“আমি যখন পাঠশালাতে যাই
আমাদের এই বাড়ির গলি দিয়ে
দশটা বেলায় রোজ দেখতে পাই
ফেরিওলা যাচ্ছে ফেরি নিয়ে।
‘চুড়ি চা—ই, চুড়ি চাই’ সে হাঁকে
চীনের পুতুল ঝুড়িতে তার থাকে…”
—শিশুর মনে হয়, ফেরিওয়ালা যখন খুশি, যেখানে খুশি যায়, কোনওকিছুতেই তার তাড়া নেই, তাই শিশুর, ‘ইচ্ছে করে সেলেট ফেলে দিয়ে/ অমনি করে বেড়াই নিয়ে ফেরি।’
‘শিশু’-র ‘বিচিত্র সাধ’—কে এভাবেই সঠিক রূপায়ণ করেন রবীন্দ্রনাথ। ঘরবন্দি শিশুর কাছে ফেরিওয়ালা এক আশ্চর্য সওদাগর। সে কী সওদা করতে এসেছে পরের কথা, প্রথমত, ফেরিওয়ালার ওই সুরেলা ডাক বা বাজখাঁই যাই হোক, সে ডাক যে ‘ঘরের বাহির করে’। শৈশব—কৈশোরে ওই হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতার জন্যই একরাশ মুগ্ধতা—মেশানো কৃতজ্ঞতা। রবীন্দ্রনাথও শৈশবে গণ্ডিবদ্ধ জীবন কাটিয়েছেন, তাই তার কলম বেয়ে শিশু ও কিশোরের সূত্রে বারে বারেই এসেছে এই ফেরিওয়ালাদের ডাক, চার দেওয়ালের বাইরে, দুয়ার বেরিয়ে কর্মচঞ্চল রাস্তাঘাটের হাঁকডাক। রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’—য় আছে— ‘ফেরিওয়ালা হেঁকে যেত গলির ও পার থেকে/ তপসি মাছের ঝুড়িখানা গামছা দিয়ে ঢেকে।’ শিশুপাঠ্য ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ভাগে আছে, ‘বাটি হাতে এ ঐ/ হাঁক দেয় দে দৈ।’
আরও পড়ুন : সহজ পাঠ নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল আটের দশক!
লিখছেন আবীর কর…
এখানে ফেরিওয়ালার ডাক শোনা যায় না, শুধুমাত্র নন্দলাল বসুর লিনোকাটে বাঁকবাহী থাকবন্দি দধিভাণ্ডর ছবি আছে, বাঁকবহনকারী দইওয়ালাকে দেখা যায় না। আর এখানে হাঁক দেয় ক্রেতারূপী এ ঐ। হয়তো দই তারা কিনতে চায়। প্রসঙ্গত স্মরণে আসবে, ‘ডাকঘর’ নাটকের অমল ও দইওয়ালার কথা, ‘দই—দই—ভালো দই’ সুরে হেঁকে যাওয়া দইওয়ালাকে গৃহবন্দি অমল তার একমাত্র খোলা জানালা দিয়ে ডাকে, ‘দইওয়ালা, দইওয়ালা, ও দইওয়ালা’— যদিও অমল দই কিনতে চায় না, তার কেনার সামর্থ নেই, উপায়ও নেই, সে শুধু দইওয়ালার কাছ থেকে দই বেচার ওই ‘সুর’—খানা শিখতে চায়। তার অমল বক্তব্য, ‘…কীরকম করে তুমি বল দই—দই— ভালো দই। আমাকে সুরটা শিখিয়ে দাও।’
পাঁচমুড়া পাহাড়ের ওপারে শ্যামলী নদীর ধারের গ্ৰাম থেকে আসা দইওয়ালা তা শুনে তাজ্জব। তার দই ফেরির জীবনে এই ‘ফেরির—সুর’ শিখতে চাওয়া তাকে বিস্মিত করে, তাই তার ঝটিতি উত্তর, ‘হায় পোড়াকপাল! এ সুর কি শেখবার সুর।’
তার উত্তরে অমলের বক্তব্যটি ব্যঞ্জনাবাহী— ‘না, না, ও আমার শুনতে খুব ভালো লাগে। আকাশের খুব শেষ থেকে যেমন পাখির ডাক শুনলে মনে উদাস হয়ে যায়— তেমনি ঐ রাস্তার মোড় থেকে ঐ গাছের সারির মধ্যে দিয়ে যখন তোমার ডাক আসছিল, আমার মনে হচ্ছিল— কী জানি কি মনে হচ্ছিল।’
অমল ও অমল-বয়সি অনেক কিশোরের মনে ফেরিওয়ালার ডাকের ব্যঞ্জনা অবর্ণনীয় আনন্দের। ওই যে দূর থেকে ওই পাড়ার ডাক এই পাড়ায় ঢুকছে, তার জন্য যে আনন্দঘন চঞ্চলতা, তা তুলনাহীন। ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ভাগের গদ্যে আছে— ‘ঝাঁকায় কাঁচা আম নিয়ে মধু গলিতে হেঁকে যায়।’ এই ঝাঁকা মাথায় ফেরিওয়ালা আমাদের গ্ৰামবাংলার রাস্তাঘাটের এক অতি-পরিচিত ছবি ও সুর। ফেরিওয়ালা নানারকমের, তাদের সওদার পণ্য যেমন রকমারি, তেমনই বিচিত্র তাদের ডাকাডাকি। কেউ সুর করে, কেউ স্বরান্ত শব্দকে যতটা সম্ভব টেনে, কেউ ছড়া কেটে নানা জিনিসপত্র ফেরি করেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারা ধাতব শব্দেরও সাহায্য নেন, নতুবা তাদের কণ্ঠের সরস বা কর্কশ কৌশলকেই কাজে লাগান। যেমন, ‘সহজ পাঠ’ দ্বিতীয় ভাগে আছে— ‘বাসনওয়ালা থালা বাজায়/ সুর করে ওই হাঁক দিয়ে যায়/ আতাওয়ালা নিয়ে ফলের ঝোড়া।’— এই যে বাসনওয়ালার নিজের হাঁকডাকের সঙ্গে ‘থালা’ বাজানোর বাড়তি সুবিধা আছে, যা আতাওয়ালার নেই। আবার ডুগডুগি বাজিয়ে বেশ কিছু ফেরির চল ছিল এবং এখনও আছে। যেমন আমাদের ছোটবেলায় ডুগডুগি বাজিয়ে আসত আইসক্রিমওয়ালা আর বাঁদর খেলা, আর আসত দড়বাজিগর ভোজবাজির খেলা দেখাতে। সেই সময় ওই একই ডুগডুগির আওয়াজের তারতম্য শুনে ঘর থেকেই বুঝতে পারতাম, কে আসছে। এখন দেখি, বাঁকুড়ার গ্ৰামে-গঞ্জে আইসক্রিম বিক্রেতা আসে ভেঁপু বাজিয়ে, ঝাড়গ্রাম শহরে গরমকালের সন্ধ্যায় কুলপিওয়ালা আসে ঘণ্টি বাজিয়ে। সাইকেল করে পাঁউরুটি বিক্রেতা যায়, ‘গ—অ—অ—রম রুট—ই—ই’ হাঁকতে হাঁকতে। বোঝা যায়, তিনি ওই প্রলম্বিত উচ্চারণে ‘গরম’ শব্দের ওপরই জোর দিচ্ছেন, বোঝাতে চাইছেন বেকারি থেকে দুয়ারে-রুটি সরাসরি।
ডুগডুগির আওয়াজ এখন আর শোনা যায় না। তবে ডুগডুগি বাজিয়ে ভোজবাজির খেলা দেখানোর এক মজাদার দৃশ্য মেলে রবীন্দ্রনাথের ‘খাপছাড়া’ গ্ৰন্থের নান্দীমুখে— ‘ডুগডুগিটা বাজিয়ে দিয়ে/ ধুলোয় আসর সাজিয়ে দিয়ে/ পথের ধারে বসল জাদুকর।/ এল উপেন, এল রূপেন/ দেখতে এল নৃপেন, ভূপেন/ গোঁদলপাড়ার এল মাধু কর।’ তারপর বুড়োওলা জাদুকর ‘যা-তা মন্ত্র’ আউড়ে ঘাসের ওপর বিছিয়ে দেয় চাদর, আর সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে চাদরের তলা থেকে বেরিয়ে আসে ছেঁড়া ঘুড়ি, গালার চুড়ি, এমনকি চড়ুইপাখির ছানা পর্যন্ত— কিছুক্ষণের ভোজবাজিতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে উৎসাহী ছেলেমেয়ের দল। এছাড়াও ডুগডুগির আওয়াজ পাই, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’-তে, যেখানে—
‘দুর্গা হঠাৎ বলিয়া উঠিল— চল্ রে অপু, ঐ কোথায় ডুগডুগী বাজচে, চল্, বাঁদর খেলাতে এসেচে ঠিক। শীগগির আয়—
আগে আগে দুর্গা ও তাহার পিছনে পিছনে অপু ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। সম্মুখের পথ বাহিয়া বাঁদর নয়, ও পাড়ার চিনিবাস ময়রা মাথায় করিয়া খাবার ফেরি করিতে বাহির হইয়াছে।’
এই ফেরির সূত্রে চিনিবাস গ্ৰামবাসীর সামর্থ চেনে, তাই অপু-দুর্গার উদগ্ৰীব হয়ে বেরিয়ে আসা দেখেও হরিহর রায়ের দরজায় সে কালক্ষেপ করে না, আর ভুবন মুখুজ্জের বাড়িতে যে কিছু বিক্রিবাটা হবে, সে-বিষয়ে সে নিশ্চিত। এই সূত্রে মনে পড়ে যায়, নট-নাট্যকার অমৃতলাল বসুর পরিচিত সেই ‘ঘটিতোলা গুরুচরণ’-কে। যিনি কুয়োর ঘটিতোলার পেশায় একজন দক্ষ মানুষ । অমৃতলাল তার স্মৃতিমূলক রচনা ‘পুরাতন পঞ্জিকা’য় জানাচ্ছেন এই পুরানো পেশাটির সম্পর্কে, লিখছেন— ‘কু—উ—উ—উ—ও—ও—ওর— ঘ—টি—তো—ও—ও—লা—আ—আ—আ’… এই কুয়োর ঘটিতোলাটা তখন কলিকাতার প্রত্যেক গৃহস্থের একজন অতি-পরিচিত ও প্রার্থিত অতিথি ছিল।… তখন সকল বাড়ীতেই এক, দুই বা ততোধিক কূপ ছিল।… ভোর না হতেই পাড়ায় পাড়ায় রাস্তায় রাস্তায় গলিতে গলিতে বেলা ১০/১১টা পর্য্যন্ত ‘কুয়োর ঘটিতোলা’ ডেকে বেড়াত। দড়ী ছিঁড়ে জলতোলা ঘটি, মেয়েদের আঁচলে রিং —এ বাঁধা চাবি গোছা, ছেলেদের পিতলের খেলনা এই রকম একটা—না—একটা জিনিস আজ আমার বাড়ী, কাল তোমার বাড়ী, পরশু ওঁর বাড়ী প্রায়ই না প্রায় পাতকুয়োর ভিতর পড়ে যেত, আর বাড়ীর লোকেরা কুয়োর ঘটিতোলার ডাক শুনবার জন্য কান খাড়া করে থাকতেন।’
তারপর অমৃতলালের লেখনীমতো, ঘটিতোলা এসে পরণের কাপড় রেখে গামছা বেঁধে, হাতের চেটোয় তেল নিয়ে নাকে-কানে আর ব্রহ্মতালুতে দিয়ে কুয়োর পাট বেয়ে নেমে পড়তো, তারপর কুয়োর নিচে গিয়ে মারত এক ডুব। আর তারা সবাই ভিড় করে নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, মিনিটখানেকের মধ্যে ঘটিতোলা ঘটি বা হারানো চাবির গোছা নিয়ে ভুস করে উঠে আসত। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচত। আর ওই অতল গহ্বরের ডুবুরি হয়ে তারা পেত, ঘটিপিছু এক পয়সা, চাবির গোছায় দু’পয়সা, দামিল জিনিস হলে এক টাকা পর্যন্ত বখশিশ মিলত। কিন্তু তাতে কি আর জীবন চলে, তাই পরে জানা যায় কলকাতায় বাসা ভাড়া করে থাকা, দেশের বাড়িতে নিয়মিত খরচ পাঠাতে হলে শুধুমাত্র সকালের মেহনতে হয় না, আরও বাড়তি রোজগারের জন্য দুপুরবেলায় গোটাকতক বালান্ডা মাদুর মাথায় করে ঘুরে বেড়ায়, বিকেলে পট ফেরি করে, আর গ্ৰীষ্মকালে সন্ধ্যার পর কুলপি বরফ বিক্রি করে ‘ঘটিতোলা গুরুচরণ’। এই জীবন-জীবিকার টানাপোড়েনে এক পঙক্তিতে এসে দাঁড়ায় অমৃতলালের গুরুচরণ আর বিভূতিভূষণের চিনিবাস।
তবে নাটকের রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত অমৃতলাল বসু জীবনের রঙ্গমঞ্চে ফেরিওয়ালাদের সুর, স্বর ও জীবনকে যে গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন, তা বোঝা যায় তার ‘পুরাতন পঞ্জিকা’-র পাতা উল্টোলেই। পরবর্তীতে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত মহাশয়ের (শাঁটুলবাবু) গভীর অনুসন্ধানমূলক গ্ৰন্থ ‘কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার আওয়াজ’ অবশ্যই উল্লেখ্য। তবে বিশ শতকের প্রথমার্ধের কলকাতার ফেরিওয়ালার হালহকিকৎ জানতে তারও অন্যতম ভরসা অমৃতলালের এই স্মৃতিকথা। যেখান থেকে জানা যায়, বেলা ন’টা সাড়ে ন’টার সময় পরিষ্কার কাপড় পরিষ্কার মেরজাই জরি বসানো বাহারে টুপি পরে দেশলাইওয়ালারা ‘লে— দেশ্লাই’ বলে রাস্তা দিয়ে হেঁকে যেত। তার একটু পরেই টিকেওয়ালা ‘টিকে লেও’ বলে হাঁক পাড়ত। এই ডাক শুনে অমৃতলালের ‘গুড়ুকখোর’ দাদামশাই-সহ আরও অন্যান্য তামাকপ্রেমী জ্যেঠামশাই, দাদাঠাকুররা হাফ ছেড়ে বাঁচতেন। এমনকী, যখন দেশলাই ছিল না, তখন চকমকি ঠুকে, শোলাতে আগুন দিয়ে টিকে ধরিয়ে অনেক মেহনত করে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সবাই মিলে ধূমপান করতেন। জাতি নির্বিশেষে তামাকু ভাতৃত্ববোধের এহেন বিরল স্মৃতিচিত্র তুলে ধরেছেন অমৃতলাল। সময়কাল ১৮৬৪/৬৫। অন্যদিকে স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী’-তে জানাচ্ছেন ১৮৭২/৭৩ নাগাদ কলকাতার রাস্তাঘাটে টিকা ও দেশলাই ফেরি শুরু হয়। কালো রঙের চাকতির মতো টিকে-কে ‘কালো বাতাসা’ বলত। অমৃতলালের বর্ণনায় পাই, ‘সরাগুড়, তিলকুটো সন্দেশ মুকুন্দমোয়া’ ডেকে গেল। আবার ‘বাত ভাল করি, দাঁতের পকা বার করি’ বলতে বলতে বেদিনী বাজারের দিকে গেল। ‘মাজনমিশি’ ‘মাথাঘসা’র চুবড়ি কাঁকে মুসলমান বুুড়ি চেঁচিয়ে গেল। বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ, ‘রিপুকম্ম’, ‘চাই ঘোল’ ডেকে যাচ্ছে। তাঁর স্মৃতিজাত লেখায় আরও এহেন ফেরিওয়ালা ও তার ডাক সম্পর্কে আছে, ‘রাস্তায় সকালে শাঁখাওয়ালা, সিঁদুরওয়ালা, মধুওয়ালা বার হল, আবার ‘ধনে সরষে লেবে গো’ বেরুল, মধ্যাহ্নে আনরপুরে দইওয়ালারা প্রকান্ড প্রকাণ্ড ধামা মাথায় ‘চাই শুকো দই’ হাঁকতে লাগল। তারা এক পয়সায় এক মালসী দুই মালসী দই দিত, মালসী উপুড় করে দেখাত যে দই ভূমে পড়ে না।… বেলা ৩টায় বেরুল মুসলমান ফিরিওয়ালা, ‘বিলিতি চুড়ি চাই, কাঁচের খেলনা চাই, সাবান চাই বলে।’— এইভাবে অমৃতলালের সরস বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে উনিশ শতকের কলিকাতার রাস্তায় নানাবিধ ফেরিওয়ালার হাঁকডাক ও তাদের বিচিত্র বিপণন কৌশল।
তবে রাস্তাঘাটে, হাটেবাটে জিনিসপত্র ফেরি করে বিক্রি করার ঘটনা সুপ্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের ‘তাম্বুল খণ্ড’-তে আছে— ‘দধি দুধ পসার সজাআঁ/ নেত বাস ওহাডন দিআঁ।/ সব সখিজন মেলি রঙ্গে/ একচিত্তে বড়ানির সঙ্গে।/ নিতি জাএ সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী/ বনপথে মথুরানগরী।’— অর্থাৎ, চতুর্দশ শতকে দুধ-দইয়ের ভাঁড় কাঁখে, মাথায় নিয়ে রাধা-সহ একদল গোয়ালিনী বড়াইয়ের মতো বয়স্কার নেতৃত্বে প্রতিদিন জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে মথুরার হাটে যাচ্ছেন। এবং পথিমধ্যে কৃষ্ণ ছাড়া ‘অনিষ্টকারী’ আর কেউ নেই। নারী সুরক্ষার প্রশ্নে আজকের ভয়াবহ দেশ-কালে দাঁড়িয়ে তা অভাবনীয়। যাই হোক, পরবর্তীতে চণ্ডীমঙ্গলে ফুল্লরার মাংস বিক্রিতেও ফেরির ছবি ধরা পড়ে। মুকুন্দরামের ফুল্লরা তার বারমাস্যার কথা শোনাতে গিয়ে বলছে— ‘মাংসের পসরা লৈয়া ফিরি ঘরে ঘরে/ আনল পোড়াএ অঙ্গ ভিতরে বাহিরে।’— লক্ষনীয় চতুর্দশ শতাব্দীর রাধা, আর ষোড়শ শতকের ফুল্লরা উভয়েই ফেরিওয়ালি।
উনিশ শতকের সমাজচিত্রের অকৃত্রিম দলিল হিসেবে গণ্য ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-তে দেখি, ‘কোথাও পাদরী সাহেব ঝুড়ি ঝুড়ি বাইবেল বিলুচ্চেন… আদালতী সুরে হাত মুখ নেড়ে খ্রীষ্টধর্ম্মের মাহাত্ম্য ব্যক্ত কচ্ছেন— হঠাৎ দেখলে বোধ হয় যেন পুতুলনাচের নকীব।’ আবার ‘দুর্গোৎসব’ অংশে আছে— ‘মধু চাই!’, ‘শাঁকা নেবে গো’ বোলে ফিরিওয়ালারা ডেকে ডেকে ঘুরছে। বিসর্জনের দিন দুপুরবেলায়… ‘ফিরিওয়ালারা ক্রমে ঘরে ফিরে যাচ্চে, রিপুকর্ম্ম ও পরামাণিকেরা অনেকক্ষণ হলো ফিরেচে, আলু পটোল! ঘি চাই! ও তামাকওয়ালারা কিছুক্ষণ হলো ফিরে গেছে। ঘোল চাই! মাখন চাই! ভয়সা দই চাই! ও মালাই ও দইওয়ালারা কড়ি ও পয়সা গুণতে গুণতে ফিরে যাচ্চে, এখন কেবল মধ্যে মধ্যে পানিফল! কাগজবদল! পেয়ালা পিরিচ! ফিরিওয়ালাদের ডাক শোনা যাচ্ছে…’
রাধাপ্রসাদ গুপ্তর ‘কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার আওয়াজ’ (১৯৮৪) এই বিষয়ে এক গভীর অনুসন্ধানমূলক গ্ৰন্থ। যেখানে লেখক ইউরোপে পেডলার বা ফিরিওয়ালার ছবি হিসেবে সুইস-জার্মান শিল্পী হোস্ট আম্মানের (১৫৩৯—১৫৯১) ‘দি বুক অফ ট্রেডস’ (১৫৬৮) থেকে যে ছবি রেখেছেন, তা তো আজকের ‘হরেক মাল’ বিক্রেতা বা ট্রেনের সেই হকার যার প্রায় আপাদমস্তক নিত্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসপত্রে ঢাকা। চিত্রশিল্পের পথে হেঁটে ফেরিওয়ালার অনুসন্ধানে নামা রাধাপ্রসাদবাবু, কলকাতার ফেরিওয়ালার প্রথম ছবি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বেলজিয়ান শিল্পী সলভিনসের আঁকা (১৭৯৯) দুধ-দই বেচা এক গোয়ালার ছবিকে। প্রসঙ্গত মনে আসবে, বাংলা সাহিত্যে প্রথম ফেরির উল্লেখ মিলছে এই এক গোয়ালিনীর সূত্রেই, তিনি রাধা গোয়ালিনী। এখনও কমবেশি দুধ, দই ফেরি হয়ে চলেছে, শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর লাইনে গেলে ট্রেনে ‘নবদ্বীপের লাল দই—ই’ বলে হাঁক দেন হকাররা। রাধাপ্রসাদ গুপ্তর বইয়ে সংকলিত, শিল্পী মাদাম বেলনসের একটি মজাদার ছবি আছে, ছবিটি বাঁদরওয়ালার, যদিও ছবিতে সে একটি রামছাগলকে লাঠির আগায় দাঁড় করিয়ে খেলা দেখাচ্ছে, আর তার পিছনে দু’টি বাঁদরছানা, পাশে ডুগডুগি এবং বিস্মিত দর্শকরা দেখছেন সেই কসরত। ১৮৩২-এ আঁকা এই ছবি। আর রাধাপ্রসাদ গুপ্ত তার ১৯৮০-তে প্রকাশিত গ্ৰন্থে ডুগডুগি বাজিয়ে বান্দরওয়ালা, ভালুকওয়ালা, আর সাপুড়ের উল্লেখ করেছেন। এই অসাধারণ ছবিটির সূত্রে মনে আসবে, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় বর্ণিত ‘আমার বাংলা’-র (১৯৬১) অন্তর্গত ‘কলের কলকাতা’-র একটুকরো ছবি। ‘ডুগ—ডুগ—ডুগ—ডুগ—ডুগ—ডুগ ঢোলক বাজছে। ম্যাজিক দেখাচ্ছে কেউ। কাঁধ পর্যন্ত বাবরি চুল। কানে লোহার মাকড়ি। অনবরত মন্তর আওড়াচ্ছে আর মাঝে মাঝে চ্যাঁচাচ্ছে— লেড়কালোক একদফে হাততালি লাগাও।…’
এমনকী, আমরা যারা গ্ৰামে-গঞ্জে গত শতকের নয়ের দশকে কৈশোর কাটিয়েছি তারাও ওই ডুগডুগি বাজিয়ে বাঁদর খেলা দেখেছি, ডুগডুগির সঙ্গে সঙ্গে তাদের বুলিও ছিল চমৎকার, থেকে থেকে তারা ভাঙা বাংলায় বলত— ‘দ্যাকো দ্যাকো বান্দর খেলা, বাচ্চে লোক সব হাততালি দাও।’ আমরা তৎক্ষণাৎ হাততালি দিতাম। জমে উঠত খেলা, নানান কসরত। অনেক সময় বাঁদর, বাঁদরী দুটো থাকত, রঙিন পোশাকও থাকত। আর তাদের ঘটা করে বিয়ে হত, ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে বাঁদরওয়ালা নানা ছড়া কাটত, আর বলত— ‘দ্যাখুন দাদা, দ্যাখুন দিদি এট্টা হলো অমিতাব বচ্চন আর উট্টা হলো শিরিদেবী, আজ এদের বিয়ে হবে, তালি লাগান।’ উপস্থিত জনতার দলে হাসির রোল উঠত, বিয়ের কথায় পাড়ার দাদা দিদিরা মুখ টিপে হাসত, আর আমাদের কাছে বিয়ে মানে তখন শুধুই— ‘ধ্যাৎ’। ডুগডুগি বাজিয়ে বাঁদর খেলা ছাড়া আসত, একধরনের ভোজবাজির খেলা, মূলত হিন্দুস্থানী, বাবা-মা-ছেলেমেয়ে নিয়ে রুজিরোজগারের লড়াইয়ে ঘুরতে ঘুরতে তারা আসত বাংলার গ্ৰাম-গঞ্জে। প্রত্যেকের চেহারায় অপুষ্টি আর পোশাক-আশাকে দারিদ্রের চিহ্ন। একটা ডুগডুগি, ঢোল, কাঁসি আর কাঁসর-কণ্ঠে— অদ্ভুত সব কথা বলে পাড়ার মোড়-সংলগ্ন ফাঁকা জায়গায় আসর জমাত। ঢোল, ডুগডগির আওয়াজে আমরা হতাম ঘরছাড়া, লোক জমে গেলে শুরু হত ভোজবাজির খেলা। প্রথম দিকে কিছু খুচরো ম্যাজিক, তারপর খাদি-বাঁশকে আড়াআড়ি বেঁধে হত দড়ির খেলা, দড়ির ওপর থালা চাপিয়ে, তার ওপর হেঁটে নানা কসরত দেখানো ইত্যাদি। ভিড় সরে গেলে, সব বেঁধেছেঁদে তারা ডুগডুগি বাজিয়ে নিত বিদায়, নতুন কোনও গ্ৰামের উদ্দেশে। এছাড়া আমাদের ছোটবেলায়, ডুগডুগি বাজিয়ে আসত আইসক্রিমওয়ালা, আমরা বলতাম আইসক্রিমবালা। পরে পরে লাল-হলুদ সিরাপ মেশানো আর বিটনুন ছড়ানো বরফ-গোলাও এসেছে ডুগডুগি বাজিয়ে, ইদানিং দেখি আইসক্রিম বিক্রেতা পাড়ায় হর্ন দেয়। হারিয়ে গেছে, আমাদের শৈশব-কৈশোরের সেই ডুগডুগি।
রাধাপ্রসাদ গুপ্ত মহাশয় তার ‘কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক ও রাস্তার আওয়াজ’ গ্ৰন্থটিতে, শশীচন্দ্র দত্তের ‘দি স্ট্রিট মিউজিক অফ ক্যালকাটা’ (১৮৮০) প্রবন্ধ থেকে, বেশ কিছু ডাকের উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রায়বাহাদুর শশীচন্দ্র দত্ত ছিলেন, বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ঔপন্যাসিক রমেশচন্দ্র দত্তর কাকা, আনুমানিক জন্ম ১৮২৪, মৃত্যু ১৮৮৫। অমৃতলালের রচনায় পাওয়া ‘কুয়োর ঘটিতোলা’ ডাকের কথা শশীচন্দ্র দত্তের রচনাতেও আছে। বোঝা যায়, তখনও ‘কুয়ো-কাঁটা’ আসেনি, এমনকী, রাধাপ্রসাদবাবুর রচনাতেও এর উল্লেখ নেই। এটা হল নোঙর কাঁটার মতো আরও ছোট ছোট অনেকগুলো আংটাযুক্ত। সম্ভবত যখন কুয়োর ব্যবহার কমল, ঘটিতোলারা হারিয়ে গেল, তখন তার বিকল্প এই লোহার কাঁটা, যা দড়ি দিয়ে কুয়োর তলায় নামিয়ে, ধীরে ধীরে অনেক ধৈর্য ধরে, কুয়ো-কাঁটাকে কুয়োর তলায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়া বালতি, ঘটির হাতল কানায় কাঁটা লাগিয়ে টেনে তোলা। তবে খুব ছোট জিনিস, কুয়ো-কাঁটা দিয়ে তোলা জটিল। সেটার সুযোগ হত কুয়ো ঝালাইয়ের সময়। আমরা ‘কু—ও—ও ঝা—আ—লাই—ই—ই’-এ ওস্তাদদের ডাক শুনেছি। বাঁকুড়ার পুনিশোল গ্ৰামে এখনও নতুন করে কুয়ো-কাঁটা, ঝালাইয়ের পেশাদার লোকরা আছেন। কিন্তু কুয়োই তো নেই।
রাধাপ্রসাদ বাবু, শশীচন্দ্রের লেখা থেকে আরও যে ডাকের কথা বলছেন, তার মধ্যে উল্লেখ্য— ‘শিশিবোতল বিক্রি’, ‘পুরানো কাগজ বিক্রি’, ‘পুরনো লোহা’, ‘পুরনো ছাতা’, ‘কাটাও শিল চাকতি জাঁতা’, ‘হাঁসের ডিম চাই গো, হাঁসের ডিম’, ‘চুড়ি লিবি গো’, ‘হজমিগুলি’, ‘চানাচুর গরমাগরম’ ইত্যাদি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ফেরিওয়ালা অপ্রয়োজনীয় হয়ে হারিয়ে গেছেন, অনেক ফেরিওয়ালার ডাকের পরিবর্তন ঘটেছে। গেরস্তের ঘরে ‘শিশি-বোতল’ কমে গেছে, তাই ওই শব্দবন্ধ বন্ধ করে বলা হচ্ছে ‘লোহা ভাঙা টিন ভাঙা’, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘নষ্ট মোবাইল, ব্যাটারি, স্টেবিলাইজার’। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার গ্ৰামেগঞ্জে এখনও, পুরানো কাপড়ের বিনিময়ে, লম্বা চুলের বিনিময়ে স্টিলের থালা বাসন নিয়ে ফেরে ফেরিওয়ালারা।
—এই প্রসঙ্গে জানাই, এখন কাঁচের শিশি বোতলের ব্যবহার কমে এসেছে। ‘পুরনো কাগজ’ —এর ডাক এখনও আছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে— ‘টিন ভাঙগা—আ, লুহা ভাঙগা—আর’ উচ্চরব। মনে রাখতে হবে মফস্বলের বসতি—চরিত্রও পাল্টে গেছে, আর এই গ্ৰামগঞ্জ মফস্বলেই যেটুকু ফেরিওয়ালাদের ঘোরাফেরা। মফস্বলেও এখন ফ্ল্যাটের সারি, তাই সুউচ্চ ফ্ল্যাট বাড়ির কানে ডাক পৌঁছে দিতে তাদের হাঁকের তীব্রতা বেড়েছে। রাধাপ্রসাদ বাবুর সময়কালে শ্রুত ‘মাটি লিবি গো’ ডাক, আমরা কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কলের কলকাতা’ রচনাতেও পেয়েছি। সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখছেন— ‘শান বাঁধানো কলের কলকাতাকে বিষম ঠাট্টা করে পিচঢালা রাস্তায় মেয়েলি গলায় কে যেন চেঁচিয়ে উঠলো— মাট্টি, লেবে গো মাটি’। রাধাপ্রসাদ বাবু, মুচিদের গম্ভীর ডাক হিসেবে উল্লেখ করেন, ‘জুতা শিলাই, জুতা ব্রু—উ—উ—স’ —এর। এই ডাকখানা রাস্তা থেকে হারিয়ে গেলেও, ট্রেনে শোনা যায়। ‘বুড়ির মাথার পাকা চুল’ —এর যে ডাকের কথা রাধাপ্রসাদ বাবুর লেখায় আছে, তা আমরা ‘বুড়ির চুল’ ডাকেই শুনেছি, যা এখন আর অলিতে গলিতে বাচ্চাদের ডাকে না, কোনো কোনো মেলায় তার দেখা মিললেও, বাচ্চারা তাকে ডাকে ‘কটন—ক্যান্ডি’ নামে। তবে আমাদের ছোটোবেলায় ‘বুড়ির চুল’ এর জায়গায় অচিরেই তার স্থান নেয় ‘শো—ও—ও—ন পাপ—ড়ি—ই—ই’ নামক সেই ঘিয়ে ভাজা, হলদে—সাদা, মায়াবিনী মিষ্টি চাঙড়। পরবর্তীতে যাকে হলদিরাম, প্রভুজীর মতো শেঠজীরা প্যাকেট বন্দী করে বাজার ধরতে চেয়েছেন। আমাদের ছোটোবেলায় আর এক জিনিস ছিল, তার নাম ‘মামা—চাটনি’, খেতে অখাদ্য কিন্তু কেনা চাই, কেননা মামা—চাটনির মোড়কের ভিতরে থাকতো ‘প্রাইজ’। হাতছানি থাকতো— সাইকেল, দেয়াল—ঘড়ির, কিন্তু অনেকবার কিনেও লাল রঙের প্লাস্টিকের বল আর মগ ছাড়া কিছুই ওঠেনি। বেশিরভাগ সময়ই ছিলো ফক্কা। কিন্তু তারপরও যখন ঝাঁকা মাথায় হাঁক পাড়তো— ‘হৈ—এ—এ মা—মা চা—টনি— মামাচাটনি, কিনলেই পুরস্কার, কিনলেই পুরস্কার’। ঐ ‘পুরস্কার’ শব্দটাই ছিলো টোপ। এখন বুঝতে পারি, ও ছিল আদতে ‘মায়া—চাটনি’।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ফেরিওয়ালা অপ্রয়োজনীয় হয়ে হারিয়ে গেছেন, অনেক ফেরিওয়ালার ডাকের পরিবর্তন ঘটেছে। গেরস্তের ঘরে ‘শিশি-বোতল’ কমে গেছে, তাই ওই শব্দবন্ধ বন্ধ করে বলা হচ্ছে ‘লোহা ভাঙা টিন ভাঙা’, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘নষ্ট মোবাইল, ব্যাটারি, স্টেবিলাইজার’। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার গ্ৰামেগঞ্জে এখনও, পুরানো কাপড়ের বিনিময়ে, লম্বা চুলের বিনিময়ে স্টিলের থালা বাসন নিয়ে ফেরে ফেরিওয়ালারা। পুরানো কাপড় প্রতি ২০টাকা, চুল কিলো প্রতি ৪০০০টাকা, খবরের কাগজ ১০/১২টাকা, বই ৮/১০টাকা। এখনও হারিয়ে যায়নি চাবির গোছা হাতে, ‘চাবি বানান’ ডাক। এখনও শীত পড়ার আগে ‘ধুনুরি’রা আসে, তুলো—ধুনা যন্ত্রের টঙ্কার ছড়িয়ে ডাক পাড়েন— ‘লে—ই—ই—প তো—ও—ও— শোক’। কলকাতার খুব কম জায়গাতে জেগে আছে পাড়া, সিংহভাগ কলকাতাতে খাড়া হয়েছে আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাট। যেখানে ফেরিওয়ালার তো কথাই নেই, স্পষ্টভাবে গেটে লেখা— ‘সেলসম্যানের প্রবেশ নিষেধ’। নানান বাধা, প্রতিবন্ধকতা ও নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে কলকাতার রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ কোনো একলা ফেরিওয়ালা হেঁটে যায়, কিন্তু হাঁক দেয় না। আবার তারই মধ্যে গঙ্গার ঘাটে ‘কানের ময়লা পরিষ্কার’, ‘মালিশ মালিশ’ ডাক শোনা যায়। অল্প বেঁচে থাকা মাঠে ময়দানে— ‘সখের জলপান’, ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’র ডাক বিলুপ্ত হলেও, ডাক শোনা যায় ‘ঘটি—ই—ই—গরম’। বেশ লাগে। ঘটিগরমের উপাদান, আঙরার—আগুন ভরা ঘটি, দেওয়ার ধরন, সবমিলিয়ে মনে হয়, বেশ সাবেকি সুন্দর।
রাস্তাঘাটের বাঁকে বাঁকে ফেরিওয়ালার ডাক কমে এসেছে। অন্যদিকে ট্রেনে বাসে ও ফুটপাতে হরেকরকম হকারদের হাঁকডাক বেড়েই চলেছে। যদিও ট্রেনে হকারি আজকের নয়, সম্ভবত ট্রেনের আরম্ভকাল থেকেই এই বিক্রেতারা আছেন। ভারতে রেলের সূচনা ১৮৫৩, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-য় ১৮৬২ তে পাই ট্রেনের কামরায় ‘হরকরা’ পত্রিকা ও ‘বাইবেল’ বেচার উল্লেখ, বর্ধমান স্টেশনে গাড়ি ঢুকতেই— ‘পান চুরুট, পান চুরুট ভাব চাই! সীতাভোগ, মিহিদানা চাই, বর্দ্ধমেনে খাজা।’— এইভাবে গাড়ি যখন যেখানে থামে, তখন সেখানে দু’-একরকমের বিক্রিওয়ালা দু’-একটা ডাক দিয়ে চলে যায়।
এই সময়ের হকারদের হাঁকডাক শুনতে হলে, তাদের বোলচাল জানতে হলে, আপনাকে লোকাল ট্রেনে যাতায়াত বাড়াতে হবে। তাহলেই বেড়ে যাবে আপনার ভোকাবুলারি, অভিজ্ঞতা, জানতে পারবেন তাদের বিপননের কৌশল-কথা। বর্ধমানে লোকাল ধরে শান্তিনিকেতনে চলেছি, ধিকিধিকি ট্রেন চলছে, ভিড় বাড়ছে-কমছে, হকাররা উঠছে-নামছে। একজন হকার উঠেই, খানিক হাঃ হাঃ করে হেসে শুরু করলেন— ‘দাদা, আসল কথা হল রস। রস। রস। বয়স আপনার যাই হোক, রস কিন্তু চাই। রস ছাড়া সবই শুকনো। তবে শুকনো কিছুই নয়, আছে রস। রসকে বের করা চাই। আর তার জন্য চাই কৌশল। তাহলেই সব রস আপনার। নমস্কার দাদা-বন্ধু-ভাই আর ডেলি প্যাসেঞ্জার। সবারই রসের দরকার, আপনার লেবুর সাইজ যেমনই হোক, ছোট-বড় মাঝারি, রস কিন্তু দরকারি। আর সব রস পেতে হলে, যন্ত্র ঠিক রাখতে হবে। আর যন্ত্র ঠিক কাজ করলে, সব রস মিলবে।’— এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ দেহতত্ত্বের মোড়কে কথা ছড়িয়ে, কামরার মধ্যে কমবেশি সবার অস্বস্তি বাড়িয়ে, তিনি তাঁর ঝোলা থেকে বার করলেন কাগজি-লেবুর রস বের করানোর জন্য প্লাস্টিকের সেই যন্ত্রটি, যাকে বলে লেমন স্কুইজার।
পণ্যদ্রব্যর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ বোলচালের মিলমিশ দেখে অবাক হতে হয়। এইভাবেই দিনের পর দিন, কত কত কথা পেড়ে, ছুড়ে, ছিটকে দিয়ে যাত্রীদের মন জিতে তাকে কিনতে প্রলোভিত/উৎসাহিত/উদ্দীপ্ত করছেন হরেক হকার, তার পরিসংখ্যান মেলা ভার। শুধু কি তাই, দেখবেন, ট্রেনে ‘ঝালমুড়ি’-র পিছে আসে চা, এও এক বাণিজ্য-কৌশল। আর তাদের ডাকখানিও শোনার— ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো। ‘ঝালমুড়ি—ঝালমুড়ি—ঝালমুড়ি’, সঙ্গে ওই মুড়ির কৌটোয় ঝালমশলা মেশানোর ক্রমাগত শব্দ জানায় তিনি ক্রমে আগত, এই শব্দও যথেষ্ট অর্থপূর্ণ ও তাৎপর্যময়।
ট্রেনের কামরায় ফেরিওয়ালার প্রলম্বিত ডাক চলে না, সেখানে পুনরাবৃত্তির রেওয়াজ লাগে। আবার ফুটপাতের বিক্রিতে দুটোতেই গলা সাধতে হয়। যদিও চায়ের ডাক দূর থেকেই ভেসে আসে, ‘চা—য়ে, চা—য়ে’ বা ‘ভাঁড়ে চা, ভাঁড়ে চা’। কেটলির আওয়াজে আর বলার ধরনে চায়ের তেষ্টা জাগে। এছাড়াও ‘চা—না মশ—লা’, ‘গরঅঅম ঘুগনি’ ‘ডিম সেদ্ধ’-র ডাক তো আছেই। আর গ্ৰীষ্মে আছে— ‘দাদাআআ দ্যাবো নাকি ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে’— অর্থাৎ, শসা। একবার একজনকে ধারালো কাটারি হাতে বলতে শুনেছিলাম— ‘দাদাআআ গরমে মাথা ঠান্ডা রাখতে, বলেন তো এক কোপে মাথা কেটে, দ্যাবো হাতে ধরিয়ে।’— তার কথা শুনে ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়ে দেখি তার অন্য হাতে এককাঁদি ডাব। যাক বাবা, ধড়ে প্রাণ এলো। কিন্তু ভাবুন, কী মারকাটারি সওদাগিরি! কথার কী অসামান্য মারপ্যাঁচ!
ট্রেন থেকে নেমে আসুন প্লাটফর্মে, সেখানেও বিক্রিবাটা চলছে, স্টেশন চত্বরেও নানা কিসিমের দোকান, সবার হাঁকডাক নেই, কিন্তু সবার চোখেই আছে আহ্বান। বাইরে বেরিয়ে এলেই, ‘দাদা, নাস্তা হবে নাকি?’ অনেক জায়গায় হোটেলের সামনে ডাকাডাকির স্বতন্ত্র লোক নিয়োগ থাকে। সারি সারি হোটেল ভারী ভারী ডাক— ‘দাদা গরম ভাত আছে, রুটি আছে’, আর একটাতে ‘গলদা আছে, পাবদা আছে, বড়ো কাৎলা, রুই পোস্ত’, এর মাঝে ‘দাদা, নিরামিষের আলাদা ব্যবস্থা আছে’।— ডাকাডাকির চোটে আপনার কানে ষাঁড়াষাঁড়ির বান ডেকে যাবে। তারই মধ্যে খাওয়াদাওয়া সেরে ফুটপাতে এলে, আবার ডাকের বন্যা।
মাঠে-ময়দানেও ডাক। আছে মেলার ডাক। বিশেষত, গ্ৰামীণ মেলা যেন ডাকের মেলা। কতরকমের পসার, কত ধরনের পসরা, আর কতশত বিচিত্র ডাক। রকমারি দোকান ডাকে, মনোহারি দোকান ডাকে। গ্ৰামীণ মেলার অন্যতম ডাক— ‘হরেক মাল দশ টাকা। যা নেবেন দশ টাকা’।
এখন ঘোষক নেই, সব ডাকেই রেকর্ডের। মেলায় সার্কাসের তাঁবু আর পড়ে না, পুতুলনাচেরও ইতিকথা হয়ে গেছে, ফলে তাদের মজাদার ঘোষণাও গেছে হারিয়ে। এখনও কোনও কোনও মেলায় লটারির দোকান থেকে ডাক আসে, নানান ম্যাজিকের কথা শুনিয়ে চলে ম্যাজিশিয়ান, আর শোনা যায় মরণকূপের ঘোষণা। হয়তো তাও একদিন হারিয়ে যাবে, যেমন হারিয়ে গেছে কতশত ফেরিওয়ালার সুর। করোনা অতিমারীর সংকটকালে কত হকার হয়েছে বেকার, কে কার খবর রাখে। তারপরও মনে রাখা দরকার রাস্তা-ঘাটে, ট্রেনে-বাসে, মাঠে-ময়দানে ও মেলায়, অজস্র হকার ও ফেরিওয়ালারা যে সহস্র সুরে হাঁকেন ডাকেন, সে কি শুধুই চমৎকার? না, তার রুজিরোজগারের তারে বাঁধা সুরের আড়ালে চাপা থাকে তার শ্রম ও সংগ্ৰাম। সেখানে কান পাতলে শোনা যাবে, একটিই নাম ও গান— অন্ন চিন্তা চমৎকারা। তার আয়োজনেই এত স্বর আর এত সুর।