আমি খেতে বসলে তুমি খামোখা বসে থাকো কেন? এখন কি আর স্বামী-সোহাগিনী সতীসাধ্বীর যুগ আছে? রাস্তায় গিয়ে দেখো একবার।’
‘আমি অমন যুগের সঙ্গে বদলে যেতে পারব না বাপু! মা-ঠাকুমাকে যা করতে দেখেছি আমিও তাই করি।’
‘কিন্তু তোমাদেরই তো বদলে যাওয়ার সময়। এখন হল নারীবাদের যুগ। নারীবাদ বোঝো? একদিন বুঝিয়ে দেব ’খন। ছেলে আর মেয়েদের আজকাল পোশাকের কোনও তফাত নেই। একজন ছেলে যা পরতে পারে একজন মেয়ে পারবে না কেন?’
‘কই কোনও ছেলেকে তো শাড়ি পরতে দেখিনি! তুমি পরবে শাড়ি?’
রামরতন শব্দ করে হেসে ওঠে। তারপর বলে, ‘তুমি একেবারে ঠিক ধরেছ। যতই সমান সমান বলে চেঁচাক, ছেলে আর মেয়ে তো সমান হয়ে গেল না! তুমি যেভাবে সন্তান মানুষ করতে পারবে আমি কি তেমন পারব কখনও? আমি এই যে স্ট্রাগলটা করছি সেটা তুমি কখনও করতে পারবে না। এত অপমান-বাধা-বিপত্তি হারকিউলিসের মতো কাঁধে চাপিয়ে পথ চলতে হয় প্রতিদিন তা কোনও মেয়েমানুষের কম্ম না।’
রামরতন সাপটে সাপটে ভাত মাখে আর মুখে তোলে। ভাতের স্পর্শে জিভ থেকে মুছে যায় গোটা দিনের পরিশ্রম, ব্যর্থ ঘোরাঘুরি। ফ্যানের হাওয়াও তার খোলা গা থেকে সবটা ঘাম মুছে ফেলতে পারে না। সে বড়সড় একেকটা দলা মুখে দেয় আর বুকের বড় বড় লোমগুলোর ওপর দিয়ে আঙুল চালাতে থাকে। পেটে দুটো ভাত পড়ে এতক্ষণে তার শরীরটা একটু জুড়াচ্ছে। সারাটা দিন খবরের কাগজের অফিস, পত্রিকার অফিস ঘুরে ঘুরে কেটেছে। যতটা পারে সে হেঁটেই ঘোরে। না পারলে বাস। তা সত্ত্বেও সারাটা দিন ঘোরার পরেও প্রায়শই দেখা যায় সে একটাও লেখার বরাত পায়নি। যেদিন সে কাজ পায় সেদিন মাইলের পর মাইল হেঁটে চলে যেতে পারে, এতটুকু ক্লান্তি বোধ করে না। এসব কাজের জন্য হেঁটে হেঁটে ঘোরার দরকার পড়ে না, একটা ফোন করলেই হয়ে যায়, কিন্তু রামরতনের তাতে বেজায় আপত্তি। সে বলে, ‘পরিশ্রমের একটা মূল্য আছে না? লেখালিখির কাজ অত ফাঁকি দিয়ে হয় না।’ গত শুক্রবার তার শরীরটা ম্যাজম্যাজ করায় কাকলি বেরোতে দেয়নি। দুপুরে রামরতন ফোন করেছিল শম্ভুনাথকে; রবিবারের সাপ্লিমেন্টে একটা লেখার জায়গা যদি পাওয়া যায়। শম্ভুনাথ ফোন ধরেনি। আলোক ঘোষও না। তপেন হাজরা কলব্যাক করলেন সন্ধের পর। শুনে চুকচুক করে বললেন, ‘ইশ, একটা জায়গা ছিল। প্রিয়দর্শীকে দিয়ে দিলাম।’ এই হয়, দূর থেকে অঞ্জলির মতো ছুড়ে দিলে কিচ্ছু হয় না। সাধকের মতো পায়ে হেঁটে জুতোর সোল ক্ষয় করে ঘুরে বেড়াতে হয়। তবে মেলে কাজ।
তা ছাড়া টেকনোলজিক্যালি সে একটু দুর্বলও বটে। জানেও না, জানার ইচ্ছেও নেই। লেখার সময়ে সে এখনও খাতা-পেনসিলই ব্যবহার করে। কম্পিউটার তার বাড়িতে নেই। ফোনটাও আদ্যিকালের ফোন। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, এসব তার ফোনে জায়গা পায় না। অবশ্য না থাকায় সে বিন্দুমাত্র অখুশি নয়, বরং সবার থেকে আলাদা হতে পেরে, নতুন যুগের হালফ্যাশনকে চেটোর আঘাতে সরিয়ে দিতে দিতে সে বেশ আত্মশ্লাঘা অনুভব করে।
তাই বলে তাকে পুরোপুরি উদাসীনও বলা চলে না। হেঁটে হেঁটে মধ্য-কলকাতা ঘুরতে ঘুরতে যখন দুপুর গড়িয়ে যায়, তখন সে মাঝেমধ্যে কলেজ স্ট্রিটে বাবলুর অফিসে এসে কিছুক্ষণ বসে। পরিবারের বাইরে এই বাবলুই তার একমাত্র বন্ধু। বয়সে সে রামরতনের চেয়েও কয়েক বছরের ছোট। বিক্রি হোক না হোক সারাদিন দোকান সাজিয়ে বসে থাকে। ইউনিভার্সিটির পুরনো প্রশ্নপত্র, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের সহায়িকা, ইউজিসি নেট-এর কোশ্চেন ব্যাঙ্ক— এইসব খদ্দের তো বাজারে কম নেই, তা-ও অন্যান্য দোকানের মতো বাবলুর দোকানে তেমন ভিড় হয় না। সারাদিনে খদ্দের আসে বড়জোর বিশ-পঁচিশজন। তার মধ্যে কেনে অন্তত সাত-আটজন। তাতেই চলে যায়, বাবলুর উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। বিকেল হলে কালিকার দোকান থেকে চপ আর মুড়ি তার দোকানে বাঁধা। রামরতন চেষ্টা করে তার আগেই ঢুকে পড়তে। তাহলে তার ভাগেও জুটে যায় দু-তিনরকম চপ আর গামলাভর্তি মুড়ি।
স্বভাবে বাবলু রামরতনের ঠিক উলটো। রামরতনের মতো উদ্যোগ, খাটনির ইচ্ছা বা ক্ষমতা কিছুই তার নেই। তার ধ্যানজ্ঞান হল বেঢপ সাইজের মোবাইলখানা— ছন্নছাড়া দোকানঘরের সবেধন নীলমণি। রামরতনের মোবাইল-বৈরাগ্য এই দোকানে এসে কিছুক্ষণের জন্য কেটে যায়। বাবলু তাকে ফেসবুকের ফিডে উঠে আসা ঘটনাবলি এক-এক করে বর্ণনা করে। কোন পত্রিকায় শঙ্খ ঘোষের কবিতা হুবহু নকল করে আরেকজন ছেপে দিয়েছে, কোন সাহিত্যিক পরকীয়া করতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন, কোন প্রকাশক সুধীনবাবুর লেখা ছেপে এখন রয়্যালটি দিতে পারছে না, কোন নতুন উপন্যাস হটকেকের মতো বিক্রি হচ্ছে— সব খবর রামরতন বাবলুর কাছ থেকে পেয়ে যায় মুড়ি আর চপ খেতে খেতে। তারপর সারা রাস্তা সেইসব কথাই ভাবতে ভাবতে আসে। তারকা সাহিত্যিকদের মহত্ব, উদারতা, কারও কারও কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির গল্প শুনতে শুনতে তার ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ে। একদিন তার নামেও কি এত এত লেখা হবে, ফেসবুক তোলপাড় করে আলোচনা হবে? নিশ্চয়ই হবে। চেষ্টা করলে সব হয়। রামরতন তার নিষ্ঠা বাড়াতে থাকে। লিখতে লিখতে রাত হয়ে যায়, ভোরে সূর্য ওঠার আগেই উঠে পড়ে। স্নান, আহ্নিক সেরে লিখতে বসে যায়। দু-তিন ঘণ্টা লিখে উঠে ঠেসেঠুসে একপেট ভাত খেয়ে সাড়ে দশটার ট্রেন ধরে শিয়ালদা। শিয়ালদা পৌঁছতে তার ঘণ্টাদুয়েক সময় লাগে। সারাদিনের মধ্যে এই ঘণ্টাদুয়েক তার চোখের পাতায় কাপাসতুলোর মতো ঘুম উড়ে এসে বসে। ঝিমোতে ঝিমোতে সে দেখতে পায় তার চারিদিকে লোকে একটু একটু করে ভিড় করে আসছে। অকৃপণভাবে সে অটোগ্রাফ বিলোচ্ছে। বড় সাহিত্য পত্রিকা থেকে ফোন আসছে ছোটগল্পের জন্য অনুরোধ জানিয়ে; ফেসবুকের যে গ্রুপগুলিতে বই-সংক্রান্ত আলোচনা হয় সেখানে একটা গোটা সন্ধে কথাবার্তা হচ্ছে শুধু তাকে নিয়ে… এসব রিপিটিটিভ স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে শিয়ালদা পৌঁছয়। শ’য়ে-শ’য়ে মানুষের সঙ্গে ছিটকে নামে প্ল্যাটফর্মে। ভিড়ের সঙ্গে পা ফেলতে ফেলতে সে মাথা নিচু করে এগিয়ে যায় আমহার্স্ট স্ট্রিট অবধি। সেখানে একটা পাবলিক টয়লেটে পেচ্ছাপ করে, ভাল করে হাত-মুখ ধুয়ে স্বপ্নগুলোকে তাড়িয়ে দেয়। তারপর শুরু হয় দপ্তরে দপ্তরে ঘোরাঘুরি।
সে ‘সাময়িকী’ সাপ্তাহিকের অফিসে ঢুকতেই সম্পাদক সুজন দাসের চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। অন্যান্য টেবিল থেকে লোকজন মুখ টিপে হাসছে। সেসব রামরতনের মগজে ঢোকে না। সে গটগটিয়ে এসে সুজন দাসের উলটো দিকে বসে, একেবারে ইয়ারদোস্তের ঢঙে জিজ্ঞেস করে,
‘কীরকম চলছে, বলুন সুজনদা!’
সুজন দাস রামরতনের দিকে তাকান না। কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলেন ‘কাজ চলছে।’ ইঙ্গিতটা রামরতন বোঝে না।
সে বলে, ‘সে তো বটেই। কাজ না করলে চলবে কী করে? এত বড় পত্রিকা, মান ধরে রাখা যায়? আগের সংখ্যার গল্পগুলো তেমন জুতের হয়নি। আমার এক বন্ধু আছে সে তো ফোন করে যাচ্ছেতাই বলল; বলল তুই দিসনি কেন, তোর গল্প তো এর চেয়ে হাজারগুণে ভাল। আমি বললাম, সবসময় আমি লিখলে তো হবে না। নতুন লেখকদেরও চান্স দিতে হবে। তারপরেও ও খুব জোরাজুরি করল; বলল, যা সুজনবাবুকে তোর একটা গল্প এক্ষুনি দিয়ে আয়। আচ্ছা বলুন তো, এটা কীরকম অত্যাচার!’
রামরতন ঝোলাব্যাগের ভেতর থেকে গল্পের পাণ্ডুলিপি বার করে সুজন দাসের দিকে এগিয়ে দেয়। সুজন দাস তখনই নেন না, কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে তারপর হাতে নেন। তারপর বলেন, ‘নির্বাচিত হলে আমরা জানিয়ে দেব। তোমাকে অফিসে আসতে হবে না। একমাসের মধ্যে না জানতে পারলে ধরে নেবে মনোনীত হয়নি।’
‘কোনও সমস্যা নেই, আমি পরের সপ্তাহে এসে খবর নিয়ে যাব। সব কাজ কি ফোনে হয়? লেখক-সম্পাদকের সামনাসামনি কথা বলাটা সাহিত্যের জন্য খুব জরুরি।’
অফিসের সবাই, এমনকী বেয়ারা রাধাকৃষ্ণ পর্যন্ত গোটা আলাপচারিতা উৎকর্ণ হয়ে শোনে, একে অপরের দিকে তাকায়, কেউ কেউ মুখে রুমাল দিয়ে হাসে— এসব রামরতন দেখেছে, কিন্তু এসবের পিছনে কারণটা কী সেটা সে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে না। অবশ্য এসব নিয়ে সে বেশি চিন্তাও করেনি। তার নিশানা মাছের চোখে স্থির থাকতে হবে, অবান্তর মানুষের কার্যকলাপ মাপজোক করে কী হবে?
কিন্তু বাঙালি কি তা করতে দেবে কাউকে? মই দিয়ে উঠতে দেখলেই লাথি মেরে মই সরিয়ে দেবে। তাদের মধ্যে সুজন দাসও যে একজন তা রামরতন জানল সেদিন। সকলের সামনে সে রামরতনকে বলল, ‘শোনো রামরতন, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। গত ছ’মাসে তুমি আটবার গল্প দিয়ে গেছ। একটাও ছাপা হয়নি। এটা হবে কি না জানি না, তবে এ ভাবে পত্রিকার দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে ঘুরে তোমার সংসার চলবে না বেশিদিন এই কথাটুকু বলতে পারি। কিছুদিন পর সম্পাদকরা তোমার লেখা আর পড়েই দেখবে না। তোমাকে অ্যাভয়েড করা শুরু করবে। শুধু লিখে হবে না, অন্য কিছু দেখার চেষ্টা করো। গল্প লিখে কারোর সংসার চলে না। প্রমোদ সান্যালের অফিসে একজন লোক লাগবে। পিয়নের পোস্ট। তুমি ভেবে দেখো। করতে চাইলে আমি কথা বলে দেব।’
কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এসেছিল রামরতন। অপমানিত সে অনেকবার হয়েছে, অনেকে বলে অপমানিত না হলে ভাল লেখা যায় না; কিন্তু তাই বলে পিয়নের পোস্ট! বাবলুর অফিসে বসে রামরতন কেঁদে ফেলেছিল ছেলেমানুষের মতো। প্রতিজ্ঞা করেছিল সুজন দাসের অফিসে সে আর কখনও যাবে না। সে যখন বিখ্যাত হবে তখন সুজন দাসকেই ছুটে আসতে হবে তার একটা গল্প নেবার জন্য। বাবলু টেবিল চাপড়ে বলেছিল— কেয়াবাত রামজি, প্রতিশোধ হো তো অ্যায়সি!
সেদিন যখন রামরতন খেতে খেতে বাঁ-হাতের আঙুলগুলো বুকের চুলগুলোর মধ্যে চালিয়ে দিচ্ছিল তখন কাকলি জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে কি কেউ কিছু বলেছে?’
‘কী বলবে?’
‘মুখ দেখে মনে হচ্ছে খারাপ কিছু বলেছে। তুমি আঘাত পেয়েছ…’
‘শোনো কাকলি, যতই প্রতিভা থাক, যথেষ্ট অপমানিত না হলে কখনও মহৎ সাহিত্যিক হওয়া যায় না।’
‘কে অপমান করেছে তোমাকে?’
‘সেসব বাদ দাও, তুমি শুনে কী করবে…’
‘আমি তোমার বউ তো, আমার শোনার অধিকার আছে। বলো না কী হয়েছে!’
‘এক সম্পাদকের দপ্তরে গিয়েছিলাম আজকে। সে আমাকে বলল, লিখে আর কী করে সংসার চালাবেন? পিয়নের চাকরি আছে একটা… করবেন?’
‘তারপর? তুমি কি বললে?’
‘আমি কিছু না বলে উঠে চলে এলাম। ভাবতে পারো কাকলি, পিয়নের চাকরি অফার করছে আমায়!’
কাকলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘পিয়নের চাকরি খারাপ কী?’
‘পিয়নের চাকরি খারাপ কী? ছোটলোকের চাকরি, এটাই খারাপ। একজন শিক্ষিত ব্রাহ্মণকে কেউ এই প্রস্তাব যে দিতে পারে তা-ই কল্পনা করা যায় না।’
‘পিয়নের চোখ দিয়ে দেখলে পৃথিবাটা হয়তো অন্যরকম লাগে। সেগুলো নিয়েও লিখতে পারো তো’।
‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? পিয়নের চাকরি অসম্মানের চাকরি। সবার ফাইফরমাশ খাটতে হবে সারাদিন।’
‘তুমিই তো বলো অপমানিত না হলে মহৎ লেখক হওয়া যায় না, তাহলে পিয়নের চাকরি নিতে আপত্তি কী?’
‘ওসব তুমি বুঝবে না। দু’টাকা কম রোজগার হলেও কলম পিষেই খাব। লোকের জন্য দোকান থেকে চা-বিস্কুট নিয়ে আসতে পারব না বাবা!’
‘ওই লোকটা যে বলল কলম পিষে সংসার চালানো যায় না। আমাদের তো সেভিংস বলে কিছু নেই। তোমার অসুখ-বিসুখ করলে…’
‘এই বয়সে কী অসুখ? অসুখ হবার আগে আমি নিশ্চয়ই লিখে নামটাম করে ফেলতে পারব।’
‘আর যদি না পারো?’
রামরতন ভাত মাখা থামিয়ে কাকলির দিকে তাকাল। আহত শিশুর মতো তার ঠোঁটদুটো কাঁপছে। চিকচিক করছে চোখদুটো। কাকলি তাড়াতাড়ি বলল, ‘মানে তোমার তো শত্রু অনেক। যদি তোমার লেখা প্রকাশ না করে…’
‘আমার ওপর তোমার বিশ্বাস নেই, তাই না কাকলি?’
‘এ মা, এ কী বলছ? বিশ্বাস থাকবে না কেন? তুমি যে একদিন নাম করবেই তা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।’
‘সন্দেহ আছে তোমার।’
‘আমার মাথার দিব্যি! শুধু বিশ্বাস নয়, হাতেকলমে তো দেখতেই পাচ্ছি। আজকেই যেমন লাইব্রেরিতে দেখলাম। ওহ্, তোমাকে তো বলাই হয়নি! তোমার লেখা একটা বইও এসেছে ওখানে। সবাই খুব প্রশংসা করছিল।’
রামরতনের মুখ থেকে গ্রহণ সরে যাচ্ছে। হঠাৎ আলোর আভা দেখা যাচ্ছে এখন। সে বলে, ‘আমার বই?’
‘হ্যাঁ গো। ‘নীল আলোর ভেলা’।’
এবার গোটা মুখটা পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার। আনন্দে বিমূঢ় হয়ে সে কাকলির দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। বইটা সে যত্ন করেই লিখেছিল বটে, কিন্তু কেউ তো উচ্চবাচ্য করেনি। মুখ ফুটে একজনও প্রশংসা করল না এখনও অবধি। কোনও পত্রিকাতে সমালোচনা বের হয়নি। কিন্তু সে তো খারাপ লেখেনি। এই লাইব্রেরিতে এনে রেখেছে মানে নিশ্চয়ই বিক্রিবাটা ভালই হয়েছে। অথচ সে যখন গিয়ে এক বছর পর খোঁজ নিল, বিক্রমবাবু কী অনায়াসেই না মিথ্যা কথাগুলো বলে দিলেন! মাছি তাড়াবার মতো হাত নাড়িয়ে বললেন, ‘আরে মশাই! বিক্রিই হচ্ছে না, আবার রয়ালটি! যান তো, বিক্রি হলে খবর দেব…’
প্রকাশক, সমালোচকরা বিট্রে করে দিল বলে, নইলে পাঠক-সমাদর তো ঠিকই পেয়েছে। এই পাড়ার লাইব্রেরির নিয়ম হল কারোর কোনও বই পড়ে ভাল লাগলে রেকমেন্ড করতে পারে। লাইব্রেরি আনানোর ব্যবস্থা করে দেবে। তার মানে একজনের অন্তত ভাল লেগেছে। এরপর যারা যারা ওখান থেকে নিয়ে পড়বে, তারাও নিশ্চয়ই মুগ্ধ হবে। ধীরে ধীরে তার নাম তৈরি হবে। বাংলার সমস্ত লাইব্রেরিতে তার লেখা বই ছড়িয়ে পড়বে। আনন্দে নিজের চোখে জল চিকচিক করতে লাগল রামরতনের।
‘কী হল, ভাত ক’টা খেয়ে নাও!’
ভাত খাওয়ার কথা রামরতন ভুলে গেছে। সে কাকলির হাত চেপে ধরে বলে, ‘জানো কাকলি, আমি ঠিক একদিন নাম করব। গোটা বাংলার সবাই আমার নাম জানবে। জানো, এই প্রকাশক সমালোচকরা আমাকে ইচ্ছে করে উঠতে দেবে না। কেন জানো, ওরা আমাকে ভয় পায়! আমার লেখায় যে সাহস আছে, যে ভার আছে, গভীরতা আছে, সেসবকে ওরা ভয়ও পায় আবার হিংসেও করে। তাই ওরা মুগ্ধ হলেও কিছু বলে না। মুখে কুলুপ এঁটে চুপ করে থাকে। ওরা ডিস্টার্বড হয়। আমার মনে হয় এখন পাঠককে ডিস্টার্ব না করলে মহৎ সাহিত্য তৈরি হতে পারবে না। সময়ের দাবি। এন্টারটেনমেন্টের জন্য সাহিত্য করলে চলবে না। তুমি হয়তো এন্টারটেনমেন্ট খুঁজতে চাও, তাই আমার লেখা তোমার ভাল লাগে না। কিন্তু একদিন মানুষ দাম দিতে শিখবে…’
‘কে বলল তোমার লেখা আমার ভাল লাগে না?’
‘তোমার ভাল লাগে আমার লেখা?’
‘ধুস, তুমি কিচ্ছু বোঝো না!’
আনন্দে বারবার চোখে জল চলে আসছে রামরতনের। ওর লেখা কাকলির ভাল লেগেছে! কত দিন সে কলেজ স্ট্রিটের গলিতে-গলিতে, হাঁটতে হাঁটতে ভেবেছে কেন কাকলি তার লেখার প্রশংসা করে না? কেন গল্প, উপন্যাস পড়ার পর বই নামিয়ে রেখে রান্নাঘরে চলে যায়? ভেবেছে কাকলির বুঝি পড়ার ধৈর্য নেই, হয়তো তার ভাষার চলন কাকলি ধরতে পারছে না… এতসব প্রশ্নচিহ্ন আজ আলগা পাড়ের মতো ভেঙে পড়েছে। ভালবাসার সমুদ্র ঢুকে পড়ছে অভিমানের গেরস্থালি ভাসিয়ে। কাকলি যে তার লেখার এত বড় ভক্ত তা আজ জেনে সে বড় তৃপ্তি পায়।
‘শুধু তাই না, শুনলাম বইটা নাকি বুক্ড ছিল এতদিন। আজ সকালেই একজন ফেরত দিয়ে গেছে। আবার আমার চোখের সামনে একজন নিয়ে গেল। চৌধুরীমশায় বললেন তোমার আরও কয়টা বই নাকি অর্ডার দেওয়া হয়েছে।’
রামরতন মিটিমিটি হাসে। প্রথমদিকে লেখালিখি শুরু করার পর সে একদিন প্রিয়নাথ চৌধুরীকে গল্প দেখাতে গিয়েছিল। প্রিয়নাথ বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘নাহ্, খুব একটা সম্ভাবনা নেই। তুমি বরং অন্য কিছুর চেষ্টা করো।’ রামরতন কিছু বলেনি। প্রিয়নাথ তার বাবার বয়সি, মান্য বাহ্মণ, মুখের ওপর তো কিছু বলা যায় না! কিন্তু আজ তিনি উচিত জবাব পেয়েছেন। নিজের লাইব্রেরিতে এনে রাখতে হচ্ছে রামরতনের বই। সম্ভবত লজ্জাতেই নিজমুখে এসে কথাগুলো বলতে পারেননি। রামরতন ভাবে একটু একটু করে অপমানের ডালি সরিয়ে সরিয়ে সে এগিয়ে যাবে। তবেই না একদিন বরমাল্য জুটবে তার গলায়!
কাকলি ঠিক ধরে ফেলেছে রামরতনের মনের কথা; সে বলে, ‘একদিন বাংলার সমস্ত লাইব্রেরিতে তোমার বই রাখবে, কিন্তু সে কথা ভেবে এখন খাওয়া বন্ধ করলে হবে? ভাতটা ঠান্ডা হয়ে গেল। ভাত না খাও মাছটা অন্তত খেয়ে নাও।’
রামরতন লজ্জিত হয়ে ভাত মাখতে থাকে। তারপর বলে, ‘ওসব হতে কিন্তু সময় লাগবে। টাকা-পয়সার টানাটানি, মধ্যবিত্ত স্ট্রাগল এখনই আমাদের বন্ধ হচ্ছে না। তবে দারিদ্র্যর মধ্যে গ্লানি নেই। রাজরানি না হও একদিন নিশ্চয়ই তুমি গর্বিত স্ত্রী হবে।’
‘রাজরানি হয়ে কাজ নেই বাপু! এই বেশ আছি। আরেকটা মাছ দিই?’
‘দাও, তোমার কই?’
‘আমার লাগবে না। তুমি এত খাটাখাটনি করে এসেছ, তোমার লাগবে বেশি।’
‘পুরুষমানুষকে খাটাখাটনি তো করতেই হয়, যারা খাটতে পারে না তারা আর পুরুষ হল কই? ভাতের ওপর দিয়ো না, একপাশে দাও। আজকালের মেয়েরা যে কেন এত স্বাধীনতা চায় ভগবান জানে! ঘরের মধ্যে সুখের জীবন ছেড়ে কেউ বাইরে রোদে-ঘামে চাকরি করতে যায়? বলো, তুমি যাবে?’
‘আমি? ধুর, যোগ্যতা থাকলে তো যাব!’
‘আজকালকার কত মেয়েই যে যোগ্যতা ছাড়াই চাকরি করছে ভাবা যায় না। বাবলুই কত গল্প করে। কী ভাবে আজকালকার মেয়েরা, ভাল মেয়েরাও, ধীরে ধীরে একটা বৃত্তে পড়ে যায়। চাকরি করতে গিয়ে, অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে রেষারেষি করতে গিয়ে সংসার করার মানসিকতাই হারিয়ে যায় একটু একটু করে। এই করতে করতে একসময় নিজেদের পরিবার, সংসারকে তারা ঠকাতে শুরু করে। পরিবারকে ঠকানোর মতো পাপ আর হয় না কাকলি। পৃথিবীর ঘৃণ্যতম পাপ। মানুষ খুন করার চেয়েও… আরেকটু ঝোল দাও তো, ভাতটা শুকনো শুকনো লাগছে। এহ্, তোমার আর থাকল না, না?’
‘আমার লাগবে না। ডাল দিয়ে খাব। তুমি এখন কী লিখছ গো?’
‘রামায়ণের একটা অধ্যায় নিয়ে উপন্যাস লিখছি। লব-কুশের পার্সপেক্টিভ থেকে বর্ণিত হচ্ছে কাহিনি। তাদের নিষ্পাপ চোখে, তারা যেভাবে দেখছে চারপাশটাকে, নিজেদের বাবা-মাকে। চারিদিকের রাজনীতি তারা বুঝতে পারছে না, কিন্তু লক্ষ করছে। একেকটা ছোট ছোট টুকরো জুড়ে জুড়ে কোলাজ তৈরি করছে…’
কিছুক্ষণের জন্য খাওয়া রামরতন থামিয়ে উপন্যাসের বর্ণনায় বিভোর হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ কাকলি বলে উঠল, ‘আচ্ছা তুমি যে ট্রেনে করে যাও, ওই ট্রেনের দৈনন্দিন যাত্রীদের নিয়ে কোনও উপন্যাস লিখতে পারো না তুমি?’
রামরতন বিরক্ত হয়। বড়সড় একদলা গ্রাস তুলে বলে, ‘ওসব লেখা সহজ। সবাই লিখতে পারবে। উপন্যাস তো একটা যেমন-তেমন লিখলেই হল না, মহাকাব্যিক হতে হবে। একটা বিরাট ক্যানভাসে জুড়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। সিস্টিন চ্যাপেলে যেরকম আছে। বুঝেছ? গোটা সিলিং জুড়ে।’
রামরতন হাত তুলে সিলিঙের দিকে দেখায়, যেন তাদের এই ছোট একতলা বাড়িটিই হল সিস্টিন চ্যাপেল। সাদা প্লাস্টার অফ প্যারিসের মধ্যে মাইকেলঅ্যাঞ্জেলো-কৃত রঙের বদলে জলের ছোপ পড়েছে। ছাদের ট্রিটমেন্ট করানো ছিল, বৃষ্টির জল ভেতরে ঢোকার কথা না। তবু ঢুকছে। আজকাল যা ঘন ঘন বৃষ্টি হচ্ছে, ট্রিটমেন্ট-ফিটমেন্ট কাজ দেবে না। জল ঠিক চুঁইয়ে ঢুকবে।
কাকলি বলে, ‘তুমি যখন অনেক নামি লেখক হবে, তখন আমাকে সিস্টিন চ্যাপেল দেখতে নিয়ে যেও।’
‘যাব। জানো কাকলি, আমি যদি আজ থেকে তিরিশ বছর আগে জন্মাতাম, তাহলে সমাদর পেতে এত দেরি হত না। কেন জানো? আজকালকার কালচারের সাথে আমি ফিট করি না। ইন্টারনেট আসার পর একেবারে সব গেছে। অর্ধেক মানুষ বই পড়ে না, যারা পড়ে তারাও ফেসবুকেই বই নিয়ে আলোচনা করে। একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে ‘পাঠক’ বলে, সেখানে যে যা বই পড়ল তার রিভিউ দেয়। তার মধ্যেও পলিটিক্স আছে জানো তো? বাবলুর কাছ থেকে খবর পাই এসব। লেখকরা টাকা দিয়ে রিভিউ বের করায়। ব্যস, একজনের রিভিউ পড়ে একশোজন কিনবে। বই ভাল হলে এ ভাবে ছড়িয়ে যাবে। খারাপ হলে ডাউন খাবে ঠিকই তবে তার আগেই ১০০ কপি বিক্রি হয়ে গেছে। বাবলু বলছিল, রামদা, ফেসবুক একটা খুলেই ফেলো… আমি বললাম না। অমন শর্টকাটে কার্যসিদ্ধি হয় না। আমি সোজা পথের মানুষ। এসব ছলচাতুরি একজন প্রকৃত পুরুষকে মানায় না। ওসব মেয়েদের… চাটনি করোনি আজকে?’
‘না, আজকে করিনি।’
‘চাটনি করবে তো, চাটনিটা না হলে খাওয়া শেষ হয় না। আমার মা প্রতিদিন চাটনি করত। উইদাউট ফেল। আর কিছু হোক না হোক, ওইটা চাই। আচ্ছা যাও, একদিন না হয় চাটনি ছাড়াই খাওয়া হল! ঘ্রাণে যদি অর্ধভোজন হয় তাহলে ভাবনায় নিশ্চয়ই সোয়া-ভোজন হবে! আহ্ মায়ের হাতের চাটনির স্বাদটা মনে পড়ছে। অমৃত বললে কম বলা হবে। আমার এই একটা আফসোস থেকে গেল জীবনে। মা যাবার আগে তোমার সঙ্গে দেখা হল না। তোমাকে যদি একটু ট্রেনিং দিয়ে দিত!’
কাকলি থালা গোছাতে গোছাতে উঠে যায়। রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলে, ‘তোমার জন্য দই রাখা আছে। নিয়ে নাও।’
শোবার আগে এক বাটি দই খাওয়া রামরতনের অনেক দিনের অভ্যেস। চাটনিরই মতো। দৈনন্দিন অভ্যাসে ছেদ পড়া সে পছন্দ করে না। কোনও খুচরো চ্যুতি, ভেরিয়েশনকে সে পাপ বলে মনে করে। তবে আজ, এই প্রথম, দই খেতে খেতে বাঁধা সময়ের আরও কিছুক্ষণ বেশি তার জেগে থাকতে ইচ্ছে করল।
ফলত মাস চারেক পর আবার সে কাকলির সঙ্গে মিলিত হয়। সঙ্গমের পর যখন চিত হয়ে শুয়ে নিস্তেজ গতিতে ঘুরে যাওয়া ফ্যানটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন কাকলি তার বুকে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, ‘শোনো…’
‘কী?’
‘কাল সকালে আমি একটু বেরোব, হ্যাঁ? তুমি কিন্তু না করতে পারবে না।’
‘কেন? কী করতে বেরোবে?’
‘আমার এক কলেজের বন্ধুর সঙ্গে দেখা করব।’
‘কোন বন্ধু?’
‘পারমিতা।’
‘শুধু পারমিতা? না আরও কেউ আছে?’
‘শুধু পারমিতা। আর কেউ নেই। তোমার চিন্তার কোনও কারণ নেই।’
‘চিন্তার অবশ্যই আছে। ঘরের বউয়ের অত বন্ধুবান্ধবের দরকার কী? আর দেখা করতে হলে ঘরে ডাকো। বাইরে যাবার কী দরকার? বাইরে যেতে যেতে নেশা হয়ে যায়। তখন আর ঘরে থাকতে মন চায় না।’
কাকলি রামরতনের বুকের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নেয়। ‘তাহলে ওকে বারণ করে দেব?’
রামরতন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘প্ল্যান যখন করেই ফেলেছ, তখন ঘুরেই আসো না হয়। এ-বারের মতো পারমিশন দিলাম, যাও।’
কাকলি রামরতনের গালে চুমু দিয়ে বলে, ‘থ্যাঙ্ক ইউ!’
পরদিন ঘুম ভাঙতেই রামরতনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। প্রতিদিন পাঁচটা নাগাদ ঘুম ভাঙে তার। আজকে সাড়ে ছ’টা বেজে গেছে। এক হাত জিভ কেটে সে কোনও রকমে হাতমুখ ধুয়ে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বেরোনোর সময়ে কাকলি বলল ‘শোনো, কাল বলছিলে চাটনির কথা। আজ যদি আম আনতে পারো, তাহলে আমের চাটনি করে রাখব তোমার জন্য।’
আমের চাটনি রামরতনের এমনিই কয়েকদিন ধরে খেতে ইচ্ছে করছিল। সে ভেবেছিল আজ বেশি সময় নেই, দরদস্তুর না করে চট করে কিছু সবজি আর এক কেজি আম কিনে ফিরে আসবে। কিন্তু দু’বার বাজারের মধ্যে পায়চারি করেও সে সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। যাতেই হাত দেয় আগুন দাম। আবার সব ছেড়ে শুধু পুঁটিমাছ, গাজর, আর বরবটি নিয়ে ঘরে ফিরে আসতেও তার ইচ্ছে করে না। গায়ে-হলুদ সাজে সলজ্জ হিমসাগরগুলো তাকে ডাকছে। বলছে আজ উৎসবের প্রহর, এসো… এসো… এসো।
দরদস্তুর করতে গিয়ে একটা ঝামেলা হয়ে গেল আমওলার সঙ্গে। আম তো কেনা হলই না, বরং যে কথাগুলো শুনতে হল সেগুলো কোনও সবজিওয়ালা তাকে বলবে এমন কথা সে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না। বাজার থেকে ফিরতে ফিরতে, সকালের ভাত খেতে খেতে, স্টেশনে দাঁড়িয়ে, ট্রেনে বসে তার মাথায় ওই একটা কথাই শুধু ঘুরেফিরে আসতে লাগল, ‘ফকিরের বাচ্চা’। বাজারের অতগুলো লোকের সামনে… ছি ছি ছি। এমন একটা কথা যে, ঘটনাটা সে কাকলিকেও বলতে পারেনি। কাকলি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল। জবাব দেয়নি রামরতন। বাজার থেকে ফেরার পর থেকেই তাকে যেন বোবায় পেয়েছে।
শিয়ালদা স্টেশনে নামার পর ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে নাম ভাসছে সুজন দাস। রামরতন তাড়াতাড়ি ফোন ধরে বলল, ‘সুজনদা বলুন, সুপ্রভাত।’
শিয়ালদা স্টেশনের ভিড় তখন গমগম করতে করতে চলেছে। সুজন দাসের প্রথম কথাগুলো ভিড়ের কোলাহলে সে কিছুই শুনতে পেল না। একপাশে সরে এসে কানের ওপর চেপে ধরল ফোনটাকে।
‘কী বললেন সুজনদা? গল্পটা মনোনীত হয়েছে?’
এবার কথাগুলো শোনা গেল। ‘গল্প মনোনীত হয়নি। আমি ফোন করেছি অন্য কারণে। ওই পিয়নের চাকরিটা কি তুমি করবে? নইলে বিদ্যুৎকে অফার করব। ও একটা চাকরির জন্য ধরেছে। তুমি করতে চাইলে কালকের মধ্যে আমাকে জানাও। বুঝলে?’
ফোন রেখে দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল রামরতন। তার পাশ দিয়ে স্টেশনের ভিড় হু হু করে এগোচ্ছে। অথচ আজ সে শরীরে কোনও ব্যস্ততা বোধ করছে না। কানের কাছে ঘুরে চলেছে ওই কথাটা— ফকিরের বাচ্চা। ভুল তো নয়। ফকিরের মতোই তো সে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করছে। তার বাবা যে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ছিলেন সে কথাটা তার দিকে তাকিয়ে কারোর একবারও মনে আসে না। সেও যদি ভুলে যেতে পারত!
কিন্তু সে ভুলতে পারে না। বাবার স্মৃতি মাথার মধ্যে বাষ্পের মতো জমে। দেখতে দেখতে পুরো মাথাটা অস্বচ্ছ কুয়াশায় ভরে ওঠে।
অন্য দিনের মতো রাস্তায় রাস্তায় না ঘুরে রামরতন মহম্মদ আলি পার্কে এসে বসল। চুপ করে বসে থাকতে থাকতে মাথার কুয়াশা ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে আর ক্রমশ বাবার মুখটা স্পষ্ট হয়। বাবা বলেন, ‘কী রে, কাঁদো কাঁদো হয়ে আছিস কেন? ফকির কি কোনও খারাপ কথা? লালনও ফকির ছিল জানিস না? মুসলমান ফকির, হিন্দু সন্নাসী, বৌদ্ধ ভিক্ষু— এঁরা তো একই পথের যাত্রী। তোর পথও এই পথ। সাহিত্য হল তোর সাধনা। মনে রাখিস, মনপ্রাণ দিয়ে সাধনা করলে একসময় ফল মেলে। ফকির দরবেশ হয়ে ওঠেন। তুইও হবি। শুধু দেখিস, চলার পথে যেন বিক্ষেপ না ঘটে।’
‘আর পিয়নের চাকরিটা?’
বাবা গম্ভীর হয়ে গেলেন। ‘তুই ফকিরের বাচ্চা হতে পারিস কিন্তু পিয়নের বাচ্চা নোস। পিয়নের চাকরি নিলে আমি তোকে ত্যাগ করব!’
রামরতন বলল— ‘আচ্ছা বাবা, আমি তোমাকে কথা দিলাম…’
মাথার মধ্যে বাবা আর নেই। বাষ্পও নেই। বাষ্প এখন চোখে। রামরতন চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল।
কলেজ স্ট্রিট ধরে বউবাজারের দিকে এগিয়ে ‘অপরাহ্ন’ পত্রিকার অফিসে ঢোকার মুখেই শিশিরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। শিশির তার দূর-সম্পর্কের মামাতো ভাই। সবসময় চালাক-চালাক মুখ করে ঘুরে বেড়ায় বলে রামরতন তাকে পছন্দ করে না। একবার ‘পরিচয়’ পত্রিকার অফিসে রামরতনের নামে অনেক কিছু বলেছিল! রামরতন অবশ্য সেসব পাত্তা দেয় না। কিন্তু কষ্ট পায় যখন দেখে শিশিরের দুটো বই হটকেকের মতো বিক্রি হচ্ছে। একটা বইয়ের নাম, ‘উত্তমকুমারের অধম জীবন’, আরেকটা ‘মহারাজ না সর্বজনীন দাদা? অজানা সৌরভ’। জনতার নাড়ি বুঝে লিখতে পারে ছেলেটা।
রামরতনকে দেখেই শিশির বলল, ‘এই যে এসো। তোমার জন্যই ওয়েট করছিলাম।’
‘তুমি কী করে জানলে যে আমি এখানে আসব?’
‘আজকেই কোনও না কোনও সময়ে তো আসতে, ভালই হল ফার্স্ট-হাফে এলে। দেখা হয়ে গেল।’
‘তোমার বই তো ভালই বিক্রি হচ্ছে।’
‘আরে ধুর! বিক্রি হচ্ছে ট্র্যাশ বলে। তোমার মতো কি আমি লিখতে পারি? তুমি হলে আসল লেখক।’
রামরতনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘কিন্তু আসল লেখকদের কী প্রচণ্ড স্ট্রাগল করতে হয় জানো তো, জীবন সুখের হয় না। তুমিই ভাল আছ। সুখে আছ।’
শিশিরের মুখে সেই চালাক চালাক হাসি। একটু বেশিই প্রসারিত হয়েছে হাসিটা। তার কারণ রামরতন বুঝতে পারে না। এইসব মানুষদের সে পছন্দও করে না। কোষ্ঠকাঠিন্যর মতো কুঁতে-কুঁতে কথা বলে, আর অদ্ভুত হাসি হেসে যায়।
‘অপরাহ্ন’ পত্রিকার অফিসে ঢুকতেই সম্পাদক ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘এখনও গল্পটা দেখা হয়নি। মনোনীত হলে জানিয়ে দেব।’
‘না না, আমিই আসব না হয় পরের সপ্তাহে একবার। ইতিমধ্যে যদি কিছু ফিচার লিখতে হয় তাহলে স্মরণ করবেন।’
‘ফিচার?’
‘হ্যাঁ, যদি কিছু থাকে।’
‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। এই বিদ্যুৎ শোনো তো।’
অল্পবয়সি একটা ছেলে এসে দাঁড়াতে, রামরতনকে বললেন, ‘বুক রিভিউ। পারবেন তো? এর সঙ্গে যান। বইটা দিয়ে দেবে। বুক রিভিউয়ের জন্য পাঁচশো। তার বেশি দিতে পারব না। রাজি?’
অফিসের পিছন দিকে গিয়ে ছেলেটি তার হাতে একটা বই দিয়ে বলল, ‘দাদা, একটা কথা আছে।’
‘বলো।’
‘আপনি কি চাকরিটা নিচ্ছেন?’
‘কোন চাকরি?’
‘ওই যে পিয়নের চাকরিটা?’
‘তাতে তোমার কী?’
‘সুজনবাবু বললেন আপনি না নিলে আমাকে দেবেন। আপনি যদি চাকরিটা না নেন তাহলে কী বলে আপনাকে… মানে, আমার চাকরিটা খুব দরকার।’
রামরতনের এবার মনে পড়ল। হ্যাঁ, বিদ্যুৎ নামটাই তো বলেছিল সুজনদা। বিদ্যুতের মতোই রোগা ছেলেটা। রামরতন বলল, ‘চিন্তা নেই। চাকরিটা তুমিই পাবে। এখন আমাকে একটু চা খাওয়াও তো।’
বিদ্যুৎ শুধু চা-ই খাওয়াল না, চায়ের সঙ্গে সিঙারাও খাওয়াল। সিঙারা খেতে খেতে রামরতন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা বিদ্যুৎ, তুমি আমার লেখা পড়েছ?’
‘হ্যাঁ দাদা, পড়েছি কিছু।’
‘কেমন লেগেছে আমার লেখা?’
‘সত্যি করে বলব?’
‘হ্যাঁ বলো না।’
বিদ্যুৎ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকল, তারপর হেসে বলল, ‘আমি দাদা সাহিত্য বুঝি না একদম।’
‘তাহলে সাহিত্য পত্রিকার অফিসে চাকরি করছ যে!’
‘চাকরি করছি না। এই পত্রিকার সম্পাদক আমার মামা হয় তো, তাই খেটে দিচ্ছি একটু।’
‘তার মানে বেতন ছাড়া চাকরি। পড়াশুনা করেছ কিছু?’
‘আর্ট কলেজে পড়তাম। শেষ করতে পারিনি। মায়ের ক্যানসার হয়েছিল।’
‘ও, তুমি শিল্পী? একজন শিল্পী হয়ে তুমি পিয়নের চাকরি করবে? শোনো মকবুল ফিদা হোসেনের নাম শুনেছ তো, উনিও অর্থকষ্টে পড়েছিলেন। কিন্তু বলেছিলেন প্রয়োজন পড়লে বাড়ির দেওয়াল রং করবেন, তবু তুলি ছাড়বেন না। এই হল শিল্পী, বুঝলে? শিল্পীর আসল কী জানো? মেজাজ। মেজাজটাই শিল্পীর প্রাণভোমরা।’
বিদ্যুতের মুখটা এখন তার বয়সের চেয়ে গম্ভীর হয়ে উঠেছে। এতক্ষণ সে মাথা নিচু করে কথা বলছিল। এবার রামরতনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চাকরিটা প্রাণভোমরাকে মারার জন্য নিচ্ছি না রামরতনবাবু, বাঁচানোর জন্য নিচ্ছি। দয়া করে সুজনবাবুকে জানিয়ে দেবেন যে আপনি চাকরিটা নিচ্ছেন না। নমস্কার।’
রামরতন হাঁটতে হাঁটতে মাথা নাড়ল। সেই জেদটাই নেই এই জেনারেশনের মধ্যে। লড়ে যাওয়ার জেদ। ফুলবাবু সব— অল্প আঘাতেই মূর্ছা যায়! গজগজ করতে করতে আরও কিছু দপ্তরে ঘুরে শেষে রামরতন বাবলুর দোকানে এসে ঢুকল।
‘আরে এসো হিরো, এসো…’ রামরতনকে দেখে বাবলু চিৎকার করে উঠেছে।
রামরতন অবাক হয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার?’
‘কী আবার হবে! তোমার প্রশংসায় তো ফেসবুক ছেয়ে যাচ্ছে!’
ব্যাপার জানতে রামরতন হুমড়ি খেয়ে পড়ল কম্পিউটারের সামনে। ‘পাঠক’ বলে গ্রুপটাতে একজন তার উপন্যাস নিয়ে পোস্ট করেছে। শুধু কি পোস্ট? এক প্যারাগ্রাফ পড়ে রামরতনের ছাতি ছত্রিশ ইঞ্চি হয়ে গেছে। সে বাবলুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোকে বলেছিলাম না? বলিনি তোকে যে একদিন লোকে আমার মূল্য বুঝতে পারবে! জীবনেই হোক, কি মৃত্যুর পর, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস থেকে আমার নাম কেউ মুছতে পারবে না।’
‘শুধু কিন্তু একজন না রামদা। কত কত কমেন্ট দেখো। এরাও পড়েছে, সবারই এক-ই কথা। একজন লিখেছে— আমার শেষ দশ বছরে পড়া শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। আরেকজন লিখেছে— কত আজেবাজে উপন্যাস পুরস্কার পায়, অথচ শিল্পের বাজারে আসল হিরে যে ছাইচাপা হয়ে পড়ে থাকে এই উপন্যাস তার প্রমাণ। আর তুমি ছাইচাপা থাকবে না গো রামদা। এবার তোমার বই হু হু করে বিক্রি হবে।’
বাবলুর দোকান থেকে রামরতন মুড়ি না খেয়েই বেরিয়ে এল। ভাল খবরটা কাকলিকে তাড়াতাড়ি দিতে হবে। শিয়ালদা স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগল সুজন দাসের কানেও ব্যাপারটা পৌঁছে দেওয়া দরকার। পিয়নের চাকরি অফার করছে! হারামজাদা!
ফেরার ট্রেনে সিট পেয়ে গেল ফরচুনেটলি। আজ আর ঘুম এল না। মনটা উশখুশ করছে কেবল। এই গোটা স্ট্রাগেলে একবারের জন্যও সংশয় তাকে ঘিরে ধরেনি। আর কেউ না হোক নিজের ওপর কখনও সে ভরসা হারায়নি। না, আরও একজন ভরসা রেখেছে বরাবর— কাকলি। সংসারের সমস্ত সীমাবদ্ধতা নিজের আঁচলের তলায় ঢেকে রেখেছে। বাড়ির লক্ষ্মী। আজকের জয় তো রামরতনের একার নয়, এই জয় কাকলিরও।
সাধারণত ঘর থেকে বেরোনোর সময়ে পকেটে বেশি পয়সা নিয়ে বেরোয় না রামরতন, পাছে বেশি খরচা হয়ে যায়। কিন্তু আজ কিছু মিষ্টি না নিয়ে ফিরলে বড় অন্যায় হবে। মিষ্টি কিনে ফিরতে ফিরতে সাতটা বেজে গেল। দরজা ধাক্কিয়ে সাড়া পাওয়া গেল না। রামরতন কাকলির নাম ধরে চেঁচাল একবার। সাড়া নেই। ব্যাগ থেকে ডুপ্লিকেট চাবি বার করে ঘরে ঢুকল রামরতন। বাথরুম থেকে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে। কাকলি রোজ এই সময়টা স্নান করে। অনেকক্ষণ ধরে। রামরতন মাঝে মাঝে রেগে যায়। তখন কাকলি হেসে বলে ‘স্নান কি অত তাড়াতাড়ি হয়? সারাদিনের ময়লা গা থেকে ধুয়ে আসতে হয় না?’ রামরতন তর্ক করে, ‘আমি সারাদিন রোদে হাঁটি, কই আমার তো হয় না। তুমি সারাদিন ঘরে বসে থাকো… তোমার শরীরে কী করে এত ময়লা জমে?’
স্নান করুক ও যতক্ষণ পারে, আজকে রামরতন রাগবে না। জামাকাপড় ছেড়ে আরামকেদারাটাতে গা এলিয়ে বসতেই ফোন বেজে উঠল। তার নয়, কাকলির ফোন। নাম সেভ করা নেই। রামরতন ফোন ধরে বলল, ‘হ্যালো?’
‘হ্যালো কাকলি? আমি পারমিতা বলছি।’
‘আজ্ঞে না, কাকলি স্নানে গেছে। বেরোলে ফোন করতে বলি?’
‘হ্যালো কাকলি, পারমিতা বলছিরে। কাজটা হয়ে গেছে।’
রামরতন বুঝল কানেকশনের গণ্ডগোলের জন্য তার কথা পারমিতা শুনতে পাচ্ছে না। অথচ পারমিতার কথা সে পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে।
‘কাকলি শুনতে পাচ্ছিস? তোর কথা আমি শুনতে পাচ্ছি না। হ্যালো, হ্যালো, শোন, কাজগুলো আমি করে দিয়েছি। ফেসবুকে পোস্ট হয়ে গেছে আলাদা আলাদা অ্যাকাউন্ট থেকে পঞ্চাশটা কমেন্ট। শুরুতে একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল, তোর বরের পদবির বানান ভুল লিখেছিলাম। তারপর শুধরে দিয়েছি। কিন্তু প্রচুর কমেন্ট হয়ে গেছে। তুই একবার চেক করে নে। আর আমাদের শর্তটা মনে আছে তো? সন্দীপনের সঙ্গে তুই আর কোনও সম্পর্ক রাখবি না। কোনও ক্যাজুয়াল কথাবার্তাও না। সন্দীপন এখন একমাত্র আমার। ওকে? হ্যালো? কাকলি, তুই কি শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা…?’
রামরতন ফোন কেটে দেয়। তারপর আরামকেদারায় বসার বদলে ধীরে ধীরে বাথরুমের সামনে এসে চুপ করে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে ধড়াস ধড়াস করে জল ঢালার শব্দ শোনা যাচ্ছে— স্নানের শব্দ— গা থেকে সারাদিনের ময়লা ধুয়ে ফেলছে কাকলি!
ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত