জীবনে প্রথম ছবি করলে, এবং সে-ছবিতে প্রতিবাদ থাকলে, সাধারণত ছবি একবগ্গা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সালটা যদি ১৯৭৪ হয়, তাহলে তো আরও থাকে। এবং সত্য ঘটনা অবলম্বনে চিত্রনাট্য লিখিত হলে, সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু শ্যাম বেনেগাল ‘অঙ্কুর’ ছবিটিকে সেভাবে চালনা করেন না। তাঁর ‘ভূমিকা’ বা ‘নিশান্ত’ দেখলেও আমরা বুঝি, তিনি একমাত্রিকতাকে পরিহার করেন, এমনকী যেখানে একঝোঁকা মনোভাব সবচেয়ে প্রত্যাশিত, সেখানেও। ‘নিশান্ত’-এ অত্যাচারী জমিদারের ছোটভাইয়ের চরিত্রে তিনি প্রেম আনেন, এবং গোটা ভিতু মিয়োনো গ্রাম যখন প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে, তখন তারা প্রবল জমিদার-ভাইদের মারে তো বটেই, তাদের পরিবারের বউকেও মারে, এমনকী যে অপহৃতা ও ধর্ষিতা নারীকে উদ্ধার করার জন্য মূলত এই প্রতিবাদ সংগঠিত, তাকেও খুন করে।
কখন যে অত্যাচারী ও অত্যাচারিত জায়গা-পাল্টাপাল্টি করে, কখন যে ধর্ষকও প্রেমের উচ্চারণ করে, কখন যে নারী-নারী সখ্য ঈর্ষাদগ্ধ শত্রুতায় বদলে যায়, কখন যে নিভন্ত গ্রামবাসীরা নিজেদের বউ ধর্ষিতা হলেও প্রতিবাদ করে না, আর কখন জীবন্ত গ্রামবাসীরা খুনের নেশায় কাকে মারছি তা খেয়ালও করে না, ফলে ঠিক-নিশানার সঙ্গে নিজ-লোককেও নিকেশ করে ফ্যালে— সমস্ত ধাঁধা-তাস এই পরিচালক দর্শকদের সামনে ছড়িয়ে রাখেন। তাঁর এই অত্যাচার ও প্রতিবাদের ছবির শেষকালে এক পুরুষ বলে, ‘এসব কী করে হল?’ আর তার সঙ্গিনী বলে, ‘কারণ জানতে পারলে মৃত্যু সহজ হয়ে যাবে কি?’ ‘ভূমিকা’ ছবিতে নায়িকার বহুপুরুষগমন দর্শককে প্রায়ই অস্বস্তিতে ফ্যালে, আকর্ষণের যুক্তিও সব ক্ষেত্রে স্পষ্ট করা হয় না, এবং মেয়েটির সিদ্ধান্তও খুব সুচিন্তিত মনে হয় না।
যে-লোক নায়িকার মা’র সঙ্গে অনুরাগের চাল চেলেছে, সেই লোকের বউ হওয়ার জেদে নায়িকা মা’র বিরুদ্ধে যায়। কখনও যে-পুরুষ সর্বক্ষণ চালাক-চালাক কথা বলে, তার দিকে ধাবিত হয়। মনে হয়, এ-নারী নিজের ভাল বোঝে না, এক কাঁটাগাছ থেকে অন্য কাঁটায় ঝাঁপ দেওয়ার তাড়না একে ভর করেছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে জেগে থাকে তার অন্তর্গত ইস্পাত, কিছুতেই খাঁচাবন্দি না হওয়ার প্রতিজ্ঞা, পিতৃতন্ত্রের দড়িদড়া ছিঁড়েখুঁড়ে আকুল বেপরোয়া ঝাঁপ। সে হয়তো লোকটাকে আসলে বিয়ে করতে চায় না, কিন্তু মা তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে— এই ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে ফোঁস করে উঠতে সে নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ভগবানের মূর্তির সামনে ছুড়ে ফেলে ঘেঁটি পাকড়ে কখনও তার মা কখনও স্বামী তাকে বলে, ‘এক্ষুনি দিব্যি কর তুই অমুক করবি’, বা ‘তমুক করবি না’, আর সে-উচ্চারণটা তখন হুকুমমাফিক সেরে দিলেও, তারপরেই হুড়মুড় ছুট দেয়, কখনও কোনও পুরুষের বাহুবন্ধনে, কখনও কোনও হোটেলে, কিন্তু আসলে এই দমঠাস জুলুম, অনুশাসন, মুঠি-কুঠুরি থেকে বাইরে, দূরে। তাকে আমাদের চোখে অছিন্ন মহিয়সী মনে হোক, সর্বত্র নিগৃহীতা হয়েও কীভাবে সে পবিত্র-কাম-অপরাজিতা থাকে দেখে দরদে ও শ্রদ্ধায় ভেসে যাক হৃদয়— এই চলতি ছকে ছবিটা না বেঁধে পরিচালক নায়িকাকে করে তোলেন ভুলবতী দ্বিধাগ্রস্ত লাস্য-বিস্তারিণী, সর্বোপরি তেজিয়ান, এবং ছবি হয়ে ওঠে বহুরংময়।
‘নিশান্ত’-এও তাই নায়ক (গ্রামে আসা শিক্ষক) বুকটান দৃঢ় মানুষের বদলে হয় ন্যায়বান কিন্তু ভিতু-মিনমিনে। আর জমিদার-প্রেমিক যখন রক্ষিতাকে নিয়ে পালাচ্ছে তখন নারীটি বার বার ব্যাকুল জানতে চায় লোকটির স্ত্রী কী করে বাঁচবে (যে কার্যত এখন তার সতিন)। ‘অঙ্কুর’ ছবিটাকেও একমেটে প্রতিবাদের ছবি হিসেবে গড়াই যেত, বলাই যেত: উঁচুজাতের লোক নীচুজাতের লোককে, পুরুষ নারীকে শুধু ভোগ করতেই চায়। উঁচুজাতের পুং মানেই ধুরন্ধর ও বিবেকহীন। তাতে ছবি যে খুব খারাপ দাঁড়াত, তা নয়। হাততালির সম্ভাবনাও বাড়ত। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, পরিচালক তাঁর প্রতিপাদ্যের দিকে এতটাই ঝুঁকে পড়েন যে ভাবেন: খামকা অনেকগুলো আলোছায়া খেলতে গিয়ে উদ্দিষ্ট উপসংহারটা ভেস্তে যেতে পারে, তাই প্যাঁচ-ঘোঁচ হাটিয়ে, স্টিরিওটাইপেই সিনেমার মূল চরিত্রগুলোকে বেঁধে দিই।
বিশেষত গরিব-দরদি শিল্পের ক্ষেত্রে এই প্রকল্পের ঢালাও লাইসেন্স থাকে, গরিব ও বড়লোককে অবিমিশ্র হিরো-ভিলেনে ভাগ করে নিলে, উদ্বাহু সমর্থন উজিয়ে আসে দর্শক ও ক্রিটিক উভয় শিবির থেকেই। কিন্তু এই পরিচালক প্রথম ছবিতেও সেই সরল পথ নেন না। এমনকী তিনি এটাকে শুধু প্রতিবাদের ছবি হিসেবেও গড়ে তোলেন না। সরাসরি-পনাকে এই স্পষ্ট প্রত্যাখ্যানের স্পর্ধা আমাদের মুগ্ধ করে, কারণ আর্টফিল্মেরও যে ছক রয়েছে, যুগ-সই হওয়ার চলিত নকশা, তা থেকে তিনি সরে আসেন। অগ্রাধিকার দেন শিল্পটার গভীরতা এবং পরিণতমনস্কতাকে, পর্দায় রক্তমাংসের মানুষ-দেখানোকে। দেগে দেওয়াকে নয়, ঘৃণায় ক্যাটক্যাটে শান-দেওয়াকে নয়। শ্যাম বেনেগালের ভাল ছবিগুলিতে এই বৈশিষ্ট্য জ্বলজ্বল করছে, প্রথম ছবি থেকেই তাঁর এই অবস্থান এবং ঝুঁকি-বান্ধবতা তাঁর উঁচুত্ব চিনিয়ে দেয়। নীচে ‘অঙ্কুর’ সম্পর্কিত একটি বিস্তারিত (‘ডাকবাংলা.কম’-এ পূর্বপ্রকাশিত) আলোচনা দেওয়া হল।
