ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • অসম্পাদিত সম্পাদক

    একরাম আলি (March 25, 2025)
     

    পত্রিকা কেমন হওয়া উচিত?

    সহজ উত্তর— সম্পাদক যেমন।

    ১৯৭৭। সেদিন রবিবার। মাস— মার্চ-ফার্চ হবে। পাটভাঙা হলুদ পাঞ্জাবি। ধুতির কোঁচা লুটোচ্ছে চকচকে পাম্প সু-র ওপর। থাকথাক চুলে কালীঘাটের পটের বাবুটি। বসে আছেন নাকতলায় প্রতিভা বসুর ভাড়াটে দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়েয় বাড়ি। পাশে আমি। নাম কী ভাই? শুনে পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে ম্যাজিশিয়ানের মতো বের করলেন লম্বা এক ফর্দ। তাতে চোখ বোলাতে গিয়ে একজায়গায় আটকে গেল। হ্যাঁ, এই তো। গলা যথাসম্ভব বিনয়ে চুবিয়ে তাঁর অনুরোধ— ভাই, কাল একবার আসতে পারবেন বাগবাজারে; অমৃত পত্রিকার অফিসে?

    আরও পড়ুন : হিমানীশ গোস্বামীর রসবোধে মজে থাকত তাঁর সহকর্মীরা! লিখছেন দীপঙ্কর চক্রবর্তী…

    সেই প্রথম দেখি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে। তখনও পর্যন্ত পড়েছি তাঁর একটি গল্প সংকলন মাত্র। সেটি ছিল সন্তোষকুমার ঘোষ সম্পাদিত।

    ১৯৬১-তে প্রথম প্রকাশ। বিগত বছরগুলোতে বহু বিখ্যাত লেখকের উপস্থিতি ছিল ‘অমৃত’ পত্রিকার পাতায়। কিন্তু কোনও ঝাঁকুনি ছিল না। নতুন দায়িত্ব নিয়ে এলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। সন্তোষকুমার ঘোষ তাঁর গদ্যে টাটকা পেঁয়াজের ঝাঁজ পেয়েছিলেন। অমৃতে সেই ঝাঁজ এসে লাগল।

    বাংলায় যাকে বলে— আনপ্রেডিক্টেবল, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তা-ই

    পরদিন আনন্দ চ্যাটার্জি লেনে যেতেই একঝাঁক প্রশ্ন। বাড়ি বীরভূম শুনে জানতে চাইলেন— অজয় পেরিয়ে বাস যখন ইলামবাজারে ঢোকে, কী দেখা যায়?

    বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিল। পিছনে জানালা। সামনে আমি। ওদিকের টেবিলে কোনও একজনের কনুই অবধি হাতা-গোটানো পাঞ্জাবি। ব্যাকব্রাশ চুল। মুখে সিগার। বাংলা সিনেমার বাইরে-যে এঁকে দেখতে পাব, ভাবিনি। পাশের টেবিলে আরও দু-জন। এককোণে কালো রঙের কুঁজো। জলের।

    কোনদিক থেকে বুঝতে চেষ্টা করা উচিত, জানি না। উনি জানিয়ে দিলেন— রাস্তার দু-পাশে দেখতে পাওয়া যায় মাটির হাঁড়ি–কলসি-বোঝাই গোরুর গাড়ি। ফরমাশ হল, বীরভূমের সাহিত্যচর্চা নিয়ে একটা লেখা তৈরি করতে।

    —কবে দিতে হবে?

    —এখনই।

    আমি হতভম্ব! এটা সম্ভব? কেউ একজন বলবেন আর লেখা শুরু হয়ে যাবে? আমার চুপচাপ বসে-থাকা দেখে কোণের একটা টেবিলের দিকে আঙুল তুলে সম্পাদকের হুকুম— ওটাতে গিয়ে লিখুন।

    গ্লাসদুয়েক জল, গোটাতিনেক সিগারেটও শেষ হয়ে গেল। লেখা আর শেষ হতে চাইছে না। তবু শেষ হল। সামনে ওরকম দশাসই সম্পাদক থাকলে না-হয়ে পারে? টেবিলে রাখতেই জিজ্ঞাসু চোখ— ক-টা স্লিপ?

    —চারটে।

    ছুঁয়েও দেখলেন না।

    —ভাস্কর! ভাস্কর!

    কোত্থেকে নতুন চরিত্রের প্রবেশ। চোখের ইশারায় লেখাটা দেখিয়ে বললেন— প্রেসে দাও। আর ড্রাইভারকে ডেকে দিও। 

    আমি হতবাক! ভয়ে-ভয়ে তবু বললাম, পড়ে দেখলেন না!

    আরও জরুরি কাজ রয়েছে তাঁর। একটা বড় খাতা, বাঁধানো, তখনও জানি না-যে, ওটা তাঁর লেখার খাতা— এসে ইস্তক যদিও লিখতে দেখিনি— ব্যাগে ভরলেন। সঙ্গে একগাদা টুকটাক কাগজ। ততক্ষণে ড্রাইভার এসে দাঁড়িয়ে। অফিসের লোকেদের— একজনের নাম ততক্ষণে জানতে পেরেছি, গৌতম— কিছু নির্দেশ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ব্যাগ নিয়ে ড্রাইভার বেরিয়ে গেল। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। এই প্রথম মুখে একটু হাসি— চলো। আমরা উঠব।

    পিছু-পিছু বাইরে এসে দেখি, অ্যাম্ব্যাসাডরের দরজা খুলে উনি দাঁড়িয়ে। বললেন— ওঠ্।

    কোথায়, জানতে চাইনি। কেননা, প্রথম দিনেই আপনি থেকে সরাসরি হুশ করে তুই! আর তিনিও হয়ে গেলেন শ্যামলদা।

    বুঝলাম, বাংলায় যাকে বলে— আনপ্রেডিক্টেবল, তিনি তা-ই। 

    ‘অমৃত’ পত্রিকার অফিসে শ্যামলদা সেখানে তৈরি করেছিলেন মুক্ত পরিবেশ

    কিন্তু তাঁর সম্পাদিত অমৃত তেমন ছিল না। প্রথম থেকেই শ্যামলদা সেখানে তৈরি করেছিলেন মুক্ত পরিবেশ। তুমি লেখক অথবা ‘হতে চাও লেখক’? তাহলে নিজের লেখার দায়িত্ব নিজে নাও। ফলে, নানা জায়গা থেকে নতুন-নতুন লেখক-লেখিকা আসতেন। তাঁদের কারও-কারও সঙ্গে শ্যামলদার কথাবার্তা ছিল রেকর্ড করে রাখার মতো।

    একবার হ্যালহেড নিয়ে কী-এক সেমিনার হচ্ছে রবীন্দ্রভারতীতে। সেখানে পেপার পড়তে এসেছেন বিহার-প্রবাসিনী এক অধ্যাপক। সেই ফাঁকে অমৃতে। লেখা দিতে।

    ‘বাংলা লেখা পড়েন? আমার ‘ইছামতী’? পড়েছেন নাকি?’ 

    —হ্যাঁ।

    —তাহলে তো আমার বি টি রোডের ধারে অবশ্যই পড়েছেন?

    —হ্যাঁ-অ্যা!

    বর বিহারেরই এক হাসপাতালের ডাক্তার আর তিনি বাংলা পড়ান এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। দু-টি মেয়ে। পাটনার কনভেন্টে ওরা পড়ে। শুনে শ্যামলদার নিদান— আপনি চাকরিটা ছেড়ে বরের কাছে চলে যান আর মেয়েদুটোকেও বাড়িতে নিয়ে আসুন। ওদের আম মেখে মুড়ি খাওয়ান। পাতা কেটে চুল বেঁধে দিন। এসব প্রবন্ধ-টবন্ধ লিখে কিছু হবে না।

    —তাহলে কি লেখাগুলো নিয়ে যাব? 

    —তা কেন? ওগুলো দিন। এত দূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন।

    লেখাগুলো ছাপাও হয়েছিল। এরকম কত-কত লেখা ছাপা হয়েছে! কোনও কোনও লেখা আজও খুঁজে বের করেন কেউ কেউ। কাজে লাগে বলেই তো খোঁজেন!

    ‘অমৃত’ এখন প্রায়-দুষ্প্রাপ্য পত্রিকা। আর, পত্রিকাটিকে দুষ্প্রাপ্যতার মর্যাদা দিয়েছে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনার গুণ। 

    বিড়লা অ্যাকাডেমিতে একবার কনটেম্পোরারি আর্টিস্ট গ্রুপের একটা আর্ট এগজিবিশন দেখতে গেলাম আমরা। শ্যামলদার নেতৃত্বে। শ্যামল দত্তরায় ঘুরে ঘুরে দেখালেন। বেশ কয়েকটা পেইন্টিঙের ছবি তোলা হল। কী হবে? এক-একটা ছবিকে বিষয় করে প্রচ্ছদ-কাহিনি হবে। সুনীলমাধব সেনের একটা ছবি টেবিলে রেখে বললেন, ‘এটা নিয়ে একরাম লিখবে। কভার স্টোরির নাম হবে— বাঁশিওয়ালা।’

    এরকম সব ছবি দিয়ে লিখতে বলা হল কয়েকজনকে। সেই সিরিজটা, বলতে হবে, বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল।

    বাংলা পত্রিকার জগতে বেশ কিছু, যাকে বলে, ব্রেক এনেছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে প্রতি রবিবার বেশ কয়েকটা জায়গায় নিলাম হত, যাকে বলে অকশন হাউস। একদিন শ্যামলদা বললেন, দেখে আয় তো কী ব্যাপার। এক রোববার গিয়ে অকশন হাউসগুলোয় ঢুকে অন্য এক জগৎ দেখে এলাম। কী পাওয়া যেত না সেসব জায়গায়! আর, আশ্চর্য করার মতো জিনিসগুলো আসত প্রাচীন পরিবারগুলো থেকে। ভেনিশিয়ান মিরর। বেলজিয়াম কাটগ্লাস। ব্রিটিশ রাইটিং টেবিল। কখনও কয়েন। তবে সতর্ক চোখে কিনতে হত। না-হলে পা পিছলে যেতেই পারে। সেই থেকে ‘নিলাম’ নামে একটা কলামই চালু হয়ে গেল। পার্ক স্ট্রিটে অকশন হাউসগুলোর—  ভিক্টর, স্পেনসার্স, রাসেল এক্সচেঞ্জ ইত্যাদির— অন্দরে ঢুকে পড়ল ছাপোষা বাঙালি। একদিন সদ্য স্বদেশ-প্রত্যাগত উৎপলকুমার বসু, আমাদের সেই উৎপলদা, গেলেন রাইটিং টেবিল কিনতে। এবং পেলেনও। পাইপে টান দিয়ে উৎপলদা বলেছিলেন, ‘বেশ সস্তাই তো!’

    শ্যামলদার পিছনে তখন নিন্দার কুণ্ডলীই ঘুরছে বলা যায়। সন্তোষকুমার ঘোষের হাত অথবা পা, কিছু একটা ভেঙে, বড় কাগজের অফিসের চাকরি ছেড়ে, এখানে এসেছেন। কিন্তু স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি। লিখে ফেললেন ‘ঈশ্বরীতলার রুপোকথা’। একটা মরিস মাইনর কিনেছেন সদ্য। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল আর আমি আছি তাঁর সঙ্গে। বললেন, ‘চল না, তিনজনে মিলে এরকম একটা গাড়ি কিনি? দেড়হাজার করে দিলেই হয়ে যায় রে!’

    তখন তাঁকে মল্লিকবাজারে পেয়েছে। লিখছেন— ‘হাওয়াগাড়ি’।

    যখন ‘মানুষ কেনাবেচার ইতিহাস’ ধারাবাহিক বেরচ্ছে, শ্যামল রায়কে আমরা কেউ পাত্তা দিইনি। এখন শুনি, বইটা অনেকে খোঁজে। 

    এমনই ছিল ‘অমৃত’। সবার মুখে তখন ঘুরছে অমৃত-র নাম। আর ঘুরছে তার খেয়ালি সম্পাদক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের নামও। একদিন দেখি কলেজ স্ট্রিটের এক বন্ধ দোকানের সিঁড়ির ধাপে শ্যামলদা বসে আছেন। তাঁর পাশে, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, স্বয়ং, তুষারকান্তি ঘোষ! 

    সেই ‘অমৃত’ বন্ধ হয়ে গেল ১৯৮০-তে। শ্যামলদারই মুখে শোনা— প্রায় ২০ বছরের আয়ুষ্কালে সবে লাভের মুখ দেখছিল অমৃত। কিন্তু একটা পুষ্করিণীর জলে ঘোষ পরিবারের বিশাল চিল্কা হ্রদ কি ভরে?

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook