গিটার অথবা মরুভূমি
গনগনে রোদের মধ্যে চোখ তুলে তাকানো দায়। অটো স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি, প্রায় ৩০ জনের পিছনে আমি দাঁড়িয়ে। সামনে অটোরিকশা ইউনিয়নের ছোট্ট ঘরটার ভেতরে ফুল স্পিডে পাখা ঘুরছে। আর দু-একজন অটোরিকশা চালক সেই ঘরের ভেতর বসে গল্পগুজব করছে। ঝাঁঝালো রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য যেন সহ্য করা যায় না। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাড়ের কাছে কলারে লাগিয়ে দিলাম। নইলে কলারে ঘামের দাগ বসে যাবে। কাঁধের ব্যাগটাকে এপাশ থেকে নামিয়ে ওপাশে নিলাম। অটোর লাইনটা সামান্য এগিয়েছে। গায়ের ফুলহাতা জামা ঘামে ভিজে ধীরে ধীরে শরীরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। অথচ উপায় নেই, আজ সোমবার। অফিসে মিটিং আছে।
এর মধ্যেই দু’জন প্যাসেঞ্জারের মধ্যে তুমুল অশান্তি শুরু হয়ে গিয়েছে। যদিও দু’জনের গন্তব্য একই দিকে, তবুও ঝামেলা শুরু হয়েছে অটোর সামনে-পিছনে বসা নিয়ে। এই চরম উত্তেজনা পেরিয়ে যখন একটা অটোর সামনে পৌঁছলাম, ভেতরে বসার মুহূর্তে গুরুগম্ভীর চালক জানিয়ে দিলেন, ‘খুচরো থাকলে তবেই বসুন, নাহলে পরের অটোয় উঠুন।’ এদিকে আমি জানি, পকেটে খুচরো নেই। অগত্যা নেমে যেতে হল। আবার দীর্ঘ অপেক্ষা।
সোমবার কখনও কখনও আতঙ্ক নিয়ে আসে! পড়ুন ইন্দ্রাশিস আচার্যর কলমে ‘মনডে ব্লুজ’ পর্ব ১১…
এভাবেই শুরু হত আমার ‘সোমবার’! রবিবার বিকেলের মতো মনমরা সন্ধে যেমন হয় না, তেমনই সোমবারের মতো নিষ্ঠুর সকাল যেন হয় না। যখন আইটি কোম্পানির হয়ে ‘মজদুরি’ করতাম, তখন হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকতাম আসন্ন শুক্রবারের দিকে। সপ্তাহান্তের দুটো দিন যে কীভাবে কেটে যেত, বুঝতেই পারতাম না। আমি কোনওদিনই পার্টি অ্যানিম্যাল ছিলাম না। শনিবার করে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম জোড়াবাগানে আমাদের পুরনো বাড়িতে। রবিবার দুপুরে ফিরে আসতাম বাগুইআটির ভাড়াবাড়িতে। তারপরই হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ত সোমবারের ‘অনভিপ্রেত’ সকাল।
প্রতি সোমবার যত রাজ্যের গুরুত্বহীন মিটিং রাখা হত অফিসে। কারণে-অকারণে মিটিং। কাজে-অকাজে মিটিং। অন্ধকার কনফারেন্স রুমে সোমবার সকাল এগারোটায় শুরু হওয়া বক্তৃতা যে কী দুর্বিষহ, যাঁরা ভোগ করেছেন, একমাত্র তাঁরাই জানেন। প্রোজেক্টরে চলতে থাকা দুর্বোধ্য অক্ষর, নম্বর আর চিহ্নের বেসুরো দাপাদাপি দেখতে দেখতে চোখ ভারী হয়ে আসত। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ম্যানেজারের প্রিয়তম ভৃত্য অনেক কষ্টে গালের চোয়াল শক্ত করে, ঠোঁট চিপে, নাক ফুলিয়ে, চোখ বড়-বড় করে হাই তোলা থেকে নিজেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছে। সোমবারের সকালের এমনই সব রসকষহীন সূচনা সহ্য করতে হয়েছে দিনের পর দিন।
এরপর যখন একদিন দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অনিশ্চয়তার জীবনে ঝাঁপ দিলাম, সেদিন অনুভব করলাম, সোমবারটা কিন্তু মোটেই রসকষহীন নয়। যথেষ্ট আনন্দের। আজকাল সত্যি বলতে কী, সোমবারের অপেক্ষায় থাকি। কখন সকাল হবে, কখন সিনেমার সেটে যাব।
বাবাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি ৩৫ বছর এক অফিসে এক টেবিলে বসে কাজ করেছ। সোমবার এলে বিরক্ত হতে না।’ বাবা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে উত্তর দিয়েছিল, ‘তোদের মতো মাইনে আমরা পেতাম না ঠিকই, কিন্তু আমরা আনন্দ করতে করতে কাজ করতাম!’
এরপর যখন একদিন দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অনিশ্চয়তার জীবনে ঝাঁপ দিলাম, সেদিন অনুভব করলাম, সোমবারটা কিন্তু মোটেই রসকষহীন নয়। যথেষ্ট আনন্দের। আজকাল সত্যি বলতে কী, সোমবারের অপেক্ষায় থাকি। কখন সকাল হবে, কখন সিনেমার সেটে যাব। কখন ব্রেইন স্টর্ম করতে বসব বাঘা বাঘা পরিচালক, সিনেমাটোগ্রাফার, অ্যাকশন ডিরেক্টরদের সঙ্গে। আমার কাছে এখন সোমবারের সকাল মানে বিষন্নতার অপেক্ষা নয়, নতুন সূচনার ব্রহ্মমুহূর্ত!
গত কয়েক মাস ধরে নিজেই ড্রাইভ করছি। সোমবার সকালে যখন জুহুর সমুদ্রসৈকতের পাশ দিয়ে গাড়িটা চালিয়ে যাই, দূরে সমূদ্রের ওপর হিরের কুচির মতো ছড়িয়ে থাকা সূর্যের আলোর দিকে মনে হয় বাবার সেই কথাগুলো কতটা দামি ছিল, ‘আমরা আনন্দ করতে করতে কাজ করতাম!’
আমার মনে হয়, সোমবারের সকাল একটা বহুমূল্য দুর্দান্ত গিটারের মতো। সঠিক সুরে, ছন্দ মিলিয়ে বাজাতে পারলে সে তোমার প্রিয় বন্ধুর মতো। যার সঙ্গে দেখা করতে মন চায়। আর যদি দায়বদ্ধতার চোরাবালি, কমফোর্ট জোনের স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলা সেই গিটারের খোলে জমা হয়, তাহলে সোমবারের সকাল এক অন্তহীন কালাহারি মরুভূমির মতো। মৃত্যুভয়, হতাশা, অবসাদ, দুশ্চিন্তা সেই পথের পাথেয়।