ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • মেডিসিনারি : পর্ব ৭

    রামাদিত্য রায় (March 5, 2025)
     

    রোগীর মন

    চিকিৎসা জীবনে নানারকম উপলব্ধি হয়। কখনও আনন্দের, কখনও দুঃখের, কখনও অসম্ভব কোনও ভাল লাগার অনুভূতি। একটা জিনিস আমার বারবার মনে হয়, যে ভাল চিকিৎসক, সে কিন্তু ভাল অভিনেতাও বটে। এমন এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়, যেখানে হয়তো আমি জানি, রোগীর আয়ু হয়তো তিন থেকে চার মাস। তাও তাকে বলতে হয়, ‘আপনি ঠিক আছেন, রিপোর্ট তো ভালই! আপনি ভাল হয়ে যাবেন।’ একথা আদতে এক গভীর ভাবনা থেকে বলতে হয়, যাতে রোগীও এক আত্ম-সম্মোহনের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে।

    চিকিৎসকের পেশায় সবচেয়ে বেশি যা জরুরি বলে আমার মনে হয়, তা হল, রোগীর আত্মবিশ্বাস বাড়ানো। একজন রোগী অনেক ওষুধ খাচ্ছেন, কিন্তু সেরে উঠছেন না, মানে এও হতে পারে, সেই রোগীর আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটছে। বহু ক্ষেত্রে, মানসিক চাপ এতটাই বেড়ে যায়, তা পক্ষান্তরে রোগীর ভাল থাকার, ভাল হয়ে ওঠার পথের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ধরা যাক, কোনও রোগীর মাথা ধরেছে, তাকে মাথা ধরার ওষুধ লিখে দেওয়া হল। সেই রোগী তৎক্ষণাৎ সব ভুলে গিয়ে বলতে পারেন, ‘আমার আসলে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।’ আসল রোগের চাবিকাঠি খুঁজে পেতে গেলে কিন্তু রোগীর সঙ্গে চিকিৎসককে একাত্ম হতে হবে। আমাদের দেশে, রোগী-পিছু ডাক্তারের সংখ্যা এতটাই কম, যে এই সময়টুকুই খুঁজে পাওয়া যায় না।

    রোগী আর চিকিৎসকের, একে-অপরের প্রতি নির্ভরশীলতা, মানসিক এবং শারীরিক— এইটাই অর্ধেক সমস্যার সমাধান ঘটাতে পারে। তখন এই যে ডাক্তারদের নিগ্রহ করা কথায় কথায়, ডাক্তারকে নিজের শত্রু ভেবে নেওয়া, বা গণশত্রু ভেবে নেওয়া— এই অবিশ্বাস, গুগল পড়ে পড়ে ডাক্তারের প্রতি অনাস্থা তৈরি হওয়া, এর অবসান ঘটতে পারে।

    আরও পড়ুন : ‘ডাক্তার, ডেথ সার্টিফিকেটটা দিয়ে দাও! একের পর এক হুমকি ফোন আসছিল আমার কাছে’, শ্যামল চক্রবর্তীর কলমে ‘মেডিসিনারি’ ষষ্ঠ পর্ব…

    ধরা যাক, কোনও রোগীকে দাঁতে ব্যথার ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ডাক্তারি পরিভাষায় একটা কথা আছে, ট্রাইজেমিনাল নিউরলজিয়া। কানের পাশ থেকে দাঁত পর্যন্ত এক ধরনের ব্যথা হয় এর ফলে। এর যে ওষুধ, তাতে রোগীর তীব্র ঘুম পেতে পারে। সেকথা রোগীকে বলতে যদি কেউ ভুলে যায়, তাহলেই সর্বনাশ! কারণ, রোগী এই ওষুধের পাশাপাশি যদি কোনও মাদক সেবন করেন, সঙ্গে সঙ্গে এই ওষুধের ক্রিয়াটা অনেকটা বেড়ে যাবে। এমন হতেই পারে, রাতে রোগী এর ফলে স্লিপ করে পড়ে গেলেন। এই কিন্তু অবিশ্বাসের সূত্রপাত! হয়তো কোনও টেস্ট বা স্বাস্থ্য পরীক্ষা, যা রোগী চাইছে না, তা জোর করে করানো হচ্ছে, রোগী তা চাইছে না। চিকিৎসকও হয়তো জানেন, সেই স্বাস্থ্য পরীক্ষা থেকে খুব বেশি কিছু পাওয়ার আশা নেই। এই জায়গাগুলো থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। আমি এমন অনেক রোগী পেয়েছি, যার হয়তো হৃদয় দুর্বল, বা অন্য কোনও কঠিন সমস্যা, আমি কিন্তু তাকে হাঁটিয়ে, কথা বলিয়ে তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়ানোরই চেষ্টা করেছি। রোগীর সঙ্গে আমাদের আসলে আরেকটু বেশি কথা বলা প্রয়োজন। তাহলেই তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো সম্ভব। শুধুই গাদাগুচ্ছের ওষুধ, সেবক-সেবিকা রেখে বিশ্রাম নেওয়ানো— এতে কোনও লাভ হয় না। মানুষের মনটা যে কত বড়, তা আমাদের নির্ণয় করতে হবে।

    সোনেক্স-এর একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন, তিনি আমাকে একদিন বললেন, ‘একটা কাশির ওষুধ লিখে দিন না!’ আমি দিলাম। পরেরদিন যেতে তিনি আবার বললেন, ‘কী ওষুধ দিয়েছেন ডাক্তারবাবু! কাশি তো একেবারে সেরে গিয়েছে!’

    আমি যখন সবে ডাক্তারি শুরু করেছি, তখন জোছন দস্তিদারের ‘সোনেক্স’ বলে একটি সংস্থা ছিল। সেই সংস্থার প্রযোজনাতেই বিখ্যাত ধারাবাহিক ‘তেরো পার্বণ’। তখন আমি জোছনদার নাটকের দলে অভিনয় করি। তাই যাতায়াত ছিল সোনেক্স-এ। সোনেক্স-এর একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন, তিনি আমাকে একদিন বললেন, ‘একটা কাশির ওষুধ লিখে দিন না!’ আমি দিলাম। পরেরদিন যেতে তিনি আবার বললেন, ‘কী ওষুধ দিয়েছেন ডাক্তারবাবু! কাশি তো একেবারে সেরে গিয়েছে!’ আমি বললাম, ‘বেশ তো! ওষুধটা খেয়ে যান।’ তিনি বললেন, ‘খেয়ে যাব? আমি তো গোটা শিশিটাই খেয়ে ফেলেছি!’ ওই একশিশি ওষুধ খেয়ে যে কী করে তাঁর কাশি সেরেছিল, আমার কাছে আজও বিস্ময়।

    কোভিডের সময় কত মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা যে হয়েছে। মানুষ কীভাবে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়— সেসময় দেখেছিলাম। এমনও হয়েছে, রোগী বাড়ি যেতে চাইছেন, বাড়ির লোক তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী নন। এর পরিণামে কী হয়েছে? এক বৃদ্ধা রোগী আমার হাত ধরে অঝোর ধারায় কাঁদছেন, আমাকে নাতি বলে ডাকছেন। অথচ, বাড়ির লোককে চিনতে পারছেন না। কারণ, যে চোদ্দ দিন তিনি অনাবশ্যক হাসপাতালে থাকলেন, সেই ক’দিন তো বাড়ির লোক তাঁর ধারে-কাছেই আসেননি। আমি রোগীদের গায়ে হাত দিয়ে কথা বলেছি, তাঁদের বুকে স্টেথো রেখেছি, তাঁদের অস্পৃশ্য করে দিইনি। বাকিদের বলেছি, দরকার হলে পিপিই কিট পরে দেখতে আসুন রোগীদের।

    এই একটা রোগকে, অসুখকে আমরা মানবতার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলাম। চিকিৎসক হিসেবে শুধু নয়, মানুষ হিসেবেও এটা কতটা দুঃখের, বলে বোঝানো যাবে না।

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook