সঞ্জীত চৌধুরীর সংগ্রহের প্রদর্শনী : From Prayer Room to Parlours
কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলের অধিকাংশ পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতল গড়ে ওঠার আগে— অন্তত এই ক’দিন আগেও, বাড়িগুলিতে পা রাখলে, শ্যাওলাধরা দেওয়ালে, টিমটিমে হলদে আলোর মায়ায়— দেখা যেত নানা রঙিন ছবি, বিষয় মূলত পুরাণে বর্ণিত ঘটনা, পদাবলি, মণীষী। অবশ্য, এই ছবিগুলো শুধুমাত্র ‘ছবি’ নয়। প্রতিটি ছবিরই সারবস্তু আলাদা-আলাদা গল্প। বলা ভাল, বাড়িগুলির দেওয়ালে, এক-একটা গল্পই টাঙানো থাকত, থাকত একটা সময়ের উপকাহিনি।
এই হরেকরকম গল্পের ছবি, পোশাকি ভাষায়: (ক্রোমোলিথোগ্রাফ, অলিওগ্রাফ) পদ্ধতিতে ছাপা ছবি নিয়ে ২৮বি শেক্সপিয়র সরণির ‘গ্যালারি এইট্টিএইট’ সেজে উঠেছে। ছবিগুলি সঞ্জীত চৌধুরীর ৩০ বছরের সংগ্রহ। অধিকাংশ ছবিরই প্রকাশকাল উনিশ শতকের শেষার্ধ ও বিশ শতক। চৌধুরী পেশায় চিত্রগ্রাহক, বিজ্ঞাপন নির্মাতা এবং সর্বোপরি একজন অভিজ্ঞ সংগ্রাহক।
সঞ্জীতের কথায়, দীর্ঘদিন, প্রায় ৩০ বছর ধরে, কখনও কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি— দেশের এমন নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছেন এই ছবিগুলি। আর্ট প্রিন্ট সংগ্রহের নেশা, প্রিন্ট সম্পর্কে আগ্রহ, সবটাই তাঁর ‘আরপি কাকা’, ওরফে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত-র থেকে পাওয়া। সঞ্জীত বলছিলেন, রাধাপ্রসাদই তাঁকে শিখিয়েছেন আর্ট প্রিন্ট-এর খুঁটিনাটি, কীভাবে তা সংরক্ষণ করতে হয়, এছাড়াও দেশ-বিদেশের নানান আর্ট প্রিন্ট সংক্রান্ত গল্পগাছা তাঁর আরপি কাকার থেকেই শোনা, পারিবারিক যোগসূত্রে।
আরও পড়ুন : বেঙ্গল বিয়েনাল-এর ঝাঁকিদর্শন শুভময় মিত্রর কলমে!
প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব…
ক্রোমোলিথোগ্রাফ পদ্ধতিতে ছবি প্রকাশ কলকাতা শহরে শুরু হয় ১৮২২-এ, তবে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই (আরও স্পষ্টভাবে বললে, সিপাহী বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে, যখন কোম্পানির থেকে শাসনভার ব্রিটিশ সরকারের হাতে গেল) কলকাতা-সহ নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে গেল এই পদ্ধতিতে ছাপা ছবি। আসলে, মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্তরা অনেকেই ‘প্রচুর টাকা’ খরচ করে অয়েল পেইন্টিং কিনতে চাইতেন না। আবার, উনিশ শতকে কলকাতা শহরে কমবেশি বাবু হওয়ার চেষ্টা সকলেই করতেন। ‘হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বাবু’ তখন ঘরে-ঘরে। (‘বাবুর ঘরে যে ধন আছে, আমার ঘরেও সে ধন চাই / কিন্তু পকেটে রেস্ত নাই’) এখন দেওয়ালে যদি অয়েল পেইন্টিং-এর মতোই একটা ছবি থাকে, কিন্তু যা আসলে অয়েল পেইন্টিং নয়, পাশাপাশি দামেও অনেক সস্তা, তার থেকে ভাল কিছুই হয় না। মূলত, এর ফলেই অলিওগ্রাফের চাহিদা বাড়তে শুরু করল এবং শহর-মফসসলের বাড়িগুলি ছেয়ে গেল এই ধরনের ছবিতে। শহরের নানা জায়গায় গজিয়ে উঠল লিথো প্রেস, মূলত উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলের কাঁসারিপাড়া, চোরবাগান অঞ্চল, হ্যারিসন রোড (অধুনা এমজি রোড), অপরদিকে, চিৎপুরের মতো অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল এই প্রেসগুলি। যার মধ্যে কাঁসারিপাড়া আর্ট স্টুডিও, ঘোষ ও মিত্র, ইম্পেরিয়াল আর্ট কটেজ, রয় ব্যানার্জি অ্যান্ড কোং থেকে প্রকাশিত ছবি এই সংগ্রহে প্রদর্শিত।
উল্লেখযোগ্যভাবে, কিছু ছবির প্রকাশক কলকাতার হলেও, ছবিগুলি বিদেশ থেকে ছেপে আসত, যেমন ‘শকুন্তলা-দুষ্মন্ত’, ‘দণ্ডী-উর্বশী’ শীর্ষক ছবিগুলি জার্মানিতে মুদ্রিত। আবার, ‘বংশীবাদন’ শীর্ষক ছবির নিচে যেমন লেখা, ‘মেড ইন অস্ট্রিয়া’। অর্থাৎ, বিদেশ থেকে ছেপে আসা লিথো প্রিন্টের চাহিদাও ছিল সে-সময়। আগ্রহব্যঞ্জক এই যে, যে-সমস্ত প্রকাশক এই বিদেশি লিথো প্রিন্টগুলি আমদানি করতেন, তাঁদের অধিকাংশই চিৎপুর অঞ্চলের, আন্দাজ করা যেতে পারে, জাহাজঘাটা কাছে হওয়ায় এই অঞ্চলের প্রকাশকদেরই বিদেশি প্রিন্ট-এর ছবি আমদানি ছিল অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
ছবির বৈশিষ্ট্যগুলি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমত, ছবির কেন্দ্রীয় বিষয় পুরাণ, কিন্তু পুরাণের কোন-কোন বিষয়? কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। একটি ছবির শিরোনাম ‘মদনভস্ম’। শিবের মদনকে ভস্ম করে দেওয়ার ঘটনা বহুল প্রচলিত। কিন্তু এই কাহিনি জনপ্রিয় হল কখন? ঠিক ভারতচন্দ্র যখন ‘অন্নদামঙ্গল’-এ এই প্রসঙ্গ আনলেন। ‘মনসা’ শীর্ষক যে আর্ট প্রিন্ট, সেই ছবির মনসাও কিন্তু মঙ্গলকাব্যে বর্ণিত মনসার প্রতিচ্ছবি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ‘মদনভস্ম’ শীর্ষক ছবি বা ‘বিজয়া’ শীর্ষক ছবিতে শিবের যে চেহারা দেখা যাচ্ছে, তা সম্পূর্ণরূপে ভুঁড়িওলা বাঙালি শিব— যার পূর্বসূত্র নিহিত রামেশ্বর ভট্টাচার্যের শিবায়ন কাব্যে। ‘বিজয়া’ ছবিটিতে পার্বতীকে যেভাবে বিদায় জানানো ফুটে ওঠে, তা যেন বাঙালি মেয়ের শ্বশুরঘরে যাওয়ার প্রতিরূপ।
কিছু ছবির বিষয় যেমন রাধাকৃষ্ণর কাহিনি। সেখানে ছবির শিরোনাম হিসেবে সরাসরি উঠে এসেছে ‘মাখনচুরি’, ‘কলহান্তরিতা’, ‘যুগল-মাধুরী’র মতো বৈষ্ণব পদাবলির কেন্দ্রীয় বিষয়। কোনও-কোনও ছবির নিচে বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস-এর পদও ছাপা রয়েছে। অর্থাৎ, কোনও না কোনওভাবে ছবিগুলি বাংলার মধ্যযুগের কাব্যধারা তথা সংস্কৃতিরও উত্তরসূরি।
এই প্রদর্শনীতে বিশেষভাবে বামাপদ ব্যানার্জি, ভবানীচরণ লাহা, শীতলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কাজের প্রিন্ট প্রদর্শিত। এঁরা সকলেই পাশ্চাত্যর বাস্তবরীতি দ্বারা প্রভাবিত; ফলত প্রতিটি ছবিতেই চরিত্রের যে গঠন, তা ভীষণভাবে বাস্তব-অনুসারী, শুধু রৈখিক গঠনেই নয়, রঙের ব্যবহারেও বাস্তব অনুসরণের ব্যতিক্রম হয়নি। বামাপদ ব্যানার্জির ‘অর্জুন ও উর্বশী’ শীর্ষক ছবিটিতে অর্জুনের গায়ের রং হিসেবে শ্যামবর্ণর ব্যবহারও চমকপ্রদ।
প্রদর্শনীর প্রতিটি প্রিন্টই অসাধারণ অবস্থায় রয়েছে, রংও সেই অর্থে বিবর্ণ হয়নি; এত সময় ধরে সংগ্রাহক যে শুধুমাত্র ছবিগুলি সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত হননি, তা বোঝা যায়। ছবিগুলি অসামান্য যত্ন, দক্ষতার সঙ্গে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত।
‘গ্যালারি এইট্টিএইট’-এর দ্বি-তল বিশিষ্ট স্পেসটিও অতি চমৎকার। সেই স্পেস-এর যথাযথ ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য বিষয়ানুগ পন্থায় ছবিগুলি সাজানো। গ্যালারিতে প্রায় প্রতিটি ছবির ওপরেই যেভাবে আলো প্রক্ষেপ করা হয়েছে তার জন্য ছবির সামান্যতম ডিটেলসও সহজে চোখ এড়ায় না।
প্রসঙ্গত, এর আগে ২০০৬ সালে ‘বিড়লা সভাঘর’-এ সঞ্জীত চৌধুরীর সংগ্রহের আর্টপ্রিন্ট প্রদর্শিত হয়েছিল, সমগ্র প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছিলেন অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ তপতী গুহঠাকুরতা। সেই প্রদর্শনীর বিষয়ের বিস্তৃতি ও প্রদর্শিত ছবির সংখ্যা ছিল বর্তমান প্রদর্শনীর তুলনায় বেশি। প্রদর্শনীটি এতই জনপ্রিয় হয়েছিল, সভাঘর কর্তৃপক্ষ প্রদর্শনীর দিন দীর্ঘায়িত করেন। এমনকী, পরে বম্বেতেও ছবিগুলি প্রদর্শিত হয়। সমগ্র প্রদর্শনীর একটি ক্যাটালগ প্রকাশিত হয়েছিল সে-সময়, বর্তমান প্রদর্শনীর বেশকিছু ছবিও সেই প্রদর্শনীতে ছিল। যার বিস্তারিত তথ্য ক্যাটালগ-এ পাওয়া যায়। ‘গ্যালারি এইট্টিএইট’-এর প্রদর্শনীর বিষয় শুধু বঙ্গীয় সংস্কৃতির ক্রোমোলিথোগ্রাফ, অলিওগ্রাফ পদ্ধতিতে ছাপা আর্ট-প্রিন্ট।
এই প্রদর্শনীর খামতি একটিই, এই ছবিগুলির একটি বিস্তারিত ক্যাটলগ প্রকাশিত হলে, সবদিক থেকেই আয়োজনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হত। আশা করা যায়, তা অদূর ভবিষ্যতে প্রকাশিত হবে।
প্রদর্শনী চলবে ২৬ মার্চ পর্যন্ত, সকাল ১১টা থেকে ৭টা, রবিবার বন্ধ।