ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • কিসমাত কানেকশন : পর্ব ৩

    তরঙ্গ মুখোপাধ্যায় (February 14, 2025)
     

    ঘোড়ার মাঠে ঘোরাঘুরি

    শ্যামবাজার মোড় থেকে একটা হলুদ ট্যাক্সি ধরে নিলে, একটা গোটা রাস্তা টাইম ট্রাভেলের ভিস্যুয়াল দিয়ে হঠাৎ এসেপ্ল্যানেড পৌঁছে যায়। তারপর রেড রোড, শীতকালীন ময়দানি ক্রিকেট আর বাঁ-হাতে থেকে যায় গড়ের মাঠ। ট্যাক্সি ঘুরে যায় হেস্টিংসের দিকে। যেখানে বিবর্ণ সবুজ ব্যারিকেড ঘিরে রাখে আরেক ময়দান। যে-ময়দানের পোশাকি নাম রেসের মাঠ। ভাল নাম ‘রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব’। ক্লাবের দরজায় অগোছালো ভিড়, অবিন্যস্ত খুচরো ব্যবসায়ী দুটো পয়সার আশায়। তখনও রেসের মাঠের ভেতরে ঢোকা হয় না, কারণ পথ আটকে এসে দাঁড়ায় বইবিক্রেতা। রেসের মাঠের বেস্টসেলার বই নিয়ে নিতে হয়। বইয়ের সাথে ফ্রি-তে নিয়ে নিতে হয় দিনের তাজা টিপস। নামহীন কোনও লেখক রেসবইয়ের পাতায়-পাতায় লিখে রেখেছে গুপ্ত মন্ত্র। যে-রহস্য ভেদ করতে পারলেই ডোপামিনের সমুদ্রে অবগাহন, আরও আনন্দ।

    তারপর ৫০ টাকা বা ৫০০ টাকার টিকিট কিনে, বেছে নিতে হয় নিজের শ্রেণিচেতনা, সাধারণ গ্যালারি কিংবা গ্র্যান্ড এনক্লোজার। এলোমেলো হাত বাড়িয়ে দেয় টিকিটঘরের প্রাচীন মানুষ, যার মুখে এক্সপ্রেশন নেই কিংবা সে বুঝিয়ে দেয় সর্বস্বান্ত হওয়ার টিকিট কাটছি বোধহয়। ৫০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকে যেতে হয় এক আশ্চর্য কলকাতার ভেতর, যেখানে সমস্ত শ্রেণি একসঙ্গে কোরাস গায় ‘জুয়া না কিসিকা হুয়া’। অনভিজ্ঞ নতুন প্লেয়ার দেখে বিদ্রূপের দৃষ্টি ছুড়ে দেয় অনেকে, অথবা কেউ নিজে এসে যেচে আলাপ করে। ‘১৯৭২ থেকে আসছি এখানে’, বলছিলেন এক অশীতিপর মুসলিম বৃদ্ধ। ‘রেসের বইটা বুঝতে হবে তোমাদের!’ শিক্ষক মহাশয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তারপর হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে-যেতে বলে যান, ‘আট নম্বর রেস মে দু’নম্বর ঘোড়া জিতেগা।’ পাত্তা না দিয়ে আমরা এগিয়ে যাই, যেমন নিঃসঙ্গ কর্নেলকে কেউ কোনওদিন চিঠি লেখে না।

    সামনে টোট কাউন্টারে আশ্চর্য ভিড়; দামি স্যুট থেকে চেক-চেক লুঙ্গি, সব শ্রেণির সমবেত প্রার্থনাসংগীত কয়্যারের মতো লাগে। ভাগ্যদেবতার কোনও ধর্ম হয় না। নিরাকার, স্তব্ধ সেই দেব কবে কাকে কোন বিস্ফোরণ দেবে তা জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও অনেক বাকি। টোট কাউন্টারে টিকিট কাটি। কত রকমারি সেইসব টিকিট! ‘উইন’, ‘প্লেস’, ‘টানালা’, ‘কুইনোলা’। ‘‘লা দোলচে ভিতা’-তে লাগিয়ে দিন’, পেছন থেকে মন্তব্য উড়ে আসে। সিনে ম্যাজিক নয়, ঘোড়াদের নাম এমনই হয়— ‘ক্যাস্টিল’, ‘মার্কোলিনি’, ‘ফরগেট মি নট’; এমনকী বাদ যান না রবীন্দ্রনাথও, ‘একলা চলো’।

    রেসের মাঠের বেস্টসেলার বই

    টিকিট কাটার পর, গ্যালারিতে ফিরে আসি। বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠে হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হয়। ঘোড়াগুলো দৌড়চ্ছে। ঘোড়াদের ওপর প্রায় শুয়ে পড়েছে জকিরা। হাতের বেত দিয়ে আরও তরান্বিত করতে চাইছে ঘোড়াগুলোকে। রিক্রিয়েশনল স্কোল্ডিং নয়, নিছক জেতার খিদে; কারণ জিতলেই তুমুল আনন্দ! রেস শেষ হতেই মাঠে এক দলের উল্লাস আর অন্য দলের নৈঃশব্দ নেমে আসে। শুনলাম, আমরাও নাকি জিতেছি! একেই বোধহয় বিগিনার্স লাক বলে। টোট কাউন্টারে জেতার টাকা তুলতে এসেই মোহভঙ্গ। কিছুই প্রায় পাওয়া যায়নি। ইতিউতি ঘুরতে-ঘুরতে দেখা হয়ে যায় মধ্যবয়স্ক বাঙালি ভদ্রলোকের সাথে। অনেকদিন তাঁর যাতায়াত। আমাদের দুঃখ শুনে মৃদু হাসেন। তারপর বলেন, ‘ভুল কাউন্টারে খেলছেন, এ তো সস্তার জায়গা, আসল খেলা হচ্ছে বুকিদের কাছে।’

    বুকি শব্দে চমকে উঠতে হয়। নব্বই দশকের ক্রিকেট হিরো আজহারউদ্দিনও তো বুকিদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন! হাতের হালকা মোচড়ে বাউন্ডারি পার করে দেওয়ার মতো আমরাও বুকিদের কাউন্টারে যাই। বাজার শব্দের সঙ্গে আরও একবার আলাপ হয় মধ্য তিরিশে। যে-বাজার আদপে দর ঠিক করে মেলানকোলির। রেসের মাঠজুড়ে এক আশ্চর্য বিষাদ কাজ করে, জেতা-হারা সব কিছু পেরিয়েও সেই বিষাদ থেকে যায়। সমরেশের গল্পে সত্তর দশকের চাকরি হারানো যুবক রাকেশ অনেক টাকা জিতেও সেই বিষাদগন্ধ নিয়ে ফেরে। হাসপাতালে তিন নম্বর বেডে শুয়ে থাকা নীরা ফিরে আসে না। পাগলের মতো সব ঘোড়ায় তিন নম্বরে বাজি ধরা রাকেশ হয়তো দীর্ঘশ্বাসে বোকা প্রেমের অহংকার পায়। নির্মম রেসের মাঠের যন্ত্রণা নিয়ে শেয়ার ট্যাক্সি ধরে হাওড়াগামী যুবক, ‘আজ সব লস, দোকান-বাজার কিচ্ছু হবে না!’

    বুকিদের বাজার কখনও থামে না, দ্য শো মাস্ট গো অন। ঘোড়াদের দর বাড়তে-কমতে থাকে। রেসুরেদের হার্টবিটের লাবডাব শোনা যায়। আমরা খুঁজতে থাকি আমাদের স্টোরিলাইন। উত্তেজনা কমাতে চা, কফি, মদ— সব কিছুর ইন্তেজাম মাঠের ভেতর। ওল্ড মংকের ধুনকিতে চোখ বুঝে কেউ বলতে থাকে এরপরের রেসে সে বাজি মেরে নেবেই। দালালের দল ঘিরে ধরে— ‘এই ঘোড়া একদম জিতবে, আপনি জিতলে একটা বিয়ারের বোতল দেবেন!’ প্রমিস কঠিন জেনেও লোভী হাত বাজি ধরে। আসলে বাজি ধরে না, নিজের অ্যাড্রেনালিনের সঙ্গে সমঝোতা করে। বেলা গড়ালে মাঠের দখল নেয় নিম্নবর্গ। কোনও মেসি-কোহলি নয়, মাঠের মসিহা হয়ে যায় স্টার জকি সুরজ নারেডু। ‘সুরজ, সুরজ!’ চিৎকারে গ্যালারি কেঁপে ওঠে। ফার্স্ট প্রাইজ সুরজ নিলে জিতে যায় একটা গোটা মাঠ। রেসের মাঠের সবুজে নারেডু ফিসফিসিয়ে ওঠে তার প্রিয় ঘোড়া ক্যাস্টিলের কাছে, ‘I want to do with you, what the spring does with the cherry trees!’

    ঘোড়দৌড়

    রেসের মাঠের কবিতা নেরুদা নয়, নারেডু লেখে। উঁচু গ্যালারিতে বসে কলকাতা দেখে কেউ-কেউ। হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্য ফোরটি টু-কে দেখে। শেষ বিকেলের স্কাইলাইন লাল হয়ে উঠলে কলকাতা ডার্বির সময় হয়। আট নম্বর রেসের ট্রাম্পেট বেজে ওঠে। আমরা কোনও বাজি ধরতে পারি না, কারণ আমরা শুধু জেনেছি, রেসের মাঠের যন্ত্রণা আমাদের জন্য নয়। তবুও আদিম রিপু জেগে ওঠে, বুকিদের কাউন্টারের কাছে পৌঁছে যাই। মিনিটখানেক স্তব্ধ হয়ে থাকি। হঠাৎ দৈববাণীর মতো মনে পড়ে যায় সেই সুপ্রাচীন চাচার কথা, যে ১৯৭২ থেকে আসছে; ‘আট নম্বর রেস মে দু’নম্বর জিতেগা’। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাজি ধরি দু’নম্বরের ওপর। ঘণ্টা বেজে ওঠে, রেস শুরু হয়। মাঠে প্রায়ান্ধকার। ঘোলাটে হলুদ আলোতে ভাঙাচোরা সিঁড়ির ল্যান্ডিং পুরনো চুমুর কথা মনে পড়ায়। আগামী কোনো কিশোরকে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ জানান দেয়, এই আলো এসেছে ৫০০ কোটি বছর আগের প্যারালাল ইউনিভার্সের কলকাতার হলুদ স্ট্রিট লাইট থেকে।

    মাটি কাঁপতে থাকে, ঘোড়ার রেসে লিডে মাতঙ্গি। সামনেই দেখা যায় ফিনিশ পয়েন্ট। হঠাৎ ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালের মেসির মরিয়া সাইড কিকের মতো ছুটে আসে দু’নম্বর ঘোড়া ক্যাস্টিল, যার ওপরে জকি নারেডু ম্যাজিক ওয়ান্ড নিয়ে বসে আছে আর ফিসফিসিয়ে বলছে, ‘I love you as certain dark things are to be loved, secretly between shadows and soul.’ বিদ্যুতের গতিতে ফিনিশ পয়েন্ট পার করে দু’নম্বর। আমরা ডার্বি জিতে গেছি। পাগলের মতো খুঁজতে থাকি সেই কর্নেলকে। সে কোথাও নেই। দৈববাণীর মতো এক সংখ্যা দিয়ে সে মিলিয়ে গেছে অতিকালের হৃদয়ের ভেতর। আমাদের সারাদিনের রেস-যাপনের সঙ্গে মিশে যায় শেষ শীতের হাওয়া, বুকি কাউন্টারের ফিসফিসানি, ফুড কাউন্টারের ঠান্ডা বিরিয়ানির গন্ধ, লালচে মেয়ের রেস জেতার পরের উত্তেজনা, খুচরো পয়সা গুনে বাড়ি যাওয়া মাতালের স্বগতোক্তি, অস্থায়ী রেসকোর্স বারের খালি বোতলের নৈঃশব্দ, বারংবার বাজি ধরা মানুষের শূন্য দৃষ্টি— এসব ইমেজারি রেসের মাঠের হুজুন তৈরি করে। রেসের মাঠ খালি হয় এরপর, হলুদ ট্যাক্সি ফিরে যায় এসপ্ল্যানেডের দিকে। ফিরতে-ফিরতে সন্ধে নেমে আসা রেসকোর্স দেখি ব্যারিকেডের ওপার দিয়ে। ফুল মুন নাইটে রেস দেখার ইচ্ছে তীব্রতর হয়। আস্তাবলে ক্যাস্টিল ঘুমিয়ে পড়লে, নারেডু আলতো করে গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়, চোয়াল শক্ত করে প্রস্তুতি নেয় পরের বাজির আর কানে-কানে বলে, ‘I love you simply without problems and Pride.’

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook