ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ : পর্ব ৪৫


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (October 15, 2024)
     

    রণেন

    ডেপুটেশন পিরিয়ড শেষ হতেই রমিতা গিয়ে যোগ দিল তার পুরনো ইশকুলে। এর অল্প কয়েক মাস পরেই গর্ভবতীও হল রমিতা। বাড়িতে যেন খুশির বন্যা। ক্রমে মিলিয়ে গেল সিমলা-দিল্লি ঘিরে যাবতীয় যত উচাটন এবং টানাপড়েন। ইতিমধ্যে অবসর নিয়ে ভূতেশও ফিরে এলেন তাঁর পৈতৃক বাড়িতে; রণেনদের বাড়ি থেকে যার দূরত্ব বলতে গেলে এ-পাড়া আর ও-পাড়া। ইতিমধ্যে রণেন তার সেই চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছে। তবে নিজের মর্জিমতো কিছু আয় তার আছে। ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায় নিয়মিতই কাজ পায় সে। এছাড়া গ্রন্থজগৎ প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত সুপণ্ডিত বিনয়কুমার দত্ত মহাশয়ের সুবাদে সেখান থেকেও কাজ আসে, নতুন-নতুন বইয়ের ইলাস্ট্রেশন করবার জন্য। গ্রন্থজগতের তরুণ প্রকাশক দেবকুমার বসু এবং বিনয় দত্ত— দুজনেই খুব পছন্দ করেন রণেনের কাজ; কিন্তু আর এক ইলাস্ট্রেটর দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতো, তার নিজের কাজে কোনও তাড়া না থাকায়, সেখানেও বেশিরভাগ কাজই হাতছাড়া হয়ে যায় রণেনের। কলকাতার বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে গ্রন্থজগতের আড্ডায় শিশিরকুমার ভাদুড়ী, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়দের মতো মানুষদের সঙ্গ করে খুবই উদ্বুদ্ধ হয়ে ফেরে রণেন; কিন্তু তারপরেই সে আবার ডুবে যায় তার নিজের মতো করে ছবি আঁকা, ক্যাকটাসের পরিচর্যা এবং নানা নকশার আয়োজনে চামড়ার কাজ করার আনন্দে। রমিতা মাঝে মাঝেই ভাবে, সেও বোধহয় বুঝতে পারে না যে, রণেন ঠিক কী চায়! নিয়মিত উপার্জন না করায় রণেনের কি আদৌ কোনও হেলদোল আছে! অথচ সে যে অলস বা শুয়ে-বসে দিন কাটায়, তা তো নয়! আপাতত সে মেতে আছে, বিভিন্ন মাপের অ্যালবাম এবং চামড়ার কারুকাজে সেগুলির কভার তৈরির ব্যস্ততায়; বাচ্চা হওয়ার পর থেকেই যাতে ফোটো সাজানোয় কোনও ব্যাঘাত না ঘটে, এই ভেবে। এমন অপূর্ব তার হাতের কাজ যে, চোখ ফেরানো যায় না। কিন্তু ওই এক ব্যারাম! কেউ পুরো পয়সা দিয়ে আগাম বুকিং করে অর্ডার দিলেও, সে কিন্তু সহজে করে দেবে না। ওর সেই এক কথা,  ফরমায়েসি কাজ এবং চাকরি এ-দুটোর কোনওটাই নাকি তাকে দিয়ে হবে না। রণেনের যুক্তি হল, যা সে পারে— সেটাই সে করে এবং বিনা তাড়ায় ভালবেসে শেষ করেও ফেলে; জোর করে ‘অকাজ’ করা নাকি তার চরিত্রবিরুদ্ধ। সেদিন যখন রণেন তাকে বলেছিল যে, তার হাতের ওইসব মেলা কাজ ফেলে, চাকরি করার সময় কোথায়! এ-কথা শুনে মিতা বুঝে উঠতেই পারেনি যে, সে হাসবে না কাঁদবে! একদিকে নিজের বাবার কাছে ক্রমেই মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে মিতার, আর অন্যদিকে রণেনের সঙ্গে থাকলেই তার মনে হয়ে যে, কোথায় গোলমাল! তারা তো দিব্যি আছে! রণেন তো এটাই বুঝতে চায় না যে, মাস গেলে রণেনের কোনও মাইনে নেই বলেই মিতার চাকরি করাটা কেন এত অপমানের! রণেনের সেই একটাই যুক্তি যে, মিতা তার যোগ্যতায় চাকরি এবং প্রশংসা দুটোই পেয়েছে; এর সঙ্গে রণেনের চাকরি না করাটাকে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে কেন!  


    প্রথম সন্তান আসা এবং তাই নিয়ে একইসঙ্গে আনন্দ, অভিমান, মিতার বাপের বাড়ির সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্কের জটিলতা— এসবে জেরবার হয়ে এক চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল রণেন। মিতাকে বুঝিয়ে চাকরি থেকে তাকে ইস্তফা দিইয়ে, ভাড়াটেদের জিম্মায় বাড়ি রেখে, মা-বউ এবং মেয়েকে নিয়ে সোজা তারা চলে গেল বোলপুর— তার দিদির ইশকুলে। সেখানে আঁকার মাস্টারের কাজ নিল রণেন। ওখানে থাকতে-থাকতেই এক আধা-সরকারি ইশকুলে লিভ ভেকেন্সিতে একটা কাজ পেয়ে গেল মিতাও। সব ভুলে দুজনেই আবার ভেসে থাকতে শুরু করল, এক মাতোয়ারা আনন্দে। তাদের জীবনে আবার ফিরে এল গান-বাঁশি-রঙের এক বিপুল আয়োজন। রণেনের বড়দিদি বিমলার সূত্রেই যোগাযোগ হল চিত্রী সুধীর খাস্তগীর-দিনু কৌশিক ছাড়াও আরও কিছু বিশিষ্টজনের সঙ্গে। ক্ষিতীশ রায় এবং প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের তো বাড়ির লোক হয়ে গেল রণেন। এই পরিচয়ের সূত্রেই রণেন জানতে পারল যে, কলাভবনে পড়বার সময়ে তার প্রাক্তন প্রেমিকা ললিতার সহপাঠী ছিলেন এই ক্ষিতীশ রায়েরই স্ত্রী। হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠল প্রভাত মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী সুধাময়ীর সঙ্গেও; জানা গেল যে, তাঁর এক শ্যালিকার বিয়ে হয়েছে রণেনদের সোদপুরের বাড়ির কাছেই থাকা এবং খুবই পরিচিত, সুপণ্ডিত সেই অনিল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এই সব মিলিয়েজুলিয়ে বন্ধুত্ব গাঢ় হল তাঁদের বড়ছেলে এবং বউ— ভনুবাবু আর সাহানার সঙ্গে। শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা এভাবে ক্রমাগত বেড়ে চলায় রমিতার এমন আশাও মনে জাগল যে, এবার হয়তো  বিশ্বভারতীতেই একটা পাকা চাকরি হয়ে যাবে রণেনের। রণেনের তো একেবারে পাগলের মতো ভাল লাগল, রামকিঙ্কর বেইজ— সকলের কিঙ্করদাকে; গুরুদেবকে সে একেবারে কাছ থেকে দেখেছে শুনে, আত্মহারা কিঙ্করদা তো বুকে জড়িয়ে ধরলেন রণেনকে। মিতাও সেই প্রথম জানতে পারল যে, ছাত্র অবস্থায় তার মাস্টারমশাই সতীশচন্দ্র সিংহ মহাশয়ের সঙ্গে নির্বাচিত ছাত্রদের সঙ্গে রণেনও এসেছিল সেই দলের সঙ্গে, এক অন্যতম সদস্য হয়ে; ১৯৪০ নাগাদ বিশ্বভারতীতে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, জীবিত রবীন্দ্রনাথকে দেখে তাঁর ছবি আঁকবার জন্য। সময় করে রণেন দেখা করতে গেল তার সরকারি আর্ট কলেজের মাস্টারমশাই এবং বিশ্বভারতীতে পাঠভবনের প্রাক্তন ছাত্র মুকুল দে মহাশয়ের সঙ্গেও। তিনি তখন দিল্লির National Museum-এর কিউরেটর হলেও মাঝে মাঝেই শান্তিনিকেতনে আসেন, তাঁর চিত্রলেখা বাড়িতে থাকতে। তিনি অবশ্য প্রথমেই জানালেন যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখান থেকে চলে যেতে, কারণ ওখানকার অন্তর্কলহ; সেসবে এঁটে ওঠা নাকি একেবারেই সম্ভব হবে না রণেনের পক্ষে। তাঁর ভাই মণীষী দে যে রণেনের প্রায় সমসাময়িক এবং যথেষ্ট পরিচিতও, সে-প্রসঙ্গ তুলে আর কথা বাড়াল না রণেন; রণেনের মনে পড়ল, বহু বছর আগে ওই মণীষীই তো তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, আবার বম্বে ফিরে গিয়ে, Bombay progressive Artists নামের দলের সদস্য হতে। মুকুল দে-র সাবধানবাণী মনে পড়ায়, রণেনেরও মনে এল একই কথা। কারণ, তার চেনা দু-একজন ফাইনাল পাশ দেওয়া সহপাঠী, ইতিমধ্যেই যারা কলাভবনে যোগ দিয়েছে তাদের কাছ থেকেও কোনও অভ্যর্থনা পায়নি রণেন। ফলে, এবার রণেনেরই এক সচেতন সিদ্ধান্তে, তাদের জীবন আবার বাঁক নিল অন্যদিকে। মিতার লিভ ভেকেন্সির কাজটা শেষ হতেই, তারা ফিরে এল সোদপুরের বাড়িতে। কারণ, একেবারে পাকাপাকি ভাবেই এবার তারা থাকতে চলে যাবে উড়িষ্যায়; অনুগুল স্টেশনে নেমে, আরও ন’মাইল ভেতরে, শহর থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন চম্পতিমুন্ডা নামে এক গ্রামে; নতুন আদর্শে গড়ে ওঠা, এক নতুন ইশকুলের কাজে একসঙ্গে যোগ দিতে রমিতা ও রণেন।    

    কারণ বোলপুরে থাকাকালীনই হঠাৎই আবার যোগাযোগ হল, উড়িষ্যার দুই প্রথিতযশা মানুষ মালতী চৌধুরী এবং নবকৃষ্ণ চৌধুরীর সঙ্গে। সবাই যাঁদের এক ডাকে চেনে ‘নুমা’ এবং ‘বাপী’ বলে। দুজনেই আশ্রমিক এবং একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির স্নেহধন্যও বটে। এঁরা যে শুধু রণেনের পূর্ব পরিচিত তাই-ই নয়, আত্মজনও বটে। কটকে থাকবার সময় থেকে এই পরিবারের সঙ্গে সখ্য ছিল, তরঙ্গনাথ এবং তরুলতার। সে এক বিরল সখ্যে— পদস্থ পুলিশ অফিসার এবং আদ্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী এমন দুটি পরিবার। এইভাবে অতদূরের এক অজানা ইশকুলে গিয়ে কাজে যোগ দিতে বারংবার মানা করলেন রণেনের দিদি; মানা করলেন বিচক্ষণ শুভানুধ্যায়ীরাও; নানা ভাবে তাঁরা এ-ও বোঝালেন যে, বিশেষত উপাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বোস যখন তাঁর দরখাস্তটি নিজে হাতে নিয়ে, প্রতিশ্রুতি না দিলেও যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক কথা বলেছেন তার সঙ্গে! এখানে আসবার কথা জানামাত্রই, রণেনের অনুরোধের অপেক্ষা না রেখেই, সত্যেন বোসকে একটি চিঠি নিজে থেকে লিখেই রণেনের হাতে দিয়ে বিনয় দত্ত বলে দিয়েছিলেন যে, সেখানে যাওয়ামাত্রই ওই চিঠি নিয়ে সে যেন দেখা করে। বিন্দুমাত্র কালক্ষয় না করে, বিনয়বাবুর সে আদেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালনও করেছি রণেন। আপাতত সেসব মাথায় নেই তার; কারণ উড়িষ্যা যাবার আনন্দে একেবারেই বিভোর হয়ে আছে সে। সেই সঙ্গে বেজায় খুশি তরুলতাও; স্বামী চলে যাবার পর কটক, ভুবনেশ্বর, পুরী, সম্বলপুর— সব জায়গা থেকে বিস্তর চিঠি এলেও বহু বছর দেখা হয়নি আর ওইসব মানুষজনের সঙ্গে, যাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তরুলতা ও তরঙ্গনাথের সংসার জীবনের বেশ লম্বা একটা সময়। আপত্তি জানিয়েও লাভ হবে না বুঝেও, রণেনের দিদির মতোই তাঁর মতামত জানালেন মিতার বাবা ভূতেশও; তরুলতাকে অনুরোধ করলেন, মিতাকে বোঝাতে যাতে মিতা অন্তত বাচ্চাসমেত এখনই সেখানে না যায়। তরুলতার মৃদু হাসিই বুঝিয়ে দিল যে, গেলে তাঁরা সকলে মিলেই সেখানে যাবেন; কারণ এর থেকেও উড়িষ্যার সব ঘোর জলা-জঙ্গলে তিনি তাঁর একাধিক বাচ্চাসমেতই কাটিয়ে এসেছেন। তরুলতার আত্মবিশ্বাসের বহর এবং উড়িষ্যা যাওয়া নিয়ে, তাঁর সেই মুখর উন্মাদনা দেখে ভূতেশের মনে হল যে, তরুবউদি নিজেকেই বোধহয় তরঙ্গনাথ ভাবছেন! বাবার দেওয়া প্রস্তাবে ঘাবড়ে গিয়ে রণেনের স্টুডিয়োঘরে গিয়ে তার কাছে একেবারে আছড়ে পড়ল মিতা! ভয় পেল যে, সত্যিই যদি তরুলতা রাজি হয়ে যান এমন এক প্রস্তাবে! রণেন তাকে আশ্বস্ত করে জানাল যে, তরুলতা রণেনকে ছেড়ে থাকতে পারলেও, তাঁর আদরের মামনিকে কিন্তু কোনওমতেই কাছছাড়া হতে দেবেন না তিনি।    

    অনুগুল যাওয়া এক পর্বই বটে। বাড়ির হাতায়, পড়ে থাকা এক টুকরো নিজের জমিতে যে বাগান করেছিলেন তরঙ্গনাথ, সেটা বিক্রি করে দেওয়ার অনুমতিও দিলেন তরুলতা; বিক্রি করে দেওয়া হল বেশ কিছু আসবাব—  মানে চেয়ার-সহ বারোজনে মিলে একসঙ্গে বসে খাবার ডাইনিং, টেবিল, দু’সেট সোফা, প্রায় বলখেলার মাঠের মতো চওড়া তরঙ্গনাথের বাবা-মায়ের সেই জোড়া খাট, পেল্লায় মাপের খান পাঁচেক লোহার বালতি, ভারী-ভারী ট্রাঙ্ক খান-কুড়ি; সেই সঙ্গে সিন্দুকের ভেতর ডাঁই হয়ে পড়ে থাকা পেতল-কাঁসার গাড়ু-গামলা-বদনাসমেত জগদ্দল সব সাবেক বাসনও। রাণী আর বদুর ব্যবহার্যগুলো বিক্রি না করে দান করা হবে, এমন সিদ্ধান্ত নিলেন তরুলতা। ওগুলো তাই আলাদা করে সরিয়ে রাখা হল তিনতলার গুদাম ঘরে। এছাড়া, আগের মতোই বাকি জিনিসপত্রসমেত বাড়িটা আবার ভাড়াটেদের জিম্মায় রেখে, প্রবাসযাত্রাটি একেবারে পাকা করে ফেললেন তরুলতা। নিয়ে যাবার জন্য আসবাব বলতে বাছা হয়েছে তরঙ্গনাথের সময়ে অর্ডার দিয়ে বানানো দু’খানা ইংলিশ খাট, একটা বড় আলমারি, খোকার ইজেল, মিতার হাত-মেশিন আর বোলপুর থেকে কেনা খান ছয়েক শান্তিনিকেতনী মোড়া। বাসনপত্র এবং জামাকাপড়ের খান চারেক ছোট-বড় অ্যালুমনিয়ম ট্রাঙ্ক ছাড়াও আরও একটা খালি ট্রাঙ্ক, সেখানে গিয়ে খোকার আঁকা নতুন ছবিগুলো রাখবার জন্য। যাবতীয় বিক্রিবাবদ সব টাকাটাই রণেন তার মায়ের হাতে তুলে দিলে, তখনই সে-টাকার গোছাটি না গুনেই মিতার হাতে দিয়ে দিলেন তরুলতা। সবে হাঁটতে শেখা নাতনিটিকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ‘শুধু এই মোহরটিই আমি নিলাম।’ আপ্লুত মিতা কিছু টাকা রণেনের হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা রাখো। তোমার রং-তুলি-ক্যানভাস-সিগারেট এবং ট্রেনের টিকিট কেনার জন্য।’ বেজায় সিরিয়াস ভঙ্গিতে রণেন বলল, ‘সেইসঙ্গে একটু ভাল চা-পাতাও।’

    যাবার দিন, সস্ত্রীক ভূতেশ এবং পাড়ার আত্মীয়স্বজন-সহ অন্যান্য চেনা পরিচিতরা তাদের বিদায় জানাতে এলে, ভীষণ অবাক হয়ে গেল সবাই; কারণ, বাড়ির নাপিত ফকিরও তাদের সঙ্গে যাচ্ছে দেখে! ফকিরেরও কিছুমাত্র পরোয়া নেই, তার নিজের বউ-ছেলেমেয়েদের ছেড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য দূর প্রবাসে চলে যাচ্ছে বলে; দু’একজন জানতে চাইলে, গদগদ ভঙ্গিতে সে শুধু বলল, ‘আমি না গেলে রনুদার চুলে তার ওই স্টাইলের ছাঁটটা হবে কী করে!’ এমন এক অদ্ভুত কথা রমিতাও এই প্রথম শুনল। তবে রমিতা এবং রণেন দুজনেই অবাক হয়ে গেল, জিনিসপত্রসমেত স্টেশনে তাদের পৌঁছে দেবার জন্য বাড়ির সামনে একটি লরি এবং মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে দেখে! তাদের সেই বিস্ময় প্রকাশ হয়ে পড়বার আগেই তরুলতা বললেন, ‘আগে তো নিরাপদে ট্রেনে উঠি, তারপরে সব বলছি।’ হাওড়া স্টেশন থেকে রাতের ট্রেন ছাড়তেই ধীরে-ধীরে মিলিয়ে গেল মিতার ভাই-বোনেদের হাত নেড়ে সি-অফ করা। মামা-মাসিরা আর ট্রেনে উঠল না দেখে হাপুস নয়নে, একেবারে শোরগোল করে কান্না জুড়ল তরুলতার নাতনি ঝিনি। এমন এক হট্টগোলের মধ্যেই তরুলতা জানালেন যে, রণেনের শালা-শালিরা যাতে ওই মোটরেই হাওড়া থেকে সোদপুর ফিরে যেতে পারে, সে-বন্দোবস্তও তিনি করে দিয়েছেন; কারণ তরুলতা ইচ্ছাপ্রকাশ করাতেই ওই লরি এবং গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ব্যারাকপুর অঞ্চলে থাকা, তরঙ্গনাথেরই এক ব্যবসায়ী বন্ধু। আর এসবের মধ্যস্থতা করেছে তাঁদের ওই নাপিত ফকির। রণেন একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে রইল তরুলতার মুখের দিকে; সেই সঙ্গে বোধহয় তাঁর পুত্রবধূ রমিতাও।

    তরুলতার মৃদু হাসিই বুঝিয়ে দিল যে, গেলে তাঁরা সকলে মিলেই সেখানে যাবেন; কারণ এর থেকেও উড়িষ্যার সব ঘোর জলা-জঙ্গলে তিনি তাঁর একাধিক বাচ্চাসমেতই কাটিয়ে এসেছেন। তরুলতার আত্মবিশ্বাসের বহর এবং উড়িষ্যা যাওয়া নিয়ে, তাঁর সেই মুখর উন্মাদনা দেখে ভূতেশের মনে হল যে, তরুবউদি নিজেকেই বোধহয় তরঙ্গনাথ ভাবছেন!


    অনুগুলের জীবনে রণেনকে দেখে মিতার বিস্ময় যেন আর কাটতেই চায় না। যুবক বয়সের ঘোড়ায় চড়া এবং গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে দূরদূরান্তের জঙ্গলে চলে যাওয়া সেই দামাল রণেনকে দেখতে পায়নি বলে বড় দুঃখ ছিল তার। তেমনই দুঃখ ছিল ঘড়ি ধরে চাকরি করতে বেরনো রণেনকেও দেখতে পায়নি বলে। কিন্তু এখানে এসে অবধি সে-দুটো ইচ্ছেই পূরণ হয়েছে রমিতার। মিতা যাকে প্রতিনিয়ত দেখছে, সে একেবারে অন্য রণেন। ইশকুল শুরু হওয়ার আগে, এখানকার একটু বড় ছাত্র এবং মাস্টারদের সঙ্গে সে চলে যায় নদীতে স্নান সেরে বালতি-বালতি জল নিয়ে ফিরতে। পুলিশ ক্যাম্পে দেখা লম্বা একটা বাঁশের লাঠি দুজনে দু’দিকে ধরে, বেশ কয়েকটা জলভর্তি বালতি তাতে সার-সার ঝুলিয়ে আনার সহজ উপায় রণেনই শিখিয়ে দিয়েছে তাদের। স্নান সেরে ফিরেই জনতা স্টোভ জ্বেলে খানিকটা গরম জল ফ্লাস্কে রেখে, মা মিতা এবং নিজের জন্য চা বানায় রণেন। গণ-কিচেন থেকে আসা, জলখাবার খেয়েই সে ক্লাসেও চলে যায় নিজের তাগিদেই। ছাত্রদের নিয়ে কখনও ইন্ডোর আবার কখনও-বা আউটডোর স্টাডি করে। দুপুরে ঘরে ফিরে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম করে; মেয়েকে বুকের ওপর শুইয়ে ঘুম পাড়ায়। তিনটে বাজলেই আবার ইশকুলচত্বরে গিয়ে ছাত্রদের নিয়ে শুরু করে দেয় নাটকের মহড়া। সন্ধেবেলা অন্যান্য ঘরগুলি থেকে মাস্টারমশাইরাও আসেন; তাদের ঘরের সামনে মোড়া পেতে বসে যান খানিকক্ষণ আড্ডা দিতে। এখানকার আকাশ-বাতাস, ছোট-ছোট পাহাড়ি ঝরনা এবং স্থানীয় ওড়িয়া ভাষা— সব যেন মিলেমিশে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে রণেনকে। ছাত্রদের দেখাদেখি মাস্টারদের অনেকেই তাকে ‘গুরুজি’ বলে সম্বোধন করেন। এরই মধ্যে মেয়ের জন্য সে বানিয়ে ফেলেছে অপূর্ব এক প্লে-হাউস। বড় একটা তাঁবুর মধ্যে নানা রকম খেলার আয়োজন। এমনকী তাঁবুর বাইরে একটা কাঠের ঢেঁকি এবং দোলনাও। আশেপাশের  দরিদ্র বাচ্চারাও খেলতে আসে সেখানে; মাঝে মাঝে মাস্টাররাও দেখতে এসে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। সন্ধেবেলা তাদের ঘরের সামনে নিস্তব্ধ অন্ধকার বারান্দায় বসে বাঁশি বাজায় রণেন। ইচ্ছে হলে মিতাও গান গায়। আর তারা দুজনে মিলে ঘুরে বেড়ায় নির্জন গ্রামের পথে-পথে। চম্পতিমুন্ডার বন-আস্তানায় এমন করেই কাটতে থাকে তাদের ভরপুর জীবন।

    তাদের আসবার দিন দশেক পরে, অনুগুল থেকে এখানে এসে, রণেনের কর্মকাণ্ড দেখে এবং ছাত্রদের কাছ থেকে তার ক্লাস নেওয়ার পদ্ধতি শুনে দারুণ খুশি হলেন নববাবু এবং মিনুদি। চম্পতিমুন্ডায় তাঁরা এসে থাকা মানেই প্রতিদিনই বেশ কিছু অতিথি আসবে। প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু বিশেষ স্নেহ করেন নিঃস্বার্থ এই আদর্শবান দম্পতিকে। তাঁদের পরিকল্পনা সার্থক করতেই এই ইশকুল তৈরিতে কেন্দ্রীয় তহবিলের অনুমোদন দিয়েছেন তিনি। সদর অফিস হয়েছে ঢেঙ্কানাল শহরে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এমন এক প্রত্যন্ত আদিবাসী অঞ্চলে যদি একটা আবাসিক সরকারি ইশকুল গড়ে তোলা যায় তো, এটাই হবে এমন এক মডেল যা অন্যন্য আদিবাসী অঞ্চলেও অনুসরণ করা যাবে। এখানেই তাদের আলাপ হয় আমেরিকান সাহেব উইলফ্রেড আর মেরির সঙ্গে। তাদের সাত-সাতটা বাচ্চা নিয়ে এদেশে এসেছে তারা, স্বাধীন ভারতের শিক্ষা-নির্মাণ প্রকল্প দেখতে। দেহাতি সম্বলপুরী শাড়ি কেটে বানানো স্কার্ট পরা মেরিকে দেখে তো আপ্লুত হয়ে গেল মিতা। ওই একই শাড়ির কাপড়ে বানানো ফতুয়া পরে আছে তার বর এবং ছেলেমেয়েরাও। আর সেই দুই সাহেব এবং মেম অবাক হয়ে গেল, পাবলিক স্কুলে পড়া এবং পাকা ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলা রণেন ও মিতাকে দেখে। ঢেঙ্কানালের বদলে, তাদের সাত ছেলেমেয়ে নিয়ে চম্পতিমুন্ডাতেই ঘন-ঘন থাকতে লাগল মেরি আর উইলফ্রেড। ওখানে বসেই ওই ইশকুলেরই ছাত্রদের আঁকা এবং মেরির ইশকুলের আমেরিকান ছাত্রদের আঁকা ছবি নিয়ে দারুণ এক এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামও করিয়ে ফেলল রণেন। সেসব খবরের সপ্রশংস সরকারি চিঠি দিল্লি মারফত এসে পৌঁছল নববাবু এবং মিনুদির কটকের বাড়িতে। বিদেশি ছাত্রদের আঁকা ছবির প্রদর্শনীতে ঝলমল করে সেজে উঠল, চম্পতিমুন্ডার ইশকুল-মাঠ।

    ওড়িয়া লোকনাট্যের সঙ্গেই, রণেন এবং মিতার পরিচালনায় এখানকার ছাত্ররা মঞ্চস্থ করল ইংরেজি নাটক আলাদিন। সেদিন বহু বিশিষ্ট মানুষদের উপস্থিতি এবং প্রশংসায় সাড়া পড়ে গেল এই আদিবাসী ইশকুলে। গ্রামের দরিদ্র মেয়ে-বউদের স্বপ্রণোদিত হয়ে তরুলতার শেখানো সেলাইয়ের কাজগুলিরও প্রশংসা করলেন সকলেই। অতিথি এবং গ্রামের অপরিচিত লোকেরাও প্রায় জনে-জনে এসে আলাপ করে গেলেন রণেন, মিতা এবং তরুলতার সঙ্গে। নববাবু আর মিনুদির জ্ঞান এবং পরিচিত-পরিধির যেন তল পায় না মিতা। অবাক হয়ে দেখে ভারতীয় সংবিধানের ওই দুই সাক্ষরকারীকেও। গান্ধী-বিনোবা ভাবের এই দুই মন্ত্রশিষ্য কেমন অনায়াসে বেরিয়ে এসেছেন সমস্ত বৈভব বৃত্তের বাইরে। তাঁদের দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে, মহাদেব দেশাইয়ের ছেলে নারাণ দেশাইয়ের সঙ্গে। ওই মেয়ের দুই ছেলেমেয়ে পুষু এবং মুনুও মাঝে মাঝেই থাকতে চলে আসে, দাদু-দিদার সঙ্গে অনুগুলের বাজিরাউত ছাত্রাবাসে। এঁদের এই জীবনযাপন এবং কর্মকাণ্ড মিতাকে দেখিয়ে রনু বলে, ‘দেখ এটাও কিন্তু একটা সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট; তবে কোনও ভাইসরয়ের প্রাসাদ বা বলরুম নেই এখানে; একেবারে মাটি থেকে গজানো গাছের মতো। তাই সেলাম ঠুকে শিরোপা পাবার ব্যাপারটাও এখানে নেই।’ মিতা বুঝতে পারে যে, এইরকম সব মানুষজনের কাছাকাছি ছিলেন বলেই তরঙ্গনাথ ও তরুলতার জীবনটাও ছিল অত সহজ এবং সুন্দর। মিতা বুঝতে পারে যে, এই মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি বোঝার মতো সচেতনতা তার বাবার নেই। বাবার চোখে সাফল্যের অভিধান হল পদ, শিরোপা এবং সেলাম। এর বাইরে যারা, তাঁর কাছে বাকি সবাই হল অলস এবং অপোগণ্ড। মনে-মনে খুব শান্তি পেল মিতা; তার বাবার সঙ্গে নববাবু বা মিনুদির যোগাযোগ হবার কোনওই সূত্র যে নেই সেটা ভেবে।

    রণেন-তরুলতার মতো না হলেও এখন বেশ গড়গড় করে ওড়িয়া বলতে পারছে মিতাও। সহকর্মী জয়নারায়ণভাই, ছাত্র মুকুন্দ বা আনন্দ— এরা তো ওড়িয়া ছাড়া আর কোনও ভাষাই বলেনি কখনও। তবে সবচেয়ে ভাল ওড়িয়া বলছে তাদের মেয়ে ঝিনি। মুঠো-মুঠো কাঁকড় কুড়িয়ে সে বোঝাতে চায় যে, এগুলোও ‘অ্যাঁওলা’ মানে আমলকী; তাই সে মুখে পুরতেই পারে। সকাল হলেই তার ফকিরজেঠু ভাল করে তেল মালিশ করে তাকে রোদ পোহাতে বলে। একটা বড় ছাতার নীচে বসে নিজের মনে বকবক করেই সে সময় কাটায়; ঠাকুমার কাছে স্নান করে আর নির্ভয়ে খেলে বেড়ায় সমস্ত চত্বর জুড়ে। কোনও কিছুতেই ভয় নেই তার। একদিন সাপ বেরনোর পর, তাকে ভয় দেখতে গেলে মিতাকেই উলটে সে বলেছে, ‘সাপ খুব ভাল; আমাকে ডাল দেয়, ভাত দেয়, তক্কারি দেয়।’ সকলের তাই বড় আদরের এই ‘ঝিনিমা’। ঝিনির এক বছরের জন্মদিন উপলক্ষে একশোটা রসগোল্লা বানিয়ে ফেললেন তরুলতা। রণেনের দেখিয়ে দেওয়া নকশায়, বাচ্চাদের রিটার্ন গিফ্‌ট হিসেবে, গাছের শুকনো ডাল আর বাতিল ন্যাকড়া-চোকড়া দিয়ে মিতা বানিয়ে ফেলল অগুনতি পুতুল। তরুলতার ব্যবস্থাপনায় কমন কিচেনে সেদিন রান্না হল, উড়িষ্যার প্রিয় খাবার— ডালমা, খুরসুলা শাক ভাজা, কাঁচকলার সাঁতলি আর মুড়ি-মাংস। বিশেষ আমন্ত্রণ পেয়ে অনুগুল থেকে চম্পতিমুন্ডা এলেন নবকৃষ্ণ এবং মালতীও। সেদিন রাতে হ্যাজাকের আলো জ্বেলে সকলকে ম্যাজিক দেখাল রণেন। রাতে শুতে যাবার আগে রণেনের আঁকার ঘরে গিয়ে খান দশেক নতুন ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন নববাবু। ছাত্রাবাসের পিছনে থাকা, প্রাচীন সেই লম্বা পাথরদুটোকে রণেনের ছবিতে দেখেই তিনি বললেন, ‘এ ছবির নাম— We Exist’।  

    ************************************************************************

    আমি রণেন এ-যাবৎকালে সর্বতোভাবে সুখী এক মানুষ মায়ের হাসিমুখ, মিতার আহ্লাদ এবং নববাবু ও মিনুদির বিশেষত আমার প্রতি গভীর আস্থা, আমাকে যেন নতুন করে বুঝিয়ে দিল যে আমি কোনও বাতিলযোগ্য মানুষ নই ভিজিটিং ফ্যাক্যাল্টি হিসেবে একবার অন্তত তাদের দেশে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য মেরি আর উইলফ্রেডের জোরাজুরি— সেটাও বেশ চুটিয়ে উপভোগ করেছি আমি উপভোগ করেছি, এখানকার গ্রামের আনাচকানাচ ঘুরে, তাঁতিদের সঙ্গে বসে-বসে পছন্দের রঙে এবং নকশায় মিতার জন্য শাড়ির বানিয়ে এনে খুব ভাল লেগেছে এখানকার মানুষদের মুখগুলির ছবি একের পর এক এঁকে

    আবার বিরক্তও হয়েছি, দিবানিদ্রার সময়ে আমার নাকডাকা নিয়ে মিনুদির অভিযোগ শুনে; মাস্টার বলে কি নাকডাকাও যাবে না?  

    বড় ছেলেদের নিয়ে জঙ্গল তাড়িয়ে একটা হরিণ মেরে এবং সেই মাংস সকলে মিলে খেয়ে যা আনন্দ পেয়েছি, সে তো বলার নয় তবে দল জুটিয়ে এই হরিণ মারতে যাওয়ায় মিনুদির যে-অসন্তোষ, সেটা আমি বুঝতে পেরেছি পুলিশের ছেলের সেই পুরনো উন্মাদনা ফিরে এলে এখানকার পক্ষে তা যে খুবই ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে, সে আমি ভালোই জানি শিকার এদের রক্তে; আবার যদি তা ধুয়ো পায়, গোলমাল বাধতে সময় লাগবে না; মাঝখান থেকে নতুন আইনে জঙ্গল-প্রাণী হত্যার দায়ে, থানা-পুলিশের কেসে অযথা ফেঁসে যাবে এই গরিব মানুষগুলোই

    আরও একটা ব্যাপারেও না বুঝেই একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে সেদিন মিতা এখন প্রায় চার মাসের গর্ভবতী এ-কথা জেনেও তাকে নিয়ে পায়ের-পাতা-ডোবা জল হেঁটেই পার হয়ে চলে গেছিলাম দুজনে; মাতলি নদীর ওই পারে, এ-সময়ে অজস্র ফুলে ভরে-ওঠা ঝাঁকড়া সেই পারুল গাছটা চেনাতে ঝমঝম করে হঠাৎই বৃষ্টি হয়ে মাতলির জল এমন বেড়ে গেল যে, হাঁটব কী! জলের স্রোতে তো পা-ই রাখতে পারছি না কেউ শেষে দুজনেই জলে নেমে মিতাকে বললাম আমার দু’হাত ধরে ভেসে থাকতে ওকে ওইভাবে স্রোতের মুখে ভাসিয়ে-ভাসিয়ে এবং নিজেও স্রোতের উলটোদিকে সাঁতার কেটে-কেটে পারে এনে তুললাম ভাগ্যিস মিতাও সাঁতার জানত! সেদিন ভিজে কাপড়ে ইশকুলে ফিরে এলে, মিতার দিকে তাকিয়ে মা শুধু বলেছিলেন, ‘রনুর সঙ্গে বনেজঙ্গলে এ-সময়ে ঘুরে-ঘুরে বেড়ানোটা একটু বন্ধ রাখলেই মঙ্গল

    মেরি-উইলফ্রেডরা ফিরে গেল; ইশকুলেও আরও কয়েকজন উৎসাহী মাস্টার এসেছেন; মা উদ্বিগ্ন রমিতার প্রসব নিয়ে; এখানকার মাইনেপত্র কম হলেও নিয়মিত জমা পড়ায় হাতে একটু টাকাও এসেছে আমাদের ফকিরও ব্যস্ত হয়েছে দেশ থেকে একবার ঘুরে আসবার জন্য

    রেজিগনেশন দিয়ে, মালপত্র নিয়ে আমরা আবার ফিরে এলাম সোদপরের বাড়িতে ওখান থেকে নিয়ে এলাম আমাদের উদ্দাম প্রেমের ফসল— দ্বিতীয় সন্তানের জন্মসূচনা; আর নিয়ে এলাম, ভাড়া তুলে দিয়ে নিজেদের বাড়িতেই একটা ইশকুল করবার নিটোল স্বপ্ন

    আশ্চর্য হয়ে দেখলাম যে, নববাবুর নাম দেওয়া সেই ‘We Exist’ ছবিটার পাথরগুলোর রং একেবারে ‘Hooker’s Green’ তবে তাতে একটুও শ্যাওলা লেগে নেই সকালের উজ্জ্বল আলোয় ওই রংটাকেই মনে হচ্ছে পান্না-সবুজ

    মনে পড়ল, বিকেলের আলোয় বনস্থলির ছায়া-ভাসা সবুজাভ মাতলিকেও তো এমনই উজ্জ্বল লেগেছিল সেদিন! অমন বিপাক-স্রোতে সাঁতরেও তো মিতার খোঁপা থেকে খসে যায়নি বেগুনি পারুল ফুলটা! সবুজ পাতার মধ্যে থেকে পেড়ে এনে, সেদিন যেটা আমি লাগিয়ে দিয়েছিলাম, মিতার খোঁপায়!

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook