ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ইতিহাসের ক্ষত ও বিনোদিনী


    শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় (January 1, 2025)
     

    বিনোদিনী মঞ্চে অভিনয় করেছেন মাত্র বারো বছর। তিনি মঞ্চে এসেছেন ১৮৭৪ সালে, মঞ্চ থেকে অবসর নিয়েছেন ১৮৮৬-র ১ জানুয়ারি। এই সময়ে বিনোদিনীর বয়স কত? এই তথ্য সঠিকভাবে জানা না গেলেও, একটা হিসেব থেকে আন্দাজ করা যায়, ১৮৬১-১৮৬৩— এই সময়ের মধ্যেই বিনোদিনীর জন্ম। মঞ্চে আসার অল্পদিনের মধ্যেই, অচিরেই নজরে চলে আসেন তিনি। বিনোদিনীর ছবি খুব খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, বিনোদিনী তথাকথিত অর্থে ‘সুন্দরী’ ছিলেন না। বিনোদিনীর ঠিক পরেই যে-শিল্পী বাংলার মঞ্চ কাঁপিয়ে দিলেন, সেই তিনকড়ি আবার ছিলেন, সে-অর্থে বেশ সুন্দরী। অর্থাৎ, মূলত প্রতিভার জোরেই কিন্তু বিনোদিনীর এই প্রভাব বিস্তার। নৃত্যগীতপটিয়সী ছিলেন। বিনোদিনীর এক আশ্চর্য আকর্ষক ক্ষমতা ছিল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যেমন প্রভা দেবীর সম্পর্কে আমাদের বলতেন, প্রভা যখন মঞ্চে আসতেন, তখন মঞ্চ তিনি একাই অধিকার করে থাকতেন। আমাদের চলচ্চিত্রের দিকে তাকালে, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় বা সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের মতো শক্তিশালী অভিনেত্রীদের পাওয়া যাবে। বিনোদিনীর কাজের যে-‘স্পেকট্রাম’, তা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যেই দেখা যায়। কারণ, বিনোদিনী কেবলই মঞ্চসফল নন, তিনি সব ধরনের চরিত্রে সফল হয়েছেন।

    বিনোদিনীর লেখা থেকেই পরিষ্কার, গিরিশ ঘোষকে তিনি ‘গুরু’ মানতেন। নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছিলেন তিনি গিরিশের কাছে। নিষিদ্ধপল্লি থেকে আসতেন সেদিনের অভিনেত্রীরা। ফলে, একটা পুরুষনির্ভরতাও তৈরি হত। তাছাড়া তাঁদের কোনও ছুঁৎমার্গও ছিল না। শুধু তো মহড়়া বা নাট্যশিক্ষা নয়, এক ধরনের দৈনন্দিনতায় এঁরা জড়িয়ে যেতেন। বিনোদিনী নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন, গিরিশও এমন প্রতিভা পেয়ে ওঁকে পাগলের মতো ভালবেসে ফেলেছিলেন। শুধু তো গিরিশ ঘোষ নন, বিনোদিনীর ‘ভুনিদা’, অর্থাৎ, রসরাজ অমৃতলাল বসু, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির মতো অভিনেতারাও জড়িয়ে ছিলেন বিনোদিনীর জীবনে। এঁরাই ছিলেন বিনোদিনীর বৃহত্তর পরিবার। এঁদের সঙ্গে মিশে বিনোদিনী একরকম ঠিকই করেছিলেন, আর তিনি বড়লোক বাবুদের রক্ষিতা হয়ে থাকবেন না। দু’টি সম্পর্ক ওঁর ব্যর্থ হয়। তারপরেও তিনি গুর্মুখ রায়কে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কারণ, গুর্মুখ অবাঙালি, সংস্কৃতিসচেতন মোটেই ছিলেন না। গুর্মুখকে বড়লোকের রামবখাটে ছেলে বলা যায়। গুর্মুখকে গ্রহণ করতে বিনোদিনী কতকটা বাধ্যই হয়েছিলেন। গুর্মুখ বয়সেও ছোট ছিলেন বিনোদিনীর থেকে। তখন সে সবে গোঁফ-গজানো ছেলে। বিনোদিনী তাঁকে বলছেন, থিয়েটার বানিয়ে দিতে। তা না হলে, বিনোদিনীকে কোন জোরে পাবে গুর্মুখ? বিনোদিনীর ছিল প্রতিভার অবলম্বন, গুর্মুখের জোর ছিল টাকার।

    নটী বিনোদিনী

    তবে, গুর্মুখ কিন্তু জানতে পারেননি, ‘বিনোদিনী থিয়েটার’ নামে রেজিস্ট্রেশনটা হচ্ছে না। বিনোদিনীকে গ্রুপের মিটিংয়ে ডেকে বলা হয়, তাঁর নামে থিয়েটার করলে থিয়েটার নাকি চলবে না। গিরিশ ঘোষের চরিত্র যদি খতিয়ে দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে, মহৎ প্রতিভার পাশাপাশিই সুবিধেবাদের নানা আভাস সেই জীবনে রয়েছে। হয়তো অন্য কেউ এই আঘাতটা বিনোদিনীকে করলে হয়তো তাঁর অতটা বাজত না। কিন্তু চূড়ান্ত আঘাতটা গিরিশচন্দ্রই দেন বিনোদিনীকে, তিনিই বলেন, ‘তোর নামে থিয়েটার করলে লোকে আসবে না বিনু।’ এই যুক্তিটা মানা সম্ভবই নয় এই কারণে, ‘য্যায়সা কা ত্যায়সা’, ‘কপালকুণ্ডলা’-র বিনোদিনীকে যেমন লোকে গ্রহণ করেছে, তেমনই এই গিরিশচন্দ্রই তো তাঁকে দিয়ে দু’বার চৈতন্যও করিয়েছেন। দেবতাতুল্য চরিত্রে যদি বিনোদিনীকে সাধারণ মানুষ মেনে নিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর নামে থিয়েটার হলে মানুষ আসত না দেখতে! এটা যুক্তিগ্রাহ্যই নয়। রামকৃষ্ণ পরমহংস বিনোদিনীকে আশীর্বাদ করেছিলেন, এ তো ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু যে সাধারণ মানুষ, যাঁরা গাঁটের কড়়ি খরচ করে বিনোদিনীকে দেখতে যেতেন, তাঁদের শিখণ্ডী খাড়া করে এত বড়় বিশ্বাসঘাতকতাটা কি করা চলে! আসল কথা কি এই, বিনোদিনীর নামে থিয়েটার হলে তা আসলে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হত, যা গিরিশরা চাননি?

    মঞ্চে বিনোদিনী

    এ-কথাও জানা যায়, বিনোদিনী ধীরে-ধীরে খুবই দাম্ভিক হয়ে উঠছিলেন। সেই দম্ভ, সেই স্পর্ধা মাঝেমধ্যে গিরিশকেও ছাড়িয়ে যেত। তাই হয়তো, গিরিশও চাননি বিনোদিনী আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠুন। তাই তিনি সহজেই বিনোদিনীকে পরিত্যাগ করেছিলেন। বিনোদিনী যে থিয়েটার ছেড়ে দিয়েছিলেন, তার মূল কারণ তাঁকে ক্রমশ প্রধান চরিত্র থেকে সরিয়ে এনে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করানো হচ্ছিল। ১ জানুয়ারি যে শেষ অভিনয় বিনোদিনী করেন, সেখানে প্রায় কোরাসে অভিনয় করেন তিনি।

    দ্বিতীয় জীবনীতে বিনোদিনী আরও ক্ষুরধার ও শাণিত। তখন আর কাউকেই তিনি পরোয়া করেন না। অনেকেই খেয়াল করেন না, এটির প্রকাশক হিসেবে নাম যাচ্ছে, নির্মলচন্দ্র চন্দ্র ও জনৈক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। অনেক নাট্য গবেষকই মনে করেন, এই শরৎচন্দ্র এক নাট্য প্রযোজক। কিন্তু গোপালচন্দ্র রায়ের লেখা শরৎচন্দ্রর জীবনী থেকে আমরা আবার দেখি, ‘রূপ ও রঙ্গ’ নামে যে পত্রিকায় এই আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছিল, তার সম্পাদক এককালে ছিলেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

    এরপর বিনোদিনী সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। যে-ক্ষোভ ওঁর জন্মায়, তা তিনি নিজের দুটো আত্মজীবনীতে সম্পূর্ণ উজাড় করে দেন। এমনটা আরও অনেক অভিনেত্রীর সঙ্গেই হয়তো ঘটে, কিন্তু তাঁদের আত্মকথা না থাকার দরুন তা পাওয়া যায়নি। বিনোদিনী এখানেই অসাধারণ হয়ে রয়ে গেলেন। ‘আমার কথা’ ও ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’— এই দুই আত্মজীবনীর মধ্যে এক যুগেরও বেশি সময়ের তফাত।

    বিনোদিনী দাসীর আত্মজীবনীর প্রচ্ছদ

    দ্বিতীয় জীবনীতে বিনোদিনী আরও ক্ষুরধার ও শাণিত। তখন আর কাউকেই তিনি পরোয়া করেন না। অনেকেই খেয়াল করেন না, এটির প্রকাশক হিসেবে নাম যাচ্ছে, নির্মলচন্দ্র চন্দ্র ও জনৈক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। অনেক নাট্য গবেষকই মনে করেন, এই শরৎচন্দ্র এক নাট্য প্রযোজক। কিন্তু গোপালচন্দ্র রায়ের লেখা শরৎচন্দ্রর জীবনী থেকে আমরা আবার দেখি, ‘রূপ ও রঙ্গ’ নামে যে-পত্রিকায় এই আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছিল, তার সম্পাদক এককালে ছিলেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এমনকী, শরৎচন্দ্রর ব্যক্তিগত অনুরোধেই বিনোদিনী দ্বিতীয় পর্বের জীবনী লিখতে শুরু করেন। মাঝপথে সেই লেখা বন্ধও করে দেন, কেন বন্ধ করেন, তার কোনও বিজ্ঞপ্তি ওই পত্রিকায় কিন্তু পাওয়া যায়নি।

    এখন স্টার থিয়েটার

    বিনোদিনী সে-সময়ে হয়তো কিছুটা ভারসাম্যও হারাচ্ছেন। যাঁর সঙ্গে প্রায় ১৭ বছর থেকেছেন, তাঁর সঙ্গে এক কন্যাও হয়, যাঁর নাম তিনি রেখেছিলেন শকুন্তলা। ভেবে দেখলে, মহাভারতে শকুন্তলাও অবৈধ সন্তান। শেষ যে বাড়িতে তিনি এসে উঠলেন, তা থেকে স্টার থিয়েটারের বাড়ির ছাদ দেখা যেত! এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হয়?

    এটা প্রায় এক রাজকীয় বিশ্বাসঘাতকতা। আমি আর অবন্তী যখন ‘বিনোদিনী অপেরা’ নাটকটি লিখি, সে-কথা মাথায় রেখেই লিখি। সেই ক্ষতর কোনও নিরাময় তো সম্ভব নয়। তাও, এতদিন বাদে স্টার থিয়েটারের (যদিও এই থিয়েটারে বিনোদিনী অভিনয় করেননি) নাম বদলে যে-সম্মান বিনোদিনী পেলেন, ইতিহাসের নিক্তিতে তা প্রতীয়মান হয়ে রইল।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook