একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষের দিকে আমি সচেতনভাবে নারীবাদ ও নারীবাদীদের পড়তে শুরু করি। সেলিব্রিটির ঔজ্জ্বল্য সরিয়ে সিমোন দ্য বোভোয়া, সেই সময় থেকে আমার পৃথিবীর মানুষ হতে শুরু করেন।
পৃথিবীতে ততদিনে উত্তর-নারীবাদের ঢেঊ আছড়ে পড়তে শুরু করেছে, এবং সেই ঢেউয়ের পরিধিতে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের পরিসরও ঢুকে পড়তে শুরু করেছে। এমনিতেই ‘নারীবাদ’ শব্দটা খুব সাবলীলভাবে ভারতীয় সামাজিক পরিসরে কখনওই উচ্চারিত হত না। নারীবাদের সঙ্গে সিগারেট, মদ, ডিভোর্স, বহুগামিতা, যৌন হতাশা, দায়িত্ব পালন না-করে বাপের সম্পত্তিতে লোভ— এগুলোকে সাবলীলভাবে জুড়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা বরাবরই ছিল। হিন্দু সম্পত্তি আইনে নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করা, ডিভোর্সের ক্ষেত্রে নারীর আর্থিক অধিকার সুরক্ষিত করা, গৃহস্থালির হিংস্রতা থেকে নারীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য কড়া আইন প্রণয়ন— এই ব্যাপারগুলি তথাকথিত ভদ্রলোক ভারতীয় পুরুষদের উত্তর-নারীবাদের ঢেউয়ে গা-ভাসানোর জন্য প্রয়োজনীয় অজুহাত তৈরি করেছিল।
মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিসরে লিঙ্গসাম্য এসে গেছে, এই সমাজে মেয়েরাই তো বেশি সুবিধা পায়, কোর্টের দৌলতে ডিভোর্স করবে আর অ্যালিমনির মোটা টাকা আদায় করবে, শুয়েই তো এক্সাম টপ করবে, ঢলাঢলি করে পুরস্কার বাগাবে, সুবিধাও নেবে আবার ইক্যুয়ালিটিও চাইবে— এই লব্জগুলি যখন লজ্জাহীনভাবে বলা শুরু হয়েছিল, বোভোয়াকে সেই সময়েই আমি পড়তে শুরু করি। ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ পড়ার সময় তাই নারীর সত্তার ‘সুবিধাবাদী ধান্দাবাজ’ ট্যাগটি আমি কিছুতেই সরিয়ে রেখে পড়তে পারতাম না। এর ফলে আমার নিজস্ব এক বোভোয়া গড়ে উঠছিল। পড়া চলাকালীন আমি দু-তিনটে নোট নিয়েছিলাম। সেই নোটগুলো মোটামুটি সাজিয়েগুছিয়ে নিচে লিখছি।
আরও পড়ুন : অলৌকিকতা তাড়া করে বেড়িয়েছিল রিলকে-কে…
১) যদিও ভারতীয়, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, ভারতীয় বাঙালি সাবর্ণ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজে লিঙ্গসাম্য চলে এসেছে বলে মনে করা হয়, তবুও কোনও এক অজানা কারণে নারীর নাগরিক পরিচয়পত্রে শুধুই বাবার নাম বা স্বামীর নাম বিরাজমান। বোভোয়া অতদিন আগে লিখে গেছেন, পিতৃতন্ত্রের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার একজন নারীকে পিতার কন্যা বা স্বামীর স্ত্রী-তে পরিণত করা। বোভোয়ার তত্ত্ব মেনে একবিংশ শতাব্দীতেও নাগরিক পরিচয়পত্রে ভারতীয় রাষ্ট্র একজন নারীকে শুধুমাত্র পুরুষের প্রেক্ষিত থেকেই দেখে। ভারতের এই প্রেক্ষিতে নারী তাই এখনও পুরুষের জন্যই নির্মিত হয়। সুতরাং, বোভোয়া যে লিখেছেন, নারীত্ব একটি নির্মাণ এবং সেই নির্মাণ সর্বদা পুরুষের প্রেক্ষাপট থেকেই— তা অস্বীকার করার জায়গা একবিংশ শতাব্দীর ভারতে এখনও অবধি নেই।
২) যদিও ভারতীয় বাঙালি সাবর্ণ মধ্যবিত্ত সমাজে নারী-স্বাধীনতার বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হয় মনে করা হয়, তবুও কোনও এক অদৃশ্য কারণে গর্ভধারণের অধিকারকে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি-নারীর অধিকার হিসেবে দেখা হয় না। এই ক্ষেত্রে নারীটির ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিসরে প্রাথমিকভাবে পারিবারিক হস্তক্ষেপ এবং খানিক দিন পর থেকে সামাজিক হস্তক্ষেপ অবাধ অনায়াসে হয়ে থাকে। মা হওয়াকে নারীর সর্বোচ্চ সত্তা হিসেবে ধরে নেওয়াই যথেষ্ট পিতৃতান্ত্রিক একটা স্বভাব, কিন্তু শুধু এই ধরে নেওয়াতেই না থেমে যখন একজন নারীকে মা হওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়— বোভোয়ার অতি পুরাতন কথাগুলি আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। নারীকে মা হিসেবে ভূমিকা পালন করাতে না পারলে পিতৃতন্ত্র চিরকাল উদ্বেগে ভুগতে থাকে। সম্ভবত, নিজের লিঙ্গের ক্ষমতায় প্রশ্নচিহ্ন আসা পিতৃতান্ত্রিক যে-কোনও মননকে বিপন্ন করে তোলে। তাই গর্ভের দখল নেওয়ার অবচেতন তখন বিবিধ সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য সচেতন হয়ে ওঠে। এমনকী, বাচ্চাকে দুধ না-খাওয়লে ব্রেস্ট ক্যানসার হতে পারে এই জাতীয় বিধিসম্মত ভয়ও দেখানো হয়। বোভোয়া নারীর মা হওয়া প্রসঙ্গে যে ক্যাথলিক গোঁড়ামির কথা লিখেছেন, তা অবলীলায় আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছুতোয় নারীকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করে চলে।
৩) যদিও ভারতীয় বাঙালি সাবর্ণ সমাজ নারীকে কোনও নির্দিষ্ট খোপে আটকাতে চায় না, তবু কোনও দৈবিক কারণে নারীর যাপিত অভিজ্ঞতার চেয়ে মিথকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে নারীকে বোঝার চেষ্টা কিছুতেই থামে না। দশভূজা মিথের চাপে রাত জেগে পিপিটি বানানো মা সকাল-সকাল উঠে ব্রেকফাস্ট বানানোর সময় গৃহ-সহায়িকাকে অন্তত সাহায্য না করতে পারলে নিজেই অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন। মায়ের হাতের রান্নার মিথের চাপে পড়ে নার্সিং পেশায় জড়িয়ে থাকা মেয়েটি ব্লেন্ডারে না-দিয়ে, শিলনোড়ায় মশলা বেটে মাংস রান্না করে এবং বরের কাছ থেকে ‘একদম মায়ের মতো হয়েছে’ সার্টিফিকেট পাওয়ার লোভ ছাড়তে পারে না। এই মিথ থেকে বেরিয়ে নারী যখনই নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ যাপনকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে, তখনই তাকে আর মায়ের মতো, মেয়ের মতো, বোনের মতো মনে হয় না। বোভোয়ার ছায়া স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে এই সময়। মিথের বাইরে গেলেই নারীকে যে ‘অপর’ হিসেবে দেখা হবে— তা তাঁর কাছ থেকেই তো শেখা।
নোটগুলো থেকে বুঝি, বোভোয়ার বিংশ শতাব্দীর টিপিক্যাল ইউরোপীয় অপরীকরণ মডেল দেশ, কাল অতিক্রম করে আমার কাছে এসে হাজির হয়েছে। আমার সময়েও মেয়েলি মিথ, নারীসুলভ আচরণ ইত্যাদির বাইরে গেলেই নারীর জন্য অপেক্ষা করে ‘পাগলি’, নইলে, ‘অনেকের সঙ্গে শুয়ে বেড়ায়’ ট্যাগ। এই সেই খুব চেনা পরিসর যেখানে নবজাগরণীয় মধ্যবিত্ত শিক্ষিত রুচির মুখোশকে সরিয়ে পিতৃতন্ত্র ভাণ ও ভণিতাহীন হয়ে নিজের দাঁত, নখ এবং নিজের লিঙ্গপরিচয়টি নির্লজ্জভাবে দিতে থাকে। এই নির্লজ্জ হিংস্রতাকে প্রতিরোধের জন্যই নারীবাদের ক্যানোপি।
অদ্ভুত ব্যাপার হল, এই পিতৃতান্ত্রিক হিংস্রতাকে প্রতিরোধ করতে করতে নারী নিজের সত্তার অনেকগুলো দিক নিয়ে ভেবে ওঠারই সময় পায় না এক জীবনে। ব্যক্তি-নারী তার ব্যক্তিসত্তায় জোর না দিয়ে নারীসত্তায় জোর দিতে বাধ্য হয় আত্মরক্ষার জন্যই। আর এই আত্মরক্ষার তাগিদই তাকে ধীরে ধীরে একটা আত্মমগ্ন পৃথিবীতে বাঁচতে বাধ্য করতে পারে। সে ভাবতে শুরু করতে পারে, তার এই প্রতিরোধ শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গের স্বার্থের জন্য। সে ভাবতে শুরু করতে পারে, এই প্রতিরোধ তাকে তথাকথিত বৃহত্তর পৃথিবী থেকে খানিক হলেও বোধহয় বিচ্ছিন্ন করছে। এইসব কারণে তার অজান্তেই, তার ভেতর জন্ম নিতে পারে এক হীনমন্যতাবোধ।
এই হীনমন্যতাবোধ কাটিয়ে তোলার জন্যই বোভোয়াকে পড়া দরকার। প্রতিটি পিতৃতান্ত্রিক পরিসরের চোখে চোখ রেখে সে যাতে উচ্চারণ করতে পারে সৃষ্টির সেই আদিম কথা— কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, বরং যথাযথভাবে বললে, নারী হয়ে ওঠে।