ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • স্বাধীনতার সাত-পাঁচ: ৩


    ডাকবাংলা.কম (August 27, 2022)
     

    ২০২২ সালে আমরা ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পা রাখলাম। কিন্তু যে আশার আলোয়, যে প্রতিশ্রুতির ঘনঘটায় ভারত ‘স্বাধীন’ হয়েছিল সে-বছর, তার কতটুকু অবশিষ্ট আছে আজ? এই দেশের মধ্যে যারা বসবাস করছি এই সময়ে, তারা আদৌ স্বাধীন তো? এই প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করেই পেন আমেরিকা জানতে চেয়েছিল, বিভিন্ন লেখকের বক্তব্য। ‘স্বাধীন’ বা ‘স্বাধীনতা’ শব্দগুলো নিয়ে তাঁরা কী ভাবছেন আজকের দিনে, তাঁরা তা জানিয়েছেন। সেই শতাধিক লেখকের শতাধিক ভাবনার কথাগুলোই এবার থেকে বাংলা অনুবাদে প্রকাশ পাবে ডাকবাংলা.কম-এ।

    গীতাঞ্জলি শ্রী (লেখক)

    মুখোশ পরা কেঁচো

    সেই ছোটবেলার কথা। এই কিছুদিন আগেও মনে হত, এই তো সেদিন। কিন্তু, হঠাৎই কী যেন একটা হয়েছে, বুঝতে পারছি, এখন মনে হয়, সত‌্যিই অনেক দিন হয়ে গেল। অনেকটা রাস্তা সত‌্যিই পেরিয়ে এলাম বলে এমনটা মনে হচ্ছে, তা হয়তো নয় । বরং, আমি অনুভব করতে পারছি, সম্ভবত আমার দিন এবার ফুরিয়ে আসছে!

    সেই শৈশবে, দুর্লভ সব শব্দ ভেসে বেড়াত হাওয়ায়। শোঁ-শোঁ শব্দ হত আকাশে, আর আকাশ ছিল বেশ আরও নীল-নীল। আমরা ছুটে যেতাম বাইরে, আর চোখ তুলে চেয়ে দেখতাম উপরের দিকে। আর দেখতাম, একটা যন্ত্র, তার দু’দিকে ইয়াল্লম্বা ডানা, কত্ত উঁচুতে উড়ছে, উড়ে বেড়াচ্ছে বহু-বহু দূরে। যাচ্ছে কোন সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে, কোন অচেনায়, যেখানে যাওয়ার কল্পনা করতে পারি বড়জোর। কিন্তু কোনওদিন সেখানে পৌঁছনো সম্ভব হবে না। ভাবতাম। 

    আর সকলে মিলে ‘হাওয়াই জাহাজ, হাওয়াই জাহাজ’ বলে চেঁচিয়ে উঠতাম। 

    না, কোনও শোঁ-শোঁ আওয়াজ নয়। বরং, এই শব্দ ছিল আমাদের স্বপ্ন, আমাদের আকাঙ্ক্ষার ঘূর্ণি আলোড়ন। 

    আজ আকাশে সেই পুরনো শোঁ-শোঁ আওয়াজ। ঠিক সেই ছোটবেলার বিরল দিন। আকাশও তেমনই ঘন নীল। যদিও আর সেই ছুটে যাওয়ার বয়স নেই। তাড়াও নেই। তবু, পা ঘষে-ঘষে আমি জানলার কাছে যাই। কিংবা যাই ব‌্যালকনির কাছে। লকডাউনের সময়ে যতটুকু আমার কাছে বহির্জগৎ। উপরের দিকে তাকাই, কিন্তু কেমন যেন মনটা ঝিমিয়ে আছে খানিক। আর আমার স্বপ্নগুলোও কিঞ্চিৎ ভেস্তে গিয়েছে। সেই একই যন্ত্র, সেই একই ডানা, সেই ভেসে বেড়ানো হুই উঁচু দিয়ে, বহু-বহু দূরে সেই একই চলে যাওয়া… হতে পারে সেসব জায়গা পেরিয়ে গিয়েছে সে, যে-জায়গাগুলো আমার নাগালের মধ‌্যে ছিল। কিন্তু আজ, চিরকালের মতো, সেসব জায়গা আমার নাগাল দূর স্বপ্ন থেকেও দূরে চলে গিয়েছে। 

    দিগন্ত অনেক দূরের হলে, তাতে একটা জাদু থাকে। সেই জাদু ছিল সেসময়। সম্ভাবনাগুলোই ছিল স্বপ্নের কারখানা। কিন্তু মানুষ বড়ই দ্রুত এবং আত্মবিশ্বাসী এবং তার আছে প্রবল চালিকাশক্তি। সে এগিয়ে গেল। এবং হয়ে উঠল প্রচণ্ড দ্রুত, অত্যধিক আত্মবিশ্বাসী, এবং নির্মমভাবে উচ্চাভিলাষী। সেসবের সমান্তরাল প্রভাব আমাকে আনন্দই দিল বটে। আমি সেই হাওয়াই জাহাজে উঠলাম একদিন, এবং দিগন্ত অতিক্রম করলাম। অজানা দেশে ঘুরে বেড়ালাম। স্বপ্নগুলো ক্রমশ বাস্তবে পরিণত হতে থাকল।

    সব কিছু সম্ভবপর হল ক্রমশ। একের পর এক দরজা খুলতে শুরু করল। আমার হাতের মুঠোয় আসতে শুরু করল একের পর এক। আমার শৈশবের যে-গাছগুলো আমার বাড়িকে ছায়া দিত, সেগুলোই এখন ছায়া পায় আমার বহুতল বাড়ির।

    মানুষ এখন সকলের মনিব, কিন্তু তার কেউ বন্ধু নেই। সে কারও বন্ধু নয়।

    সে এখন বাজারে অন‌্যকে চমকায়। গ্লোবাল কম্পিটিশনে তার তাবত পৌঁছ। বাধা অতিক্রমে তার জুড়ি মেলা ভার। দেশে, গ্রামাঞ্চলে, দেশান্তরে, দেশের কেন্দ্রে, প্রান্তে, আকাশ, জলে তার দৌড় সর্বত্রব‌্যাপী। মহাকাশেও সে একদিন পাড়ি জমাবে অনুরূপভাবে।

    আমরা সব কিছুকেই ওলোটপালট করে ছেড়েছি। আর তা নিয়ে আমাদের ভাললাগার অন্ত নেই। আমিও তাই করেছি। কারণ আমি এই চাকচিক্যময়, অতিরঞ্জিত, অতি-সক্রিয় বিশ্বের সমান সুবিধেভোগী। আমাদের গতি দিন-কে-দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু সব কিছুকে ওলোটপালট করা মানে বিশৃঙ্খলাও।

    সব কিছুই তো বেশ জীবন্ত ছিল। কোনও জড় পৃথিবীকে তো আমরা প্রাণ দিইনি অতিরিক্ত। আমরা এই জ‌্যান্ত পৃথিবীটাকেই ওলোটপালট করলাম। ব‌্যতিব‌্যস্ত করলাম এই পৃথিবীর বাতাস, জল, মাটি, পর্বত, কীট, কেন্নোদের।

    সতর্কতা কি আসেনি? সবই কেমন কাঁপছে আর আমরাও দুলছি এই আন্দোলিত জগতে। এর গতি আরও বাড়বে। আর, কে না জানে, গতি ভাল, কিন্তু তা মৃত‌্যুকে ডেকে আনে। কিন্তু আমরা তো আমাদের অমরত্বে বিশ্বাস রেখেছিলাম।

    আর সেই বিশ্বাসে আঘাত হানল। একটা নিতান্ত ভাইরাস।

    বন্যায় একটি বিছে এক সাঁতারুর কাঁধে উঠেছিল এবং নিরাপদে পাড়ি জমিয়েছিল তীরের দিকে। মাঝপথে সে কামড় বসাল সেই তারই পিঠে, যে কিনা বাঁচাচ্ছিল সেই বিছেকে। তবু, এই বিছে নির্দোষ। কারণ, দংশন করাই তার ধর্ম।

    ভাইরাসও তাই। সে নিছক সীমানা পেরিয়ে, শরীরকে সংক্রমিত করার ধর্মে মেতে ছিল।

    সে তো নির্দোষ।

    কিন্তু মানুষ? তার ধর্ম?

    এবং আমিই বা বাদ যাই কেন? আমিও তো এই মানবজাতির ওতপ্রোত অংশ! গতির প্রতি এরকম নেশা লেগে যাওয়ার পর, সেই নেশা কাটাতে গেলে কী করা দরকার এখন, কতটা করা দরকার? এত এত উড়ানের পর, বায়ুমণ্ডলকে চিরে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়ার পর, কীভাবে ও কতটা আমাদের সেই ডানাকে ভাঁজ করে রাখা প্রয়োজন?

    আমাদের ইশারায় পৃথিবীকে চলতে হবে। সেখানে ভাইরাস করবে আমাদের ওপর খোদকারি! কিন্তু, তার জন‌্য আমরা আমাদের দৌরাত্ম‌্য কমানোর কথা ভাবলাম না, অন‌্যদের থমকানোর কথা ভাবলাম।

    তাহলে আমরা কি এলিয়েন এবং রোবট? আমরা তো ভেবেছিলাম রোবট তৈরি করব, নিয়ন্ত্রণ করব। আমরা তো ভেবেছিলাম এলিয়েন খুঁজে বের করব। আরে আপনি, হ‌্যাঁ হ‌্যাঁ আপনি, মাস্ক পরে আছেন, হ‌্যাঁ আপনি, তার ওপর থ্রি-পিস প্রোটেক্টিভ স্যুট, আপনি মানুষ তো? আমিও মানুষ তো? হাসি নেই আমাদের। জড়িয়ে ধরা নেই, চুম্বন নেই। স্পর্শহীন, ভালবাসাহীন আমরা এক অদ্ভুত প্রজাতি, কী মজা না?

    মানুষের থেকে সরে যান, কারণ এলিয়েন এবং রোবটরা আমাদের উপর আছে। আর, আমরাই কি সেই এলিয়েন, রোবট নই?

    আমি নিশ্চিত ছিলাম, আপনি না পারলেও আমি ঠিক পালাব! দেখছেন, ওই কেঁচোটা। কাদা থেকে মাথা তুলে চারিদিকে বিপর্যয়ের দিকে সে তাকিয়েছিল। সে দেখল আরেকটা কেঁচোও সেই একই কাজ করছে। অন‌্যজনকে সে বলল— তুমি এখানেই আটকে থাকো, আমি সুখের চারণভূমিতে চললুম!

    তখন দ্বিতীয় কেঁচো উত্তর দিল— ওরে বোকা, আমি তোর অন‌্য প্রান্ত রে, তুই আমার সঙ্গে জুড়ে আছিস! আমি যেখানে থাকব, সেখানে তুইও থাকবি! যেখানে তুই যাবি, আমিও সেখানেই যাব। কিন্তু যাওয়া যাবেই বা কোথায়?

    তারপর, যেন বিশাল কোনও সমস‌্যার সমাধান করে ফেলেছে, এমন একটা ভাব করে সে বলল, এই নাও, মাস্কটা পরো!

    মোদ্দা কথা, যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। এবং কোত্থাও প্লেন উড়ছে না। আর, যখন উড়ছে, তখন নিরাপদ নয়। এদিকে, আমরা একগুচ্ছ কেঁচো, কিছু মাথা, কিছু লেজসর্বস্ব হয়ে জগাখিচুড়ি করে ফেলেছি সব, মরে গিয়েছে একগুচ্ছ। আর অতি বাড় বেড়়েছি বিপুল। এই মাস্কে মুখ লুকিয়ে আমাদের দৌরাত্ম‌্য আরও বেড়েছে।

    এসব তো এই সেদিন কথা। হ‌্যাঁ, প্লেন আবার উড়ছে এবং আমরা আগের মতোই আহ্লাদে আটখানা হয়ে দিব‌্য উড়ে বেড়াচ্ছি ধেইধেই করে। ভুলে গিয়েছি একটু ধীর হওয়ার কথা, কোনও শিক্ষা হয়নি আমাদের। আমরা পৃথিবীর উন্নতি ঘটাতে তৎপর। আমাদের বিশ্বাসের পারদ চড়চড় করছে আত্মবিশ্বাসের জ্বরে।

    অন্তত গান্ধীজি এতটা পাগল ছিলেন না!

    তবিশ খ্যার (লেখক)

    গেরুয়া ও সবুজের মাঝে 
    ক্রমশ গুটিয়ে আসা ফালি
    এখনও লেখার জন্য জায়গা ছেড়ে রাখে
    সাদা বলতে এককালে কী বোঝাত
    মানে খুব জোরে তিনটে গুলির আওয়াজ হওয়ার আগে অবধি
    কিন্তু তারপর, 
    সেই চিলতে সাদা আজ হয়ে উঠেছে জাতির কাফন।

    সুমনা রায় (লেখক, অধ্যাপক)

    আক্কেল দাঁত

    বাংলার মাটিতে অনুপ্রবেশকারীরা হল উইপোকা… ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার এক-এক করে এই অনুপ্রবেশকারীদের বেছে বের করবে, আর সব ক’টাকে ছুড়ে ফেলবে বঙ্গোপসাগরের জলে। — অমিত শাহ, এপ্রিল ২০১৯

    আমি যেই মুখ খুলি
    আমার ভাইয়ের নাম ধরে সে ডাকে
    আর আমার মুখ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
    সে জিজ্ঞেস করে, ‘কে বড়?’
    আমি আমার দীর্ঘ দীর্ঘতর বেঁচে থাকার কথা প্রায় ভুলে গিয়ে, অনিশ্চিত
    বুঝভম্বুলের মতো আমতা-আমতা করে বলি, ‘আ-আ-আমি।’

    ‘একদম হুবহু এক’ সে বলে ওঠে।
    ‘আপনাদের মুখের ভিতরে, মানে নীচের পাটিতে দাঁতগুলো যেভাবে বসানো, আপনার আর আপনার ভাইয়ের একদম এক।’
    কেন? নাক, চোখ, কপাল— এত কিছু মিল রয়েছে যে— সেসব উবে গেল? 
    হ্যাঁ, উবেই গেল।
    কেবল দাঁত? 
    আমি থুতু গিলে নিই।

    আমার সামনে ঝুলছে 
    ভারতের মানচিত্র,
    একদম হাঁ মুখ খোলা—
    গোয়া, কেরল, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, 
    বঙ্গ— তার নীচের পাটি। 
    পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ, তার আক্কেল দাঁত। তিন নম্বর আক্কেল দাঁত।

    ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখানে’, ব্যথায় কঁকিয়ে আমি বলে উঠলাম
    ‘এখানে… 
    হ্যাঁ এখানেই ব্যথা হচ্ছে…’

    মাননীয় ডেন্টিস্ট এরপর খসখস করে প্রেসক্রিপশনে লিখতে থাকেন। 
    ‘ওটাকে তুলে দেব আমি… 
    ওটা আক্কেল দাঁত, থার্ড মোলার।’ 
    আমার ভাই, আমার সমস্ত আত্মীয় পরিজনের জন্য আমার চিন্তা হয়, যাদের আমার
    মতোই দাঁত, মুখের ভিতরকার গড়ন। 
    আমরা অপেক্ষা করছি,
    বাংলা থেকে কবে আমাদের উপড়ে ফেলা হবে।

    সুনীল অমৃত (লেখক, অধ্যাপক)

    আমার সেই সহকর্মীদের, যাদের হেনস্তা করা হল, তাড়া করে বেড়ানো হল, গ্রেফতার করা হল—

    ভয়ংকর সেই নৃশংসতার বিপরীতে তোমরা ধরে রাখতে পেরেছ তোমাদের রসিক মন আর চরিত্রের মাধুর্য। ইতিহাসকে মুছে দেওয়ার, ইতিহাসকে বিকৃত করার সেই যন্ত্রের মোকাবিলা করেছ তোমরা তোমাদের বেপরোয়া স্মৃতিকে হাতিয়ার করে। তোমাদের প্রামাণিক সাক্ষ‌্যগুলি কথা বলেছে সেই জীবনগুলির হয়ে, যাদের বেঁচে থাকা আজ তছনছ, কথা বলেছে সেই সম্প্রদায়গুলির হয়ে যাদের ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র। বালির খাদান হিসেবে ব‌্যবহার করা হয়েছে যেসব নদী, বাঁধের জন‌্য উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে যেসব অরণ‌্য, মনুষ‌্য-অত‌্যাচারে যে প্রজাতির প্রাণীগুলি আজ বিলুপ্তির পথে— সেই সমস্তদের হয়ে সকল পীড়়িতর কাছে তোমরা আশ্রয় হয়ে, আশার আলো হয়ে দাঁড়িয়েছ। তোমাদের কাজে, তোমাদের কথায় অন‌্য এক ভারত বেঁচে আছে এখনও। সেই ভারত আরও পরিপূর্ণ, আরও জীবিত, আরও দিলখোলা এই দুনিয়ার প্রতি।

    তনুজা দেশাই হিদিয়ার (লেখক, গায়ক-গীতিকার)

    সুজি, চিনি, বাদাম, ঘি

    সেই বছর পঁচাত্তর আগের কথা। আমার মা, ছোট্ট সে তখন, থাকে ভারতের কোলাপুর শহরে। শৈশবের রোদ তখন তার গালে খড়ি কাটছে, তার জিভের ডগায় সেই সময়ের স্বাদ সে এখনও টের পায়। মা বলে—

    ১৫ অগাস্ট তো? ভারতে স্বাধীনতা… বড়রা তো তাই বলেছিল।

    বন্দে মাতরম্ দিয়ে স্কুলে প্রার্থনাপর্ব শেষ হল। 

    খদ্দরের শাড়ি, ব্লাউজ পরে আমার ছোট্ট মা। মাতৃভূমিকে সে দেবীরূপে ভাবছে তখন।

    গায়ে গয়না। ঝলমল করছে দেশমাতৃকা। গায়ে তার সোনালি শাড়ি।

    টানা-টানা চোখে প্রজ্ঞার ঝিলিক। আর ওই মুখশ্রীতে মিষ্টি হাসি, যা তার শ্রেষ্ঠ অলংকার। 

    আর তাতে আগামীর আশ্বাস।

    তারপর মাস্টারমশাইরা যেন জাদু-ডিব্বা থেকে বের করে আনতে লাগলেন একের পর এক লাড্ডু আর বিলোতে শুরু করলেন সবাইকে।

    সেই ঘাম-নুন গা, আর ঠোঁটে মিষ্টি স্বাদ। মা একেবারে দেখতে পাচ্ছে, সবার হাতে একটা করে লাড্ডু। খ্রিস্টান ছেলেমেয়েগুলোও মহানন্দে সেই লাড্ডু খাচ্ছে। পাশের পোলিশ উদ্বাস্তু কলোনির ছেলেমেয়েরাও ভিড়ে গেছে, তাদের ঝলমলে মুখ, আর ওই ভিনদেশি গলায় মিঠে মারাঠি ভাষা। লাড্ডুর সুজি তাদের ফেলে আসা মাতৃভূমির খাবারের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। 

    এটাই ছিল মায়ের চোখে স্বাধীনতার ছবি। কোনও পতাকা উত্তোলন, বা কুচকাওয়াজ, বা খবরের কাগজের হেডলাইন নয়।

    সুজি। চিনি। বাদাম। ঘি।

    সবার হাতে ঐশ্বর্য।

    অনাগত মিঠে দিনের প্রতিশ্রুতি।

    কিন্তু, কয়েকমাসের মধ্যেই সেই মিঠে স্বাদ ক্রমশ বদলে যেতে থাকল। আধপোড়া। কটূ। ঝাঁঝালো। জ্বলে উঠল ঘরবাড়ি। লক্ষ্মীপুরী, কোলাপুর জুড়ে আগুন হিংসা ছড়াতে লাগল দাবানলের মতো।

    শুরু হল আমরা-ওরা’র খেলা।

    একদিন আমার ছোট্ট মা আর তার প্রিয় বান্ধবী মমতাজ বাড়ির চৌহদ্দিতে লুকোচুরি খেলছে। হঠাৎই মমতাজকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল তার দাদা। কত করে অনুরোধ করল তারা, বায়না করল, কান্নাকাটি, তবুও শুনল না।

    হিন্দুরাও তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মুসলিমদের মেলামেশা রুখতে নিষেধাজ্ঞা জারি করল।

    দুটো ছোট্ট মেয়ে। তাদের দেখা করা নিষেধ।

    শুধু লুকোও, খুঁজে বার কোরো না। 

    শৈশবের খেলায় লেপে দেওয়া হল কালি। স্পষ্ট দাগিয়ে দেওয়া হল, কে কোন দিকে। 

    কেন আমাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হল সেই দিনগুলো? আমাকে আর মমতাজকে তো দেওয়া হয়েছিল সেই লাড্ডু-মিঠে প্রতিশ্রুতি। দেশ সবার মা, সবার প্রতি সে যত্নবতী, সবার জন‌্য সমান স্বাধীনতা, কেউ বাদ পড়বে না— এসবই তো বলা হয়েছিল। কী হল তবে?

    আর, ছোটবেলার সেই দেবী, সেই রত্নখচিত মাতৃমূর্তির এখন আলুথালু চুল। সোনালি শাড়ি ছিঁড়ে ছত্রখান, গায়ে ক্ষত, চোখের কোণে কালি, চোখ লাল। 

    কোথায় সেই চাকচিক্য, সেই ঝিলমিলে ঠোঁটের কোণের হাসি? শুকিয়ে গিয়েছে সব।

    কোথায় গেল সেই চা, নাসপাতি, জুঁইফলের সুবাস? নাহ! কেবল ঘাম-রক্ত-বারুদের কটূ গন্ধ। পূতিবাষ্প।

    সেই দেশমাতৃকাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। সবাইকে শ্বাস নিতে দিতে হবে। যাতে সবাই নিরাপদে, আরও মর্যাদা নিয়ে, শান্ত সহাবস্থান করতে পারে। 

    সব নদী সমুদ্রে মিশে যাক।

    রাস্তায় খেলার সময় বাচ্চাদের যে সারল্য, তা-ই চাই। খোঁজো।

    কথা বলো। 

    শৈশবের একটা স্মৃতি কি বোঝাতে পারে না, কেমন হতে পারে স্বাধীনতা…

    হে দেশ, আমার সোনা দেশ, আমার দেশের মানুষেরা, এই ৭৫ বছরের পূর্তিতে:

    চলো আমরা ফিরে যাই সেই জাদু-ডিব্বার কাছে। 

    কোনও বুলেট নয়, বারুদ নয়।

    সুজি! চিনি! বাদাম! আর ঘি!

    মিষ্টি দিন আসুক।

    সৌজন্যে : https://pen.org/india-at-75/

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook