ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • প্রিয় মনস্টার

    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (March 14, 2025)
     

    হিংসে না থাকলে কেউ সতীনের পো-কে কুড়মুড়িয়ে চিবিয়ে খেত না, কেউ সুন্দরী সৎ মেয়েকে বিষাক্ত আপেল উপহারও দিত না। রূপকথাই হত না। সুয়োরানি আর দুয়োরানির মধ্যে তীব্র হিংসেহিংসি না থাকলে, কেনই-বা ভাল লোক দুঃখু পাবে, কখনই-বা পোষা টিয়ে তার কষ্ট ঘোচাতে ফন্দি করবে, কখন সব্বাই ভুল বুঝতে পারবে এবং খারাপ লোককে হেঁটে কাঁটা ওপরে কাঁটা দিয়ে বেধড়ক মেরে ফেলা হবে? শুভর জয় অশুভর পরাজয়, শেষপাতে ভিলেনের প্রতি ভয়াল ভায়োলেন্স— গোটা ফর্মুলাটাই হিংসের ওপর ব্যালান্স করে দাঁড়িয়ে। অবশ্য ফ্রয়েড বলেছেন, শিশুপুত্র মায়ের ব্যাপারে বাবাকে টেরিফিক হিংসে করে, এবং তা খুব নির্মল হিংসে নয়। সেক্ষেত্রে, কে বলতে পারে, মাতৃভক্তির মতো বন্দিত আবেগও হিংসের ওপরেই ভর দিয়ে স্বল্প নড়নড়। 

    কিন্তু বাঙালি যেখানে ‘মেরে পাস মা নেহি হ্যায় তো কেয়া হুয়া রে হতভাগা, ক্ক-ক্ক-কলচর হ্যায়’ হাঁক পাড়ছে, সেখানে মানতেই হবে, হিংসে না থাকলে বাংলা সংস্কৃতিটাই বাঁচত না। পৃথিবীর সব শিল্পীই সমসাময়িক শিল্পীদের প্রতি ঈর্ষায় জ্বলে খাক, কিন্তু বাঙালিদের দহনটা কিছু বেশি, তারা পুড়ে কাক, সবুজ কাক। সত্যি বলতে, বাঙালি শিল্পীর মূল চালিকাশক্তিই হল ঈর্ষা। এমনিতে যে-লোক সেরেফ বাঁদিক ফিরে পাশবালিশ জড়িয়ে দিন কাটিয়ে দিত, সে যে পটাং উঠে বসল এবং ঝটাং কলম টেনে সাঁইসাঁই, তা শুধু আচম্বিতে ফোন এল বলে: অমুক লেখক পেরাইজ পেয়েছে। অ্যাঁ! মুহূর্তে মাথায় সবজে বালব চিড়িকচাঁই। আমি থাকতে ও পুরস্কার পায় কেমনে? লিখতেই তো জানে না। নির্ঘাত লবি করেছে। বা বিচারকগুলো নির্বোধ। বা দুইই। গা-চিড়বিড় উচ্চে, জিভ উচ্ছে দিয়ে ধুচ্ছে, ফলে এমন সৃষ্টি করব দাঁড়াও ব্যাটাচ্ছেলেরা গুচ্ছের প্রাইজ না দিয়ে পথ পাবে না। এ থেকে যুগান্তকারী কাব্যও উৎপন্ন হতে পারে। প্রতিভার তাড়না যাকে ঠেলে তুলতে পারছিল না, সাধনার দায় যাকে পিচুটি ধুয়ে টেবিলে বসাতে পারছিল না, নাটক বা চলচ্চিত্র বা চিত্রকলার প্রতি প্রগাঢ় প্যাশন যাকে টেবিলল্যাম্পের বৃত্তে মনপতঙ্গের মিনিলাফ পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত করতে পারছিল না, আনন্দের আবহাওয়া আত্মার আরাম যাকে বলাতে পারছিল না এই বাণীটি ঠিকই আমি লেখার সুখেই লিখি, সে প্রাণপণ ঝুঁকে নিবিষ্ট হল কারণ তার সতীর্থ (এবং সুতরাং প্রকাণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বী) আজ স্বীকৃতি পেয়েছে। মেরে বেরিয়ে গেছে। অতএব জ্বলুনিতে এবার স্ব-কীর্তির বার্নল।

    শশী কাপুর-অমিতাভ বচ্চনের সংলাপের চোরা হিংসেই কি আত্নস্থ করেছে বাঙালি?

    এবং বাঙালির সাফল্যের দ্যোতকও অন্যের ঈর্ষা। কাউকে এসে যদি লোকে বলে, আপনাকে দু’হাজার জন ঈর্ষা করে, আর কাউকে বলে আপনার প্রতি ঈর্ষালু সাতাত্তর জন, দ্বিতীয় লোকটা মুষড়ে ঘষটে বিড়ি-অবশেষ। শিল্পীকে স্তাবক যদি বলে, দাদা, আজ আর কেহ আপনাকে ঈর্ষা করে না, সে বুক চাপড়ে কোদাল হাঁকড়ে ধরণী দ্বিধা হও, অট্টালিকার বারান্দায় বসে ধনী যদি শোনে প্রতিবেশী ও পথচারী ঈর্ষাশূন্য হৃদয়ে হাঁটিতং ও কেহই টেরিয়ে উদ্যানপুষ্পে দীর্ঘশ্বাস স্প্রে করছে না, তার পাশবই গুটিয়ে পিটুলি। মানুষ হয় অন্যের প্রতি হিংসে যাপে, নয় অন্যের হিংসে দিয়ে নিজেকে মাপে। প্রতি সন্ধ্যায় মদ ও হিংসা দিয়ে আচমন করে তবে বাঙালি সুস্থিত হয়, সম্মিলিত ঈর্ষা-গরল ছুবলে একাত্মতা পোয়ায়, বিদ্বেষ-সাফাই তাকে আত্মস্ট্যাচু নির্মাণে কাঁধ দেয়: অযোগ্য সহকর্মী কেন প্রোমোশন পেল আর নীতিহীন ভায়রাভাই ক্যায়সে বাড়ি হাঁকাল, জানতে বাকি আছে? কিন্তু তাহা মন্দ নয়, পাখিকে হিংসে না করলে মানুষ রকেট বানাত কি? বা ঘোড়াকে হিংসে না করলে রেলগাড়ি? এক দেশ অন্য দেশকে হিংসে না করলে বিমানবন্দর তকতকে নূতন হত? শৈশব থেকে মানুষ যা দ্যাখে তার দিকে তর্জনী বাগায়, ওইটা নেব, সেইটা খাব, ওর যা আছে হুবহু ওই খেলনা আমারও চাই। না পেলে ঠোঁট ফোলায়, পুতুল খেললে দুদিনে বোর হয়ে অন্যের (বৃহত্তর) পুতুলের প্রতি ধায়। নিজের হাতবাক্সটি নিয়ে সে অনবরত অসন্তুষ্ট, তাই সে উড়ছে, অলিম্পিকে বর্শা ছুড়ছে, চাঁদ পেরিয়ে সূর্যের কক্ষপথে পুড়ছে, এবং ‘ধুর চে!’ বলে পুঁজিবাদে জুড়ছে। 

    সেক্ষপীর বলেছিলেন, হিংসের চোখের রং সবুজ। তারও আগে ভাবা হত, মানুষের পিত্তি উপচে পড়লে হিংসে জন্মায়, তাই হিংসের রং সবুজ, বা অন্তত কালচে-সবুজ। যে-শেডের সবুজই হোক, এই কিঞ্চিৎ গোলমেলে শ্যামোলোসুন্দরো যেভাবে সভ্যতার কান পাকড়ে রেখেছে, তাতে পৃথিবী রংদার।

    গোটা বিশ্বের চাকা গড়গড়াচ্ছে এই হিংসের ইঞ্জিন, তার সবুজ বগবগে ক্বাথ উথলে পড়ছে শ্যামল শ্যাম্পুর ন্যায়, ঢেকে দিচ্ছে চরাচর। ফট করে উপদেশ গজায় বটে ‘ছিঃ হিংসে কোরো না’, হিংসে আর হিংসার নিকট-উচ্চারণ এই ভুলের পালে অধিক হাওয়াও দেয়, কিন্তু আমি একে পেরিয়ে যাব, ওর চেয়ে বেশি লাফাব, ওকে ঠেলে ফেলব এবং তাকে পেলে ঠেলব— এ-প্রবৃত্তি মুছে গেলে গোটা অর্থনীতি হেঁচকি তুলে ফুটনোট ফুটে সেপ্টিক। মানুষ হিংসেহীন প্রাণী হলে, কেউ শপিং মল যেত না, কারণ যা জামাকাপড় আছে তা দেড় জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু পাশের লোকটার চেয়ে ঝিংচ্যাক হয়ে উঠতে হবে, বা অন্তত তার সমান ফ্যাশন-দুরস্ত, এই তাড়নাই তার ব্যাংক থেকে সরসরিয়ে পিঁপড়েদলের মতো টাকা রওনা করে দেয় বাজার-সিন্দুকে। গেরস্থকে চোখ নাচিয়ে নাগাড়ে ইঙ্গিত করে কলিগের আশি ইঞ্চি টিভি, হিমালয়-ধোক্কড় ফ্রিজ। প্রতিবেশীর নীল ই-গাড়ি তাকে জপায়, ওঠো, জাগো, স্পিড তোলো। 

    ওথেলো-র দমচাপা হিংসের আবহ এখনও প্রাসঙ্গিক

    সেক্ষপীর বলেছিলেন, হিংসের চোখের রং সবুজ। তারও আগে ভাবা হত, মানুষের পিত্তি উপচে পড়লে হিংসে জন্মায়, তাই হিংসের রং সবুজ, বা অন্তত কালচে-সবুজ। যে-শেডের সবুজই হোক, এই কিঞ্চিৎ গোলমেলে শ্যামোলোসুন্দরো যেভাবে সভ্যতার কান পাকড়ে রেখেছে, তাতে পৃথিবী রংদার। বন্ধুর রূপসি বউ হলে বাসরে গমগম গানের পিছে যাহা ফুটন্ত বগবগ করে, তা-ই ত্রিকোণ প্রেমের দিকে ঠেলে দেয়, বা অন্তত নিজ পানসে বউয়ের সঙ্গে অধিক-উত্তেজিত সঙ্গমে ললকায়। বড়ভাই লাগাতার প্রশংসা পাচ্ছে দেখে ছোটভাইও পুড়তে-পুড়তে গল্পের বই পড়তে শুরু করে এবং ক্রমে রসে মজে যায়, ও-ই তার সাহিত্যজীবনের শুরু। প্রবীণ কবি অবধি ফর্ম নিয়ে নিরীক্ষা শুরু করেন, কারণ নয়া যুগের অর্বাচীনেরা তাঁকে কলা দেখিয়ে খ্যাতির গুড় চাখছে। হিংসেই এই গ্রহকে ঘুরঘুরন্তি রাখে, একলা দ্বীপে কেউ নিজের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে অসম্ভবে ঝাঁপ দেয় না, পিলপিলে সমাজে পাশের লোক ওভারটেক করছে বলেই ফাঁকিবাজি ভুলে কর্ম-ওয়াগনে লাফিয়ে চড়ে। 

    এই দম চেপে দৌড় মারার মধ্যে দীনতা নেই কি? আছে। এ থেকে অহেতুক ঘেন্না বিরাগ প্রতিশোধেচ্ছা জন্মায় না কি? হুঁ, সে ভি হয়। কিন্তু সে তো লাঙল চালালে মাটির পোকা ফালাফালা হয়, বা বেস্টসেলার বই ছাপলে গাছ মরে। হিংসে আমাকে যে নিত্য-উড়ান দিচ্ছে, তাতে ভর করে আমরা মেঘ আকচে নিচ্ছি ও থুপে-থুপে আকাশকুসুম বানাচ্ছি, সেদিকেই মন দেওয়া ভাল। মানুষ সবুজ এই ধোঁয়ার বশে বহুবার রইরই ধাবিত হতে গিয়ে হড়াম মুখ থুব়ড়ে পড়ে, তখন সেল্ফ-হেল্প বই, বা রবীন্দ্রগান, নিদেন মোটিভেশনাল উদ্ধৃতি তাকে বগল ধরে তোলে এবং বলে, হাল ছেড়ো না। অর্থাৎ, ফের হিংসে করো, নূতন একপিস হিংসে, ব্যাস। কিচ্ছুই তোমার অবসাদ ভাঙাতে পারছে না, সকালে বিছানা ছেড়ে ওঠার এক-কণা কারণ জোগাতে পারছে না দর্শনবই ধর্মগ্রন্থ ইউটিউব পর্নোগ্রাফি? তবে স্বেচ্ছায় এট্টু এক্সট্রা পিত্তি পড়তে দাও, ফেসবুক স্ক্রলিয়ে দাঁত ঘষটে দ্যাখো কোন কোন অযোগ্যের পাত পড়েছে আনন্দযজ্ঞে এবং তোমায় নেমন্তন্নর সম্ভাবনার ন্যাজটুকু অবধি নেই দিগন্তে। ব্যাস, প্রাচীন হর্সপাওয়ার গরগরিয়ে উঠবে এবং আবার তুমি হবে জীবন-যুক্ত, উপযুক্ত, গোছালো, এবং পরিপাটি বিজয়েচ্ছায় নিজ সাধ্যকে চেষ্টা দিয়ে ত্রিগুণ করে ঝাঁপাবে সিদ্ধির খোঁজে। তাতে সফল হবেই, ডুয়েল লড়লে নিজে অক্কা পাবে না, নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু তোমার জড়তাকে গাঁট্টা মেরে চনচনিয়ে দিল যে সবুজ বন্ধুখান, তার নিন্দে করলে কৃতঘ্নতা হবে না, ভাইটি? এই ধুলোপৃথিবী— যেখানে ঈর্ষা করব ঈর্ষা করব বলে আসিতেছি চলে, ঈর্ষাযোগ্য হব বলে কামড় দিচ্ছি রোলে, স্বাদু রাং সাপ্লাই দিচ্ছে হিংসের ছাগলে, ফুসফুসের গর্ভগৃহে হিংসে-দানা ফোলে— তাকে মহাশূন্য থেকে দেখলে নিট সবুজ গোল্লা মনে হচ্ছে, সে কি জাস্টিস নহে? 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook