কলকাতার সঙ্গে আপনি তো তাহলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে…
১৯৬৭-তে আমার বিয়ে হয় জ্যোতি কাউর আলুওয়ালিয়ার সঙ্গে। তো, এই জ্যোতির দিদি ছিলেন শ্রীশিক্ষায়তনের হোস্টেল ওয়ার্ডেন। আর আমার বোন ওই শ্রীশিক্ষায়তনের হোস্টেলেই থাকত। আমি মাঝে মাঝে আমার বোনের সঙ্গে যখন দেখা করতে যেতাম, ওর সঙ্গেও দেখা হত। আমার তখন বয়স ২০, ওর ১৮। তারপরে আমরা ঠিক করলাম বিয়ে করব। ওর বাড়িতে খোঁজ করল, ছেলে কী করে। ও বলেছে, ছেলে তো কিছু করে না। ফ্রিল্যান্সিং করে। আমি তখন ওর দিদিকে একটা চিঠি লিখলাম যে, আমি কোনও চাকরি করি না ঠিকই তবে ‘দিনমান’-এ আর আরও কয়েকটা জায়গায় নিয়মিত লেখালিখি করি। এরপর কী করে জানি না, ওর দিদি রাজি হয়ে গেলেন। জ্যোতি তখন পড়ত চণ্ডীগড়ে। মাঝে মাঝে আসত আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমিও মাঝে মাঝে যেতাম। আমি বললাম যে, ওসব দেনাপাওনার তো কোনও বালাই নেই আর ঘটা করে বিয়েও আমি করতে চাই না। আমরা বরং দিল্লিতেই রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে নেব। তাতে ওর দিদি রেগে গেছিলেন। বলেছিলেন, এটা কেন? তোমরা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করতে চাও, সেটাই হবে। কিন্তু তোমাকে এখানে আসতে হবে। এদিকে আমার কাছে তো পয়সা নেই। কলকাতায় কী করে আসব! তাও আবার বিয়ে করতে! তো, জ্যোতির দিদি আমায় মানি অর্ডার করে ৪০০ টাকা পাঠিয়ে, একটা স্যুট কিনতে বললেন। এদিকে স্যুট তো কোনওদিন পারিনি। ভাবলাম, বেশ ভালই হল। খাদি ভবনে গিয়ে একটা রেশমি পাঞ্জাবি আর ভাল একটা চামড়ার চটি কিনলাম নিজের জন্য। গেট-আপ চেঞ্জ হয়ে গেল আমার। ওই খরচ করেও, কলকাতার টিকিটের পয়সা ছিল। ব্যাস, তাই নিয়ে বিয়ে করতে চলে এলাম কলকাতা। আমি ভেবেছিলাম আমার দিদির ওখানে উঠব কিন্তু ওর দিদি ওদের ওখানেই রেখে দিলেন আমাকে। তখন একদিন ব্রেকফাস্ট করছি আর বলছি যে, এবার জ্যোতিকে নিয়ে দিল্লি রওনা দিতে হবে আমায়। ওর দিদি শুনে ভাবলেন, এ কি পাগল না কি? না আছে পয়সা, না আছে চাকরি, বলছে বউকে নিয়ে যাবে! এদিকে আমার স্ত্রী তখন পড়াতেন একটা ছোট স্কুলের প্রাইমারিতে। তাতে শ-দেড়েক টাকা মাইনে পেতেন। সে-সময়ে সেটা বেশ ভালই মাইনে। আমি তখন ওর দিদিকে বোঝালাম যে, না, আপনি যতটা ভাবছেন ততটা খারাপ অবস্থা নয়। আমি ওকে খাওয়াতে পারব। শেষ পর্যন্ত ওর দিদি মেনে নিলেন। আমরা দিল্লি চলে এলাম।
এক অর্থে আমি কিন্তু দিল্লিতে থাকিনি। আমি থেকেছি ওই সাহিত্য আর শিল্পের জগৎটার মধ্যে। দিল্লিতে আমি থাকতাম না। থাকতে পারতাম না। দিল্লি খুব অ্যাগ্রেসিভ। সেখানে সবসময়ে লোকে একটাই কথা বলে— স্কুটার কিনব, টিভি কিনব, গাড়ি কিনব। আর এখন তো সেটা আরও বেড়ে গেছে। আমায় বরং এগিয়ে নিয়ে গেছে আমার ওই জগতের ‘সেন্স অফ বিলংগিং’-টা। টাকা আছে, নেই, কিন্তু কিছু বন্ধু আছে; এত বড় বৃত্ত আছে, সেটাই আমার আনন্দ। আমার প্রথম কবিতার বইও বেরোয় কলকাতা থেকে। আমার তখন ২৮ বছর বয়স। আমার থেকে বয়সে একটু বড় এক বন্ধু ছিলেন এখানে— মানিক বাচ্ছাওয়াত। ওঁর একটা প্রেস ছিল। সেখান থেকেই বেরোয়।
বিয়ের পরেও এক বছর আমি কোনও চাকরি করিনি। আমার স্ত্রী আর আমি শুধু ওয়ার্ল্ড সিনেমা, ইব্রাহিম আলকাজি বা আরও যাঁরা-যাঁরা ওখানে নাটক করতেন তাদের নাটক, যামিনী কৃষ্ণমূর্তির নাচ— এইসব দেখে বেড়াতাম। সত্যি বলতে কী, সেই সময়ে ওটাই ছিল আমার জীবন। সেই সময় থেকেই শিল্পের প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে আমার আগ্রহ তৈরি হয়ে উঠতে থাকে। যে-কারণে পরে নানা কাজ করতে পেরেছি। পরে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে আমাকে যখন বলল হিন্দিতে একটা পত্রিকা শুরু করতে, তখন ‘রঙ্গপ্রসঙ্গ’ নামে পত্রিকাটা বের করতে গিয়ে ঘাবড়াইনি। অবশ্য তার আগে চাকরিটা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। আসলে চাকরি ছাড়তে আমার এক মিনিটও লাগত না। কিন্তু এবারে অনেক বছর চাকরি করে, তারপর চাকরি ছেড়েছিলাম। ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’য় ২৭ বছর চাকরি করেছি একটানা। আমায় ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’য় নিয়ে গেছিলেন বাৎস্যায়নজি। ১৯৯৮-তে ওরা কাগজটা ‘হিংলিশ’-এ (হিন্দি + ইংলিশ) করল। আমি বললাম যে, আমি লিখতে পারব না। তখন ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র ফ্ল্যাট ছিল আমার কাছে। আমার দুই মেয়ে বড় হচ্ছে— একজন ১৮, আরেকজন ২০। তখন ওখানকার ম্যানেজার আমাকে নিজে বলেছিলেন যে, তুমি জানো যে তুমি কী করতে যাচ্ছ! তোমার এই ফ্ল্যাটটা চলে যাবে। এটা তো ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র ফ্ল্যাট! আমি বললাম— রমেশজি, যা খুশি হয়ে যাক, কাল থেকে আমি আসব না। জানি না কোত্থেকে এই সাহস আসত! এর পিছনে হয়তো বিরাট ভূমিকা ছিল স্বামীনাথনের।
স্বামীনাথনের কোনও নিজের ফ্ল্যাট নেই, ভাড়াবাড়িতে থাকছেন। এই সময়ে একদিন কপিলা বাৎস্যায়ন ওঁকে বলেছেন যে, আরে এই এশিয়াড ভিলেজে সব আর্টিস্টরাই ফ্ল্যাট নিচ্ছে, তুমিও ফর্ম জমা দাও। হয়ে যাবে। উনি বললেন— ঠিক আছে, ফর্ম জমা দিয়ে দেব। এখন ফর্ম ভর্তি করার সময়ে সেখানে একটা ক্লজ ছিল যে, আপনাকে কী কারণে এই ফ্ল্যাট দেওয়া হবে। স্বামী সেটা পড়েই ফর্মটা কুচি-কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। বললেন— আরে, আমাকেই জিজ্ঞাসা করছে যে আমায় ফ্ল্যাট দেবে কেন। কে দিতে বলেছে! দিও না তাহলে! সে-সময়ে তো ওঁর ছবি তেমন বিক্রি হত না। আর এখন ওঁর এক-একটা ছবি নিলামে বিক্রি হয় ৩-৪ কোটিতে। ফলে ওঁর ছেলেরা এখন বড়লোক। অথচ এক সময়ে পয়সা না থাকায়, উনি ওঁর ছেলেদের স্কুলের ফি দিতে পারেননি। ওঁর ছেলেদের তখন স্কুল থেকে বের করে দিয়েছিল। ওঁর সঙ্গে যে আমার জীবন কেটেছে, আমি ভাগ্যবান। আর আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখতেন উনি। রাজা ফাউন্ডেশনের জন্য এই স্বামীনাথনের জীবনীই আমি লিখেছি । রোজ চার পাতা করে লিখতাম, আর আমার স্ত্রী বলতেন— তুমি তো কোনও বইপত্রই দেখছ না! আমি বলতাম— স্বামী-র জীবনী লিখব, তার জন্য আমার বইপত্র দেখার দরকার? আসলে ওঁর জীবনটা আমার কাছে ছবির মতো পরিষ্কার ছিল!
পঞ্চাশের দশকে তো এখানে অনেক বড় কবিই ছিলেন— সুনীল, শক্তি, বিনয়… এদের বাদ দিয়ে আপনি হঠাৎ অনুবাদের জন্য শঙ্খ ঘোষের কবিতাই বেছে নিলেন কেন?
শঙ্খ ঘোষের নাম আমি প্রথম শুনি শ্রীকান্ত বর্মার কাছে। শ্রীকান্ত বর্মার একটা পত্রিকা ছিল ‘কৃতি’। সেখানে আমাদের তরুণ লেখকদের একটা গোষ্ঠী নিয়মিত লিখতাম— আমি, অশোক বাজপেয়ী, অশোক সাক্সেরিয়া, মহেন্দ্র ভাল্লা, কমলেশ— আমরা সবাই। আরেকজন ওখান থেকে লেখা শুরু করেছিলেন, তিনি এখন খুবই নামকরা লেখক— বিনোদ কুমার শুক্ল। তাছাড়া মুক্তিবোধও লিখতেন ওখানে। এটা মূলত ছিল তরুণদেরই পত্রিকা। যাই হোক, সাহিত্য অকাদেমির লাইব্রেরি থেকেই আমি প্রথম শঙ্খ ঘোষের একটা কবিতার বই পড়ার জন্য নিই। সে-কবিতা পড়ে আমার মনে হল যে, এর অনুবাদ আমায় করতেই হবে। দেখি, আমার হিন্দিতে এ-কবিতা কেমন লাগে। দু-তিনটে কবিতা আমি হিন্দিতে অনুবাদ করে, ছাপতে দেওয়ার আগে অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখলাম শঙ্খ ঘোষকে। সেটা ১৯৮২-’৮৩ সাল। তিনি তাঁর উত্তরে সানন্দে সম্মতি দিলেন। তারপর সেগুলো বেরোল সাহিত্য অকাদেমির জার্নাল ‘সমকালীন ভারতীয় সাহিত্য’-তে। এরপর হঠাৎ ১৯৮৩-তেই অশোক বাজপেয়ীর একটা চিঠি পেলাম যে, আমরা শঙ্খ ঘোষকে ভোপালে ডাকতে চাই। তোমাকেও আসতে হবে। ওঁর সঙ্গে বসে তুমি ওঁর কবিতা অনুবাদ করো। ওখানে একসঙ্গে বসে ১৫-টা কবিতা অনুবাদ করেছি। তারপর ভোপাল থেকে দিল্লি ফিরেই দেখি আমার আমন্ত্রণ এসেছে আইওয়ার রাইটিং প্রোগ্রাম থেকে। শঙ্খ ঘোষ ওখানে যে-বাড়িটায় ছিলেন, আমিও ছিলাম সেই বাড়িটায়। ওখানে বসেই তারপর আমি শঙ্খ ঘোষের আরও অনেক কবিতা অনুবাদ করি। তাছাড়া কলকাতায় আমার বন্ধু অশোক সাক্সেরিয়াও ছিলেন শঙ্খ ঘোষের অত্যন্ত গুণগ্রাহী। পরে উনিও শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে যান, বেবী হালদারের ‘আলো আঁধারি’-র ভূমিকা লিখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাতে। শঙ্খ ঘোষ লিখেও দিয়েছিলেন সে-বইয়ের ভূমিকা। শঙ্খ ঘোষ ছাড়াও অশোক সাক্সেরিয়ার সঙ্গে আমার অনেক কিছু নিয়ে গল্প হত। রবীন্দ্রনাথ থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়— সব প্রসঙ্গেই কথা হত। সুভাষদা যখন জ্ঞানপীঠ পেলেন, তখন ‘নবভারত টাইমস’ থেকে আমায় কলকাতা পাঠিয়েছিল সুভাষদার একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। সেই সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়ার সময়েও আমার সঙ্গে ছিলেন অশোক সাক্সেরিয়া। বাংলা সাহিত্য পড়ার ব্যাপারে আমার একটা উৎসমুখই ছিলেন তিনি। হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি, ইউরোপের সাহিত্য, রাজনীতি— সমস্ত ব্যাপারেই ওঁর ছিল জ্ঞান। গান্ধীর আশ্রমে উনি ছোটবেলায় ওঁর মা-র সঙ্গে চলে যেতেন মাঝে মাঝে, যখন ওঁর বাবা জেলে থাকতেন। এবং ওঁর মতো মানুষও আমি আর দেখিনি। অত বড়লোক, লর্ড সিনহা রোডের ওই বিশাল বাড়ি সাক্সেরিয়া হাউস… ওঁর বাবা মারা যাওয়ার পর উনি ঠিক করলেন বাড়ি ছেড়ে দেবেন। তখন ওঁর ছোটভাই দিলীপ এসে একদিন আমায় বলল যে, দেখুন তো দাদা কী করছে! বাইরে একটা ঘর ভাড়া করেছে। এরপর তো গোটা মাড়োয়াড়ি সমাজ আমায় দোষ দেবে। বলবে, ভাইকে ঝগড়া করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমার চূড়ান্ত বদনাম হবে। আপনি তো দাদার বন্ধু। আপনি দাদাকে একটু বোঝান। তখন আমি অশোককে বললাম যে— আপনি কেন এসব করতে যাচ্ছেন? উনি ভাবলেন একটু। ভাইয়ের সমস্যাটা তো সত্যি। তারপর বললেন যে— আমার কোনও গাড়ি চাই না, কোনও বাড়ি চাই না, আমাকে বাড়ির শুধু একটা ঘর দিয়ে দাও। উনি বিয়ে করেননি কোনওদিন। আর ওঁর ওই ঘরটা হয়ে উঠেছিল বাইরে থেকে কলকাতায় আসা হিন্দি লেখকদের মিলনক্ষেত্র। শর্মিলা বোরা জালান, অলকা সারাওগি— এঁরা সবাই ওখানে আসতেন। কিছু-কিছু বাঙালি তরুণ লেখকরাও আসতেন।
যে-সময়ে আপনি কলকাতায় ছিলেন, সেই সময়ে কলকাতায় যাঁরা বাংলায় লেখালিখি করছেন বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, তাঁদের সঙ্গে কি তখন আপনার কোনও যোগাযোগ হয়েছিল?
হ্যাঁ। আড্ডা হত তো তাঁদের কারোর-কারোর সঙ্গে। সন্দীপনের সঙ্গে সেন্ট্রাল এভিনিউর কফি হাউসে মাঝে মাঝে আড্ডা হয়েছে। ওঁর সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভাল লাগত। উনিও বলতেন যে, আমাদের টেবিলে চলে এসো। তবে ওঁরা বোধহয় আমার থেকে বয়সে একটু বড়ই হবেন।
আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে?
সুনীলের সঙ্গে তখন আমার খুব একটা আলাপ হয়নি বোধহয়। পরে তো খুবই বন্ধুত্ব হয়েছে। ১৯৯৫-এ আমরা একসঙ্গে গেছিলাম চীনে। শক্তির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তার অন্য একটা কারণ আছে। একবার এখানে এসেছিলেন হিন্দি সমালোচক নামওয়ার সিং। উনি আগে বেনারস থাকতেন। ওঁকে শক্তি চিনত বেনারস থেকেই। ওই যে গিন্সবার্গদের সঙ্গে শক্তি যখন বেনারস গেছিল, তখন। ফলে দুজনেই দুজনকে চিনতেন। আমার ছোটগল্প পড়ে ভাল লাগায় উনি কলকাতায় এসে আমাকে খুঁজে বের করেছেন। একদিন আমায় বললেন যে, ভবানীপুর যেতে হবে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে। শক্তির নাম তার আগে শুনেছিলাম দু-একবার। ওই সন্ধেটা আমি ভুলিনি কোনওদিন। ডাবলডেকার বাসে করে ভবানীপুর এসেছিলাম। সেটা শক্তির বাড়ি নয়, ওঁদের অন্য কোনও এক কবিবন্ধুর বাড়ি। যিনি পরে শান্তিনিকেতন গেছিলেন পড়াতে…
শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়?
হ্যাঁ… হ্যাঁ… ওখানে গিয়ে দেখি, অনেকজন… কেউ বসে আছে, কেউ মদ খাচ্ছে, আর ঘর জুড়ে ভর্তি সিগারেটের ধোঁয়া… সেই শক্তির সঙ্গে আলাপ হল। পরেও দু-চারবার দেখা হয়েছে। তারপর তো আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাই। পরে যখন সুনীলের সঙ্গে কথা হয় ১৯৯৫-এ, তখন ওর মনে পড়েছে যে সেইদিন ও নিজেও ছিল। তাছাড়া কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসেও দু-একবার দেখা হয়েছে বোধহয়। আমিও যেতাম ওখানে রূপা অ্যান্ড কোম্পানিতে। ওখানকার মালিক মেহেরা সাহেবের সঙ্গেও আমার আলাপ ছিল ভাল, কারণ উনি আবার আমার বাবার বন্ধু ছিলেন বইয়ের দোকানের সূত্রে। তার অনেক বছর পরে আবার শক্তির সঙ্গে দেখা হল একটা জ্ঞানপীঠের অনুষ্ঠানে। এখন মনে পড়ছে না কার… কিছু কথা হয় তখন… তারপর আবার দেখা হয় ভোপালে। শক্তি ওখানে উঠেছিলেন জাহানামা প্যালেস হোটেলে। সকালবেলা গিয়ে দেখি, শক্তি মদ খাচ্ছে। আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল— তুমি কী খাবে বলো! আমি বললাম— চা খাব। শক্তি অবাক হয়ে বলল— চা? তারপর একদিন রাত্রিবেলা গেছি ওখানে বি. ভি. করন্থজির বাড়ি। পার্টি ছিল। সেখানে শক্তি দেখলাম বেশ রাতের দিকে গান গাইতে শুরু করল।
আপনারা যখন ভারতভবনে গেছিলেন, তখন তো ওখানে শঙ্খ ঘোষ ছাড়াও স্বামীনাথন, দিলীপ চিত্রে— এঁরাও ছিলেন?
হ্যাঁ। আমি তো স্বামীনাথনের জীবনীও লিখেছি। ওখানেও একটা পাতায় শঙ্খ ঘোষের কথা আছে। আরেকজন খুব নামকরা হিন্দি লেখক ছিলেন তখন ওখানে— কৃষ্ণ বলদেব বৈদ্য। ভারতভবনে সে-সময়ে সারা ভারতের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত লেখকরাই আসতেন— অনন্তমূর্তি, বালচন্দ্র নেমাড়ে, আরও অনেকে। ওখানে অনেকের সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব হয়েছে। ভারতভবনের শুরুর থেকেই আমি ছিলাম আর্ট-কমিটিতে। আমাদের মিটিং হত। আর অশোকের সঙ্গে তো আমার অনেক পুরনো বন্ধুত্ব। আমরা প্রায় সমবয়সি। আমি অশোকের থেকে ছ-মাসের বড়। আমরা প্রায় একই সময়ে লিখতে আরম্ভ করেছি।
আরেকটা অন্য ঘটনার কথা বলি। অজ্ঞেয়র যখন শতবর্ষ হল, তখন প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন থেকে ন্যাশনাল লাইব্রেরির অডিটোরিয়ামে একটা বড় করে অনুষ্ঠান হয়েছিল। আমরা সবাই গিয়েছিলাম। এজন্যই ঘটনাটা মনে এল। সেদিন সৌমিত্র বাংলা অনুবাদে অজ্ঞেয়র কবিতা পড়েছিলেন। শঙ্খ ঘোষও ছিলেন। তাঁর পাশেই বসেছিলাম আমি। আমাদের সবারই খুব ভাল লেগেছিল যে অজ্ঞেয়কে নিয়ে অনুষ্ঠানটি শুনতে শঙ্খ ঘোষ এসেছেন। অনুষ্ঠানের শেষে দেখি হলের সমস্ত লোক এসে, একে-একে ওঁকে প্রণাম করে যাচ্ছেন। সে এক অপূর্ব দৃশ্য!
সৌমিত্র চ্যাটার্জির সঙ্গে আমার আলাপটাও আরেক গল্প। সেটা ২০০৭-’০৮ সাল হবে। আমার বন্ধু দেবেন্দ্র রাজ অঙ্কুর তখন ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার ডিরেক্টর। আর আমি তখন ওখানকার পত্রিকার সম্পাদক। আমাকে দেবেন্দ্র বললেন— আমাদের এবার ভারত রঙ্গমহোৎসব হবে। আমি সৌমিত্রকে ডাকতে চাই। আর তুমি তো বাংলা জানো। তুমি আগে কথা বলো বাংলায়। রিকোয়েস্ট করো ওঁকে। আমি বললাম, ঠিক আছে, ফোন করছি। কথা হল বাংলায়। সৌমিত্র বললেন— ঠিক আছে, আমি আসব। তবে একটা চিঠি… আমি বললাম— হ্যাঁ, চিঠি তো অবশ্যই পাঠাব। আর আমাদের ডিরেক্টরও আমার পাশে বসে আছেন। উনিও আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর তো সৌমিত্র এলেন, অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হল, সৌমিত্রর বক্তৃতা হয়ে গেল। তারপর আমি গাড়ি নিয়ে প্রায় বাড়ি পৌঁছে গেছি, হঠাৎ অঙ্কুরজির সেক্রেটারির ফোন— আপনি কোথায়? আমি বললাম— আমি তো প্রায় বাড়ি পৌঁছে গেছি। এই ঢুকব। বললেন— সৌমিত্র জিজ্ঞাসা করছেন যে, আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন যে প্রয়াগ, তিনি কই? সে যদি এই সন্ধেবেলা এসে, আমার সঙ্গে একটু বসে, তাহলে আমার ভাল লাগবে। সে কি ড্রিঙ্ক করে? যদি ওর আসা সম্ভব হয়, তাহলে ওকে একটু আসতে বলুন। তো, আবার আমি গাড়ি নিয়ে ফিরে এলাম। তারপর আবার NSD-র গাড়ি নিয়েই আমি সৌমিত্রকে নিয়ে বেরোলাম। ওঁর সঙ্গে গাড়িতে বসে দুটো-একটা কথা বলার পরেই মনে হল যে, এই লোকটাকে আমি যেন বহু বছর ধরে চিনি। আমি হিন্দিতে লিখেওছি সেইসব অভিজ্ঞতাগুলো। যাকে আমি অনেক-অনেক ছবিতে দেখেছি, এমনকী তার সঙ্গে আইডেন্টিফাইও করতাম… আমরা তো মোটামুটি সমবয়সি… বিয়ের পর সেই যে শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে দৃশ্যগুলো… সেই যে রেললাইন ধরে হাঁটার দৃশ্য… ‘অপুর সংসার’-এ… সেসব মনে করেই রোমাঞ্চ হচ্ছিল। কলকাতায় থাকতেই আমি ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছিলাম। সত্যি বলতে কী, সত্যজিৎ আমার জীবনকে অনেক বদলে দিয়েছেন। পরে সত্যজিৎকে নিয়ে আমি বইও লিখেছি। আসলে, সত্যজিতের এই ছবিগুলো এইজন্যই মহান যে, সেগুলো শুধু আপনাকে নানা তথ্য সরবরাহ করে না, বরং আপনার মধ্যে এক ধরনের বোধ জাগিয়ে তোলে। যাই হোক, তারপর তো আড্ডায় বসে সৌমিত্রর সঙ্গে অনেক কথাই হল। শঙ্খ ঘোষের কবিতা, জীবনানন্দের কবিতা— আরও নানা বিষয়ে। ওঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল আমার সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটিতে, যোগেন চৌধুরীর একটা বড় প্রদর্শনী হয়েছিল সেখানে।
বাঙালিদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা সত্যিই খুব গভীর। কতজনের সঙ্গে যে এরকম কত গল্প! ঋত্বিক ঘটক যখন দিল্লিতে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর উপর ছবি করবেন বলে, তখন ওঁর সঙ্গেও আমার দেখা হয়েছিল। সেই আড্ডায় আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, পদ্মশ্রী পেয়ে আপনার কেমন লাগছে? বললেন যে— কেমন আর লাগবে? একদিন ভবানীপুরের পার্কে বসে আমি রাম খাচ্ছিলাম, হঠাৎ পুলিশ এসে আমায় ধরল। আমি বললাম যে, আমি পদ্মশ্রী। তার বিশ্বাস হল না। সে আমায় ধরে থানায় নিয়ে গেল। থানার যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তিনি আমায় দেখে চিনতে পারলেন। বললেন— আরে, এ তুমি কাকে ধরে এনেছ? ঋত্বিক হেসে বলেন— পদ্মশ্রীর প্রয়োগ আমি এইরকমই করি!
আপনি তো অক্টাভিও পাজের কবিতাও অনুবাদ করেছেন হিন্দিতে। সেটা কি পাজ যখন ভারতে ছিলেন, সেই সময়ে?
না, সেটা করেছি তার অনেক পরে। তবে পাজ থাকার সময়ে দেখা হয়েছে কয়েকবার। একবার তো স্বামীনাথনের বাড়িতে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। স্বামীর বাড়িতে মাঝে মাঝে ছোটখাট আসর বসত আমাদের। সেরকম এক আসরে পাজ এসেছিলেন। সেদিন স্বামী তরুণ সরোদবাদক বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীকে বলেছিলেন বাজাতে। বিশ্বজিৎ আমজাদ আলি খানের ছাত্র। সেদিন বাজিয়েছে। পাজের বেশ পছন্দ হয়েছে সেই বাজনা। বাজানো শেষ হওয়ার পর স্বামী পাজকে বললেন— এই ছেলেটার একটা কিছু ব্যবস্থা করে দিন। পাজ বললেন— ঠিক আছে, আমি দূতাবাসে ওর অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে দেব। আর ওর বিদেশ যাওয়ার কোনও ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখি। স্বামী বলে উঠলেন— না না, আমি সেইসব ব্যবস্থা করতে বলিনি। সেসব কিছুই করতে হবে না আপনাকে। বলে, পাজের হাতটা টেনে নিয়ে গিয়ে বিশ্বজিতের মাথায় রাখলেন। বললেন— ব্যবস্থা করতে বলার মানে এইটা… ওকে আশীর্বাদ করে দিন ভাল করে। আমরা সবাই হেসে উঠলাম।
অনুবাদ সম্পর্কে নতুন কিছু ভাবছেন?
আমার মনে হয়েছিল নতুন প্রজন্মের জন্য কিছু অনুবাদ করা দরকার। গান্ধীর আত্মকথা, ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল ডান্স, পশ্চিম ইউরোপের চিত্রকলা— এগুলো আমি অনুবাদ করেছি তাদের জন্য। নিয়োগী বুকস-এর থেকে নির্মলকান্তি ভট্টাচার্য আমায় প্রায় খান কুড়ি বই পাঠিয়েছিলেন অনুবাদের জন্য। আমার ঠিক মনমতো হচ্ছিল না। হঠাৎ একদিন আমি তার মধ্যে মহম্মদ রফির জীবনী পড়তে শুরু করলাম। পড়তে-পড়তে আমার এত ভাল লাগল যে, আমি সেটাই অনুবাদ করব ঠিক করলাম।
সবসময়ে কি এইরকম ভাললাগা থেকেই সব অনুবাদ করেছেন?
না। কখনও আনন্দের জন্য করেছি, কখনও আবার পয়সার জন্য। এই যেমন শঙ্খ ঘোষের জন্মদিনে, সকালবেলা ভাবছিলাম যে, আজ শঙ্খ ঘোষের জন্মদিন, আর আমি কলকাতাতেই আছি। তাহলে কিছু একটা করা উচিত। তাই ওঁর ‘সীমান্ত’ কবিতাটা অনুবাদ করলাম বসে-বসে।
কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হল যে, কবিতাটাকে একেবারে ভিতর থেকে টের পেতে হবে। কবিতাটা যেভাবে সম্ভব হয়ে উঠল… কবিতা শুধু চেষ্টা করে তো বানানো যায় না, সেটা নিজের থেকে জেগে ওঠে… তার এক লাইনের পর আরেকটা লাইন কীভাবে যে চলে আসছে, সেটা কবি নিজেও সবসময়ে জানেন না। এটা বোধহয় কবিতা বা পেইন্টিং-এর ক্ষেত্রে খুব সত্যি। এটা না হলে সেই শিল্প সার্থক হয় না বোধহয়। এই পদ্ধতিতে শিল্পকাজটা না হলে… যেমন ধরা যাক, আপনার চোখের সামনে এক টুকরো মেঘ ভেসে এল… এভাবে কোনও লাইন এসে গেল, বা কোনও-কোনও শব্দ এসে গেল… সেই লাইন বা সেই শব্দগুলোই কেন এল? এগুলো খানিক বোঝার চেষ্টা করতে হয় অনুবাদের সময়েও।
নতুন কিছু অনুবাদ করার কথা ভাবছেন এখন?
অ্যাসাইনমেন্ট কিছু নেই। তবে শঙ্খ ঘোষের আরও কিছু অনুবাদ করব আমি নিজের ভাললাগার তাগিদেই।
(সমাপ্ত)