বাংলা ছবির ইতিহাসকে গবেষণার পাতায় ধরা হয়েছে অনেকবারই। আর অ্যাকাডেমিক পরিসরের বাইরে বাংলা সিনেমা-চর্চা তো সেই গত শতকের দুয়ের দশক থেকেই চলেছে। যে কোনও ইতিহাসেরই যা নিয়ম— কিছু নাম এই পরিসরে বারবার উঠে আসে, কিছু নাম ভেসে বেড়ায়, কিছু নাম বিভিন্ন কারণে অন্তরালে চলে যায়, বা বলা চলে, মুখে মুখে ফেরে না। এটা বিশেষ করে চোখে লাগে, অভিনয়ের ক্ষেত্রে, কারণ সিনেমার ক্রিউ, পরিচালক ও সুরকার বাদে, যেন অন্তরালেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু জনতা সিনেমা বলতে যেহেতু মূলত অভিনেতাকে চাক্ষুষ করার প্রক্রিয়াই বোঝে, অন্তত সিনেমার প্রাক-ডিজিটাল সময়ে, তাই অভিনয়ের আঙিনায় তুলনামূলক ভিসিবিলিটি নিয়ে আমাদের অনেক মাথা ব্যথা। অভিনেতার গড়ন নিয়েও। উত্তমকুমারকে চিহ্নিত করতে ‘নায়ক’ শব্দ এগিয়ে রাখব না অভিনেতা; সৌমিত্র, অনিল বা শুভেন্দু কি আসলে চরিত্রাভিনেতা, যাঁরা মাঝে মাঝে নায়কও হয়েছেন? ছবি বিশ্বাস তো কত ছবিতে নায়ক না হয়েও প্রোটাগনিস্ট। ভানুও তাই। ওদিকে ছায়া দেবী, ভারতী দেবী, বা ধরা যাক দীপ্তি রায় বা সুমিতা সান্যালের কথা। তারা কি শুধুই টাইটেল সিকোয়েন্স-এর দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্লেটে থাকবে? রবি ঘোষকে কি আমরা শুধু কমেডিয়ানের লেবেল এঁটে দেখব? উৎপল দত্ত যখন ‘ফেরারি ফৌজ’ করছেন, সেই সময়ে সিনেমার সঙ্গে রবি ঘোষের সম্পর্ক গভীর হওয়ার শুরু, এবং তাতে খুবই চিন্তায় পড়েন উৎপল। রবি তো জাত অভিনেতা, ও কি শুধুই জেস্টর হয়ে থেকে যাবে? এরকম যুক্তি, তক্কো আর গল্প চলতেই থাকে।
এই প্রাককথনের হেতু সেই অভিনেতা, যিনি প্রায় সারাজীবন ওরিয়েন্টাল ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে কাজ করেছেন। আর তার চেয়ে অনেক বেশি দিন ধরে অভিনয় করেছেন। ৬৫ বছর ধরে। প্রথমে স্টেজে— অহীন্দ্র চৌধুরী, উৎপল দত্ত, ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে। পরে চুটিয়ে সিনেমায়। উত্তমকুমারের থেকে দু-মাসের ছোট এই অভিনেতার পর্দায় আগমন ১৯৪৮-এর ‘দেবদূত’ দিয়ে। শেষ ২০১২-র ‘বরফি’ দিয়ে। ২০০৫-এ যখন ‘ক্রান্তিকাল’-এর জন্য জাতীয় পুরস্কার পান, তখনই তিনি প্রায় ৮০। তাই ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে, ২০১৩-তে ৮৭ বছর বয়সে যখন তার প্রয়াণ হয়, সেই সময়ে তিনিই ছিলেন ভারতীয় ছবির ব্যস্ততম প্রবীণ অভিনেতা। হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন : বিনোদিনীকে চূড়ান্ত আঘাত দিয়েছিলেন গিরিশচন্দ্রই…
কিন্তু ১৯৫০ থেকে ’৮০— বাংলা ছবির যে অফুরান ঐশ্বর্য, তার তালিকা নিয়ে বসলে অনেকের কথাই উঠে আসবে, কিন্তু হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো-বা কিছুটা পিছন দিকে থাকবেন। লোকে ‘কাপুরুষ’ আর ‘মহানগর’ বারবার দেখবে, বারবার বলবে যে, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া এই চরিত্রগুলোতে কাউকে ভাবাই যায় না, কিন্তু হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাপারে আলাদা করে ভাববে না। বা ধরা যাক, ‘চৌরঙ্গী’-র কথা।
‘চৌরঙ্গী’-র মতো এঁসেমব্লে ছবি বাংলা ছবির পরিসরে কমই, প্রায় সব চরিত্রেই বাঘা বাঘা লোক, ভানুর ‘নিত্যহরি’ তো বাংলা ছবির হল-অফ-ফেমে যাবে, কিন্তু ব্যাংকুয়েটের দায়িত্বে থাকা, খুঁতখুঁতে, সদা-ব্যস্ত, সাসপেন্ডর-সহ ফ্লানেল প্যান্টালুনে অল্পকেশ জিমি-ও ছোট ভূমিকায় অবিস্মরণীয়।
ভাবতে বসলে, অনেকগুলো ছোট ছোট চরিত্রে হারাধন চোখ টানেন। একদিকে উত্তমের প্রায় অজানা, কিন্তু মনোবিশ্লেষণ নিয়ে রীতিমতো আধুনিক ছবি ‘মোমের আলো’, অন্যদিকে নারায়ণ সান্যালের ‘নাগচাঁপা’ অনুপ্রাণিত ‘যদি জানতেম’-এ উত্তমের স্বল্পবাক পি কে বসুর পাশে সরকারি উকিল; একদিকে ‘সোনার কেল্লা’-য় তোপসের বাবা, অন্যদিকে ‘সীমাবদ্ধ’-তে তালুকদার, এছাড়া ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘কোরাস’, ‘অপরিচিত’, ‘পদিপিসির বর্মীবাক্স’। সবচেয়ে ছোট রোল বোধহয় ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’। মৃত্যুর ক’মাস আগে এক দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছিলেন সেই অভিজ্ঞতা।
‘একদিন মানিকদা ফোন করে বললেন, তোমাকে একটু উপকার করে দিতে হবে৷ একটা ছোট্ট সিকোয়েন্সে সাইলেন্ট রোলে অভিনয় করে দিতে হবে৷ নর্থ ক্যালকাটার একটা বাড়ির ছাতে শ্যুটিং হবে৷ লখনউয়ের রইস লোকেরা ছাতে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে৷ তুমি কি করে দেবে? আমি বললাম, অমন করে বলবেন না৷ হুকুম করুন৷ এক মিনিটেরও কম দৈর্ঘ্যের একটা দৃশ্য৷ তবু অভিনয় করে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, আর কখনও পাইনি৷’
সত্যি কথাই! চরিত্রের পর্দায় উপস্থিতির দৈর্ঘ্য কবেই বা ভাল অভিনেতার কপালে ভাঁজ ফেলেছে।
সত্যজিৎ রায় বা ‘মানিকদা’ আরও অনেকের মতো হারাধনের জীবনেও ঈশ্বর বা ঈশ্বরপ্রেরিত। মানিকদা বলতে একটা ঘটনা তিনি বলতেন অনেকবারই। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর শুটিং বেনারসে হবে, তাই সস্ত্রীক সেখানে গেছেন উমানাথ ঘোষাল ওরফে হারাধন। ফেলুদার সঙ্গে আলাপের দৃশ্যে ঘোষালের সঙ্গে তার স্ত্রীকেও দেখতে পাই আমরা। সেই ভূমিকায় অন্য কেউ নয়, ছিলেন হারাধনের নিজের স্ত্রী পরিণীতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নিজের কথায়, তাঁর মানিকদা বলেছিলেন, ‘হারাধন তোমাকে আর নকল বউ দেব না৷ আসল বউকে নিয়েই শটটা দাও৷ মানিকদার হুকুম অগ্রাহ্য করতে পারিনি৷’
সত্যজিৎ রায়ের শেষের আগের ছবিতেও ছিলেন হারাধন। এলিট ‘ওল্ড গার্ড’ আনন্দমোহনের বড় ছেলে প্রবোধের ভূমিকায়। প্রবোধ ব্যবসায়ী, এবং যাকে বলে বিষয়আশয়ে প্রাজ্ঞ, বিভিন্ন আদান-প্রদানে সিদ্ধহস্ত, দুর্নীতি কাঁটা হয়ে যার বিবেকে বেঁধে থাকে না। সত্যজিতের ছবি হিসেবে ‘শাখা প্রশাখা’ মধ্যমানের, কিন্তু প্রবোধের মধ্যে কোথাও একটা ‘কাপুরুষ’-এর চা এস্টেটের ম্যানেজার বিমল গুপ্ত বা ‘মহানগর’-এ অটোনিট সেলাই মেশিন কোম্পনির মালিক পাবনার হিমাংশু মুখার্জীর ছায়া আছে। পরের দু-জন ঠিক সেই অর্থে কোরাপ্ট নন, আবার এটাও ঠিক যে, সময়ের নিরিখে প্রবোধ অন্য দু-জনের থেকে প্রায় দু-দশকেরও বেশি এদিকে, যে সময়ের ব্যবধানে একধরনের দুর্নীতি অনেকটাই সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। কিন্তু এছাড়া এরা সকলেই পরিশীলিত, তথাকথিত সেলফ-মেড, এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে আত্মতৃপ্ত। উমানাথ ঘোষালও কিন্তু দূরে নেই। পড়তি, কিন্তু একসময়ের ল্যান্ডেড জেন্ট্রি। এই একজায়গায় বারবার বাজিমাত করেছেন হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়। এই চরিত্রগুলোর জন্য ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র ইন্দ্রনাথ রায় বা ‘দেবী’-র কালীকিঙ্কর চৌধুরীর মতো উন্নতকায়, প্রাংশু ব্যক্তিত্বের দরকার নেই। হারাধনের স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা ছিল বরং সাবেক বুর্জোয়ার আধুনিক রূপ, যার বসতি বাগবাজার নয়, বালিগঞ্জ; যার বাহন জুড়িগাড়ি নয়, বরং সেলফ ড্রিভেন মরিস মাইনর।
তিনি নিজে মনে করতেন, বাঙালি থাকে শুধুমাত্র ‘কাপুরুষ’ আর ‘মহানগর’-এর জন্য মনে রাখবে। এ-কথাটা ঠিক নয়। বরং যেটা বলা যেতে পারে যে, একসময়ের বুর্জোয়ার একটি সার্বিক রূপ হারাধন বন্দোপাধ্যায় আমাদের দিয়ে গেছেন— তাদের বাচনভঙ্গি, তাদের হাঁটাচলা, তাদের বাংলা কথনে কিঞ্চিৎ দম্ভ এনে দেওয়া ইংরেজির ব্যবহার, একধরনের কর্পোরেট ওয়ার্ক এথিক, এগুলোকে সম্বল করে জীবন্ত হয়েছে বিমল গুপ্ত বা হিমাংশু মুখার্জী।
হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সিনেমায় আরও একটা কারণে খুব জুরুরি। বাংলা সিনেমার এক সময়ের যে জগৎ, তাতে দারিদ্র, ক্লেশ, ক্ষুধা, বেকারত্ব, আকাল— এগুলো বারবার ঘুরে এসেছে। কখনও জনপ্রিয় ছবিতে, কখনও রাগী প্যারালাল সিনেমায়। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী কয়েকটা দশক শুধু ধূসর ও মলিন, এরকম ভাবার কোনও কারণ নেই। চল্লিশের ভয়ংকর সময়টাই হোক বা ষাট-সত্তরের অস্থিরতা, বাঙালি জীবন বা বাংলা ছবির রাজধানী কলকাতা কিন্তু চিরকালই অনেক স্তরে বিন্যাসিত; এককথায় রঙিন। হারাধনের সবচেয়ে স্মরণীয় চরিত্ররা বাংলা ছবির ওই আপাত-মলিন একমাত্রিকতার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমাদের সামাজিক বিন্যাসের জটিলতাকেই বরং উদ্ভাসিত করেছে।
তাই হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় থাকবেন। আরও অনেক অনেক দিন। জিজ্ঞেস করা যেতে পারে যে, কী ছিল ২০২৬-এ শতক ছুঁয়ে যাওয়া সদাহাস্য হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফুরান প্রাণশক্তির রহস্য? তাঁর নিজের কথায়, ফল আর দু-পেগ স্কচ। চিয়ার্স টু দ্যাট!