ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ভোটের ম্যাসকট


    আবীর কর (May 11, 2024)
     

    ভোট বড় বালাই। সেই কবে দাদাঠাকুর বলেছিলেন, ‘আমি ভোটের লাগিয়া ভিখারি সাজিনু/ফিরিনু গো দ্বারে দ্বারে…’ বা আরও সরস প্যারোডিতে লিখেছিলেন, ‘ভোট দিয়ে যা/আয় ভোটার আয়/মাছ কুটলে মুড়ো দিব/ গাই বিয়োলে দুধ দিব…’। লোকসভা ভোট শুরু হয়ে গেছে। ভোটের প্রার্থীরা ভিখারির মতো ঘুরছেন ট্রেনে-বাসে, খেতে-খামারে, চায়ের দোকানে, পাড়ার আড্ডায়, এমনকী গেরস্থের রান্নাঘরেও তাঁরা ঢুকে পড়ছেন। মুখভরা হাসি আর গালভরা প্রতিশ্রুতিতে প্রমাণের আপ্রাণ প্রচেষ্টা, ‘আমি তোমাদেরই লোক’।

    এসব নাহয় হল, কিন্তু তাই বলে জনগণকে ভোট দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা কিংবা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা! না, তাঁরা ভোটপ্রার্থীর প্রতিনিধি নন। তাঁরা হলেন স্বয়ং প্রশাসন তথা বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন কমিশনের প্রতিভূ। ফেলুদা এবং টেনিদা হলেন ভোটের ম্যাসকট। মনে পড়বে, ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে পুরুলিয়া জেলার ভোটারদের উৎসাহ দিতে ভোটের ময়দানে সত্যজিৎ রায়কে সহায় করেছিলেন জেলা প্রশাসন। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর আদলে ‘জয় বাবা ভোটনাথ’, আবার সঙ্গে জটায়ু ও তোপসে। ফেলুদার মতোই ভোটনাথের পরনে পাঞ্জাবি আর পায়ে কোলাপুরি চটি। তোপসে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিস্বরূপ ফুল শার্ট, কালো ট্রাউজার্স, অন্যদিকে প্রবীণদের পক্ষে ধুতি-পাঞ্জাবি আর জহরকোটে জটায়ু তথা লালমোহন গাঙ্গুলি। ভোটনাথের তলায় লেখা, ‘আমি দাঁড়াচ্ছি ভোটের লাইনে। আপনারাও আসুন’। সেবার শুধু ফ্লেক্স-ব্যানারে ভোটনাথের আবেদন থেমে থাকেনি, প্রশাসনিক স্তরে নির্মিত হয়েছিল তার অডিও-ভিডিও ক্লিপ। সেখানে শুরুতেই ফেলুদার সেই সিগনেচার-টিউন। তারপর ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবির চরিত্রদের মুখে রাখা হয়েছে ভোটের জন্য ‘উদ্দেশ্যমূলক সংলাপ’। সেখানে জটায়ুর সঙ্গে হাজির মগনলাল মেঘরাজ। এক জায়গায় মগনলাল তার নিজস্ব ঢঙে বলে চলেছে, ‘নিয়ম তো বহুত সিম্পল আছে। আপনাকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। ঘরে বসে থাকবেন। আমি ভোট করিয়ে দেব।’ তার উত্তরে ভোটনাথের সটান জবাব, ‘আপনাকে ভোট করাতে হবে না। ভোট করানোর জন্য নিরাপত্তা বাহিনী ও ভোটকর্মীরা রয়েছেন। সর্বোপরি নির্বাচন কমিশন আছে। ভোট আমাদের অধিকার।’ মগনলাল আর ভোটনাথের সংলাপেই স্পষ্ট আমাদের ভোট ও তার অধিকারের নেপথ্য কাহিনিটি। যদিও সেই ভরাভয়কে বরাভয়ের উদ্দেশ্যেই নির্মিত এহেন কল্পকাহিনি। তবে পুরুলিয়া জেলায় ফেলুনাথ তথা ভোটনাথের আগমনের কারণ বোধহয় পরিচালক সত্যজিতের কালজয়ী সিনেমা ‘হীরক রাজার দেশে’র একটা বৃহৎ অংশ শুটিং হয়েছে পুরুলিয়ার জয়চণ্ডী পাহাড়ে এবং আড়ষা গ্রামে।

    বাঙালির জনপ্রিয় ফেলুদার পাশাপাশি খুব পরিচিত মজার চরিত্র টেনিদা। এবার ২০২৪-এর লোকসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে উত্তর কলকাতার নাগরিকদের বুথমুখী করতে ভোট ময়দানে টেনিদা। শোনা যায়, টেনিদা তথা ভজহরি মুখুজ্জের ঠিকানা উত্তর কলকাতার পটলডাঙা। ঢ্যাঙা, দীর্ঘনাশা, ভোজনরসিক, গুলগল্পে সাবলীল ভজাদা তথা টেনিদা কি পারবে, চৌরঙ্গী-জোড়াসাঁকো অঞ্চলের ভোটারদের ভোটদানের হার বাড়াতে! ২৫ জানুয়ারি জাতীয় ভোটার দিবসে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের উদ্যোগে এই লোকসভায় উত্তর কলকাতার ভোট-ম্যাসকট নির্বাচিত হয়েছেন টেনিদা; সঙ্গে আছে হাবুল, ক্যাবলা আর প্যালা। টেনিদার মুখে সিরিয়াস কথা, ‘আমি পটলডাঙার টেনিদা বলছি, আমার ভোট, আমার অধিকার। সুবিধা আছে বুথে, চল সবাই ভোট দিতে। ডি-লা-গ্র্যান্ডি-মেফিস্টোফিলিস।’ কোনও বক্তব্য ঢাকাইয়া বাঙাল হাবুলের উদ্দেশ্যে, ‘মনে রাখিস হাবুল, তোকে যেন কেউ রাবড়ি আর চমচম খাইয়ে ভোট না লুটে নেয়। ভোটাধিকার ভাগ হবে না। Every Vote counts.’ আবার চশমা-আঁটা ‘জ্ঞানী’ ক্যাবলাকে টেনিদার মোক্ষম ডায়লগ, ‘শোন ক্যাবলা, বড়-বড় কথা বলিস, অথচ ভোট দিতে যাস না। আমরা ভারতের ভোটদাতা, আমরা ভারতের নির্মাতা। Use your vote, use your voice.’ এছাড়াও পালাজ্বরে ভোগা, পেটরোগা, পটল দিয়ে শিঙি মাছের ঝোল খাওয়া প্যালাকে টেনিদার স্পষ্ট বার্তা, ‘ওরে প্যালা, পটল দিয়ে শিঙি মাছের ঝোল-ভাত তো এতদিন খেয়ে এলি। এবার যা, জীবনে প্রথম ভোটটা নির্ভয়ে দিয়ে আয়! মনে রাখিস, The Ballot is stronger than the Bullet.’ এইরকম সব টুকরো কথায় টেনিদার বাক্‌চাতুর্যে গণতন্ত্রে জনগণের শক্তি ও নির্বাচনের স্বচ্ছতা তুলে ধরেছেন উত্তর কলকাতার প্রশাসন।

    ভোটে গণতন্ত্রের জয়গান, সাধারণ মানুষের অসাধারণ ক্ষমতা প্রতিপন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে বারে বারেই নির্বাচনের ময়দানে নামতে হয়। এমনকী স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যম করে তাদের অভিভাবকদের কাছে পৌঁছাতে হয় সাধারণের ভোটাধিকার সম্পর্কে সচেতন বার্তা এবং পরিশেষে তাদের ভোট দিতে তথা দেশ গড়তে আহ্বান জানানো হয়। আর এই আহ্বানকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন ম্যাসকট। যদিও দেশের নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব স্থায়ী ভোট-ম্যাসকট আমাদের জাতীয় পশু বাঘের আদলে হলুদ-কালো ডোরাকাটা ‘শেরা’। লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত— যে-কোনও অঞ্চলে ভোটের প্রচারদূত হতে পারে ‘শেরা’, কিন্তু তারপরও অঞ্চলভেদে এলাকাবাসীর মধ্যে ভোটদানের হার বাড়াতে, গণতন্ত্রের ধ্বংসকারীদের রুখতে, নির্ভয়ে-নিশ্চিন্তে ভোটদানের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে, যে-কোনও রাজ্যের যে-কোনও জেলার জেলা-প্রশাসনিক স্তরে সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সহজে সংযোগ করতে স্বচ্ছন্দ কোনও বিষয়বস্তু বা ব্যক্তির চিত্র-চরিত্রকে আসন্ন নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ স্বচ্ছ ভোট-প্রচারক হিসেবে তুলে ধরা হয়। জেলা প্রশাসনের নকশা-নির্মিত ম্যাসকট ও তার বিশ্লেষণ নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠিয়ে চূড়ান্ত অনুমতি পেলে জেলা প্রশাসনের নির্বাচনী দপ্তর আনুষ্ঠানিক ভাবে জনসংযোগের ক্ষেত্রে ম্যাসকটকে ব্যবহার করেন। ২০১১ সাল থেকে সাধারণতন্ত্র দিবসের আগের দিনকে জাতীয় ভোটার দিবস আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তারপর থেকে ভোটের বছর মূলত ভোটার দিবসেই জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ভোটের ম্যাসকটের কার্যক্রম শুরু হয়। যেমন ২০১৯ সালের লোকসভায় পূর্ব বর্ধমানের ‘ভোট্টু’ তথা ভোটের ম্যাসকট চিহ্নিত হয়েছিল ধানশিসের ফ্রেমে কাঠের পেঁচা, যা পূর্ব বর্ধমানের ধান চাষ এবং নতুনগ্রামের কাঠের পুতুলের প্রতিনিধিত্বমূলক। সেবার ধান্যলক্ষ্মী আর লক্ষ্মীপেঁচাযুক্ত ফ্লেক্স, ব্যানার এবং ট্যাবলো প্রচার চালিয়েছিল, ‘নির্ভয়ে ভোট দিন, নিজের ভোট নিজে দিন’। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পূর্ব বর্ধমানের ‘ভোট্টু’ ছিল ‘বাঘচাষি’। কাঁধে লাঙল নিয়ে ট্রাক্টরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বাঘমামা, পূর্ব বর্ধমানের চাষিদের প্রতিনিধি হয়ে তিনি সাধারণ মানুষকে নির্ভয়ে ভোটদানের সাহস জোগান। অন্যদিকে স্টিল-আয়রন অঞ্চল পশ্চিম বর্ধমানে ২০১৬-তে ভোট-ম্যাসকট ছিল, ‘স্টিলম্যান’। জেলা নির্বাচন আধিকারিক, ‘স্টিলম্যান’-এর উদ্বোধনকালে অভয় দেন, ‘ভোটাররা নির্ভয়ে যেন ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে হাজির হন।’

    এবার যা, জীবনে প্রথম ভোটটা নির্ভয়ে দিয়ে আয়! মনে রাখিস, The Ballot is stronger than the Bullet.’ এইরকম সব টুকরো কথায় টেনিদার বাক্‌চাতুর্যে গণতন্ত্রে জনগণের শক্তি ও নির্বাচনের স্বচ্ছতা তুলে ধরেছেন উত্তর কলকাতার প্রশাসন।

    এক-এক জেলায়, মূলত জেলার পরিচিতি সাপেক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন নির্বাচন কমিশন নির্দিষ্ট ভোট-ম্যাসকট। তাই অনেক সময়ে জন-প্রাণী ছাড়াও জনপ্রিয়তায় এগিয়ে থাকা বিষয় বা বস্তুর দায়িত্বেও থাকতে পারে এহেন দায়িত্বভার। যেমন ২০১৬-র বিধানসভায় মালদা জেলায় ভোটের প্রচারে নেমেছিলেন ‘ফজলিবাবু’। হ্যাঁ, সেবার মালদার আমই আমজনতাকে ভোটদানে উৎসাহিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিল ইলেকশনের ময়দানে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা বরাবরই দক্ষিণরায়ের খাসতালুক। তাই তার বীরবিক্রমের বিভঙ্গে গড়া ‘বাঘু’ ২০২১-এর বিধানসভায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ব্লকে-ব্লকে ছড়াল সমাচার, ‘বাঘু বলে/ভোট দেব সকলে’। গোসাবা ব্লকে বাঘুর ট্যাবলোতে লেখা হল, ‘গোসাবার গর্ব, বাঘ, হরিণ, সুন্দরবন এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন’। বা, ‘গোসাবার গর্ব জল, জঙ্গল, বাদাবন এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন’। অন্যদিকে উত্তর চব্বিশ পরগনায় সেবার ভোটদূতের ভূমিকায় ছিলেন স্বয়ং ‘বাগদা’। পুরো জেলা মাছ চাষের জন্য বিখ্যাত। ৩৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বাগদা চাষ হয়। মিষ্টি ও নোনা জলের হরেক স্বাদের মাছের মধ্যে সেরা বাগদা চিংড়ি। উত্তর চব্বিশ পরগনার ঠাটে সেই ‘বাগদা বলেন, সকলে ভোট দিতে চলেন’। আবার দিনাজপুরের উত্তর এবং দক্ষিণের মধ্যে দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমুন্ডির মুখা বা মুখোশের ঐতিহ্যে গড়া ‘নাগরিক’ ২০১৯-এর লোকসভায় লোকজনের ভোট-সচেতনতা বাড়াতে সাদা ধুতি আর হলুদ পাঞ্জাবিতে সেজে ওঠেন। মুখা নাগরিকের মুখে ছিল, ‘আপনার ভোট/আপনার অধিকার/দেশ গড়ার অঙ্গীকার’। ২০২১-এর বিধানসভায় ওই ম্যাসকটে স্থলাভিষিক্ত হন জেলার আর এক অন্যতম জনপ্রিয় খন পালাগানের ‘খন-দাদু’ আর ‘খন-দিদা’। তাঁরা ছড়ার সুরে বললেন, ‘আঠারো হোক বা আশি/চলো ভোট দিয়ে আসি’। কিংবা, ‘বুথেই হোক বা পোস্টালে/গড়ব দেশ সবাই মিলে’। এইভাবে জেলার প্রযত্নে ব্লক স্তরের নানা অঞ্চলে ভোটের ম্যাসকটের প্রচারাভিযান চলে, ভোট-বর্ষের গোড়া থেকেই। প্রথমে ভোটার তালিকায় নতুন নামের অন্তর্ভুক্তিতে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনীতে ম্যাসকটের ভূমিকা রয়েছে। তারপর অবাধ, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের অঙ্গীকারে চলে তার অভিযান। জেলার প্রতিভূ হয়ে সে জেলাবাসীকে সচেতন করে। ২০১৪ লোকসভায় দার্জিলিং-এর বাসিন্দাদের ভোট সচেতনতা বাড়াতে ম্যাসকটের ভূমিকায় ছিল ‘রেডপান্ডা’। গঙ্গা-বিস্তীর্ণ হুগলির ক্ষেত্রে ২০১৬-র বিধানসভায় ভোটের পক্ষে প্রচারে নামানো হয়েছিল ‘শুশুক’কে। আবার ২০২১-এর বিধানসভায় আলিপুরদুয়ার জেলায় বঙ্গযুদ্ধের ভোট-লড়াইয়ে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা প্রমাণের জন্য তোড়জোড় বেঁধে ছিল ‘একশৃঙ্গ গন্ডার’। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হাওড়া জেলার জন্য ‘বাঁটুল’, পশ্চিম মেদিনীপুরে ‘ধামসা’, বীরভূমে ‘একতারা’ ভোটার তালিকা তৈরিতে এবং ভোটারদের সচেতন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

    তবে ভোটযুদ্ধের মাঠে-ময়দানে সবচেয়ে বেশিবার ম্যাসকটের ভূমিকায় যথার্থ ভূমিকা পালন করে এসেছেন যিনি, তিনি হলেন গোপাল ভাঁড়। তার দায়িত্বে পড়ে নদিয়া জেলা। কথিত আছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার বিদূষক ছিলেন সুচতুর ও সুরসিক গোপাল ভাঁড়। যদিও তার ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নিয়ে অনেকেই সন্দিহান; কিন্তু সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে তার জনপ্রিয়তা। সম্ভবত সেই জনপ্রিয় প্রিয়জন হয়ে নদিয়াবাসীকে ভোটের ব্যাপারে সচেতন করতে ‘ভোট গোপাল’ পর পর চারবার নির্বাচিত হন। সেই বেঁটেখাটো বেঢপ চেহারা, খেটো ধুতি, বিশাল ভুঁড়িযুক্ত বপুতে ছোট্টো ফতুয়া, মুখে এক চিলতে মিচকে হাসি। ২০১৬-র বিধানসভায় ‘ভোট গোপাল’-এর বক্তব্য ছিল, ‘ভোট আমাদের মিশন/পাশে আছে নির্বাচন কমিশন’। ২০১৯ সালের লোকসভায় ‘ভোট গোপাল’-এর কড়া নির্দেশ ছিল, ‘কোনও ভোটারই যেন বাদ না পড়ে’। ২০২১-এর বিধানসভায় ম্যাসকটের ভূমিকায় গোপাল ভাঁড়ের হ্যাট্রিক। সেই সময়ে আবার করোনা অতিমারীর সংকটকাল কাটিয়ে ভোট, তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে গোপালের মুখে মাস্ক, হাতে স্যানেটাইজার আর বাঁ-হাতের তর্জনীতে ভোটদানের কালি। সেবার নির্বাচনক্ষেত্রে তার সাফ কথা ছিল, ‘মগজাস্ত্রে দিয়ে শান/সপরিবারে ভোট দান’। এবারের লোকসভাতেও শোনা যাচ্ছে নদিয়ার জেলা প্রশাসন তাদের প্রিয় গোপাল ভাঁড়কেই চাইছে ‘ভোট গোপাল’ হিসেবে, যিনি সহজ কথায় ভোটের কথা বলতে পারেন সাধারণ মানুষকে।

    এই লোকসভা নির্বাচনে ভোটের নতুন ম্যাসকট হিসেবে ইতিমধ্যেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন ‘ঘোটকনাথ’, তিনি বাঁকুড়া জেলার প্রতীকী চরিত্র। সম্ভবত বাঁকুড়া জেলার পাঁচমুড়া গ্রামের ঘোড়ার খ্যাতিতেই এহেন চরিত্র নির্মাণ। এই ‘ঘোটকনাথ’ ডাক দিয়েছেন, ‘চলো ভোটে যাই, দেশ বানাই’। কোথাও-বা জেলার নারীশক্তিকে উজ্জীবিত করতে আহ্বান জানাচ্ছেন, ‘বাঁকুড়ার মা-বোন শোনো/ঘরের মতো দেশের ভারও/তোমাদের হাতে জেনো’। এর আগে ২০২১-এ, বাঁকুড়া জেলার ভোট-ম্যাসকট ছিলেন মাদল কাঁধে ‘ভোটানন্দ’, তার ট্যাগলাইন ছিল, ‘ভোটের সাজে/মাদল বাজে’। ভোটানন্দের সূত্রে মনে আসবে ছৌ-নৃত্যশিল্পীদের অবয়বে গড়া সুঠামদেহী বীর ‘ভোটেশ্বর’-এর কথাও, ২০১৬-র বিধানসভার প্রচারে পুরুলিয়ার ম্যাসকট। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, ইয়াব্বড় গোঁফ, পরনে বাঘছাল, চরণে নাগরা আর নির্ভীক কণ্ঠে তার বক্তব্য ছিল, ‘আমি তো রয়েছি, নির্ভয়ে ভোট দিন’। সেবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিচারে সেরা ম্যাসকট নির্বাচিত হয়েছিল ‘ভোটেশ্বর’। দক্ষিণবঙ্গের বাঁকুড়া-পুরুলিয়া বরাবরই ভোটের ম্যাসকট ব্যবহারে এনেছে নতুনত্ব এবং তাদেরকে পাথেয় করে ভোটের প্রচারে বেড়েছে ভোটদানের হারও। এবং এক্ষেত্রে হার বাড়লেই জিত। এবারেও নির্বাচন কমিশনের নজর কেড়েছে পুরুলিয়ার ভোট-ম্যাসকট ‘পলাশমণি’। পুরুলিয়ার পরিচিতিতে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে ছৌ, টুসু আর পলাশ। তাই ছৌ-এর মুখড়ায়, পলাশের সাজসজ্জায় এবং আদরের টুসুমণি নামের অনুকরণে ‘পলাশমণি’। তিনি নির্ভয়ে নিজের ভোট নিজে দেওয়ার কথা বলছেন। তাঁর বাঁ-হাতের তর্জনীতেও ভোট দেওয়ার চিহ্ন। ‘পলাশমণি’ জিতে নিয়েছেন রাজ্য নির্বাচন দপ্তরের পুরস্কার। এর আগে ‘ভোটেশ্বর’ও পুরস্কৃত হয়েছেন। পুরুলিয়ার ভোট প্রচারে কখনও এসে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছেন ‘ফেলুদা’, উত্তর চব্বিশ পরগনার হয়ে একদা গলা ফাটিয়েছেন ‘বাগদা’, এবার উত্তর কলকাতার হয়ে ভোটারদের ঘুম ভাঙাতে নেমেছেন ‘টেনিদা’। নদিয়ার মানুষকে বুথমুখী করতে আজও ‘গোপাল ভাঁড়’ সর্বেসর্বা। এইসব স্বনামধন্যদের জানাই কুর্নিশ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনী উৎসবকে সফল করতে যারা আজও অদ্বিতীয় এবং অপরিহার্য!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook