ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হিয়া টুপটাপ, জিয়া নস্টাল: পর্ব ১৪


    শ্রীজাত (April 17, 2022)
     

    রোববার

    বাবা মা’র সঙ্গে রোববার কাটানোর বাড়তি সুযোগ আমার প্রায় কোনওদিন ঘটেনি। দু’জনই এমন পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যে, বাকি বন্ধুদের বাবা মা’দের কাজের ধরনের সঙ্গে একটুও মিল ছিল না। অন্য সব অভিভাবকদের কী সুন্দর রোববার ক’রে ছুটি লেখা থাকত, আমার বাবা মা’র ঠিক তার উল্টো। বাবা সাংবাদিক মানুষ। হপ্তায় তিনরকমের শিফটে কাজ। কিন্তু রোববার ছুটি খুব কম থাকত। হয়তো বুধবার কী শুক্রবার ছুটি, সেদিনও কোনও অনুষ্ঠানে চলে গেল, পরদিন রিভিউ লিখতে হবে ব’লে। মা’র ছিল গানের কাজ। নানা মেহফিলে ডাক আসত সে-সময়ে। তা ছাড়া হপ্তায় সাতদিনই বাড়িতে গানের ক্লাস। এর মধ্যে শনি আর রবি ছিল সবচাইতে জাঁদরেল দুখানা দিন। সকাল সাড়ে আটটা থেকে সেই যে গান শেখানো শুরু, শেষ হতে হতে বেলা তিনটে কি বিকেল চারটেও পেরিয়ে যেত। অতএব আমার রোববার বাবা মা’র ছুটির ছায়া ছাড়াই রোদ পোহাত বাড়ি জুড়ে।

    তা সত্ত্বেও, রোববারকে ঘিরে একরকমের অপেক্ষা কাজ করত আমার মনে। তার কারণ আর কিছুই না, মাংসের ঝোল। নাহ, পাঁঠার মাংস নয়, নেহাতই মুরগির। সেও যে প্রতি রোববার হতে পারত, এমনটা নয়। তবে মাঝেমধ্যে হতোই। আর যেসব রোববার হতো, তাদের সুগন্ধ আর স্বাদ ছিল আলাদা রকমের। কে রাঁধত সেই ঝোল? এইখানে বলি, আমার সেই ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে রান্নার কাজে আসত সবিতাদি। কত আর বয়স হবে তখন তার? বছর পঁচিশেক। তারই মধ্যে তার রয়েছে অশান্তির সংসার আর দুই ছোট ছোট ছেলে। সেসব রেখেই সে আসত রোজ আমাদের বাড়ি, রান্নার কাজে। আর আসত আমাকে সং দিতে। আমার অনেক বন্ধু’র দিদি ছিল, আমার নিজের কোনও দিদি ছিল না। বয়স এগোতে এগোতে সবিতাদিই হয়ে উঠেছিল আমার দিদি। যত কিছু আবদার আর বায়না আমার, তার হাতে পরিয়ে দিতাম। পাড়ার দোকানে হজমি কিনতে যাওয়া থেকে রথের মেলায় পাঁপড় খেতে যাওয়া। সবিতাদি সবটুকু হাসিমুখে মেনে নিতো। বাবা আর মা’ও জানত, সবিতা আছে যখন, আমাকে নিয়ে কোনও চিন্তা নেই।

    সেই সবিতাদি এক অসামান্য মুরগির ঝোল রান্না করতে জানত, যা কেবল রোববারেই খাওয়া চলে। রোববারের রোদ, রোববারের বারান্দা, রোববারের স্নান বা রোববারের আলিস্যির সঙ্গে যেমন কোনও কিছুর তুলনা চলে না, তেমনই রোববারের মাংসের ঝোলের সঙ্গে অন্য কোনও দিনের রান্নার কোনও মিল নেই। বেলা এগারোটা সাড়ে এগারোটা থেকে তোড়জোড় করে যখন বারোটা সোয়া বারোটা নাগাদ মাংসটা প্রায় হয়ে আসত, তখনই আমার অর্ধেক খাওয়া হয়ে যেত। ঘ্রাণে

    তা সেই সবিতাদি এক অসামান্য মুরগির ঝোল রান্না করতে জানত, যা কেবল রোববারেই খাওয়া চলে। রোববারের রোদ, রোববারের বারান্দা, রোববারের স্নান বা রোববারের আলিস্যির সঙ্গে যেমন কোনও কিছুর তুলনা চলে না, তেমনই রোববারের মাংসের ঝোলের সঙ্গে অন্য কোনও দিনের রান্নার কোনও মিল নেই। বেলা এগারোটা সাড়ে এগারোটা থেকে তোড়জোড় করে যখন বারোটা সোয়া বারোটা নাগাদ মাংসটা প্রায় হয়ে আসত, তখনই আমার অর্ধেক খাওয়া হয়ে যেত। ঘ্রাণে। বাইরের ঘরে মা’র ক্লাসে হয়তো তখন বেহাগের বন্দিশ ‘ক্যায়সে সুখ সোবে’ চলছে, তারই সঙ্গে মিশে যেত আশ্চর্য ঝোলের গন্ধ।

    রান্না যে খুব মশলাদার বা জমজমাট, এমন কিন্তু নয়। নেহাত সাধারণ, পাতলা ঝোল। সঙ্গে ডুমো করে কাটা আলু। কিন্তু সেই পাতলা হলদে-সোনালি চিকচিকে ঝোলের যে-স্বাদ সবিতাদি আনতে পারত, তা অপার্থিব। ওই বারোটা থেকে মন যে সেই রান্নার প্রতি চলে যেত, সে আর কোনও দিকে তাকাতো না। অনেক পরে যখন পড়েছি বিনয় মজুমদারের সেই বিখ্যাত পঙক্তি, ‘সকল ফুলের কাছে মোহময় মন নিয়ে যাবার পরেও / মানুষেরা কিন্তু মাংস রন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে’। তখন নিজের ছোটবেলার রোববারগুলো মনে পড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকেনি কোনও।  

    খুব তারিয়ে তারিয়ে খেতাম, মনে আছে, সাদা আনকোরা গরম ভাতের সঙ্গে সেই মাংসের ঝোল। আর কোনও পদ সেদিন না রাঁধলেও আমাদের চলে যেত। বাবা বাড়িতে নেই, মা ডুবে আছে গানে, সবিতাদি ভারী যত্ন করে আমাকে বেড়ে খাওয়াত মাংস ভাত। স্টিলের একখানা চকচকে কানাউঁচু থালা ছিল আমার। সেইটায় আচ্ছা করে সময় নিয়ে চেটেপুটে খেতাম। বাবাকে দেখে দেখে পাতের কোণে একটু নুন আর এক কোয়া পেঁয়াজ নিতাম, মাংসের সহকারী হিসেবে। এমনিই আমি আলসে, তার ওপর এই দিনটায় চেষ্টা করতাম, যতক্ষণ দেরি করে খাওয়া যায়। যত বেশি সময় ধরে সেই আশ্চর্য রান্নার স্বাদ নেওয়া যায়, ততই আমার ভাল। খাওয়া শেষে স্টিলের চকচকে থালায় আঁকিবুকি কাটা ছিল আমার অভ্যেস, ঝোল আর আঙুলের নকশার মাঝখানে নিজের মুখ ফুটে উঠতে দেখা যেত থালায়, তাতেও যে কতখানি মজা পেতাম, আজ ভাবলে অবাকই লাগে একরকম।

    এইরকম অনেকগুলো বছর কাটার পর, এক সকালে সবিতাদি আর এল না। না-বলে ছুটি নিতো না কখনওই, তাই আমরা একটু চিন্তাই করছিলাম সকলে। সন্ধের দিকে, পাশের বাড়ির ঠিকে কাজের মহিলা এসে জানালেন, সবিতাদি বিষ খেয়েছে দুপুরে। একটু আগে ঘর থেকে তার দেহ পাওয়া গেছে। এভাবে মানুষ চলে যেতে পারে, সেই আমার প্রথম জানা। তখন সন্ধে নেমে আসছে পাড়ায়, ঝিঁঝির ডাক ফুটে উঠছে চারপাশে, বন্ধুরা খেলা সেরে পড়তে বসে গেছে, তার মধ্যে সবিতাদির এই মুছে যাওয়া, বিষ খেয়ে নিজেকে হারিয়ে দেওয়া, এই ব্যাপারটা আমি ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছিলাম না। কেবল বুঝতে পারছিলাম, আর কোনও দিন সবিতাদি’র সঙ্গে দেখা হবে না। ছোট্টখাট্টো চঞ্চল সেই মানুষটির ঝকঝকে আদুরে হাসির সামনে দাঁড়ানো হবে না আমার। আর কেউ আমাকে ওরকম মাংসের ঝোল রেঁধে খাওয়াবে না কখনও।

    আমি যেতে চেয়েছিলাম খুব, আমাকে যেতে দেওয়া হয়নি। বাবা খবর পেয়ে বাড়ি ফিরেই ছুটে গেছিল সবিতাদি’র বাড়িতে। হয়তো অশান্তি হয়েছিল আবার, হয়তো আর পারেনি দাঁতে দাঁত চেপে পরেরদিনের জন্য অপেক্ষা করতে। আদরের দুই ছেলেকে আবছা একটা বয়সে দাঁড় করিয়ে রেখে বিষ খেয়ে নিয়েছে। সবিতাদিকে ভুলতে পারিনি। যেমন ভুলতে পারিনি সেই সন্ধেটা। আর ভুলতে পারিনি তার হাতের আশ্চর্য মাংসের ঝোলের স্বাদগন্ধ। এখন আমরা কাচের প্লেটে খাই। বাড়িতে মাঝমধ্যেই মাংস রান্নাও হয়। কেবল সেই রোববার আর ফিরে আসে না। খাওয়া শেষ করে থালায় আঁকিবুকি কাটার অভ্যেসটাও ছেড়ে গেছে কবেই। কাচের প্লেটে আর যাই হোক, নিজের মুখ ফুটে ওঠে না।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook