আপনি কখনও ভেনিস গেছেন?’
‘না না, আমি কেন, আমার চোদ্দো পুরুষের কেউ যায়নি। চেনাজানার মধ্যে আমাদের কাউন্সিলার কাকলি মাল গেছিলেন। কাকলি মানে কুটুপিসি। এ-নামেই সবাই তাঁকে চেনে। এমনকী ভোটের ক্যাম্পেনের সময়ে দেওয়ালে কাকলি মালের পাশে ফার্স্ট ব্র্যাকেটে ‘কুটুপিসি’ নামটাই লেখা থাকে।’
ভোটে জেতার খুসিতে কুটুপিসি সেক্রেটারি শ্যামলালকে নিয়ে ইউরোপ গেছিলেন। শ্যামকে সবাই বলে ‘স্যাঁকারুটি’। বেশি নয়, এক হপ্তার ট্যুর। বাকি জায়গায় উচ্ছ্বাস চেপে রাখলেও ভেনিসের সেন্ট মার্ক বাসিলিকায় এসে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না শ্যামলাল। অবশ্য সব দায় তার ঘাড়ে চাপানো ঠিক হবে না। কারণ তাঁরা ইন্ডিয়া থেকে এসছেন শুনেই সোলার টুপি পরা মাঝি ‘গ্রেট গ্যাম্বলার’-এর ‘আ মোরে মিয়া’ গাইতে শুরু করে।
তাদের খালপাড়ের মতোই নোংরা কালো জল। নিজেকে বচ্চন মনে হলেও নিজে না গেয়ে পিসিকে গাইতে বলে শ্যাম। অনেককাল আগে ‘দিওয়ার’-এ নীতু সিং-এর ভরা বুক দেখার উত্তেজনায় পাড়ার টু-সিটার রকে একা বসে শ্যাম ফুল দরদ দিয়ে শুরু করে ম্যায়নে তুঝে পায়া, পুরো লাইন শেষ করার আগেই শান্ত কুকুর কালু লাফিয়ে উঠে বাঁ-পায়ে মোক্ষম কামড়। চোদ্দোটা ইঞ্জেকশন নিতে হয়েছিল। কিন্তু পিসির ব্যাপারটা আলাদা।
পলিটিক্সে আসার আগে লোকে তাঁকে খালপাড়ের আশা ভোঁসলে বলে ডাকত। রাতে কাজ সেরে ফেরার পর এখনও কন্ট্রাকটর হাজব্যান্ডের সঙ্গে টিচার্স খেতে-খেতে ‘দো ঘুঁট বা হ্যয় বিছুয়া’ গাইতেন। আজ এই পরিবেশে একেবারে গলা খুলে গাইলেন পিসি। গাইলেন বললে ভুল হবে, ব্লু কুর্তি, শ্যাম্পু করা চুলে একেবারে জ্বালিয়ে দিলেন। পুরোটা ভিডিওতে তুলে ফেসবুকে দিয়ে দিল শ্যাম। মুহূর্তে লাখখানেক লাইক। পিসির ওয়াটসঅ্যাপে ওপর মহল থেকে একটাই বার্তা এল, ‘বিহেভ ইয়োরসেল্ফ।’
দেশে ফিরে হাজব্যান্ডকে দিয়ে তাদের বাসস্ট্যান্ডটাকে ভেঙে ভেনিসের ফেমাস গন্ডোলা স্টেশন স্যান মার্কোসের স্টাইলে তৈরি করান। ঠিক করেন, এবার ফেরি সার্ভিস চালু করবেন। কেউ বিলিভ দেবে না কিন্তু এক সময়ে আজকের এই পচা খাল দিয়ে দূর-দূর থেকে লোকে যাতায়াত করত। সাহেবরা পাখি শিকারে আসত। শোনা যায়, কখনও-সখনও দক্ষিণরায়ের দেখাও মিলত। যে-কারণে মিত্তিরদের বাড়িতে আজও দুটো দো-নলা রয়ে গেছে। মিত্তিরদাদু মাঝে মাঝে ছাদে দাঁড়িয়ে সেগুলোকে তেল দেন, নীচ থেকে ছেলেরা বলে, ‘কী দাদু, মেশিনে তেল দিচ্ছ?’
২.
কেন কে জানে এই বাসস্টপে কোনোদিন বাস দাঁড়ায় না, দাঁড়ায় কিছুটা সামনে। এটা গলায় পিংক রিবন বাঁধাতে ঠ্যাঙে কুকুর বুলা আর তার বাচ্চাদের আড্ডা। এদিক দিয়ে শহর থেকে বাস যায়, উলটোদিক দিয়ে আসে। মাঝখানে ফ্লাইওভার। নীচ থেকে গাড়ি-বাসের মাথাগুলো দেখা যায়। আর দেখা যায় রংবেরঙের হেলমেট। জ্যাম থাকলে মনে হয় জলের মধ্যে দিয়ে ভাসতে-ভাসতে চলেছে।
ফ্লাইওভারের নীচে স্বামীজি থেকে নেতাজি সবাই হাজির।এদের ফাঁকে-ফাঁকে ঘাসের হাতি-ঘোড়া-গণ্ডার। রোজ বিকেলে ওপারের উঁচু বাড়িগুলোর মাথার ওপর থেকে সূর্যটা টলতে-টলতে খালের জলে ডাইভ দেয়। এই সময়ে বুলা তার ছেলেপুলেদের নিয়ে খাবারের খোঁজে বেরোয়। একইসঙ্গে হেগে-হেগে পাড়াটার সত্যনাশ করে। তিন-তিনবার মিউনিসিপ্যালিটি থেকে কুকুর-ধরা গাড়ি এসেছিল। ধরা তো দূর, একটার ল্যাজের দেখাও পায়নি।
বুলাদের দেখভাল করত ড্যাটন। ওপার থেকে মাংসের ছাঁট নিয়ে আসা, জলের ধারে হাগানো। গেলবার দোলে সিদ্ধির ঝোঁকে সিন্ডিকেটের টপ জিৎ-এর মেন লাভার মংকাকে জমিয়ে টিপে ধাঁ হয়ে গেল। তারপর থেকেই হাগাহাগির ঝামেলাটা শুরু।
‘ভেনিসের মতো নোংরা নয়, জলটা পদ্মফুলে ভরিয়ে দে।’ কথামতো ক্যাডাররা আশপাশের সব পুকুর খালি করে পদ্মে ভরিয়ে দেয় পচা খাল। নৌকো আসে গোপলার ভেড়ি থেকে। তালেগোলে পাঁক সাফ করার কথা কারো মাথায় আসেনি। ওইদিন পিসি ব্যস্ত ছিলেন বাসস্ট্যান্ডের পেছনের দোকানগুলো ওইদিন সকালে খোলা থাকবে কি না তাই নিয়ে।
আজ যেখানে ফুলে সাজানো নৌকাটা রাখা হয়েছে, ওপরে বাঁশের তৈরি টেম্পরারি ব্রিজের পাশে মানিকের ফুলের দোকান। এক সময়ে তার পারমিশন ছাড়া একটা পাতাও হিলত না। তিন বছর আগে নতুন অল্টো নিয়ে ছেলে লাভার নিয়ে বেরিয়েছিল। এক্সপ্রেসওয়ের মুখে হেড অন, বডি কাঁচিয়ে বার করতে হয়। মানিকের ধারণা, তার পাপেই এই কাণ্ড। প্রায় এক মাস ঘর থেকে বেরোয়নি মানিক। তারপর তার এক চ্যালার কাকার পরামর্শে ফুলের বিজনেস।
নীচ থেকে জলের ধার থেকে টবগুলো উঠে আসে, মনে হয় জল থেকেই ফুলগুলো উঠে এসেছে। এরপর বুড়িমার রুটি, কষা। আই টি-র ছেলেমেয়েরা বুড়িমার মেন খদ্দের। এরপর ভোলার মোমো, বউদির লেবু পেরিয়ে খান পনেরো দোকান। এর মধ্যে মেন দোকান দুটো। প্রথমটা গজার সাট্টা কাম ডেলি লটারি, অন্যটা সাসারামের রমেশের। এখানে লিকার চা, দুধ চা, কফি ছাড়াও নানারকমের বিস্কিট, চিপস, ক্যাডবেরি ইত্যাদি পাওয়া যায়। তবে বিখ্যাত হল ডিমটোস্ট।
শুধু এই দুটো দোকানের সামনেই একটা করে বেঞ্চি আর খানকতক প্লাস্টিকের টুল আছে। গজার খদ্দেররা সবসময়ে গম্ভীর। কানে পেনসিল বা বিড়ি গোঁজা, হিসেবে ব্যস্ত। রমেশের ভ্যারাইটি খদ্দের। সকালে ডেলি ওয়েজের লেবাররা। দুপুরে বাচ্চাদের স্কুলে দিতে আসা মায়েরা বা দলছুট লাভাররা।
বিকেল চারটে থেকে ছ-টা শুধু বেঞ্চি নয়, চারপাশটা দখল করে রাখে বিটার মুন হোটেল কাম রেস্তোরাঁর মেয়েরা। এরা খায়, হাসে আর হাতে-হাতে ঘোরে সিগারেট। এরা ট্রেনে দেড়/দু-ঘণ্টার পথ পেরিয়ে আসে। কম্পিউটার ট্রেনিং বা ওইরকম কোনও ভুজুং দিয়ে। এসে চুপচাপ ঢুকে পড়ে বিটার মুনের ২০৭ নম্বর ঘরে।
এখানে ওদের সবার আলাদা-আলাদা লকার আছে। সব খুলে ব্র্যান্ডেড ব্রা-প্যান্টি থেকে জিনস-টপ পরে মেক-আপ টেক-আপ ঠিক করে যে যার ঘরে ঢুকে পড়ে। বড়জোর এক ঘণ্টা। সব কেটেকুটে ১২০০ থেকে ১৫০০। অনেকে আবার শ-পাঁচেক বখশিস দেয়। মালিক মলহোত্রা সাহেবের দয়ার শরীর। মাকুন্দ ম্যানেজারকে বলে দিয়েছে একদম ওই টাকায় হাত না দিতে।
৩.
বাসস্ট্যান্ডে ইনোগরেশনের দিন সকাল থেকে হুলুস্থুল। ভাবা যায় না এত ফুল, রঙিন কাগজের শিকলি। কুকুরগুলোকে পার্টির ছেলেরা বাঁশ নিয়ে ভাগিয়েছে। লিটন, ডট্যান, গোল্লা, এট্টু, পালক— সবার গেরুয়া পাঞ্জাবি, সঙ্গে ধুতি বা ঢোলা পাজামা। বাট নো জিনস, নো টি-শার্ট। পিসি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, এর কোনও ব্যত্যয় হলে মেরে গাঁড় ভেঙে দেবেন।
টিভি জ্যামে আটকে আছে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঢুকে যাবে। কুটুপিসি ব্রা আর সায়া পরে আয়নার দিকে তাকিয়ে বগলে সেন্ট দিতে-দিতে বলেন, ‘বাঞ্চোতরা আর অবরোধ করার দিন পেল না?’
‘নিজের পার্টিকে খিস্তি করছ? আর এত যে সেন্ট দিচ্ছ, ওখানে তোমাকে কে শুঁকবে?’
‘বোকাচোদার মতো কথা বোলো না, জানো তো আমার ঘামে একটা বিটকেল গন্ধ হয়।’
‘আমার তো ওতেই হয়ে যায়।’
‘সক্কাল-সক্কালই চড়িয়ে ফেলেছ না কি?’
‘কী যে বলো!’
সাদা ধুতি, ফ্যাব ইন্ডিয়ার চাইনিজ কলার দেওয়া শার্টে কুটু পিসাই আজ টোটাল রঞ্জিত মল্লিক। পিসি লাল ব্রা-টা গলিয়ে বলে, ‘হুকটা লাগাও তো।’
পিসা দু-হাতে বুক চটকাতে-চটকাতে পিঠে মুখ ডুবিয়ে দেয়, ‘এক কাট লাগিয়ে নিলে হত।’
‘চোদনামি না করে হুকটা লাগাও।’
৪.
পিসিরা আসার মিনিট পনেরো পর টিভি এল। পিসির লাল পাড় সাদা গরদ, কনুই-ঢাকা লাল ব্লাউজ, খোলা চুলে পার্টির সাইন দেওয়া হেয়ার ক্লিপ। টিভির লোকেদের জন্য মাংসের চপ, মিষ্টি, কফি। খেতে-খেতে মেয়েটি বলে, ‘দাদাকেও ফ্রেমে রাখতে হবে। পুরো রঞ্জিত মল্লিক-মৌসুমি।’
পিসি হেসে বলে, ‘প্রথমে বাসস্টপ ইনোগরেশন। তারপর মিনি লেকচার। এই বাসস্টপ আর ফেরি সার্ভিসে সাধারণ মানুষের, আমার হকার ভাইদের কতটা সুবিধা হবে। ব্যাস, প্রোগাম বলতে এই। আপনাদের টোটাল নাম্বারটা আমার সেক্রেটারিকে বলে দেবেন, ওই ক-টা গিফট হ্যাম্পার গাড়িতে তুলে দেবে।’
পিসি গলা চড়ান, ‘শ্যাম, ওঁরা ক-জন আছে জেনে নে।’
শ্যাম গলা নামায়, ‘পিসি একটা খুচরো প্রবলেম…’
‘হ্যাঁ?’
‘মানে, নৌকাটা কে চালাবে?’
পিসি দাঁতে-দাঁত চাপে, ‘খানকির ছেলে, এতক্ষণ কি ছিঁড়ছিলি না কি? একটা মাঝি ঠিক করতে পারলি না?’
‘না না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। প্রবলেম অফ মেনি। একে আপনি তায় টিভি, ৭ নম্বরের ফুল টিম বডি ফেলে দিয়েছে।’
‘চ্যাটচালাকি না করে দু-মিনিটের মধ্যে একটা কাউকে খাড়া কর।’
এই সাইডে চুল্লুকে বলে মাদার ডেয়ারি। আজ নৌকোর এক্সাইটমেন্টে সকলেই ২/৪ প্যাকেট এক্সট্রা মেরেছে। শ্যামের মুখে ‘কে নৌকা চালাতে পারে?’ শুনে, সাড়ে চার টাল্লা মেরে মধু তাকে একটা লম্বা কিস খেয়ে বলে, ‘নো পবলেম শ্যামদা, আমার শালা বোটলগ্নে জন্ম।’
৫.
প্রবল হাততালির মধ্যে প্রথমে মধু উঠে হাত বাড়ায়। তার হাত ধরে পিসা, পিসি। সবার মোবাইল ক্যামেরা চালু। মধু দড়িটা খোলে। কুটুপিসি হাত নাড়ান। এর মধ্যে নৌকোটা সোজা যাবার বদলে একটা পাক মেরে ডানদিকে টাল খেয়ে হেলে পড়ে। পাকা ফলের মতো খসে পড়েন পিসি, পিসা। হইহই-রইরই-মারমার-কাটকাট। মুহূর্তে দশ/বারোটা ছেলে লাফিয়ে পড়ে।
পাঁকে লেপা পিসি-পিসাইকে তোলা হল। মধু খানকতক লাথি খেয়ে পোঁদ তুলে পড়ে রইল খালপাড়ে। পিসিদের নিয়ে আসা হল টিউবওয়েলের সামনে। টিভি ক্যামেরা বহুত বারণ করা সত্ত্বেও এঁটুলির মতো লেগে থাকে। ফেসবুকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে পিসির পড়ার খবর। ‘দ্য ফল’ নামের একাধিক ট্রোল।
দাদাগিরির লম্বা এক্সপিরিয়েন্স থেকে জিৎ বোঝে, এখনই শক্ত হাতে রাশ না ধরলে ব্যাপারটা বেশি রকম সিরিয়াস হয়ে যাবে। কতকটা বাধ্য হয়েই সে তিন নম্বর গলাটা বার করে, ‘বহুত টাইম ধরে বলা হচ্ছে ম্যাডাম দোকানপাট বন্ধ করে কেটে পড়ুন। না হলে কিন্তু…’
‘না হলে কী করবেন আপনি?’ মেয়েটি তেরিয়া।
‘অ্যাই গবা, সব ক-টাকে গাড়িতে তুলে দে।’
‘আপনি কিন্তু প্রেসের গায়ে হাত দিতে পারেন না।’
‘আমি কী পারি, না পারি, তার কোনও আন্দাজ আপনাদের নেই। ভালো চান তো কেটে পড়ুন।’
টিভির লোকেরা কেটে পড়ে ঠিকই, তার আগে ড্যামেজ যা করার করে দিয়ে যায়। পিসিরা যখন টিউবওয়েলের নীচে, ওদিকে চ্যানেলে-চ্যানেলে তখন হেডিং— ‘নৌকাডুবি : কবিগুরুর পর আরেকবার’।
ওদিকে টিউবওয়েল টিপতে-টিপতে লগা গলা চেপে দুলুকে বলে, ‘কী সাইজ মামা, পুরো মুঠোভরা!’
‘একটা মুঠোয় আঁটবে না গুরু!’
৬.
বাড়িতে ফেরার আগেই হাইকমান্ডের ফোনে মটকা গরম হয়ে আছে কুটুপিসির। না ফোন নয়, মেসেজ; ‘কুটু অনেক হয়েছে, পলিটিক্স ছেড়ে এবার ছাদে বসে বড়ি দাও।’
বাড়ি ফিরে সোজা শোবার ঘরে ঢুকে শাড়ি-ব্লাউজটা টেবিলের ওপর ছুড়ে ফেলে, এসিটা চড়িয়ে দু-হাত মাথার পেছনে দিয়ে, খাটে বডিটা ফেলে দিয়ে বলেন, ‘সব শালা বেইমান। এদের জন্য কম করেছি! এই তার রিটার্ন?’
পিসা ক্যাবিনেট খুলে ব্লেন্ডার্স প্রাইডের বোতলটা খুলে গ্লাসে খান চারেক আইস কিউব ফেলে একটা জমজমাট পেগ রেডি করে লম্বা চুমুক দিয়ে পিসির মুখে ধরে বলেন, ‘গুছিয়ে মেরে দাও। মনে রেখো ব্লেন্ডার্স কখনও বেইমানি করে না।’
পিসিকে খাইয়ে বাকিটা মেরে সিগারেট ধরালেন পিসা।
‘এসিটা যাবে।’
‘না হলে নতুন আসবে কী করে?’
‘কাউন্টারটা দাও।’
সিগারেট বাড়িয়ে পিসির ওপর আলতো করে শুয়ে পড়েন।
‘আরে, কী হল কী, এখনও পাঁকের গন্ধ ছাড়ছে।’
‘গিজারটা অন করে আসি, অনেকদিন একসঙ্গে চান করা হয় না।’
ওদিকে খালপাড় এখন শুনশান। নৌকোটা উলটো করে সাইডে রাখা আছে। তার পাশেই পড়ে আছে মধু। না, নেশা নয়, কেলানি। সাট্টার ঠেকে এসব নিয়ে কোনও হেলদোল নেই, তারা রোজকার মতোই গম্ভীর। মেয়েদের আড্ডা আজ নৌকো নিয়ে গরম।
‘তুই নৌকোডুবি দেখেছিলি?’
‘তখন ক্লাস নাইন। ফার্স্ট লাভার মুকুন্দর সঙ্গে গেছিলাম দীপক হলে। বন্যার সময়ে স্ক্রিনে ফুটে উঠত— ‘বান আসিতেছে পা তুলিয়া বসুন’।’
‘আর কী কী তুলেছিলি?’
সমবেত হাসি।
‘রিয়া-রাইমা একসঙ্গে বোধহয় ওটাই ফার্স্ট?’
‘কে জানে! আমি বেঙ্গলি মুভি দেখি না, আমার ফেভারিট সলমন আর রণবীর।’
‘কাপুর না সিং?’
‘যে-কোনও একটা হলেই হল।’
‘তোরা যাই বলিস, আমার কিন্তু ঋতুকে হেভি লাগে, লোকটার টেস্ট ছিল মাইরি। কীসব কামিজ পড়ত…’
দুলু, লগা, মধুর জন্য ফ্রি-তে মোমোর সুপ নিয়ে এসেছে। লগা বলে, ‘গরমা-গরম ঝোলটা খেয়ে নে, বডিতে তাকত আসবে।’
৭.
দিন তার নিয়মমতো চলে। সূর্য ফ্লাইওভারের পুবদিকে উঠে বিকেলে পুরো আকাশ খুনে ভরিয়ে খালে নেমে যায়। নতুন ঘটনা বলতে মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনের দিন ঘোষিত হয়। গেরুয়া শাড়িতে কুটুপিসির তুলি হাতে ওয়ালিং-এর ছবি ওঁর ফেসবুক পেজে চলে আসে। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান : রং দে তু মুঝে গেরুয়া।
এবারেও পিসির চান্স পাকা। আর হবে নাই বা কেন! পাকা রাস্তা, ২৪ ঘণ্টা জল। রাস্তার দু-ধারে ফুলগাছ। মোড়ে দুটো বদ্রি-মুনিয়ার খাঁচা। প্রথমে কল্পতরু হাউসিঙের সামনে একটা পেল্লায় অ্যাকুয়ারিয়াম বসানো হয়েছিল। ব্যাস, সেভেন্থ হেভেনের লোকেরা ঝামেলা শুরু করল— ‘এরিয়ায় কড়োর খসিয়ে ফ্ল্যাট কিনব আমরা, অ্যাকুয়ারিয়ামের বেলা কল্পতরু!’
ফালতু চান্স না নিয়ে ওখানে পিসা ওর ডবল সাইজের একটা বানিয়ে দিয়েছেন। এইসব দেখভালের জন্য বাকু বলে একটা খুচরোকে ৫০০০ দিয়ে অ্যাপয়েন্ট করেছেন। কিন্তু বিরোধীদের আপত্তির শেষ নেই। প্রথমত খালের ধারে সব খুল্লাম-খুল্লা পেচ্ছাব করে। গন্ধে টেঁকা দায়। তার চেয়েও বড় হল কুকুর। পুরো বাসস্ট্যান্ডটা দিনভোর থাকে কুত্তাদের দখলে। তাড়া দিলে একটু দূরে গিয়ে বসে। লোক সরে গেলেই যে কে সেই!
পুরো পাড়া পায়খানায় ভরিয়ে রাখে। ঝাড়ুদার সুলতান এক্সট্রা টাকা নিয়েও সাফ করতে রাজি নয়। বলে, ‘ট্যাকা দিচ্ছেন বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন না কি? আমি ডেলি-ডেলি দশ/বিশ কেজি গু সাফ করতে পারব না।’
এবার নতুন পোস্টার পড়ে বাংলা-ইংরিজি দু-ভাষাতেই। বাংলায় লেখা হয়, ‘সৌন্দর্যায়ন = কুত্তার গু’। ইংরিজিতে লেখা হয়, ‘বিউটিফিকেশন = ডিওডোরেন্ট ডগ শিট’।
৮.
পিসা অনেকদিন ধরেই প্রবলেমটা শুনছিলেন। আজ পিসির থাইতে হাত দিয়ে সুড়সুড়ি দিতে-দিতে বললেন, ‘নাউ দ্য টাইম হ্যাজ কাম। আই হ্যাভ টু ইর্যাডিকেট দেম…’
ব্যাপার ভীষণ রকমের সিরিয়াস না হলে পিসা ইংলিশ বলে না।
‘কী করবে?’
হালকা কানকি মেরে বলে, ‘ওয়েট অ্যান্ড সি ডার্লিং।’
পরের সন্ধ্যায় পিসার লোকেরা বিষ মাখানো মাংস ছড়িয়ে দিল বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে। পরদিন দেখা গেল বুলা ছাড়া সব ক-টা মরেছে। সুলতান ভায়েদের নিয়ে এসে সব ক-টাকে নোংরা ফেলার মাঠে মাটি খুঁড়ে, চুন দিয়ে পুঁতে দেয়। কী ভাবছেন ফ্রি-তে? একেবারেই নয়। বহু দর কষাকষির পর ৩.৫ কেজি খাসির মাংস, পাঁচটা বাংলার বোতল, নগদ ১০০১ টাকা।
স্বাভাবিকভাবেই সেবার পিসি রেকর্ড ভোটে জেতেন। বুলা আর বাসস্ট্যান্ডে বসে না। আকাশের দিকে মুখ করে দূরের কালভার্টে বসে থাকে। কেউ কিছু দিলে খায় না। মাঝে মাঝে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদে। তার কান্নায় কখনও-কখনও মেঘ ছিঁড়ে স্বর্গের দরজা খোলে। ভগবান এসে বুলার পিঠে হাত রেখে চোখের জল ফেলেন কিছুক্ষণ।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র