ইরফান খান সম্পর্কে কিছু লেখার গণ্ডগোল এই যে, ইরফানের জন্মদিনে আসলে ওঁর মৃত্যুর কথাই মনে পড়ে। আমাদের একটা সহজাত প্রবৃত্তি আছে, যে যখন থাকে তখন তাকে শ্রদ্ধা-সম্মান করি বটে, উচ্চাসনে বসাই, কিন্তু সে চলে গেলে কতখানি অন্যরকম হয়ে যায় চারপাশটা, সেটা একমাত্র কেউ চলে গেলেই বুঝি। কে চলে গেলে কী হবে, এই কষ্টকল্পনা আমরা করতেও চাই না, এবং আমাদের পক্ষে করা সম্ভবও হয় না।
এপ্রিল মাসে, প্যান্ডেমিকের মধ্যে, সকালে ঘুম থেকে উঠে বসে প্রথম খবর পেয়েছিলাম ইরফান খান আর নেই। ইরফান চলে গেছিলেন অদ্ভুত এক যুগ-সন্ধিক্ষণে। প্রথমত, তিনি এমন একটা সময়ে চলে গেছিলেন, যখন গোটা ভারত একটা অদ্ভুত সময় কাটাচ্ছে। মানুষ মূলত নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। সেই সময়টাকে বলা যেতে পারে একুশ শতকের সবচেয়ে বড় সংকট। কিন্তু অতিমারী যখন চলে গেল, তখনও দেখা গেল মানুষ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। ইরফান চলে যাওয়ার পরে আমাদের কাছে এক যুগ-সন্ধিক্ষণ স্পষ্ট হল। একরকম করে একটা সমাপ্তি ঘটল ভারতীয় বিনোদনে আধুনিক অভিনেতাদের যুগের।
উত্তর-অতিমারী কালে আমরা আবার দেখতে পেলাম যে, স্টারেরা ফিরে আসছে। ফিরে আসছে হাইস্পিড শট, ফিরে আসছে সোয়্যাগ, ফিরে আসছে ধুন্ধুমার অ্যাকশন, ফিরে আসছে গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ, ফিরে আসছে প্রেজেন্স, ফিরে আসছে শরীর। ইরফানদের মাধ্যমে, এখানে ইরফানের একার কথা বলা ঠিক হবে না, মনোজ বাজপেয়ী-জাকির হুসেন এবং তৎপরবর্তীকালে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, পঙ্কজ ত্রিপাঠী, রাজকুমার রাও থেকে নতুন সময়ের অভিনেতা আদর্শ গৌরব— সবাই কীরকম যেন একটু ব্যাকফুটে চলে গেলেন। কারণ ভারতবর্ষে বিনোদন, স্নায়ু থেকে আবার যেন শরীরে ফিরে গেল। মস্তিষ্ক থেকে, হৃদয় থেকে, আবার যেন এইট প্যাকে ফিরে গেল। চিতল পেট, ভাল বাইসেপ, উঁচু কাঁধ এবং দাড়ির নীচে একটু হাত বুলিয়ে পৃথিবীকে হুংকার দেওয়া যে আমিই শ্রেষ্ঠ— এরকম একটা রাজতন্ত্রে, দেশের শাসনব্যবস্থার মতোই, দেশের বিনোদন ব্যবস্থাটাও ফিরে গেল।
আরও পড়ুন : সত্য স্পর্শ করার দায় একান্তভাবে অভিনেতারই থাকে…
বহুদিন আগে মানুষের মনে যে আঙুল রাখা শুরু করেছিলেন ভারতীয় অভিনেতারা, যাঁদেরকে আমারা অল্টারনেটিভ অভিনেতা বলি, আপামর ভারতের মানুষেরা যাঁদেরকে আর্ট ফিল্মের সূত্র ধরে চিনেছে, নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরী— তাঁরা ফুরিয়ে গেলেন। তবে এও ঠিক, ভারতীয় সিনেমার জগৎ এত বৃহৎ, এত বৈচিত্রময় ছিল, সেখান থেকে মোগ্যাম্বো ছাড়াও আমরা অসাধারণ-অদ্ভুত কিছু রোলে অমরিশ পুরীকে পেয়েছি। এই ভারতীয় সিনেমার মধ্যেই আমরা শশী কাপুরকে পেয়ে গেছিলাম গিরিশ কারনাডের ‘উৎসব’ ছবিতে, সম্পূর্ণ অন্যরকম এক রোলে। এই ভারতের ‘সারাংশ’ ছবিতেই অনুপম খের নামক এক অভিনেতার বিস্ফোরণ ঘটে। এই ভারতেই শ্যাম বেনেগাল, গোবিন্দ নিহালনি, এঁরা নানারকম ছবির মাধ্যমে এই সমস্ত অভিনেতাদের তুলে ধরেন, এবং এই অভিনেতারা ইরফানের মতোই বিভিন্ন কমার্শিয়াল ছবিতে সফলতার সঙ্গে অভিনয় করলেও, আসলে ভারতের কিছু সংখ্যক মানুষের কাছে এঁরা উচ্চমানের অভিনেতা হয়ে থাকেন বেশ কিছু দুরন্ত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। যে-চলচ্চিত্রের মূল উদ্দেশ্যই ছিল প্রশ্ন করা, একটা আলোচনাকে তুলে আনা, এবং মানুষের মনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরে গিয়ে স্পর্শ করা।
সব দেশের সব অভিনেতা এটা পারেন না। আমাদের দেশেও সকলে এটা পারেননি। সমস্ত প্রজন্ম পেরিয়ে এসে যাঁরা পেরেছেন, ইরফান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অগ্রগণ্য বলা চলে। এই মুহূর্তে ভারতের যে-সমস্ত অভিনেতা জীবিত, তাঁরা প্রত্যেকেই এ-কথা স্বীকার করেন।
আমি কলকাতা শহরের একজন অভিনেতা। আমরা মূলত কলকাতাতেই অভিনয় করি, কলকাতার মানুষজনই সেসব দেখে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গ না বলাই ভাল, কারণ আমাদের বিস্তার বা ব্যাপ্তি সত্যিই গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে নয়। গ্রামগঞ্জের মানুষজন যেটুকু আমাদের দেখে থাকেন, সেটা আমাদের অভিনয় নয়; কিছু সাক্ষাৎকারের টুকরো, ভাইরাল সংলাপ, সিনেমার রিল— এইসব। আমরা যে-কাজ করি, সেই কাজটার যে একটা পূর্ণাবয়ব আছে, আমাদের সেই আসল কাজটুকুও কলকাতার একটা সীমিত অংশের মধ্যে আবদ্ধ। সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত কয়েক মাসে যে-দুটি ছবি ব্যাবসায়িক সাফল্য লাভ করল, সেগুলিও মেরেকেটে দেখেছেন বড়জোর ১০ থেকে ১৫ লক্ষ মানুষ। কলকাতায় থাকেন এক কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ। ফলত বোঝা যাচ্ছে, বাংলা ভাষার অভিনয়ের ব্যাপ্তি, এই বাংলাতেই আর সেরকম আলোচনাযোগ্য নয়।
এইরকম একটা অবস্থায় বসে, কলকাতার একজন অভিনেতা হিসেবে, আমি ভেবেছিলাম অভিনয় দিয়ে মানুষকে স্পর্শ করার কথা। এখনও ভাবি। মানুষের এমন সত্য, যা মানুষ ঘুম থেকে উঠেই চোখ খুলে দেখতে পায় না, বা সমস্ত অনুভূতির মধ্যেও খুঁজে পায় না— সেই নিবিড় সত্যগুলোতে অত্যন্ত সহজভাবে একটা হাত রাখতে চেয়েছিলাম। সুইচ টেপার মতো করে চেয়েছিলাম একটা নতুন দরজা খুলে দিতে। চোখের মধ্যে দিয়ে, শরীরের মধ্যে দিয়ে, সংলাপের মধ্যে দিয়ে, তাকিয়ে থাকিয়ে থাকার মধ্যে দিয়ে। হাতের মাসলের মাধ্যমে নয়, চিতল পেটের সিক্স প্যাকের মাধ্যমে নয়, চওড়া কাঁধের মাধ্যমে নয়, এমনকী দাড়িতে হাত বুলিয়ে বা চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়েও নয়।
ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে সেটি অবশ্যই একটি আঙ্গিক, এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক; কিন্তু ভারতবর্ষ এমনই এক বৈচিত্রময় দেশ ছিল, যেখানে আজ থেকে এক দশক আগেও হয়তো শত ফুল বিকশিত হতে পারত, আমাদের দেশ আর সেই দেশ নেই। ফলত আমাদের দেশ এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে ইরফান খানের না থাকাই ভাল। ইরফান খানের মতো মানুষকে লালনপালন করার জন্য এবং ঠিক ভাবে সম্মান জানানোর জন্য আমাদের দেশ আর প্রস্তুত নয়। রাজিও নয়। আমাদের দেশ উলটোদিকে ঘুরে গেছে। হিংসার দিকে, বলের দিকে, শরীরের দিকে। মস্তিষ্ক এবং হৃদয়ের দাম এখন খুবই কম। আমাদের দেশে শ্রদ্ধার অপর নাম হয়ে উঠেছে ‘ফ্যানাটিজম’। অভিনেতা, ক্রিকেটার কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব— পাগলের মতো প্রভু রূপে সবাইকে পুজো করা হয়।
ইরফান যে অভিনয় করেছেন, কিংবা ধরা যাক তাঁর পূর্বসূরি বা উত্তরসূরিরা, অভিনয়ের একজন ছাত্র হিসেবে যদি আমি নিজের কথাও বলি— আমরা সবাই যে-জলের স্পর্শ পেতে চাইছিলাম এবং আমাদের দর্শকদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইছিলাম, সেই মন এবং মাথা আমাদের দেশ থেকে প্রায় নিঃশেষিত হয়ে আসছে। আমি জানি রবি ঠাকুর বলেছেন, ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’, সেটা অনন্তকালের মানুষকে নিয়ে বলেছেন; কিন্তু আমাদের ‘দেহ পট সনে নট সকলই হারায়’। আমরা আমাদের সময়কালের মধ্যেই বাঁচি। আমাদের যা শিল্প, যা সৃষ্টি, সব আমাদের সময়ের মধ্যেই করে যেতে হয়।
যেহেতু ইরফানের অভিনয় ধরা রইল আমাদের কাছে, হয়তো এমন একটা সময় আসবে, যখন সারা পৃথিবীর মানুষ চমকে উঠবেন এই ভেবে যে, একজন অভিনেতা কী করে তাঁর চোখের মাধ্যমে, শরীরের মাধ্যমে বা সংলাপের মাধ্যমে এইরকম একটা গভীর সমুদ্রের সন্ধান দিতে পারেন। আজকের দেশ, সে-দেশ নয়।
আমরা সৌভাগ্যবান শুধু এই কারণে যে, কারণ যখন ইরফান অভিনয় শুরু করেন, তাঁর প্রতিভার মধ্যগগনে, তখনও দেশটার মধ্যে একটা নরম হৃদয়, একটা সহনীয় মস্তিষ্ক ছিল— যেখান থেকে ইরফানকে অন্তত আমরা চিনে নিতে পেরেছিলাম। আজ আমরা নতুন অভিনেতাদের চিনে উঠতে পারছি না। কারণ, আমাদের হৃদয় আর মস্তিষ্ক আর তেমন নেই।
এখন এত মতামত জানানো হয়, এবং বিশেষ করে শিল্প নিয়েই জানানো হয়, এবং শিল্প বলতেও, শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে নয় কিন্তু, অভিনয় নিয়ে জানানো হয়— কারণ সিনেমা আলোচনা ও সমালোচনার জন্য এত সহজ বিষয়। তাই ইরফানের ‘আন্ডার-অ্যাকটিং’ বা ‘নন-অ্যাকটিং’ নিয়ে যা কথা হয়, তার প্রেক্ষিতে আমি কোনও মন্তব্য করব না।
ইরফান তাঁর চরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে এমন একটা দিঘির মতো, ছায়ার মতো নিবিড় আশ্রয় তৈরি করতে পেরেছিলেন, যেখান থেকে তাঁর অভিনয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল অদ্ভুত একটা গাছের মতো। ম্যাকবেথের মতো ভয়ংকর ক্ষমতালোভী চরিত্রেও সেই ছায়া আমরা দেখেছি, দেখেছি ‘লাইফ অফ পাই’-তেও, দেখেছি ‘আংরেজি মিডিয়াম’-এর চরিত্রে, দেখেছি পিকুর বন্ধু বা ড্রাইভারের চরিত্রেও। আর এই সমস্ত চরিত্রেই ইরফান কেমন যেন ব্রেখটের এলিয়েনেশনের মাধ্যমে বা উলটোভাবে, সেই চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে দর্শকদের জানান দিতেন, আমরা মানুষ, যে মানুষ চাষ করেই ভালবাসা ফলিয়েছে।
ভারতীয় সিনেমা যে টাকা, সংখ্যা, লগ্নি এবং লাভ— এই অঙ্কেই আটকে যাবে, এইটাই সিনেমার সমার্থক হয়ে যাবে ভারতে, সেটার কারণ ইরফানের মৃ্ত্যু নয়। ইরফান বেঁচে থাকলে তাঁকে এই ব্যবস্থাটার মধ্যেই থাকতে হত। কিন্তু ঘটনাটা এমন সময়ে ঘটেছে, যাতে ইরফানের মৃত্যুটাকে একটা যবনিকা পতন বলে মনে হয়। কিন্তু সিনেমা ও অর্থর এই সমার্থক হয়ে ওঠা, এটার প্রস্তুতি আগে থেকেই, ২০১৫-’১৬-র সময় থেকেই চলছিল।
অনেকক্ষণ হতাশার কথাই বললাম। কিন্তু মুম্বইয়ের নতুনদের কথা যেমন বললাম, এখানেও দুর্বার, সুহোত্র, উজান, সুরাঙ্গনা, ঋদ্ধি, অঙ্গনারাও আছেন। কাজেই, যাঁদের মন এখনও সংবেদনশীল, তাঁদের কিন্তু এখনও ভেঙে পড়ার কোনও কারণ নেই। কারণ হৃদয়ের শিল্প, মনের-মস্তিষ্কের শিল্প যাঁরা করতে চান, তাঁরা কিন্তু সকলে এখনও ঘরে ঢুকে যাননি, তাঁরা কাজ করছেন। ফলে, ফাঁকা মাঠে এখনই গোল দেওয়া যাবে না। এই টিমেও কিছু খেলোয়াড় এখনও আছেন। তাঁদের কষ্ট করতে হচ্ছে, হবেও, কিন্তু খেলোয়াড়রা আছেই।
মনে রাখবেন, হতাশা আমাদের ভিত্তি, সুদিন আমাদের ভবিষ্যৎ।