চৌসর
বিশপ
গতি বলতে তুমি যা বোঝো, সে আকাশের পাতে সাদা সরল এক রেখা, যা ধীর এক নিজলয়ে উবে যাচ্ছে। বাতাস তাকে বিব্রত করে উঠতে পারছে না। অথচ, বজ্র তীর্যক নেমে আসে, তারো চেয়ে দ্রুত তঞ্চক, পাশা পালটে ফেলার মুহূর্তে পার্সের কুঠুরিতে নিস্পন্দ কন্যার মুখ, তার অজন্মা কন্যার মুখ— সে ঝলক-খানিক দেখে তবেই ফিরবে।
কেননা, যাওয়া আর ফেরার রাস্তা এক নয়, দুপথের ভুলচুক এক নয়। বোঝা আর না’বোঝার ফাঁকগুলি আত্মীয় না হয়ে উঠলে, কিছু তো বিলম্ব হয়, অনিশ্চয়তা, ফলত ক্ষমা…। কপালে ঘামের বিন্দু, সেও চশমার ফ্রেমের নিকটে এসে দিশা নির্ধারণে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
বিশপ সেই, যে চিহ্নের বশ, পক্ষের দাস। তুমি তাকে করুণায় রেখো।
বিশপ ২
একই পক্ষে, তবু পৃথিবীর নির্জন কেন্দ্রে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পড়লেও তারা একা। তীব্র ছায়া আর আলোর চৌখুপিগুলি তাদের নিবদ্ধ রেখেছে।
ধূসরতা সেই অঞ্চল, যেখানে মানুষের গড়ে ওঠা আর ভেঙে পড়ার ইতিহাস, বর্তমান থাকে। ঐতিহ্য মেনে নেয়া আর অস্বীকারের মহড়াগুলি থাকে। তবু ভবিষ্যৎ, ওহো। চালানি ঝিনুকখোলে সিসের মুক্তো, তার যাত্রা হত্যার দিকে। পিতল-জ্যাকেটে আজ তাকে নিবিড় মর্মভেদী বলে বোধ হবে। অথচ, আদতে মর্ম তার চ্যানেলের বাইরে পাশের মানুষটিকে ছুঁয়ে দেখতে চায়, নির্দ্বিধায় আহত হতে চায়।
যেই কুঠুরির আলো নিভিয়ে এসেছ, সেই ঘরে তুমি আছ। পাশের কামরা, যেখানে শ্যাম্পেন খোলা হল সেখানেও তুমি। তবু খুন হয়ে ওঠার আগে অব্দি কেউ কাউকে নাম ধরে ডাকতে পারবে না।
বিশপকে করুণায় জেনো।
নাইট
চৌহদ্দি আর প্রতিবন্ধকতা ভেঙে ফেলতে গেলে, আগে তাদের ত্রিমাত্রিক ও দৃশ্য করে তোলো। পরিমাপযোগ্য করে তোলো। অশ্ব তাই করে। রুচিকে সে ইস্পাতে ঢালাই করে, ভয়কে দেয় মাটির প্রলেপ, পূর্বপুরুষের যে বোঝা তোমার কন্দরে ভারী বিমূর্ত হয়ে আছে, তাকে দেয় চামড়ার মুখোশ। শুধুমাত্র অশ্বের কারণেই নাইট নিজেকে আজ অতিক্রম করতে পারবে।
নাইট নিজেকে অতিক্রম করে গেছে— বর্মের নীচে তার স্তনগুলি আজ আর বেমানান নয়। বিনিময়ে, অশ্বকেও আজ সে লিঙ্গে নির্ধারিত করে তুলবে না। সাদা আর কালোর মধ্যে নির্বিবাদ ঘোরাফেরা তাদের মানায়। ধূসর মাফলারে রক্তের লাল ছিট যেভাবে মানানসই।
রুক
যে সমস্ত আখর রয়েছে চোখের পেছনে, আর ধূসরকে ভাগ করা সাদা ও অব্যক্ত— নৌকা তারাই। আর নাব্য তাই, যার অন্তরে, অন্তত এক প্রবাহ রয়েছে, ক্রমে বা চকিত সরে আসা তীরভূমি যাকে ব্যাহত করে না। যেমন রক্ত, অনন্ত ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া স্নেহ, ঋণবিমুখ দুধ।
অথচ নৌকা সেই প্রবাহকে চিরকালের মতো বিভক্ত করে যাবে। আহত দু’একটি তরলবিন্দু মনে পোষে বিভাজনস্মৃতি, তারা শুধু তটের সমীপে এসে পাঁকে ও কাদায় দেশ গড়ে, সীমারেখা গড়ে। এই চৌসরে আজ তোমার বিনতি। সাদা-কালো, নির্দ্বিধা, সোজা ও হিংস্র দেশ। যেখানে নৌকা ভাসে সেখানে জলের ভাষা মৃত।
নির্বাহক
প্রতীক চিহ্নক। বাঁধা তাকে পড়তেই হবে, নির্দিষ্ট বস্তুতে, স্থানে, বা কালে— এটুকু ভাবতে পারলে সীমিত হয়ে আসে ক্ষমতা ও রাজা। অথচ নির্বাহক, মানুষের অন্নে উড়ে বসে, বস্ত্র ছিঁড়ে খায়, তিনপুরুষের বাস ধ্বসিয়ে দেয় নির্লিপ্ত প্রস্রাবে৷
রানি বা মন্ত্রী, যে নামেই ডাকো, আদতে সে তুমিই, মুখের যেদিকটায় হেরে যাওয়ার নিশান ঘনিয়ে রয়েছে আয়নার সামনে তাকে কেবল ঠেসে ধরছ আর ধরছ।
রাজা
মানুষ কী চায়? চারটি দেয়াল— প্রথম নুনের; তার অশ্রু-স্বেদ-লহু লবণাক্ত করে। দ্বিতীয় মাটির, যাতে শস্য-শল্ক আঁকা, কবরীকাঞ্চন ফুল, উরুতের ফাঁকে ঘন বনাঞ্চল। তৃতীয় লোহার: প্রাণপণ আঘাত শানাবে, দিনশেষে হতোদ্যম ফিরে আসা ক্ষতচিহ্নে লবণ দাগাতে। চতুর্থ জল, যার অন্য পারে, পরের দেওয়ালগুলি রম্য বোধ হয়।
নৃপতি তো সাধারণ নয়। নৃপতির দেয়াল থাকে না। যতদূর শরীরের ছায়া, রাজত্ব ততই। পেছনে দেয়াল নেই। সূর্যের যাত্রা রয়েছে। সূর্যাস্ত ঘনিয়ে এলে রাজ্য হয় সুদূরপ্রসারী, যত দীর্ঘ সারস উড়েছে।
জলের দেয়াল ফুঁড়ে মানুষ দেখতে পায়, অনন্ত খাদ, রাজার দৃষ্টির অগোচরে, পিঠপিছে, রাজা তার অস্তিত্বের কথাই জানে না, তবু নিজের সমস্ত দিয়ে তারই পাহারায়…।
বোড়ে
গোড়ায় তাকে দু পা, ঠিক দু পা হাঁটার অনুমতি দেয়া হল। সোজা। তার পর এক পা এক পা করে প্রতি চালে। আড়ে সামান্য এক আঘাতের অধিকার, ছায়া আর আলোর গারদে শর্তসাপেক্ষ দুএক লাইন ঘোরা ফেরা।
মাঠ ছেড়ে চলে আসতে চায় সে, এই জেনে যে, যুদ্ধ শুরুর আগে, নাইট বিশপ রুক রানি ও রাজার মতো একই রক্তমাংস আর মৌলের অধিকারী সে, বাস তার একই কুঠুরিতে পাশাপাশি। সে শুধু স্বাতন্ত্র্য চায়। নিজের আকারটুকু মেনে ও মানিয়ে নিয়ে সহাবস্থান।
অথচ অপরপ্রান্তের কাছে, নিষ্ক্রান্তির কাছে পৌঁছে উঠতে পারলে সে সেই বিপর্যয়ে পরিণত হবে যে বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে তার ক্ষুদে বুকখানি চিতিয়ে রেখেছিল সারাটা সময়।
এই বিবর্তন। আর এই নিষ্ফলতা।