টুকরো টুকরো আকাশ
একজন চিকিৎসক তাঁর চিকিৎসাযাপনে অনেক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন, অনেক রকমের জটিল অসুখের মুখোমুখি হন, এইভাবে তিনি নিজেকে ঋদ্ধ করেন। কিন্তু তাঁর এই জার্নিতে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বোধহয় এই যে, তিনি খুঁজে পান এক বিস্তৃত মানবজমিন। এক-একজন রোগী, এক-একজন মানুষকে তিনি আবিষ্কার করেন নিবিড়ভাবে; সেখানে দেখা দেয় আশ্চর্য সব ভুবন! চেকভ বা বনফুল হয়তো তাঁদের এই পর্যবেক্ষণকে রূপান্তরিত করেছিলেন অসামান্য সব ছোটগল্পে!
সে আমার চিকিৎসক-জীবনের প্রথমদিকের কথা। মির্জাপুর স্ট্রিটের একটি ক্লিনিকে সপ্তাহে দু’দিন যাই আমি। বাসে করে পৌঁছতে হয় বলে, পৌঁছতে প্রায় দিনই দেরি হয়ে যায় কিছুটা। তখনও গাড়ি নেই আমার। একদিন ক্লিনিকে ঢুকে দেখি শিল্পী গণেশ পাইন বসে আছেন ওয়েটিং হলে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছেন তিনি। নিজেকে খুব লজ্জিত লাগল। গণেশদাকে ভেতরে ডেকে বললাম সে-কথা। তিনি বললেন, আরে সে তো হতেই পারে, এতদূর থেকে আসছ! তারপর শুনলাম তাঁর সমস্যার কথা। তাঁর ঘাড়ে আগের দিন রাতে তৈরি হয়েছে একটি গভীর ক্ষত। তিনি তখন ছবি আঁকছিলেন, একটি বিষাক্ত পোকা তাঁর ঘাড়ে এসে বসেছিল। গণেশদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন না কেন পোকাটাকে! তিনি মৃদু হেসে বললেন, আসলে ছবি আঁকার সময়ে ব্রাশ ছেড়ে হাত তোলা যায় না ঠিক। বুঝতে পারলাম যে কী গভীর মনঃসংযোগে তিনি ছবি আঁকেন, পোকার দংশনের ব্যথাযন্ত্রণা তিনি অগ্রাহ্য করে ফেলেন সে-সময়ে। গণেশ পাইন কীভাবে ‘গণেশ পাইন’ হয়ে উঠেছিলেন, তারই একটি ছোট্ট দৃষ্টান্ত এটা।
আরও পড়ুন : গ্রামে সাড়ে চারশো রুগি দেখতে হত তিন ঘণ্টায়!
পড়ুন কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কলমে মেডিসিনারি পর্ব ১…
অগ্রজ শিল্পী পরিতোষ সেনের বাড়িতে এক সময়ে যেতাম প্রায়ই। তাঁর সঙ্গে গল্পে-আড্ডায় চিত্রকলার বিশ্বজগৎটা উন্মুক্ত হয়ে যেত চোখের সামনে। একদিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখি, তিনি কোমরের প্রবল যন্ত্রণায় কাতর, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছেন না। সঙ্গে-সঙ্গে একজন অর্থোপেডিক চিকিৎসককে ফোন করে ডেকে নিলাম তাঁর বাড়িতে। তিনি নিজের হাতে ইঞ্জেকশন দেবেন বললেন তাঁর কোমরে। বেশ কিছুটা দূরে গাড়িতে করে গিয়ে সেই ইঞ্জেকশন, ওষুধ কিনে নিয়ে এলাম। পরে তাঁর বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে আসছি, স্ত্রীকে বললেন দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। অন্য সময়ে তিনি নিজেই দিতেন প্রতিবার। বেরোবার সময়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কত টাকা লেগেছে ওষুধ, ইঞ্জেকশন কিনতে। আমি বলতাম না কিছুতেই। এর কয়েকদিন পরে আমার বাড়ির ঠিকানায় পোস্টে একটি চেক এল। পরিতোষদা অসুস্থতার মধ্যেই পাঠিয়ে দিয়েছেন— ওষুধ, ইঞ্জেকশনের দাম! এই আত্মসম্মান, এই চরিত্রগুণ বিরল এই যুগে!
এমবিবিএস পাশ করার পর তখন আমি সরকারি ত্বক বিভাগের সিনিয়র হাউজ-স্টাফ। আমাদের বিভাগে একটি তরুণী ভর্তি রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। তার বয়স আঠারো-উনিশ হবে। সে অনাথ, মিশনারি কোনও সংস্থা তাকে ভর্তি করেছে এখানে। তার একটি বিরল কঠিন অসুখ, সিস্টেমিক স্কেলরোসিস। বাঁচার আশা খুব কম। সকাল-বিকেল যখনই তার বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়াই, সে আমায় সজল নয়নে বলে, ‘আমাকে ছেড়ে দেবেন না তো? আমি মিশনারিদের ওখানে কিছুতেই ফিরতে চাই না।’ আমি তাকে দিনের পর দিন ভর্তি রাখি। আশ্বাস দিই, ছাড়ব না। পরে একদিন আমার ডিপার্টমেন্টের অধিকর্তা নির্দেশ দিলেন তাকে ছেড়ে দিতে। মাদার টেরেসা-র কাছে চিঠি লিখলাম। তাঁর কেন্দ্রে গিয়ে কথাবার্তাও বললাম, তাঁরা ওই মেয়েটিকে নিতে নারাজ। বাধ্য হয়ে মেয়েটিকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। যেদিন সকালে সে চলে যাবে, মিশনারিরা তাকে নিতে এসেছে, আমি তার ওয়ার্ডেই ঢুকলাম না, তার সঙ্গে দেখা করলাম না, পাশের করিডর দিয়ে পালিয়ে এলাম!
সিনিয়র হাউজ-স্টাফ থাকার সময়েই একজন পেশেন্ট ভর্তি হয়েছিল আমাদের অধীনে, তাঁর সারা শরীরের ত্বকজুড়ে র্যাশ, ওষুধের বিক্রিয়ায়। তিনি ক্রনিক অ্যালকোহলিক, লিভারের অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁর স্ত্রী আমাকে হাতে-পায়ে ধরে বলে গেলেন যে, তিনি কিছুতেই যেন অ্যালকোহল না পান, তাঁর তিনটি ছোট-ছোট বাচ্চা। পরে একদিন সিস্টারদের কাছে শুনলাম যে তিনি ওয়ার্ডের চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের পয়সা দিয়ে মদ আনিয়ে খান নিয়মিত। শেষ পর্যন্ত রোগীটি বাঁচলেন না, তাঁর স্ত্রী অঝোরে কাঁদছিলেন করিডরে দাঁড়িয়ে। নিজেকে খুব অসহায় লাগল। শারীরিক চিকিৎসা করলেও সমাজের চিকিৎসা তো করতে পারছি না আমরা! এইজন্যেই কি চে গুয়েভারা চিকিৎসা ছেড়ে একদিন বন্দুক তুলে নিয়েছিলেন কাঁধে?
পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন অর্থাৎ এমডি করার পর তখন নতুন-নতুন প্র্যাকটিস করছি। একদিন এক ভদ্রলোক তাঁর ভাই ও স্ত্রীকে নিয়ে এলেন আমার প্রাইভেট চেম্বারে। ভাইয়ের রোগটি কুষ্ঠ বা লেপ্রসি হয়েছে বলে নির্ণয় করলাম। ভাইকে বাইরে বের করে দাদা ও বউদিকে রোগের কথাটি বললাম। পরদিন থেকে দাদা আর এলেন না কখনও। বউদি দেওরকে নিয়ে নিয়মিত আসছেন চেম্বারে। তাঁর কাছে শুনলাম দেওরকে বাড়ির বাইরে একটি পরিত্যক্ত ঘরে থাকতে বাধ্য করছেন দাদারা। শুধু সেই বউদি যান খাবারদাবার দেওয়ার জন্যে। আর মাঝে মাঝে তাকে আমার চেম্বারে নিয়ে আসেন। সেদিন অনুভব করলাম ‘চারুলতা’র অন্য এক রূপের!
কবি মণীন্দ্র গুপ্তের একটি সাক্ষাৎকার নিতে গেছিলাম আমাদের পত্রিকা থেকে। তিনি নিজে কিছুই বলেননি। বেরনোর সময়ে তাঁর স্ত্রী কবি দেবারতি মিত্র বললেন, তাঁর ত্বকের একটি অসুখের কথা। পরে একদিন গেলাম তাঁর অসুখের চিকিৎসা করতে। তাঁর অসুখের ব্যাপ্তি দেখে শিউরে উঠলাম, এতদিন কোনও চিকিৎসাই প্রায় না করে কাটিয়ে দিয়েছেন! দেবারতিদির আগ্রহে চিকিৎসা শুরু হল, নিয়মিত যেতাম। মণীন্দ্রবাবু প্রতিবারই বলতেন, আবার কষ্ট করে এলেন কেন? আমি তো ঠিকই আছি! ওষুধপত্র ছাড়াও ত্বকের নার্সিং কেয়ারের প্রয়োজন ছিল খুব। দিনের পর দিন দেবারতিদি সেটা করেছেন, যেভাবে দেখিয়ে দিয়ে এসেছি। ত্বকের অসুখের ওই ভয়াবহ যন্ত্রণার প্রকোপেও কীভাবে মণীন্দ্রবাবু নির্বিকারভাবে লিখতেন, পড়তেন, তা দেখে বিস্ময় বোধ করতাম। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে, তাঁর বাড়িতে কোনও এসি ছিল না— তারই মধ্যে একটি পূজা সংখ্যার উপন্যাস শেষ করলেন। ক্রমে-ক্রমে অনেকটাই ভাল হয়ে উঠলেন ত্বকের দিক থেকে। একদিন ফোন করে ডাকলেন, অথচ নিজে কোনওদিনই অসুখের ব্যাপারে কিছু জানাতেন না, যা বলার দেবারতিদিই বলতেন। গেলাম, উনি হংকং থেকে ছেলেকে দিয়ে দুটি চাইনিজ পেন্টিং আমার জন্যে আনিয়েছেন। বললেন, আমি খুব ভাল আছি। আর তার কিছুদিন পরেই অন্য এক অসুখে তিনি চলে গেলেন চিরতরে!
ডা. অশোক চৌধুরী আমাদের কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রধান, এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ অধ্যাপক, সব ছাত্ররা তাঁকে সমীহ ও ভয় করে চলে। মেডিসিনে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য, চিকিৎসক হিসেবে প্রথিতযশা। বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী, মূল্যবোধ ও নীতির বাইরে কোনও কিছু করেন না কখনও। কিন্তু সেই সময়ে সরকারি কাজকর্মের ব্যাপারে কিছুটা পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন। ওয়ার্ডে ক্লাস করবার সময়ে সেই ব্যাপারে উল্লেখ করবার জন্য একবার তাঁর বকুনিও খেয়েছিলাম বেশ। রিটায়ার করার পরে তিনি একদিন আমার কাছে ত্বকের চিকিৎসার জন্যে এলেন। বললেন, তুমি আমায় যা বলবে আমি তাই ফলো করব। সত্যিই তাই করলেন। একেবারে এক আদর্শ রোগীর মতো আচরণ করে গেলেন, যেন তিনি কোনওদিন চিকিৎসাবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন না! এই সময়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটা ছিল খুব দুঃখের, চিকিৎসক স্ত্রী মারা গেছেন, একমাত্র ছেলে মানসিক ভাবে অক্ষম। অথচ তাঁর ফোনে ফোন করলেই সবসময়ে রিংটোন বাজত, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি’…।
চিকিৎসক-জীবনের প্রথমদিকে পেয়েছিলাম আরেকজন সিস্টেমিক স্কেলরোসিস রোগীকে। মহিলাকে তাঁর স্বামী নিয়ে আসতেন নিয়মিত। খুবই যত্নশীল ছিলেন স্ত্রীর ব্যাপারে, যা নির্দেশ দিতাম সবই পালন করতেন অক্ষরে-অক্ষরে। একদিন তিনি হঠাৎ বললেন, আমার স্ত্রীর অসুখটা তো শুরু হয়েছিল যখন আমরা ভূপালে ছিলাম, তখনই তো গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটেছিল। আপনি কি চিকিৎসাগত দিক থেকে লিখে দেবেন যে এই অসুখটার জন্য ওই গ্যাস দুর্ঘটনাটা দায়ী, তাহলে আমি বেশ কিছু টাকা ক্লেম করতে পারি। আমি বললাম চিকিৎসাশাস্ত্রে তো এভিডেন্স ছাড়া কিছু লেখা সম্ভব নয়। এই রোগ যে ওই কারণে হয়েছে, তার তো কোনও প্রমাণ নেই। কী করে লিখব! পরদিন থেকে তিনি আর এলেন না। পরে পরিচিত একজনের কাছে শুনেছিলাম যে স্ত্রীর চিকিৎসা করানো বন্ধই করে দিয়েছেন তিনি!
অনিল বিশ্বাস। তখন বলা হত বামপন্থী সরকারের মূল চাবিকাঠিই ছিল তাঁর হাতে। মাঝেমধ্যে আমার চেম্বারে এসে রাতের দিকে দেখিয়ে যেতেন, খুব শান্তশিষ্ট ভাবে, কোনও সেলিব্রিটি-সুলভ দম্ভ ছিল না একবারেই। কিডনির অসুখে তিনি খুবই অসুস্থ তখন। তাঁর কাছ থেকে একজন এসে তাঁর ফ্ল্যাটে দেখতে যেতে অনুরোধ করলেন। গেলাম। আমাকে দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন তাড়াতাড়ি। প্রচণ্ড বকাবকি করলেন তাঁর অনুগামীকে। কেন ওঁকে ব্যস্ত চেম্বার থেকে নিয়ে এসেছ এখানে? আমিই যেতাম, বলোনি কেন আমাকে? তাঁকে দেখার মাঝখানে বেশ কয়েকবার ফোন এল তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্যে। তাঁর সহকারী ফোন দিতে চাইছিলেন না। আবার বকাবকি! জোর করে নিলেন সেইসব ফোন। এই পার্টিরই আরেকজন সর্বভারতীয় নেতা, দিল্লি থেকে এসে একজন চিকিৎসককে দিয়ে আমাকে ফোন করালেন, পার্টি অফিসে গিয়ে তাঁকে দেখে আসার জন্যে। যেতে অস্বীকার করলাম, বললাম, চেম্বারে আসতে বলুন, দেখে দেব, এত রোগীকে বসিয়ে রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি আসেননি, আমিও যাইনি!
বাংলা ভাষার একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, রবীন্দ্রজীবন ও সাহিত্যের ধারক, তাঁর বাড়িতে যেতাম তখন মাঝেমধ্যে। তাঁর গলার সমস্যা দীর্ঘদিনের, যার জন্যে অধ্যাপনা থেকে স্বেচ্ছা-অবসর নিয়েছিলেন নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই। গলার সমস্যাটা ক্রমেই বাড়ছিল। অনেক অনুনয়ে-বিনয়ে চিকিৎসক দেখাতে রাজি করালাম। তাঁর বাড়িতে একজন ইএনটি চিকিৎসককে ডেকে আনালাম। তিনি দেখলেন এবং মত দিলেন যে একবার কোনও নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে একটু আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে আর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে। রাজি হলেন না কোনও পরীক্ষা করাতে, অনেকবার বলেও কাজ হল না। বউদিও বললেন একদিন, ওঁর ‘না’ টা তুমি ‘হ্যাঁ’ করাতে পারবে না কোনওদিন! সত্যিই পারলাম না…