ করল। অন্যদিকে, ব্যবসায়ী কিছু ভুল করার জন্য চার বছর বাদে প্রচুর লোকসান করে একদম ডুবেই গেল। তখন?
নীলা: খুবই সহজ, চার বছর বাদে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি কৃষক অনেক বেশি সফল।
নীলাব্জ: তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে সময় একটা বড় ফ্যাক্টর, সাফল্য মাপার জন্য। তাই না? এরপর আরও পাঁচ বছর বাদে দেখা গেল, কৃষকটি সাপের কামড় খেয়ে মরে গেল কিন্তু ওই ব্যবসাদার আবার ওই ব্যবসাটা টেনে দাঁড় করাল, তখন দশ বছর বাদে কে সফল?
নীলা: এত বাজে কী করে বকতে পারো তুমি নীলাব্জ? মরে যাওয়া মানুষের সঙ্গে সাফল্যের তুলনা করব এখন?
নীলাব্জ: আমিও তো সেই কথাই বলছি। মরেই তো যাবে সেই, এত সাফল্য নিয়ে কী করবে? গলায় ঝুলিয়ে ঘুরবে?
নীলা: অদ্ভুত ব্যাপার! তুমি চাও না সফল হতে? কেন যাচ্ছে বম্বে? নিশ্চয় কোনও ধান্দায়? কী?
নীলাব্জ: একটা কাজ আছে।
নীলা: হ্যাঁ, তো চাও না তুমি সেই কাজে সফল হতে? ফেল মেরে আসতে চাও সেটাতে?
নীলাব্জ: আহ্, রেগে যাচ্ছ কেন এত?
নীলা: না, না, তুমি বড্ড বাজে বকো। এই যে পাইলট প্লেন ওড়াচ্ছে, চায় না সফল ল্যান্ডিং? একটু এদিক থেকে ওদিক হলে, আমরাও মরব, নিজেও মরবে।
নীলাব্জ: আরে বাবা, আমি তা বলছি না…
নীলা: কী বলতে চাও? তুমি সাক্সেসকে ঘৃণা করো, তাই তো? সফল মানুষদের গায়ে থুতু ছেটাতে চাও?
নীলাব্জ: আস্তে! আস্তে! গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলে ফেলেছ, সফল মানুষ। নীলা তুমি ‘সফল মানুষ’ মানে কী বলতে চাও?
নীলা: আর পাঁচজন সফল মানুষ বলতে যা বোঝে, আমিও তাই বুঝি।
নীলাব্জ: না, মানে কী দিয়ে মাপছ সাফল্য? বইয়ে কী লেখা? কী দিয়ে মাপতে বলছে?
নীলা: দুনিয়া যা দিয়ে মাপে, আমিও তাই দিয়েই মাপব।
নীতিহীনতা নিয়েও তুমি ভাবিত নও যা বুঝছি। ঠিক আছে ধরো, একজন সফল ডাক্তার। বিশাল নামডাক কিন্তু মদারু। বউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল নয় আর ছেলেটাও একদম বিশ্ব-বখাটে। এই ব্যক্তিকে তুমি কি একজন সফল মানুষ বলে চিহ্নিত করবে? মৃত্যুর আগে এই মানুষটি কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ‘আই অ্যাম আ ফেইলিয়র!’
নীলাব্জ: প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না ঠিক করে। আচ্ছা ধরো, একজন মন্ত্রী। রাজনৈতিক ভাবে সফল, কারণ সে মন্ত্রিত্ব পেয়েছে, যা তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এটা পেতে গিয়ে তাকে মাঝেমধ্যেই বেশ কিছু পথের কাঁটা দূর করতে হয়েছে। কাউকে জেলে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে, কাউকে ভ্যানিশ করে দিতে হয়েছে, আবার কাউকে মেরেই ফেলতে হয়েছে। এদিকে অনিদ্রার রুগি। হজমেরও বেজায় সমস্যা। সকালে একটা অমলেট খেলেও বিকেল চারটে অব্ধি খিদে পায় না। এই মানুষ কি সফল মানুষ?
নীলা: নিজের কার্যসিদ্ধির জায়গা থেকে যদি দেখি, তাহলে অবশ্যই সফল। হজমে অসফল না নিদ্রায় অসফল এই নিয়ে বইয়ে মনে হয় না কিছু লেখা পাব আর আমি ওটা নিয়ে ভাবছিও না। তোমার যত বাজে কথা।
নীলাব্জ: আর নীতিহীনতা নিয়েও তুমি ভাবিত নও যা বুঝছি। ঠিক আছে ধরো, একজন সফল ডাক্তার। বিশাল নামডাক কিন্তু মদারু। বউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল নয় আর ছেলেটাও একদম বিশ্ব-বখাটে। এই ব্যক্তিকে তুমি কি একজন সফল মানুষ বলে চিহ্নিত করবে? মৃত্যুর আগে এই মানুষটি কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ‘আই অ্যাম আ ফেইলিয়র!’ বলে সিনেম্যাটিক ভাবে কাঁদতেও পারে।
নীলা: তুমি মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়ছ কেন? ফ্যামিলি লাইফ ঘাঁটা বলে সে ব্যর্থ?
নীলাব্জ: ভেরি গুড। এবার পরের প্রশ্ন। খাজা উকিল। সব কেস হারে কিন্তু ফ্যামিলি লাইফ দারুণ। ভাল গানও করে। উকিল সাহেব কি তাহলে সফল না অসফল মানুষ?
নীলা: বুঝেছি, তুমি বলতে চাইছ সফল মানুষ বলে কিছু হয় না। ক্ষেত্রবিশেষে কেউ সফল, কেউ অসফল, তাই তো?
নীলাব্জ: সফল মানুষ তো হয়ই না, তাছাড়া কী হবে এসব মেপে? সাফল্য কি আদৌ মানুষের হাতে? আমাদের শুধু মনের আনন্দে কাজ করে যেতে হয়; সাফল্য এলে এল, না এলে এল। কী যায় আসে?
নীলা: তুমি গীতার বাণী আউড়াচ্ছ কেন? জীবন কি দর্শন দিয়ে চলে? জংধরা তালাতে চাবি গুঁজে ঘুরিয়ে চলেছি, খুললে খুলবে, না খুললে, না খুলবে। আমি মনের আনন্দে চাবি ঘোরাতে থাকব? সকাল থেকে মনের আনন্দে অঙ্ক কষে চলেছি। উত্তর মিললে মিলল, না মিললে মিলবে না, মনের আনন্দ তো হচ্ছে! যত সব বুজরুক।
নীলাব্জ: আমি মোটেও সে-কথা বলছি না। আমি বলছি, কাজ ভাল হলে এমনিই সাফল্য আসে।
নীলা: বাজে কথা। একে তো ভাল-খারাপ আপেক্ষিক। তা ছাড়া অনেক খারাপ জিনিসকেও সফল করে তোলা যায় বিভিন্ন কায়দায়।
নীলাব্জ: এইসব লিখছে তোমার বইয়ে? পরীক্ষককে কী করে ঘুষ দিতে হয়? কী করে কাউকে তেল মেরে কাজ হাসিল করতে হয়? কী করে হানি ট্র্যাপে ফাঁসিয়ে কারও জীবন বরবাদ করতে হয়?
নীলা: আবার বাজে বকছ তুমি। শোনো, সাফল্যের না একটা ফর্মুলা আছে…
নীলাব্জ: ফর্মুলা?
নীলা: একটা প্যাটার্ন। সেগুলো আয়ত্ত করতে পারলে, সাফল্য আসবেই। নিজের স্বভাবের মধ্যে নিয়ে আসতে হয় সেগুলোকে।
নীলাব্জ: বেঁচে থাকার ফর্মুলার? অসম্ভব, থাকতে পারে না।
নীলা: দেখবে, সব সফল মানুষ… সরি, সরি, কর্মক্ষেত্রে সফল মানুষের কিছু-কিছু জিনিস একদম এক। সফল সিনেমা, সফল গান, সফল উপন্যাস— সব কিছুর একটা ফর্মুলা রয়েছে।
নীলাব্জ: ইউ মিন, বাণিজ্যিক ভাবে যেগুলো সফল।
নীলা: হ্যাঁ।
নীলাব্জ: কিন্তু সেটাই সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি নয়। গান, সিনেমা, ছবি আঁকাকে এই সমীকরণে বসাতে যেয়ো না। ভ্যান গঘ মারা যাওয়ার পর, সেই আঁকা বাণিজ্যিক ভাবে সফল হল। কোন ফর্মুলাতে ফেলবে ওর ছবিগুলোকে?
নীলা: কিন্তু বাণিজ্যিক ভাবে সফল না হলে তো জানতেও পারতাম না আমরা…
নীলাব্জ: পারতাম না কিন্তু তা বলে কি ওই ছবিগুলো ব্যর্থ হয়ে যেত?
নীলা: কেউ জানতেই না পারলে কীসের সাফল্য আর কীসেরই-বা ব্যর্থতা?
নীলাব্জ: তুমি পাগল হয়ে গেছ।
নীলা: পাগল তুমি, অন্য সিট থেকে ঝাঁপিয়ে এসে আমার সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করছ।
নীলাব্জ: এরকম বাজে বই যারা লেখে আর যারা পড়ে, দুজনকেই আমি ঘৃণা করি। সাক্সেসফুল ইন লাইফ মানে কী? জীবন কি লং জাম্প? জীবন মানে কী, তাই মানুষ এখনও বুঝল না আর এই হরিদাস পাল সেই জীবনকে সফল করতে…
নীলা: অনেক হয়েছে। এবার চুপ করো আর আমাকে পড়তে দাও।
এই বলে নীলা আবার মন দিয়ে বইটা পড়তে থাকে। নীলাব্জ পকেট থেকে হেডফোন বের করে কানে গুঁজে, চোখদুটো বোজে। বাকি পথ আর কেউ কারোর সঙ্গে কোনও কথা বলে না।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী