নির্বাচিত রোদবৃষ্টি
আচ্ছা, আমি এখন যে-ঘরে শুয়ে আছি, সেখানে কুড়ি বছর আগে কারা থাকত? তারা কীভাবে ঝগড়া করেছিল? আরও তিরিশ বছর আগে কি এই বাড়িটা আদৌ তৈরি হয়েছিল? না কি অন্য বাড়ি ছিল? দেওয়ালের রং কী ছিল, টিভি কোনদিকে রাখত? তারও একযুগ আগে, এখানে কি কুঁড়েঘর ছিল? সেখানকার বাসিন্দারা কী ভাষায় কথা বলত? একটু গাঁইয়া টোনে? তারও আগে, এই জায়গাটা নিশ্চয়ই জঙ্গল ছিল। তখন কি একেবারে ঠিক এখানটায় একটা বাঘ বসে হাঁপাচ্ছিল?
এইসব চিন্তা আমাদের তন্দ্রালস মস্তিষ্কে ভুড়ভুড়ি তুলে মিলিয়ে যেতে পারে, কিন্তু এরকম একটা তরঙ্গকে মূলধন করে একটা গোটা সিনেমা বানিয়ে ফেলা সাধারণত হয় না। কিন্তু এই যে ‘এখান’, এটা কত যুগে কতরকম লোককে ঠাঁই দিয়েছে, আর তারা কত রঙের কত জীবনযাপন করে গিয়েছে, তা-ই নিয়েই তৈরি হল ‘হিয়ার’ (চিত্রনাট্য: এরিক রথ, রবার্ট জেমেকিস, পরিচালনা রবার্ট জেমেকিস, ২০২৪)।
বিভূতিভূষণ ছোটগল্প লিখেছিলেন, ‘একটি কোঠাবাড়ির ইতিহাস’। ১২৪০ সালে একজন তাদের খড়ের বাড়ি ঘুচিয়ে একটা পাকা বাড়ি করল। আবার ১২৮০ সালে, তার ছেলে সেখানে একটা দোতলা বাড়ি করল। যখন ১৩৪০ সাল এল, তার নাতি কলকাতায় বড় তেতলা বাড়ি করেছে। ১৩৫০ সালে, গ্রামে এদের গোটা ভিটে বনজঙ্গলে ঢেকে গেছে। একতলা বাড়িটার ছাদ ধসে গেছে, শুধু দেওয়াল দাঁড়িয়ে আছে। লোকে সাপের ভয়ে ওদিকটায় যায়ই না। মানে, গল্পটায় প্লট কিছুই নেই, শুধু বলা আছে একটা বাড়ির জন্ম থেকে মৃত্যুর গল্প, যেখানে একসময় প্রাণ গমগম করত, তারপর সব শুনশান বিবর্ণ হয়ে গেল। অচল মিশ্র-র ছবি ‘গমক ঘর’-এও বলা হয়েছিল একটা বাড়ির গল্প, যেখানে কয়েক প্রজন্ম থাকল, তারপর সেটা ভাঙা হল। সেখানেও কোনও নায়ক বা নায়িকা নেই, বাড়িটাই নায়ক। বাড়ির মধ্যে বা আশেপাশে যে জীবন বয়ে গেছে, আমরা তার কিছুটা দেখলাম। ‘হিয়ার’-এ, একটা বাড়িকেই শুধু দেখানো হল— আরও ভাল করে বললে, বাড়িটার একটামাত্র প্রশস্ত বসার ঘর— যেখানে বারে বারে বহু পরিবার এসে থাকল, তাদের জীবনের কয়েকটা ঝলক আমাদের সামনে ফুটে উঠল। যখন-তখন দৃশ্য মিলিয়ে গিয়ে জায়গা করে দিচ্ছে অন্য পরিবার, অন্য মানুষ, অন্য সময়কে, আর আমরা তার সাক্ষী থাকছি।
আরও পড়ুন : রোবটের মনুষ্যত্ব আছে, প্রেমও আছে? ‘ছায়াবাজি’-র পূর্ববর্তী পর্ব…
ওই বাড়ি হওয়ার অনেক-অনেক আগে, ওখানে যখন আদিম অরণ্য ছিল, তখন সেখানকার আদিবাসী কিছু লোককেও দেখানো হয়, মূলত এক দম্পতিকে। এমনকী, আরও আগে, প্রাগৈতিহাসিক কালে, এই জমিটায় ডাইনোসর ঘুরে বেড়াত, অগ্ন্যুৎপাত বা ধূমকেতুর ধাক্কায় সারা পৃথিবীর সঙ্গে এখানটাও জ্বলেছিল, তারপর তুষার যুগে ঢাকা ছিল বরফে, তারপর ফের শ্যামল প্রকৃতি হাল ধরল, তা-ও আমরা দেখতে পাই। যেন পৃথিবীর একটা টুকরো জায়গায় যুগ যুগ ধরে যা হয়ে চলেছে, তার একটা কোলাজ উপস্থিত করা হচ্ছে। ‘হারমোনিয়াম’ বা ‘দ্য ইয়েলো রোলস রয়েস’ ছবিতে, আমরা হারমোনিয়াম বা গাড়ি হাত-বদল হয়ে যার-যার কাছে যায়, তাদের দেখি। এখানে বাড়ি স্থাণু, লোকেরা আসে ও যায়। একটা চমৎকার কাণ্ড করেন জেমেকিস, আমরা বসার ঘরটাকে সবসময় দেখি ক্যামেরার একই দৃষ্টিকোণ থেকে। যেন সামনে মঞ্চে একটা অভিনয় হচ্ছে, আর আমরা প্রথম সারিতে সিট পেয়েছি। একক, দশক, শতক ধরে একই জায়গায় বসে দেখে যাচ্ছি, নির্বাচিত রোদবৃষ্টি। চ্যানেল সার্ফ করার মতো একবার দেখি এখনকার সময়, একবার পিছিয়ে যাই হয়তো তিরিশ বছর, কখনও হয়তো একশো বছর। এই জমিটা একসময় ছিল বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিনের অবৈধ সন্তানের, তাঁকেও দেখানো হয়, একবার স্বয়ং বেঞ্জামিনকেও।
তবে বেশি নজর দেওয়া হয় একটাই পরিবারের ওপরে। তাদের তিন প্রজন্ম আমরা দেখি। এক সেলসম্যান ও তার স্ত্রী প্রথমে আসে, তারপর তাদের ছেলেমেয়ে জন্মায়। বড় ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন টম হ্যাংকস, তাঁকে (এবং অন্যদেরও কয়েকজনকে) কম্পিউটারের কারিকুরিতে বিভিন্ন বয়সি রূপে দেখা যায়। তাঁর চরিত্র যখন আঠারোর যুবক, সে ভাল ছবি আঁকে, গ্রাফিক আর্টিস্ট হতে চায়। কিন্তু তার বান্ধবী গর্ভিণী হয়ে পড়ায়, তাকে তখনই বিয়ে করতে হয়, এবং এক সময়ে সংসার চালাতে সেলসম্যানের চাকরিই নিতে হয়। বান্ধবীরও শখ ছিল উকিল হবে, তাও হয়ে ওঠে না। তাদের মেয়ে অবশ্য উকিল হয়, এবং ধীরে একটা বিরাট পরিবারের অনেকরকম লোকওয়ালা প্রবল প্রাণচঞ্চল বাড়ি খাঁ-খাঁ একটা বিষণ্ণ ও স্মৃতিভরা বাড়িতে বদলে যায়। যেখানে অনেকগুলো স্বপ্নের গুঁড়ো পড়ে থাকে। প্রবীণ টম হ্যাংকসের যখন ডিভোর্স হয়ে যায়, সে আবার আঁকতে শুরু করে। তার বিচ্ছিন্না স্ত্রী-র স্বপ্ন ছিল প্যারিস যাওয়া, মেয়ের দৌলতে মেয়ের সঙ্গে সে সেই শহরে ঘুরে আসে, যার বিবরণ আমরা একটা ফোনালাপে জানতে পারি। ছবি শেষও হয় এই পরিবারকে দিয়েই।
তার মানে এই নয় যে, অন্য মানুষ দেখানো হয়নি। এমন পরিবার দেখানো হয়েছে, যার কর্তা একটা ছোট প্লেন চালিয়ে ওড়েন, সেটাই তাঁর নেশা, শখ। তিনি বাড়িটাও নেন এটা এরোড্রোমের কাছে বলেই। এবং গিন্নি বারে বারে বলেন, ওই জিনিস উড়তে গিয়ে একদিন না একদিন পড়ে যাবেই। ভদ্রলোক মারা যান, অবশ্য তাঁর নিজস্ব এরোপ্লেনটা আছড়ে নয়, নিতান্ত জ্বরে। আরেকটা পরিবারের পরিচারিকার কোভিড হয়। সেই কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে বাবা ছেলেকে পইপই করে বোঝান, কোনও পুলিশ তাকে জোরে গাড়ি চালানোর জন্য ধরলে কত সন্তর্পণে বারে বারে অনুমতি নিয়ে গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে লাইসেন্স বা দরকারি কাগজপত্র বের করে দিতে হবে, কতবার ‘স্যর’ সম্বোধন করতে হবে সবিনয়ে। কখনও কোনও পরিবারের ছোট মেয়েটি এ-ঘরে বেহালা প্র্যাকটিস করে, কখনও মিউজিক্যাল চেয়ার খেলতে গিয়ে ডানপিটে ছেলে মা-র কাছে তীব্র বকুনি খায়। আদিবাসী দম্পতির প্রেম, সন্তান জন্মানো ও নারীটির মৃত্যুও আমরা দেখি, এবং সেই মৃতদেহের গলায় পরিয়ে দেওয়া হার খুঁড়ে বের করেন বহুদিন পর ওই বাড়ির উঠোন থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক সমিতির লোকেরা। তা দেখে পুলকিত স্পর্শ করতে যায় সেরিব্রাল স্ট্রোক হওয়া এখনকার প্রবীণা। এক সময়ের চিহ্ন আরেক সময়ে জেগে ওঠে।
ছবির ফ্রেমের মধ্যে যখন-তখন আরও একটা বা দুটো ছোট ফ্রেম ফুটে ওঠে, সেখানে চলছে অন্য দৃশ্যের টুকরো, এবং ক্রমশ ছোট ফ্রেমের দৃশ্য বড় হয়ে পুরো পর্দাকে দখল করে এবং সেই সময়ের সেই মানুষরা তখন দাপিয়ে বেড়ায়। যেমন প্রতিটি মানুষই মনে করে, তার সময় ও তার জীবনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তার সিগারেট-ধরানো বিকেলবেলাটির মতন সময়খণ্ড আর কোনওদিন আসেনি, তেমনই যখন আমরা যা দেখি, সেটাকেই মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে হয়, তারপর পরিচালক আবার ঝটিতি ওই ঘটনাটা মুছে দেন ও অন্য ছোট ফ্রেম এবার সমগ্র পর্দার দাবিদার হয়ে ওঠে। ফলে অনেক সময়ই, একই সঙ্গে আমরা একাধিক সময়ের দৃশ্য পর্দায় দেখতে পাই, কিছুটা বড় জায়গা জুড়ে, কিছুটা ছোট আয়তক্ষেত্রের মধ্যে, কখনও হয়তো একযুগের টিভি অন্যযুগের রেডিওর সঙ্গেই সমস্বরে চলতে থাকে। এই অদ্ভুত চিত্রভাষা, কৌশল বারবার প্রয়োগ করে জেমেকিস জীবনস্রোতের ধরনকে দিব্যি পাকড়ে ধরেন। যেন বলেন, দেখো বাবা, নিজেকে এক-ময় ভেবো না, বাঁদিকে ঘুরলেই অতীতের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাবে, আর ডাইনিং টেবিলের দিকে বসে ঝিমোচ্ছে ভবিষ্যৎ।
‘হারমোনিয়াম’ বা ‘দ্য ইয়েলো রোলস রয়েস’ ছবিতে, আমরা হারমোনিয়াম বা গাড়ি হাত-বদল হয়ে যার-যার কাছে যায়, তাদের দেখি। এখানে বাড়ি স্থাণু, লোকেরা আসে ও যায়। একটা চমৎকার কাণ্ড করেন জেমেকিস, আমরা বসার ঘরটাকে সবসময় দেখি ক্যামেরার একই দৃষ্টিকোণ থেকে।
এই ধরনের গল্প বা ছবিতে সাধারণত একটা নির্দিষ্ট লোক বা একটাই পরিবার নিয়ে হইহই করা হয় না, এদিক-ওদিক ক্রমাগত ঘুরে ঘুরে বেড়ায় ক্যামেরা বা কলম, এবং লোককে বলে, সহস্র মুহূর্তের এক-এক আঁজলা যেখান-সেখান থেকে তুলে তোমায় দেখাচ্ছি, কিন্তু কাউকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করছি না এটাই বোঝাতে: কেউ কেন্দ্রে থাকে না। থেকে যায় শুধু পাহাড় বা আকাশ, আর যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন লোক তাদের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে বয়ন করে ও ইচ্ছেকে কবর দেয়। কিন্তু এই ছবিটা খুব বেশি করে একটা পরিবারকে দেখিয়ে যেন একটু হলিউডোচিত নিরাপদ খেলা খেলে নেয়। পরিচালক নির্ঘাত ভেবেছেন, তা নইলে নোঙর থাকবে না, আখ্যান একদম ভেসে, ছেতরে যাবে। আশঙ্কা ঠিকই, কিন্তু আরও এক-দুটো কাহিনি-টুকরোকে সমান গুরুত্বও হয়তো দেওয়া যেত। যে পরিবারকে পরিচালক কেন্দ্রে রাখেন, সেখানে টম হ্যাংকস-এর চরিত্রের বউ নাগাড়ে স্বামীকে বলে, এই বাড়িতে সে এত লোকের হাটের মাঝখানে থাকতে চায় না, এই সোফাটা অবধি সে দু’চক্ষে দেখতে পারে না, তারা কি কিছু টাকা জমিয়ে অন্য বাড়িতে উঠে যেতে পারে না। কিন্তু স্বামী কিছুতে ঝুঁকি নিতে পারে না। একটা সময় গোটা বাড়িটা তাদের হয়ে গেলেও, মেয়েটির মন উঠে যায়, সে এই সম্পর্ক এবং বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তার স্মৃতি ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে। এবং টম হ্যাংকসের চরিত্র যখন এই বাড়ি বেচে দিয়েছে, দশ মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে সম্পূর্ণ ফাঁকা ঘরে সে তার স্ত্রীকে নিয়ে বসে। তাকে মনে করানোর চেষ্টা করে, এই ঘরে সে প্রথম আসে ভাবী শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করতে, এই ঘরের সোফায় তারা সঙ্গম করে, এই ঘরে তাদের বিয়ে হয়, এই বাড়িতে সে সন্তানের জন্ম দেয়। মানে, জীবনের বহু বাঁকমুহূর্তের ক্ষেত্র এই ঘর। স্ত্রী প্রায় কিছুই মনে করতে পারে না, কিন্তু তাদের ছোট্ট মেয়ের একটা রিবন হারিয়ে যাওয়া ও সোফার মধ্যে থেকে সেটা দিনকয়েক পরে খুঁজে পাওয়ার ঘটনা সহসা তার স্পষ্ট মনে পড়ে যায়। এবং সে বলতে থাকে, এখানে থাকতে আমি কত ভালবাসতাম! সজ্ঞানে সে বারে বারে বলেছিল, এই বাড়ি, এই ঘর সে সহ্য করতে পারে না, এগুলো ছিল তার কাদায় পুঁতে যাওয়া স্থবির জীবনের দ্যোতক, কিন্তু আজ তার স্বল্প স্মৃতি তাকে ভাবায়, এখানে অনেকখানি সুখ সে ফেলে রেখে গিয়েছে। হয়তো মানুষ এভাবেই স্মৃতিকে নির্মাণ করে নেয়। হয়তো বিষাদ ভুলে যাওয়া একটা বড় ক্ষতি।
এই মুহূর্তেই প্রথম ক্যামেরা আমাদের ঘুরে গিয়ে গোটা ঘরটা দেখায় এবং তারপর বেরিয়ে গিয়ে গোটা বাড়িটা। আর তখনই একটা পাখি এসে একটা বাড়ির কাছে উড়তে থাকে, যে পাখির এক জাতভাইকে আমরা দেখেছিলাম আদিম অরণ্যে জনজাতির ওই স্ত্রীহারা লোকটির কাছে উড়তে। বহুকাল আগের এক স্বামীর বিরহ এখনকার আরেক স্বামীর স্মৃতিহারা স্ত্রীর সান্নিধ্যের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। হয়তো এভাবেই একটা পাখি বা দুটো রামধনু আমাদের বিভিন্ন অশ্রুকে হাজার বছরের ব্যবধানে বেঁধে রেখেছে, আমরা জানি না। হয়তো দেশ ভেঙে পড়া বা স্বৈরাচারীর রাজ্যজয়ের উপাখ্যানের চেয়ে সন্তানের ছোট্ট পুতুল জুড়ে দেওয়ার স্মৃতি আমাদের বেশি দামি সম্পদ। হয়তো আমাদের এমনি জীবন, আধশোয়া জীবন, আনমনা জীবন একই রঙে ছুপে তারপর কলরোল না তুলে, নীরবে লুপ্ত হয়ে যায় বলেই তারা আমাদের মানবজাতির প্রকৃত একবাঁধুয়া রঙিন রিবন।