১৯৬১ সালে শেষ হল ঋত্বিককুমার ঘটকের চার নম্বর ফিচার ছবিটি, ‘কোমল গান্ধার’। এর আগে দু’টি বোমা তিনি ফেলেছিলেন, ‘অযান্ত্রিক’ এবং ‘মেঘে ঢাকা তারা’, এবং তারপরেও এহেন বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়াননি সেসময়ের প্রযোজককুল। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার— (পড়ুন প্রযোজক নেই, পয়সা নেই, এমনকী, বগলে একখানা হার্ড বাউন্ড স্ক্রিপ্ট অবধি নেই) জিনিয়াস এক ফিল্মমেকার, নেমে পড়লেন সিনেমা বানাতে। তাহলে এই পরিচালকের আছেটা কি? আছে এমনই প্রতিভাবান একদল পাগল কলাকুশলী, যাঁরা এই অসম্ভব মানুষটিকে আর তাঁর সিনেমাকে বিশ্বাস করেন, এবং আছেন এক তৎকালীন সুপারস্টার, ভারতীয় সোফিয়া লোরেন, সুপ্রিয়া দেবী। সুপ্রিয়া চৌধুরীর হাতে তখন দারুণ সব বড় বড় প্রজেক্ট– শুটিং চলছে একাধিক শিফ্ট-এ। এদিকে তিনিই আবার ঋত্বিক ঘটক-এর ‘কোমল গান্ধার’-এর অনসূয়া।
প্রযোজক ছাড়া, অর্থ ছাড়া পরিচালক, যখন যেমন পারেন, যেভাবে পারেন কিছু টাকা জোগাড় করেন এবং তুলে নেন ছবির খানিকটা দৃশ্য। সুপ্রিয়া হয়তো তখন শুট করছেন অন্য একটি ছবি। তারই মাঝখানে ঋত্বিক এসে তাঁকে প্রায় তুলে নিয়ে গেলেন কয়েকটি শট-এর জন্য। সুপ্রিয়াও চালু শুটিং-এর পরিচালকের হাতে-পায়ে ধরে হয়তো দু-তিন ঘণ্টা ম্যানেজ করলেন। সুপ্রিয়া জানতেন, ঋত্বিক-এর ছবির জন্য এক পয়সাও পাবেন না তিনি, জানতেন মাঝে মাঝেই ছবির সেট থেকে এভাবে উধাও হয়ে যাওয়া, সেই শুট থামিয়ে রেখে অন্য শুটে চলে যাওয়া, ওঁরই ‘রেপুটেশন’ খারাপ করবে, বাজারে বদনাম ছড়াবে। খুব ভাল করেই জানতেন যে প্রডিউসার, ডিরেক্টরকে ওইসব সাংঘাতিক সব গুলগপ্পো দিয়ে তিন-চার দিন বেমালুম গায়েব হয়ে, ‘কোমল গান্ধার’-এর কিছুটা করে আউটডোর শুট করে আসার চক্করে ওঁর পিনাকল-এ থাকা কেরিয়ার বেমালুম হাওয়া হয়ে যেতে পারে।
তবুও সুপ্রিয়া যা করেছেন তা বোধহয় একমাত্র তিনিই পারতেন— সেই সময়ে, এই সময়েও।
আরও পড়ুন : ফল আর দু-পেগ স্কচেই বাজিমাত হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের…
সুপ্রিয়া দেবী-র নাম উঠে আসলেই, ‘ফেভিকলের মজবুত জোড়’-এর মতোই হাতে হাত ধরে উঠে আসে ‘উত্তমকুমার’-এর নাম; অথচ আমার মনে হয়, সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে নামটির উঠে আসা উচিত— সে নাম, ঋত্বিককুমার ঘটক।
১৯৬০-এ, ঋত্বিক-এর ‘নীতা’ হলেন সুপ্রিয়া। ছবির নাম, ‘মেঘে ঢাকা তারা’। সুপ্রিয়ার অভিনয় নিয়ে হয়তো তেমন সংশয় ছিল না কারও কিন্তু তা নিয়ে উৎসাহও ছিল না তেমন। তিনি ছিলেন অনেকটাই গ্ল্যামারাস, স্টার মেটেরিয়াল। বাঙালি গড়পড়তা হাইট-এর চেয়ে বেশ খানিকটা লম্বা, ছিপছিপে ফিগার-এর মেয়েটি। সেই সময়ের একমাত্র নায়িকা, যিনি দারুণ নৃত্যশীল্পিও। হাই চিক-বোন, কাটা কাটা চোখ-মুখ, দারুণ স্টাইলিশ এবং ততটাই সাহসী পোষাক আর মেক-আপ-এর ক্ষেত্রে— রীতিমত আন্তর্জাতিক, তেমনটি আর কেউ নন। এই মেয়েকে সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, তরুণ মজুমদারের ছবিতে হয়তো মানায় না, মানে আপাত-ভাবনায় এমনটাই মনে হতে পারে। সত্যজিৎ রায়-এর কথা বিশেষভাবে যদি বলি, তাঁর সিনেমার নারীচরিত্রগুলির চেহারার, মুখাবয়ব-এর একটি বিশেষ গড়ন-ধরন আছে— একধরনের পেলবতা, কমনীয়তা। এমনকী, ‘মহানগর’-এর আরতির মতো একটি শক্তিশালী চরিত্রেরও দাঁড়ানোতেও, হাঁটাচলাতেও যে বডি-ল্যাঙ্গুয়েজটি— সেটি বেশ ‘ফেমিনাইন’। তৎকালীন সমসাময়িক মাস্টারদের মধ্যে, একমাত্র ঋত্বিক ঘটকের ছবিতেই আমরা এমন একজন অভিনেত্রীকে পাই, যার শরীরী ভাষা চ্যালেঞ্জ জানায় ‘হিরোইন’-কে দেখার চিরাচরিত দৃষ্টিকোণকে। সুপ্রিয়া রীতিমতো গ্রিক-হিরোদের মতো রোবাস্ট, সটান, কুণ্ঠাহীন। তাঁর পদক্ষেপে পেলবতার থেকে বেশি জানান দেয় সত্তা-বোধ।
নীতার চরিত্রে সুপ্রিয়া দেবীর অনবদ্য অভিনয় চমকে দিয়েছিল সারা দেশকে, আজও তার দাপট কিছু কম না। ওই চরিত্রটি আর কাউকে দিয়ে রিপ্লেস করা সম্ভব না। অসামান্য অভিনেত্রী হয়তো অনেকেই আছেন, কিন্তু নীতার চরিত্রে, বলিদানের মধ্যেও যে অহংটুকু, মাথা না-নোয়ানোর যে রোয়াবটুকু তাকে ব্যতিক্রমী করে তোলে— তা সুপ্রিয়া দেবীর প্রত্যেকটি চলনেবলনে, পিঠ সোজা করে, ঘাড় উঁচু করে হেঁটে যাওয়াতেই প্রকাশিত হয়।
সুপ্রিয়া দেবী যে ঠিক কী মাপের অভিনেত্রী, তা বোঝাতে ওই একটি ছবিই হয়তো যথেষ্ট, কিন্তু ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র ঠিক পরের বছরেই সুপ্রিয়া অভিনয় করলেন নীতার একটি সম্পূর্ণ উল্টো চরিত্রে, ঋত্বিক ঘটকেরই ‘কোমল গান্ধার’-এর অনসূয়ার চরিত্রে। অনসূয়ার মতো চরিত্র এখনও খুব একটা দেখা যায়নি বাংলা তথা জাতীয় সিনেমায়। অনসূয়া একটি মেয়ে, যে আদতে একজন নাট্যকর্মী। সে পরিচালক, অভিনেতা, সংগঠক, অনসূয়া নাট্য-বিপ্লবের অংশও। এই মেয়ের ধ্যান, জ্ঞান, জীবন— নাটক বা থিয়েটার। আপাদমস্তক শিল্পী মেয়েটি নিজে যথেষ্ট পরিচিত নাট্যশিল্পী হয়েও, অন্য দলের এক্সট্রা হয়ে স্টেজ-এ নামে, কারণ সে ভাবতেই পারে না, কোনও অবস্থাতেই নাটকের কোনওরকম ক্ষতি হয়ে যাওয়ার কথা। সে স্বপ্ন দেখে, দুই দল মিলে একটি বড় প্রোডাকশন নামানোয়, এমন একটা কাজ করার— যা ছাপ রেখে যাবে ইতিহাসে। এই কর্মকাণ্ডে ঝাঁপ দেওয়ার আগে তার মাথায় আসে না এই দুই দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, নোংরামি, খেয়োখেয়ির কথা। সে বুঝতেই পারে না, ভেতরে ভেতরে কতরকম দলাদলি আর খেলা চলছে প্রোডাকশনটির বারোটা বাজানোর জন্য। অনসূয়া সেই রোম্যান্টিক, আদর্শবাদী জাত-শিল্পী, যে একজন নারী। হয়তো কিছু বায়োপিক বাদে মহিলা শিল্পীর ওপর কোনও উল্লেখযোগ্য কাজ— সিনেমা এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বিশেষ মনে করতে পারি না। পুরুষ নির্মাতারা জানেনই না হয়তো, নারী শিল্পীর জগৎ ও ভাবনা। স্বাভাবিকভাবেই তাই আজও অধরা – একজন ‘ওম্যান আর্টিস্ট’-এর পোর্ট্রেট।
‘কোমল গান্ধার’-এর প্রথম দৃশ্যেই সুপ্রিয়ার প্রেমে পড়তে হয়। পারলে ফ্রেম ফ্রিজ করে দেখি, এরকমই বোন স্ট্রাকচারের একটি মুখ আর তেমন ছাড়ানো, সুঠাম এক শরীর। এঁকে অনায়াসে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায় ইতালীয় ছবির প্রেক্ষাপটে অথবা কাউবয় ফিল্ম-এর টেক্সান চারাচরে— চুল চুড়ো করে নট করা, পায়ে হাই বুটস, হাতে একটা ডবল-ব্যারেল শটগান। সুপ্রিয়াকে বলা চলে, ‘হ্যান্ডসম লেডি’। ভৃগুর সঙ্গে প্রেমও যখন সে করছে, কেঁদে ফেলছে যখন ভালবাসারই ঘায়ে, তখনও তার বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ কী আত্মবিশ্বাসী, কী অনায়াস! এই যে দুই ভালবাসার পুরুষকে ঘিরে অনসূয়ার প্রেম-প্যাশন এবং দ্বন্দ্ব, অথচ সে-বিষয়ে তার অকপটতা, কোনওরকম কুণ্ঠা না-থাকা, এবং তার চেয়েও বড় কথা, শেষ অবধি কারও চয়েস না হয়ে নিজে চুজ করা— নিজের জীবন, নিজের যাপন, নিজের সঙ্গী বেছে নেওয়া— তা এই মুহূর্তেও সময়ের থেকে বহু পা এগিয়ে থাকা একটি অ্যাপ্রোচ। ভাবা যায়, ঋত্বিক এখানে তার আরেক চরিত্রকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছেন, অনসূয়া সম্বন্ধেই, সেই মান্ধাতা আমল থেকে আজ অবধি চলে আসা ‘স্লাট শেমিং’– ‘মেয়েটি একটি ফ্লার্ট, ওকে এভয়েড কর!’
উত্তম-সুপ্রিয়ার জুটির কাহিনি আমার কাছে পরম সম্মানের আর আদরের হলেও, সবচেয়ে প্রিয় নয়। আমার প্রিয় ‘অনসূয়া’-র স্রষ্টা ঋত্বিককুমার ঘটক আর ‘অনসূয়া’ চরিত্রে অনসূয়াকে অতিক্রম করে যাওয়া অভিনেত্রী, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আর ‘কোমল গান্ধার’-এর অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিরো, সুপ্রিয়া দেবীর যুগলবন্দি।
শুনেছি, উত্তমকুমার চলে যাওয়ার পর তাঁর মরদেহ নিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি তাঁর ময়রা স্ট্রিট-এর বাড়িতে, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী সুপ্রিয়া দেবীর কাছে। সুপ্রিয়া দেবী আর তাঁর মেয়ে সোমা দেবী এনটি ওয়ান-এ এসে তাঁদের সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে শেষবারের মতো দেখে গিয়েছিলেন। এর চেয়ে নক্কারজনক ট্র্যাজেডি কি আর হয়? জানি না। তবে একজন হাড়ে-মজ্জায় অভিনেতার কাছে বোধহয় এই ট্র্যাজেডিও কম না, যখন সেই পরিচালক অকালে চলে যান, যাঁর সঙ্গে সেই অভিনেত্রীর পার্টনারশিপে তৈরি হতে পারত আরও অনেক কালজয়ী, আন্তর্জাতিক মাস্টারপিস! ঋত্বিক-সুপ্রিয়াও, সত্যজিৎ-সৌমিত্র-র মতোই আবিশ্ব কুড়িয়ে নিত আরও কুর্নিশ।