‘অঙ্কুর’ (১৯৭৪, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: শ্যাম বেনেগাল, সংলাপ: সত্যদেব দুবে) প্রেমের ছবি। মানে, একপক্ষ কীভাবে প্রেমের সহ-জ প্রতিজ্ঞার ভার বইতে পারল না, তা-ই নিয়ে ছবি। আবার ঈশ্বরেরও ছবি বলা যেতে পারে, কারণ ছবির একদম প্রথমে এক নারী মন্দিরে প্রার্থনা করে তার একটা সন্তান চাই, ছবির শেষে দেখা যায় তার স্বামী তাকে মন্দিরে এনেছে, সে গর্ভবতী বলে। কিন্তু সে গর্ভবতী হয়েছে স্বামীর ঔরসে নয়, আর তার ফলে বহু অপমানও তাকে সইতে হয়েছে ও হচ্ছে, তবে ওসব বোধহয় ঈশ্বরের দায়িত্ব নয়। অবশ্যই প্রতিবাদেরও ছবি, কিন্তু মনে রাখতে হবে, এখানে উঁচু জাতের লোকটিকে, অর্থাৎ অত্যাচারীকে, বেশ কিছুটা দরদের দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। সে নিষ্ঠুর খুব একটা নয়, প্রধানত ক্যালাস, ব্যক্তিত্বহীন। কিন্তু শেষ অবধি তার মেরুদণ্ডরহিত কাজকর্ম ঠিক উঁচু জাতের নৃশংসতারই হুবহু অনুসারী হয়ে দাঁড়ায়। কাহিনির এই গড়নেই ছবিটির অনন্যতা।
উঁচুজাতের ছেলে বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারে না, কলেজের পড়া মিটতেই তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় একটি ছোট মেয়ের সঙ্গে, সে ক’দিন পর, উপযুক্ত হলে, ঘর করতে আসবে। এর মধ্যে, জমিজমা ও ক্ষেতের দেখাশোনা করতে, ছেলেটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গ্রামে। সেখানে সে নীচুজাতের পরিচারিকার হাতে চা-ও খায়, তার রাঁধা ভাতডালও খায়, জাতপাত মানে না। এতে গ্রামের লোকে অবাক হয়, একটু রাগও করে। হয়তো কর্তৃত্ব দেখানোর জন্যই, ছেলেটি প্রথমটা গ্রামে ঘুরে রাগারাগি করে হ্যানো বন্ধ করে ত্যানো চালু করে। তার বাবার এক অবৈধ সঙ্গিনী (এবং সন্তান) রয়েছে এখানেই, বাবা তাদের সেরা জমি দিয়েছেন, তাদের ওপর এই ছেলেটির রাগ। সে তাদের ক্ষেতের জল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। তার ধারণা, বাবা কোনওদিনই এখানে আসবেন না, ফলে সে রাজার মতো ব্যবহার করে পার পেয়ে যাবে। পরিচারিকা লক্ষ্মী তার ঘর ঝাড়েপোঁছে, রান্না করে, সাপ হিসহিস করে তেড়ে এলে তাড়িয়ে দেয়। সেই লক্ষ্মীর স্বামী বোবা-কালা, সে খেজুরের রস চুরি করে খেলে, এই ছেলেটিরই আদেশে তার মাথা ন্যাড়া করে, উলটো গাধায় চড়িয়ে ঘোরানো হয়। সে লজ্জায়-অভিমানে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। লক্ষ্মী এখন একা, তার প্রতি ছেলেটির একটা আকর্ষণ জন্মেওছে, এক সময় সে লক্ষ্মীকে বলে, সারাজীবন তাকে রক্ষা করবে, তার ভার নেবে। লক্ষ্মীর সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়। অবশ্যই এক সময়ে বাবা আসেন, এক বকুনিতে সিংহ ইঁদুর হয়ে যায়। বাবা বলেন, নীচুজাতের মেয়ের সঙ্গে সে সম্পর্ক করেছে, গ্রামে ঢি-ঢি পড়ে গেছে। ইচ্ছে করলেই জুতো মেরে সেই মেয়েকে গ্রামছাড়া করার ব্যবস্থা তিনি করতে পারেন। ছেলেটি তর্ক করার চেষ্টা করে, মিনমিন করে বলে, ওরাও তো মানুষ, তবে সাধারণত তার আপত্তিগুলো ‘কিন্তু বাবা…’-র বেশি এগোতে পারে না।
তারপরেই ছেলেটির বউ চলে আসে, বাড়ির সাজসজ্জা বদলে ফ্যালে, এবং লক্ষ্মীকে তাড়াতে সচেষ্ট হয়। ছেলেটির তরফে সামান্য আপত্তি দেখা যায়, কিন্তু যেই সে শোনে লক্ষ্মী গর্ভিণী, তক্ষুনি তার সব প্রেম ও মুক্তচিন্তা বেমালুম উবে যায়, সে আঁতকে বলে, বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দে, বা তুই কোথাও চলে যা। কাজ থেকে বহিষ্কৃত, শারীরিক শ্রমও তেমন করতে পারবে না, তাই লক্ষ্মী খেতে পায় না। একদিন খাবার চাইতে এদের বাড়িতেই আসে, তাকে যখন খাবার এনে দিচ্ছে বাড়ির কর্ত্রী, লক্ষ্মী রান্নাঘর থেকে চাল চুরি করে, কিন্তু ধরা পড়ে যায়। ছেলেটি চেঁচিয়ে ওঠে, তোকে চাবুক মারা উচিত, শুধু মেয়ে বলে ছেড়ে দিলাম। ছেলেটির বউও এই অনাবশ্যক নিষ্ঠুর উচ্চারণে অবাক হয়ে যায়, কিন্তু ছেলেটি তখন সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে আধভাজা। লক্ষ্মীকে সে সত্যি পছন্দ করেছিল, তাকে এ-বাড়িতে সর্বময়ী হিসেবেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, তাকে বার বার বলত তুই বাড়ি যাবি কেন এখানেই থেকে যা, এখন সেই মেয়ে ভিখিরির মতো নিঃস্ব ও নির্বাসিত, তা নিয়ে ছেলেটির যথেষ্ট পাপবোধ রয়েছে, তার কামড়ও সে কম খাচ্ছে না। সে লক্ষ্মীর চোখে চোখ রাখতে পারে না, শুধু চায় যে কিছু একটা মিরাকল হোক, আর লক্ষ্মী উবে যাক, যাতে কেউ না জানতে পারে সে এই মেয়েটির সঙ্গে শুয়েছিল।
এর মধ্যে আমরা দেখেছি, গ্রামের এক মেয়ে স্বামীকে ছেড়ে অন্য জাতের লোকের সঙ্গে চলে গেছিল বলে তার বিচার হয়েছে। সে চেঁচিয়ে বলেছে, তার স্বামী যৌনক্ষমতাহীন, তাই তার বউ হয়ে শরীরের খিদে মেটে না। কিন্তু বিচারের রায় দেওয়া হয়েছে, স্ত্রী শুধু স্বামীর নয়, তার পরিবারেরও, সমাজেরও। তাই স্বামীকে ছেড়ে যাওয়া যাবে না, ভিনজাতের লোকের কাছে তো যাওয়া যাবেই না। বিচারের পর দেখানো হয়, মেয়েটি মারা গেছে। হয়তো আত্মহত্যা। হয়তো কেউ মেরে ফেলেছে। এও দেখানো হয়, মদ খেয়ে তাসের আড্ডায় বাজি রাখতে রাখতে, ঘড়ি হেরে গিয়ে, গলার চেন হেরে গিয়ে, শেষে একটি লোক তার বউকে বাজি রাখে। সেই আড্ডায় বারবার সব পুরুষ নিজেদের ‘মরদের বাচ্চা’ বলে দৃপ্ত ঘোষণা করে, বোঝা যায় এটিই তাদের সর্বোচ্চ আস্ফালন। যদিও পরের দিন সকালে বউটিকে আনতে গিয়ে জিতে যাওয়া লোকটি সফল হয় না, বউটি তার তিরস্কারের মধ্যে যুধিষ্ঠিরের নামটি স্পষ্ট করেই বলে। তার মানে, ছবিটা এই দেশে নারীর অধিকার নিয়েও। যদিও ওই বিচারসভায় উপস্থিত বড়লোকের ছেলেটিকে বিপর্যস্ত দেখিয়েছিল, যদিও ওই তাসের আড্ডায় বসে থাকা বড়লোকের ছেলেটিকে স্তম্ভিত ও বিরক্ত দেখিয়েছিল, কিন্তু পরে তার নিজের কাজেও বোঝা যায়, দলিত মেয়েকে ভোগ করে তারপর জঞ্জালের ঢিপিতে ছুড়ে দেওয়া যায়।
কিন্তু তা বলে এই গ্রামের মানসিকতাকে এক ছাঁচে ঢেলে দেওয়া যাবে না। যে পুলিশটা মনে করে, নিচু জাতের মেয়ের ছোঁয়া খাবার খাওয়া উচিত নয়, সে লক্ষ্মীকে ভুট্টাক্ষেতে চুরি করতে দেখে, বড়লোকের ছেলেকে এসে বলে, এ কী, আপনি লক্ষ্মীকে কিছু জমি দিন, খাবারদাবারের ব্যবস্থা করুন, সে তো আপনার কাছেই ছিল এতদিন। আপনার বাবা তো এখানকার মেয়েকে ভোগ করেছেন, তার বদলে তাকে জমি-জিরেত দিয়েছেন। ছেলেটি বলে, তুমি বেশি কথা বলতে এসো না। তারপর একদিন ছেলেটি, লক্ষ্মীর হঠাত-ফিরে-আসা স্বামীকে লাঠি হাতে তার দিকে দ্রুত হাঁটতে দেখে (সে চাকরি চাইতে আসছিল), ভাবে সে প্রতিশোধ নিতে আসছে, আর তাকে চাবুক দিয়ে বেধড়ক মারতে থাকে। সেই মার দ্যাখে গ্রামের কিছু লোক, সেই পুলিশ, একটি ছোট ছেলে। তাদের মুখেচোখে থাকে উঁচু জাতের লোকটার প্রতি, উঁচু জাতের প্রতি, অবিমিশ্র ঘৃণা। কিন্তু তারা প্রহার থামাতে যায় না, সাহস পায় না। লক্ষ্মী এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বামীকে বাঁচায়, চেঁচিয়ে বড়লোকের ছেলেটিকে গাল পাড়ে, অভিসম্পাত দেয়। বড়লোকের ছেলে ছুটে ঘরে গিয়ে খিল দিয়ে হাঁপাতে থাকে ও কাঁদতে থাকে। তার বউ তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তাদের মাঝখানে দেওয়ালে ঝোলে তাদের বিয়ের ছবি, ফ্রেমে বাঁধানো। বউ লক্ষ্মীকে সহ্য করতে পারে না, কিন্তু এই দৃশ্যে তার নীরব তিরস্কার ও লক্ষ্মীর উচ্চ-চিৎকার এক বিন্দুতে মিলে যায়। আর বড়লোকের ছেলেও হয়তো নিজের ভীরুতা, লক্ষ্মীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, লক্ষ্মীর স্বামী বোধহয় এবার সমুচিত শাস্তি দেবে এই ভয়, সেই ভয়কে জনসমক্ষে ক্রোধে বদলে নেওয়ার পরাজয়— সব মিলিয়ে নিজেকে তেমন সহ্য করতে পারে না। শেষে ওই দর্শক বাচ্চা ছেলেটি ধীরে-ধীরে কিছুটা পিছিয়ে এসে, বড়লোকের বাড়ির জানলায় ঢিল ছুড়ে কাচ ভেঙে দেয়। ছবি শেষ হয়ে যায়।
উঁচুজাত নীচুজাতকে যেভাবে পেষে, পুরুষ নারীকে যেভাবে পেষে, বাবা ছেলেকে যেভাবে পেষে, সব দমন নিয়েই ছবি। কিন্তু ছবিতে প্রায়ই সেতার বাজে, বাঁশিও, আর যখন লক্ষ্মীর সঙ্গে ছেলেটির অনুরাগের মুহূর্ত দেখানো হয়, তখন তা অনুরাগই, শুধু ভোগলিপ্সা নয়, চক্রান্তমূলক ভানও নয়। লক্ষ্মী একবার, শাড়ি পরতে-পরতে (সম্ভবত আশ্লেষজনিত কারণে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল), ছেলেটির প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিল একটি পাখির নাম। ছেলেটির বউ এসে যখন তাকে সেই পাখির নাম জিজ্ঞেস করে, বলতে গিয়ে ছেলেটির মুখ স্মৃতিকাতরতায় ও আত্মগ্লানিতে কালো হয়ে আসে। সে আবেগের মধ্যে কোনও ফাঁকি নেই। ছোট ছেলেটি কাচ ভেঙে দিয়ে যে প্রতিবাদ করে, তা হয়তো অঙ্কুর, তা থেকে যে-বিদ্রোহের একদিন উদ্গম হবে তা নিশ্চয়ই কাম্য, কিন্তু এই বড়লোকের ছেলের অসহায় থতমত মুখটাও দর্শকের সামনে ভাসে। সে ক্ষমতা দেখায় অন্যের ক্ষেতে জল বন্ধ করে দিয়ে, আবার বাবার সামনে কেঁচো হয়ে বাঁচে। তার রাগ হয় বাবা অন্য মেয়ের সঙ্গে কুড়ি বছর সম্পর্ক রেখেছেন বলে, কিন্তু সে নিজেও বিয়ের বাইরে অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করে ফ্যালে। এই মেয়েটিকে সে ভালবাসে, কিন্তু বাবাকে বা বউকে সে কথা দাপিয়ে বলার সাহস সে সংগ্রহ করতে পারে না। সে জাতপাত মানে না, কিন্তু তার জাতপাত-মানা বাবা বরং একটি নীচুজাতের মেয়ের আশ্রয় ও ভরণপোষণের বন্দোবস্ত করার সাহস দেখান, যা সে পারে না। তার গুলিয়ে ফেলা, ঘাবড়ে থাকা, লতপতে মনপিণ্ডটাও এ-ছবির নায়ক। একটা প্রতিবাদী ছবি সাধারণত যে একমেটে আগুন-রঙে লেপা থাকে, এ-ছবি তার চেয়ে আলাদা।