কিছু জীবন হয় পোয়েটিকে জাস্টিসের মতো, আবার কিছু মৃত্যু হয় পোয়েটিকে ইনজাস্টিসে ভরা। কেয়া চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে ঘটেছে দ্বিতীয়টাই। একজন মেধাবী অধ্যাপক, তুখড় অনুবাদক এবং অবিস্মরণীয় অভিনেতা কেয়া চক্রবর্তীকে বাঙালি মনে রেখে দিল কেবল তাঁর আকস্মিক ও রহস্যময় মৃত্যুর জন্যই। হায় রে বাঙালি!
কেমন ছিল কেয়ার পথচলা, কেমনই বা ছিল তাঁর শেষ ক’টা দিন? তাঁর জীবনের খানিক ঝাঁকিদর্শন থাকুক প্রথমেই।
কেয়া চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২ সালের ৫ অগাস্ট, উত্তর কলকাতার বাগবাজারে। পড়ালেখা করেন স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে, পরবর্তীতে স্কটিশেই ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ কলেজজীবন থেকেই, আন্তঃকলেজ নাট্যপ্রতিযোগিতায় পেয়েছিলেন সেরা অভিনয়ের জন্য সম্মান। ১৯৬১-তে সরাসরিভাবে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হন নান্দীকারের ‘চার অধ্যায়’ প্রযোজনার মাধ্যমে। ব্যক্তিগত কারণে, এর পরের পাঁচ বছর ‘নান্দীকার’ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে আবার ‘নান্দীকার’-এ ফিরে আসেন ১৯৬৬ সালে। অভিনয় করতে থাকেন একের পর এক বিখ্যাত নাট্য প্রযোজনায়। অভিনয় করেছেন ‘তিন পয়সার পালা’, ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র’, ‘ভালোমানুষ’, ‘আন্তিগোনে’, ‘তুঘলক’, ‘শের আফগান’, ‘চক্র’, ‘ফুটবল’ প্রভৃতি নাটকে। ১৯৭৪-এ ‘ভালোমানুষ’ এবং ১৯৭৫-এ ‘আন্তিগোনে’-র জন্য পান ‘দিশারি’ পুরস্কার।
আরও পড়ুন : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে ছিল তাঁর জীবনেরই ছাপ! লিখছেন পৃথ্বী বসু…
তবে একটা জীবনের সবকিছুই কি এক অভিমুখে, মসৃণভাবে চলে? জীবন তো আর নাট্যমঞ্চ নয়, বা সিনেমাও নয়। ১৯৭৪ সালে কেয়া অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে দেন, সর্বক্ষণের নাট্যশিল্পী হয়ে নান্দীকারের সঙ্গে কাজ শুরু। বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জনের শেষ ছিল না। চাকরি ছাড়ার পর উপার্জনের মূল রাস্তা ছিল অনুবাদ ও বাটা কোম্পানির বিজ্ঞাপন লেখা। তখন কেয়া কিছু বেতার নাটকের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। লিভিং সাউন্ড স্টুডিওতে বেতার অভিনয়ের বেশ কিছু কাজ করতে শুরু করেন কেয়া। ‘বোরোলিনের সংসার’ বেতার নাটকের সূত্রে শ্রাবন্তী মজুমদারের সঙ্গে কেয়ার পরিচয় হয়, পরবর্তীতে তা বন্ধুত্বে পরিণত হয়। শ্রাবন্তী মজুমদার তাঁর স্মৃতিচারণায় বলছেন– ‘কেয়াদির সঙ্গে কথা বলে বুঝতাম, মানসিকভাবে কী অসম্ভব বিধ্বস্ত কেয়াদি, কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও কেয়াদির কাজের প্রতি আন্তরিকতা এত টুকু কম ছিল না।’ উপার্জনের তাগিদে কেয়া চক্রবর্তী সিদ্ধান্ত নেন সিনেমায় অভিনয় করার। এটাই কি তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট? না কি শেষের শুরু?
সালটা ১৯৭৭। সিনেমার নাম ‘জীবন যেরকম’। কেয়ার চরিত্রটি ছিল এক অন্ধ মায়ের। সিন-টি ছিল, মা এবং ছেলে লঞ্চে করে যাওয়ার সময় ছেলে লঞ্চ থেকে পড়ে যায়, মা ছেলেকে বাঁচাতে ঝাঁপ দেয় গঙ্গায়। কেয়া কোনও ডামি ব্যবহার না করে এই শট দিতে যান। কেয়া সাঁতার জানতেন না। কোনওরকম জাল পাতা ছিল না গঙ্গায়, বা ছিল না কোনও অন্য সাবধানতা অবলম্বনের রাস্তা।
তাহলে হঠাৎ কেয়া এই শটটি নিজে থেকে দিতে গেলেন কেন? মাঝগঙ্গায় শুটিংয়ের অনুমতি ছিল কি? কোনও চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল তাঁর ওপর? তাঁকে কি কেউ ধাক্কা দিয়েছিল? তিনি কি জেনে-বুঝে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন? না কি গোটাটাই সিনেমার মিথ্যেকে সত্যি বানানোর জন্য ব্যর্থ প্রচেষ্টা?
মাঝগঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে তলিয়ে যান কেয়া। সম্ভবত তাঁর শাড়ির আঁচল জড়িয়ে যায় লঞ্চের প্রপেলারের সঙ্গে, আঘাত লাগে মাথাতেও। ঘটনাটি ঘটে ১২ মার্চ, সেদিন দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৩ মার্চ সকালে দেহ পাওয়া যায়। দেহ আনা হল মর্গে। ঊর্মিমালা বসু এবং ভদ্রা বসুর উপর দায়িত্ব পড়ে কেয়া চক্রবর্তীর মৃতদেহকে নতুন কাপড় পরিয়ে দেওয়ার। ঊর্মিমালা বসুর স্মৃতিচরণা থেকে জানা যায়– ‘যে শুয়ে আছে, সে কি আমার কেয়াদি? অমন সোনার রং
কোথায় গেল?…
এই কথাগুলি লিখতে লিখতে হঠাৎ উৎপল দত্তর ‘আজকের শাজাহান’ নাটকটির কথা মনে পড়ে গেল। কেন? যাঁরা নাটকটি পড়েছেন বা সাম্প্রতিক প্রযোজনাটি দেখেছেন, বা ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দ্য লাস্ট লিয়র’ দেখেছেন, তাঁরা হয়তো বুঝতে পারবেন। বাকিদের জন্য এটুকু বলা যায়, পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার এক দৃশ্যে, এক বৃদ্ধ, ‘ভেটেরেন’ অভিনেতার অভিব্যক্তি কিছুতেই মনোমতো হচ্ছিল না এক তরুণ, সিনেমার জন্য নিবেদিত প্রাণ পরিচালকের। তারপর সেই অভিনেতাকে ডামি ব্যবহার না করেই সেই শট দিতে উসকানি দেন সেই পরিচালক। সেই অভিনেতা তখন কী করেন? মেনে নেন না প্রথমেই। এই অবাস্তব প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। কিন্তু শেষত তো তিনি অভিনেতা! ‘মেফিস্টো’-র হেনরিক হফগেনের মতো সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে অসহায় হলেও, অভিনয়ের আয়ুধটুকু তো তাঁর রইলই!
সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে বলা যায়, কেয়া যদি চাপে পড়েও ডামি ছাড়া ঝাঁপিয়ে পড়ে থাকেন মাঝগঙ্গায়, তাহলে কেন তিনি তা করেছিলেন? মায়ের চরিত্র যেমন ছেলেকে বাঁচাতে ওইটুকুই করতে পারেন, কেয়াও তো একজন অভিনেতা। অভিনয় তাঁকে এই অতলে টেনে নিয়ে গেল না কি?
বলাই বাহুল্য, এই শটটি শেষ পর্যন্ত হয়নি। মাঝগঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে তলিয়ে যান কেয়া। সম্ভবত তাঁর শাড়ির আঁচল জড়িয়ে যায় লঞ্চের প্রপেলারের সঙ্গে, আঘাত লাগে মাথাতেও। ঘটনাটি ঘটে ১২ মার্চ, সেদিন দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৩ মার্চ সকালে দেহ পাওয়া যায়। দেহ আনা হল মর্গে। ঊর্মিমালা বসু এবং ভদ্রা বসুর উপর দায়িত্ব পড়ে কেয়া চক্রবর্তীর মৃতদেহকে নতুন কাপড় পরিয়ে দেওয়ার। ঊর্মিমালা বসুর স্মৃতিচরণা থেকে জানা যায়– ‘যে শুয়ে আছে, সে কি আমার কেয়াদি? অমন সোনার রং কোথায় গেল? আমার মনে হল, যে মাটি তাকে আশ্রয় দিয়েছিল, সেই মাটি তার সমস্ত আদর কেয়াদির মুখে, গালে, কপালে, গলায় লেপে দিয়েছে। কেয়াদি আমার মাটির কেয়াদি।’ কেয়া চক্রবর্তীর শেষযাত্রার মিছিলে নাট্যকর্মীরা পোস্টার লিখেছিলেন – ‘কেয়াদি তুমি কাজ করতে করতে চলে গেলে, আমরা কাজ করতে করতে তোমাকে মনে রাখব।’
মার্চ মাসের এই দু’টি দিন বাংলার নটচঞ্চুদের হুট করে কেয়া চক্রবর্তীর কথা মনে পড়ে, ‘আহা, উনি কত মহান নাট্যশিল্পী ছিলেন’ বলে দু-লাইন লেখা হয় ফেসবুকের দেওয়ালে, আবার তারা গোটা ঘটনাটা ভুলে যায়। কিন্তু প্ৰিয় গ্ৰুপ থিয়েটারের নটচঞ্চুগণ, আপনারা হয়তো জানেন না বা মানেন না, কেয়া-র মৃত্যুর জন্য আপনারাই কিঞ্চিৎ দায়ী। কেয়া চক্রবর্তীর শারীরিক মৃত্যু হয়েছিল সিনেমার ইউনিটের অনভিজ্ঞতা বা আরও সোজাসুজি বললে, ‘ক্যালাসনেস’-এর জন্য। কিন্তু একজন সর্বক্ষণের থিয়েটার কর্মী, যিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছেন সম্পূর্ণ সময়টা থিয়েটারে দেবেন বলে, তাঁকে ঠিক কী কারণে সিনেমা করতে যেতে হয় বলতে পারেন?
কেয়া না হয় মরে বেঁচেছেন, কিন্তু আমাদের সমসাময়িক নাট্যকর্মী বন্ধুরা, যাঁরা থিয়েটার নিয়ে প্রথাগত পড়ালেখা করেছেন, শিক্ষিত শিল্পী, তারাও থিয়েটার ছেড়ে প্রতিনিয়ত চলে যাচ্ছেন কেন? এই প্রশ্নও সহজ, উত্তরও জানা। কলকাতার গ্ৰুপ থিয়েটার (সে যতই সরকারি অনুদান পাক না কেন) নিজেদেরকে অর্থ উপার্জনের বিপরীতে এক ভিনগ্রহী পরিকাঠামো হিসেবে চিহ্নিত করবেন, অভিনেতা বা টেকনিশিয়ানদের টাকা দেবেন না, আবার তাদের থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময়ও চাইবেন, এত কিছু তো একসঙ্গে হয় না। কেয়া চক্রবর্তী কাজ করতে করতে চলে গেছেন, এটি বেদনার, দুর্ভাগ্যজনক, হতাশারও, তবে প্ৰিয় বাংলার নটচঞ্চুরা, কেয়া কিন্তু থিয়েটারটাই করতে চেয়েছিলেন, সিনেমাটা নয়। আপনারা যদি আর একটু যত্ন করে কেয়াকে, বা আরও হাজার হাজার ‘কেয়ার মতো’-দের ধরে রাখতে পারতেন, তাহলে শিল্পীদের এই পরিণতি হয় না, হতে পারে না।