অকাজের অবসর
আমার চাকরিজীবন প্রায় কুড়ি-একুশ বছর হয়ে গেল। চব্বিশ বছর আগে যোগ দিয়েছিলাম চাকরিতে। মাঝে আড়াই-তিন বছর চাকরি ছেড়ে ছবি বানিয়েছি, যুক্ত থেকেছি চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে।
আমি যে চাকরি করি, সেখানে ডেডলাইন শেষ কথা বলে। তাই সপ্তাহের কোনও দিন আর আলাদা করে থাকে না। এক্সেলে সেলগুলোকে যেভাবে মার্জ করে দেওয়া হয়, সেভাবেই সাতটা দিন যেন জোড়া লেগে যায়। তারপরে যখন কাজ শেষ হয়, তখন হয়তো তিনদিন ছুটি পাওয়া যায়। যদি প্যাশন থেকে, ভালবেসে কাজটা করি, তাহলে ভালই লাগে করতে। কিন্তু এমন অনেক কাজ তো করতেই হয়, যা কেবল বেতনের জন্য, চাকরির দায়ে করতে হচ্ছে, তখন সোমবারগুলো আতঙ্ক নিয়ে আসে। আর শনি-রবিবার হয়ে ওঠে বনলতা সেন।
শুক্রবার বিকেল থেকে শান্তির আবহ, আর রোববার যখনই আসছে, তখনই সোমবারের দাঁতনখ স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করছে। তখন বিরক্ত লাগত, মেজাজ দেখিয়ে ফেলতাম আশপাশের মানুষকে। সোমবারের কাজ সবসময় অফিসটাইমে শেষ হত না।
কিন্তু আবার কোনও প্রোজেক্ট হয়তো সফলভাবে শেষের পথে, তখন শুক্রবারের রাত হয়ে উঠত চনমনে। তখন সোমবার দিনটাও আর বিভীষিকা থাকত না। আমার অফিসের বন্ধুবান্ধবরাও ছিল অন্যরকম, তাদের সঙ্গে আড্ডা মারতেও ভাল লাগত।
এরপর যখন সিনেমা বানাতে এলাম, তখন যেমন আনন্দ ছিল, তেমন একটা মনকেমনও ছিল। মনকেমনটা এখানেই, যে, বাকিদের যেমন তখন একটা শনি-রবিবার ছিল আলাদা করে, আমার তেমনটা ছিল না। সপ্তাহের প্রতিটা দিনই যখন শনি-রবিবার হয়ে যায়, তখন অসুবিধেই হয়। তখন মনে হয়, বাকিদের মতো আলাদা করে শনি-রবি কেন পাই না?
এমন অনেক কাজ তো করতেই হয়, যা কেবল বেতনের জন্য, চাকরির দায়ে করতে হচ্ছে, তখন সোমবারগুলো আতঙ্ক নিয়ে আসে। আর শনি-রবিবার হয়ে ওঠে বনলতা সেন।
সিনেমায় শনি-রবিবারই হয়তো বেশি কাজ করতে হত। কারণ, আমি এমন অনেকের সঙ্গেই কাজ করতাম, যাঁরা পেশাগতভাবে অন্য কাজ করতেন। তাই শনি-রবিটাই ছিল কাজের দিন। ওই যে বললাম, প্যাশন, ভালবেসে কাজ করা। ভালবাসি বলেই তো এই কাজটা করতে এসেছিলাম। তাই কোনও ক্লান্তি ছিল না। কারণ, পরিশ্রমে তো আসলে ক্লান্তি নেই, আছে প্রেশারে, মানসিক চাপে।
একটা উদাহরণ দিয়েই বলি, মে মাসের কাঠফাটা গরমে পুরুলিয়াতে ‘নীহারিকা’-র শুটিং করছি, শীতকালের প্রেক্ষাপট ছিল এই ছবিতে। ফলত, সবাই সোয়েটার পরে কাজ করছে। টাইট শিডিউল, ফলে হাড়ভাঙা খাটুনি। তাতেও কিন্তু, একজনও ক্লান্ত হয়ে ওঠেনি। আর পরিশ্রমের পর যখন অবসর আসে, তখন তার আলাদা মাধুর্য আছে।
সিনেমা চাইলেই তো আর পরপর বানানো যায় না এখানে। সে আলোচনা থাক বরং। এখন আবার চাকরিতে ঢুকেছি। আলাদা করে শনি-রবি পাচ্ছি। কিন্তু যে ছুটিটা, যে অবসরটা সত্যিই পাই না, তা হল প্রকৃতি দিয়ে ঘেরা, দিগন্তখোলা কোনও মাঠে, ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ নিয়ে বসে থাকা। ধীরে ধীরে চুমুক দেব সেই চায়ে। তাকিয়ে থাকব সামনের দিকে। কাজের পর এমন অকাজের সময়টুকু পেলে, এই উপলব্ধির অবকাশটুকু পেলে, আর কোনও ব্লুজ, আর কোনও বিষাদ থাকবে কি?