রিকশাওয়ালার ছেলে ও বাঙালির দুর্নীতি
ডাক্তার হওয়ার আর পাঁচটা সুবিধের মধ্যে একটা হল, অনেক রকমের মানুষের সঙ্গে আলাপ হওয়া। ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, যৌন পছন্দ এবং আরও যেসব বিভাজন-রেখা আছে, সেই সব নির্বিশেষেই মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়। এবং ক্রাইসিসের মুহূর্তে আলাপ হয় বলে, তাঁরা নিজেদের উজাড় করে কথা বলেন। অনেক গল্প জানা যায়।
শুধুমাত্র এই কারণে শিক্ষিত, বাঙালি, হিন্দু, কলকাত্তাইয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাইরে হরেক কিসিমের মানুষ দেখে আসছি দীর্ঘ সময় ধরে। অজ-পাড়াগাঁ থেকে কলকাতা, মফস্সল থেকে জেলাশহর, শহরতলি থেকে কলকাতার আন্ডারবেলি— সব জায়গার মানুষ দেখা। এঁদের দেখি ভয়ংকর কৌতূহলপ্রবণ একটা মন নিয়ে, যে মন সবসময় গল্প খুঁজছে। যখন লেখালিখি শুরু করিনি, তখন থেকেই এই অশালীন কৌতূহল আমার সঙ্গী।
আমার অনেক গল্প-উপন্যাসে সেইসব মানুষ এবং তাঁদের সঙ্গে আমার ইন্টারঅ্যাকশনের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে। উঠে এসেছে নানা ঘটনা। প্রতিটি চিকিৎসকের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ঠাকুরমার ঝুলি বা ঠানদিদির থলের থেকে অনেক বেশি গল্প থাকে। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ বা জীবন-মৃত্যুর আলো-আঁধারিতে আঁকা নানা গল্প।
আরও পড়ুন : মিশনারিদের কাছে আর ফিরব না, কাতর কণ্ঠে বলেছিলেন অসুস্থ তরুণী, পড়ুন সঞ্জয় ঘোষের কলমে মেডিসিনারি : পর্ব ২…
আমারও আছে। সেই থলে থেকে বেছে নিলাম ১৯৯৩ সালের একটি ঘটনা।
আমি তখন শেয়ালদার মেডিকেল কলেজ থেকে স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যায় হাউসস্টাফশিপ শেষ করে কর্মহীন সময় কাটাচ্ছি। ‘পাবলিক সার্ভিস কমিশন’ বা পিএসসি-র পরীক্ষা দিয়ে ‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি…’; কিন্তু নিয়োগপত্র হাতে আসেনি। সেটি আসছে ধাপে ধাপে। প্রথম তালিকায় আমার নাম ছিল না। পরের তালিকা কবে প্রকাশ হবে, কেউ জানে না। এই সময় সবাই যা করে, আমিও সেটাই করছিলাম। বাড়িতে বসে তেড়ে পড়াশোনা করছিলাম এমডি-র প্রবেশিকা পরীক্ষায় চান্স পাওয়ার জন্য।
পড়তে আপত্তি নেই, কিন্তু বাবার হোটেলে খেতে বাধো-বাধো ঠেকছিল। টুকটাক হাতখরচ তোলার আশায় আমি তিন মাসের জন্য সার্জারিতে হাউসস্টাফশিপ করি শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে। শল্যচিকিৎসা বেছে নেওয়ার পিছনে নির্দিষ্ট যুক্তি ছিল। আমি যেহেতু এই বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা করব না, তাই অল্প সময়ের মধ্যে কিছু কাজ শিখে নেওয়া যাক।
শম্ভুনাথে যোগ দেওয়ার পর আমার আসল আগ্রহ তৈরি হল জায়গাটা নিয়ে। লি রোড, এলগিন রোড, বিশপ লেফ্রয় রোডে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধেগুলো কেটে যেত। তিব্বতি এক পরিবারের একটি দোকান রয়েছে ওখানে, ‘হমরো মোমো’ নামে। সেটি ওঁদের বাড়ির বসার ঘর। সেখানে রোজ মোমো বা থুকপা খেতাম। তিব্বতি খাবার তখন কলকাতার ওই এক জায়গাতেই পাওয়া যেত। লক্ষ্মীবাবুর সোনাচাঁদির দোকান, লক্ষ্মীবাবুর আসলি সোনাচাঁদির দোকান, আসলি লক্ষ্মীবাবুর সোনাচাঁদির দোকান, লক্ষীবাবুর সোনাচাঁদির আসলি দোকান— দেখে দেখে আশ আর মিটত না।
আর ছিল ওয়ান বাই ওয়ান বিশপ লেফ্রয় রোড। রোজ বাড়িটার সামনে দিয়ে যেতাম আর ঘাড় উঁচু করে দেখতাম। সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর দিন রবীন্দ্র সদন চত্বরে গিয়েছিলাম দীর্ঘ সময়। সেটা ১৯৯২ সাল। ১৯৯৩ সালে তিনি আর নেই। আমি কখনও বাড়িতে ঢোকার কথা ভাবিনি। এখন মনে হয়, চলে গেলে খারাপ হত না।
কথা হচ্ছে ডাক্তারি জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। সেই সূত্রে মনে পড়ল, প্রৌঢ়, বিহারি এক রিকশাওয়ালার কথা। তিনি আউটডোরে এসেছিলেন পুরুষাঙ্গে ঘা নিয়ে। বছর পঞ্চাশের মানুষটি ধুতি ফাঁক করে যা দেখালেন, সেটা দেখে ফাইনাল ইয়ারের ডাক্তারি ছাত্রও বলে দেবে যে, পুরুষাঙ্গে কর্কটরোগ হয়েছে। পরিভাষা ব্যবহার করলে, ‘পেনাইল ক্যানসার।’
রিকশাওয়ালার বাড়ির লোক হিসেবে এসেছিলেন তাঁর ছেলে। ছেলেকে একবার দেখলেই বোঝা যায়, সদ্য কলকাতার পা রেখেছে। কলকাতার জল গায়ে পড়েনি। বাবার অসুস্থতার কথা শুনে ছুটে এসেছে। বছর ত্রিশেক বয়স, পরনে নোংরা প্যান্ট আর জামা, পায়ে হাওয়াই চপ্পল। শুনলাম সে বিবাহিত, তিন সন্তানের বাবা। রিকশাওয়ালার স্ত্রী মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে।
এই রোগের মূল চিকিৎসা হল পুরুষাঙ্গ কেটে বাদ দেওয়া। রোগ কতটা ছড়িয়েছে, তার ওপরে নির্ভর করে অংশবিশেষ বা পুরোটা বাদ দিতে হয়। আবার পরিভাষা ব্যবহার করি। ‘পার্শিয়াল পেনেকটমি’ বা ‘টোটাল পেনেকটমি।’ এইরকম শল্য চিকিৎসায় কোন পুরুষই বা রাজি হতে চায়? যে কারণে স্তনের ক্যানসারে স্তন বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠলে মহিলারা ভেঙে পড়েন, সেই কারণেই ছেলেরাও ভেঙে পড়েন। রোগী বা তাঁর ছেলে কেউই রাজি হলেন না চিকিৎসা পদ্ধতি জেনে। অনেক বোঝানোর পরে ছেলে প্রথমে রাজি হলেন। তিনিই বাবাকে যা বোঝানোর বুঝিয়েছিলেন।
আমি বরাবরই মিচকে টাইপের। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কীভাবে বাবাকে রাজি করালেন?’
ছেলে বলেছিলেন, ‘বাবাকে বললাম, অপারেশন না করালে তুমি মরে যাবে। মরে গেলে ওটা কোনও কাজেই লাগবে না।’
রোগী ও তাঁর বাড়ির লোক রাজি হওয়ার পরে অপারেশন হল। তারপরে শুরু হল ক্ষতস্থানের পরিচর্যা বা ড্রেসিং। প্রথম দু’দিন আমি নিজের হাতে ড্রেসিং করেছিলাম। তারপরে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তিনদিন ছুটি নিই। ছুটির পরে কাজে ফিরে জানতে পারি, আগামিকাল রোগীকে ছুটি দেওয়া হবে।
সেদিনও আমিই ড্রেসিং করলাম। দেখলাম, ক্ষতস্থান প্রায় শুকিয়ে গেছে। ছুটির আগে আর-একবার ড্রেসিং করে দিলেই হবে। যে সিনিয়র চিকিৎসকের অধীনে রোগী ভর্তি ছিলেন, তিনি জানিয়ে দিলেন, আগামিকাল ছুটি দেওয়া হবে। সেটা জেনে রোগী খুব খুশি। আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলেন। বিকেলের রাউন্ডে যখন তাঁকে দেখতে গিয়েছি, তখন জানালেন, ‘আমি আর কলকাতায় থাকব না বাবু। গাঁও চলে যাব। আমার রিকশাটা এখন থেকে ছেলে চালাবে।’
পরের দিন বাপ-বেটা মিলে যখন ব্যাগপত্তর নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন, তখন আমি অন্য রোগীর কাজে ব্যস্ত। ছেলে আমার কাছে এসে হিন্দিতে বলল, ‘স্যর, একটু দরকার ছিল। এদিকে আসবেন?’
আমি কাজ ফেলে সিঁড়ির কাছে গেলাম। ছেলে আমার হাতে একশো টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বলল, ‘বহোত শুকরিয়া সাব।’
মনে আছে, খুব রেগে গিয়েছিলাম। ছেলেটিকে ধমক দিয়ে বলেছিলাম, ‘ডাক্তারি করার জন্য সরকার থেকে আমাকে মাইনে দেয়। তুমি টাকা দেওয়ার কে হে?’
ছেলে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বুঝতে পারছে না, কী ভুল করেছে।
আমি নিজেকে বোঝালাম, আমারই দোষ। এত উত্তেজনা অর্থহীন। ওরা, মানে গরিব বিহারিরা আজও জেনে উঠতে পারেনি যে, টাকা দিয়ে সবকিছু কেনা যায় না। আমরা, বাঙালিরা অন্য ধাতুতে গড়া।
নিজেকে মহৎ ভেবে যথেষ্ট ইগো-মালিশ হল। করুণার দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমাদের এখানে এরকম হয় না। তোমার বাবাকে সুস্থ করে তোলা আমাদের কর্তব্য। এর মধ্যে টাকাপয়সা আসছে কেন?’
‘সেই জন্য দিইনি তো!’ ছেলেটি বিস্মিত হিয়ে বলল, ‘ড্রেসিং করার জন্য দিয়েছি। আপনি যে তিনদিন ছিলেন না, সেই ক’দিন ড্রেসিং করে ‘ওমুকদা’ টাকা নিল। আপনার আগের দু’দিনের ড্রেসিং করার টাকাও নিল। এখন পরের দু’দিনের টাকা দিচ্ছি। রেখে দিন বাবু।’
‘ওমুকদা’ ছিলেন হাসপাতালের এক অচিকিৎসক কর্মচারী। ‘অচিকিৎসক’ শব্দটি লিখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! যাক! আমার পেশার কারও নিন্দে করিনি। আজ জানি, কোনও পেশারই একশো শতাংশ মানুষ ধোয়া তুলসীপাতা হতে পারে না। আর জানি, বাঙালিরাও সুযোগ পেলে ফাটিয়ে দুর্নীতি করতে পারে।
এই শিক্ষা আমাকে দিয়েছিলেন সেই বিহারি রিকশাওয়ালার ছেলে।