ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • নবপত্রিকা কেন গৌণ!


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (October 19, 2023)
     

    সার্বিক এবং সম— এইসব শব্দ যতই যা ভাবি না কেন, মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা সেই স্কেলটায় সমানেই চলতে থাকে মাপামাপি। মুখ্য আর গৌণের বাছবিচার। এমনকী তা ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে, মা দুর্গার মূর্তির সামনে দাঁড়িয়েও। পুজোটাও যেহেতু মা দুর্গার নামে তাই হঠাৎ করে খটকা লাগে না। কিন্তু ভাবনার জটিল মাকড়সা-জালে আটকে পড়া পোকার মতো ছটফট করতে করতেও মনে হয় এমনটা কেন! এক চালচিত্রে কেন সবাই সসম্মানে সমান মাপের নয়! চোখ সরু করে দেখি আর ভাবি। শুধুমাত্র বিন্যাস সুন্দর করা, না কি শাস্ত্রকারদের অন্য কোনও বিচার আছে এর পিছনে! না জানি শাস্ত্র, না পারি মূর্তি গড়তে। ফলে মাথা খাটিয়ে এটা সেটা ভাবা ছাড়া আর উপায় কী! কে-ই বা বসে আছে এসবের উত্তর দেওয়ার জন্য উন্মুখ!

    মা দুগ্গার সমারোহে কতজন, কতরকম ভাবে উপেক্ষিত বা গৌণ থেকে যান বা যায়, সে লিস্টি তৈরি করতে গেলে চিত্রগুপ্তের স্ক্রোলের চেয়ে কম কিছু হবে না।

    তবে সাধারণের চোখে সব চেয়ে উপেক্ষিত বোধহয় কলাবউ। এমনকী এও এক সংশয় যে এই কলাবউটি কি আসলে গণেশের বউ! অথচ ইনিই কিন্তু আসল দুর্গা। অপৌত্তলিক ও শাকম্ভরী। দেবীর ন’রকমের রূপকে একসঙ্গে মিলিয়ে কলাবউ বা নবপত্রিকা তৈরি করা হয়।

    তবে সাধারণের চোখে সব চেয়ে উপেক্ষিত বোধহয় কলাবউ। এমনকি এও এক সংশয় যে এই কলাবউটি কি আসলে গণেশের বউ! অথচ ইনিই কিন্তু আসল দুর্গা। অপৌত্তলিক ও শাকম্ভরী। দেবীর ন’রকমের রূপকে একসঙ্গে মিলিয়ে কলাবউ বা নবপত্রিকা তৈরি করা হয়। মনে করা হয়  তা যেন দেবীরূপে, ঈশ্বরের শক্তিরই বিভিন্ন প্রকাশ। কলাবউ নির্মাণ ও তাঁর পুজোর নিয়ম পড়ে ভারি ভালো লেগেছিল। প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে সঙ্গীত ও শক্তির এক অপূর্ব উৎসব। এই প্রতীকী উৎসবে জড়িয়ে আছে আমাদের কৃষিভিত্তিক জীবন-যাপন এবং তার পরিচর্যা। মঙ্গলদায়িনী আটটি গাছকে সাদা অপরাজিতার মূল এবং হলুদ সুতো দিয়ে , একটি কলাগাছে একসঙ্গে বেঁধে দেবীর দেহ কল্পনা করা হয়। স্তন কল্পনায় ওপর দিকে বাঁধা হয় দু’টি কাঁচা বেল। ওই কাল্পনিক দেহ ঘিরে পরিয়ে দেওয়া হয় একখানি আটপৌরে নতুন শাড়ি ; লালপেড়ে  সাদা। সেই সঙ্গে এয়োতীর চিহ্নে শাখা-পলা-সিঁদুরও। গনেশের পাশে রাখা আল্পনা আঁকা একটি পিঁড়ির ওপর এঁকে যখন স্থাপন করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় , দেখে মনে হয় ঠিক যেন ঘোমটা-টানা বউটিই । কলা গাছের কাণ্ডে অন্য গাছগুলিকে বাঁধা হয় বলে এবং কলাপাতাটা প্রায় সকলেরই চেনা– তাই হয়তো এর পরিচিতি কলাবউ বলে। এটি আসলে নবপত্রিকা। এখানে নব শব্দের অর্থ নয় সংখ্যাটি; আর পত্রিকা হল পাতা।

    এই নয়টি বিভিন্ন গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম গুলি হল-

    দেবী ব্রহ্মাণী- কলা গাছ, দেবী কালিকা- কচু গাছ, দেবী উমা- হলুদ গাছ, দেবী কার্তিকী- জয়ন্তী গাছ , দেবী শিবা- বেল গাছ, দেবী রক্তদন্তিকা- ডালিম গাছ, দেবী শোকরহিতা- অশোক গাছ , দেবী চামুণ্ডা- মান গাছ , দেবী লক্ষ্মী- ধান গাছ। এই প্রতিটি গাছই হয় ভোজ্য না হলে ভেষজ; এবং বাড়ি ঘরের আশেপাশে লাগালে সহজেই বেড়ে ওঠে। সুষম গৃহস্থীর চিহ্ন। অনেকের ব্যাখ্যায় এঁদের মধ্যেই আছেন দুর্গার অষ্ট নায়িকারাও। তাঁর সহযোদ্ধা হিসেবে এঁরাই তাঁকে সুরক্ষা দেন; যেমন  ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, বৈষ্ণবী, বরাহী, নারসিংহী, কৌমারী, ঐন্দ্রী ও চামুন্ডা ।

    ষষ্টীর রাতে হয় নবপত্রিকার অধিবাস। পরদিন ভোরবেলা থেকে শুধু কি স্নান! দেবীর দাঁত মাজানো , খুস্কি তাড়ানো এবং মাথা ঘষা শেষে, গায়ে লাগানোর তেল-হলুদের কথাও বলা রয়েছে। আট আঙুল পরিমাণ সরু বেলকাঠ দিয়ে দেবী দাঁত পরিষ্কার করেন।  কুলকুচি করার জন্য গরম জল নিবেদন করতে হয়। স্নানের আগে গায়ে মাখার জন্য তেল ও কাঁচা হলুদ রাখতে হয়। সপ্তমীর ভোরে সূর্যোদয় হলেই শুরু হয় নবপত্রিকার স্নান ও মহাস্নান। এদিন অষ্ট-কলসের জলে স্নান করানো হয় দেবী দুর্গার প্রতীক— নয়টি শক্তির সমাহার এই নবপত্রিকাকে। অষ্ট-কলসে থাকে অষ্ট-মঙ্গলের মাহাত্ম্যও। মহাসপ্তমীর দিন ভোরবেলা পুরোহিত নিজেই কাঁধে করে নিয়ে  যান এই নবপত্রিকাকে কোনও নদী বা জলাশয়ে স্নান করাতে। স্নানের বিধিও আসলে প্রকৃতিকেই আর একভাবে আরাধনা করা।

    এই স্নান পর্বে যা যা লাগে সেই উপকরণগুলিকে ভাগ করা হয়েছে এভাবে –

    মৃত্তিকা : গঙ্গামাটি, গজদন্ত-বরাহদন্ত-বৃষশৃঙ্গে ওপড়ানো মাটি , খড়্গ-কোপ মাটি, বল্মীকের মাটি (উই ঢিপি) , নদের মাটি , নদীর উভয় কূলের মাটি, পর্বত, চুনা-পর্বত ও গিরির মাটি , রাজদ্বার, বেশ্যাদ্বার ও চতুষ্পথের (চার মাথার মোড়) মাটি।

    শুদ্ধ উদক: বৃষ্টির জল, তীর্থের জল, নদী, ঝর্না, সরোবর, সাগর, পুকুর , হ্রদ, মোহনা ও ত্রিধারার জল; অষ্ট কলসে আলাদা আলাদা করে ধরা বিভিন্ন নদীর জল, উষ্ণ প্রস্রবণের জল ছাড়াও লাগবে ডাবের জল, পদ্ম-রেণু জল ও শিশির; লাগবে পঞ্চরত্ন (সোনা, রুপো, প্রবাল, মণি, মুক্তো) ধোয়া জল , পঞ্চশস্য চূর্ণ জল (ধান, যব, তিল, মুগ, মাসকলাই), পঞ্চকষায় জল (জাম, কুল, বকুল, বেড়েলা, শিমুল-ছালের রস); এছাড়াও কুশোদক, পুষ্পোদক, শঙ্খোদক (শামুকের গা ধোয়া পরিস্রুত জল) এবং আখের রস। 

    • যে নদীগুলির জল নিতে হবে তাঁরা হলেন – গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, আত্রেয়ী, ভারতী, সরযূ, গণ্ডকী, শ্বেতগঙ্গা, কৌশিকা, ভোগবতী ও মন্দাকিনী। এতরকম জল না পাওয়া গেলে, যতটুকু যা যোগাড় হয়েছে সেই জল শঙ্খের মধ্যে দিয়ে ঢেলে শুদ্ধ করে নেওয়া যায়।

    সুগন্ধি তৈল: তিল তেল, বিষ্ণু তেল, নারকেল তেল, পঞ্চকষায়-তেল , পঞ্চশস্য চূর্ণ তেল এবং ফুল নিসৃত তেল।

    ওষধি চূর্ণ : হলুদ, নিম-কাঠি, হরিতকী , কেশর, আমলকী, চন্দন কাঠ এবং পদ্ম-রেণু-চূর্ণ; এছাড়াও লাগবে পঞ্চগব্য-চূর্ণ , পঞ্চকষা-চূর্ণ , পঞ্চশস্য-চূর্ণ, পঞ্চরত্ন-চূর্ণ, সর্বৌষধি-চূর্ণ , মহৌষধি-চূর্ণ ।

    অন্যান্য উপকরণ : দুধ ,দই , ঘি, মধু, কর্পূর, অগরু, চন্দন, কুমকুম, পদ্ম এবং সহস্রধারা।

    রাগ, রাগিণী ও বাদ্য : মনে করা হয় যে স্বরবর্ণ হল শক্তি আর সুস্বরবর্ণ হল রাগের মধ্যে দেবত্ব বা চেতনার প্রকাশিত রূপ। এই স্নানে তাই আর এক বিধান হল , যখন ওই আটটি  কলসে করে দেবীকে স্নান করানো হবে, তার প্রতিটি কলসের জল দেবীর গায়ে ঢালার সময় আলাদা আলাদা বাজনা বাজানোর রীতি রয়েছে। এই কারণেই দুর্গাপুজোয় আটটি রাগের ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যায়। মহাস্নানে নির্দিষ্ট  এক এক নদী জলের জন্য নির্দিষ্ট সেই রাগবাদ্যের ক্রম তালিকা— মালব রাগে বিজয়বাদ্য, ললিত রাগে দেববাদ্য, বিভাস রাগে দুন্দুভিবাদ্য, ভৈরব রাগে ভীমবাদ্য, কেদার রাগে ইন্দ্রাভিষেক বাদ্য, বঢ়াড়ি রাগে শঙ্খবাদ্য, বসন্ত রাগে পঞ্চশব্দ বাদ্য এবং শেষে ধানেশ্রী রাগে ভৈরববাদ্য। 

    দর্পণ: নবপত্রিকা মণ্ডপে প্রবেশের পর দর্পণেও মহাস্নান করানো হয় দেবীকে। এরপর বাকি দিনগুলিতে মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তির সঙ্গেই পূজিত হতে থাকেন নবপত্রিকাও । 

    নবপত্রিকার পুজো একাধারে যেমন কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষের বৃক্ষপূজা, অন্যদিকে রোগব্যাধি বিনাশকারী বনৌষধির পূজাও। আর এই বিবিধ উপকরণ সংগ্রহের মধ্যে দিয়েই যোগাযোগ ঘটে এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের; পরিচিতি ঘটে বিচিত্র সম্ভারের সঙ্গেও; বিণিময় চলে প্রাকৃতিক জ্ঞান ও সঙ্গীত-বাদ্যের । এই পুজোর প্রস্তুতিও চলে সারা বছর ধরে। ভারতবর্ষের মূল ধর্ম ওই চরৈবেতির মধ্যে দিয়েই যেন ঘুরে ঘুরে এবং খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করে চলা ওই অসংখ্য উপাদান।

    কিন্তু যবে থেকে এই শাকম্ভরী দুর্গাকে একপাশে স্থাপন করে, মায়ের মৃন্ময়ী রূপের জৌলুশ বেড়েছে, তবে থেকে দুর্গাপুজোর ধরণটাও বদলাতে শুরু করেছে। যা ছিল প্রাকৃতিক উৎপাদন ও সংগ্রহের বস্তু তাই হয়ে দাঁড়াল কিনে আনা উপাচার। পুজোটাও হয়ে যেতে লাগল বাজারমুখি এক উৎসব। পুজো ও পুরষ্কারের সমীকরণে আরাধনা ব্যাপারটাই কি গৌণ হয়ে পড়ছে না? ঘরে বাইরে যে হিংসার প্রকাশ এবং মানুষে মানুষে বা দেশে দেশে যে ভয়ানক যুদ্ধ চলছে , সেখানে  কেইই বা দুর্গা আর কেইই বা মহিষাসুর! প্রকৃতিকে ধবংস করে, পরিশুদ্ধতা এবং অনাড়ম্বরের বিপ্রতীপে গিয়ে উৎসব করছি আমরা। আটপৌরে জীবন-যাপনকে বাতিল করে সমগ্র পুজোটাকেই  কি গৌণ করে তুলছি না সদলবলে ! আরও এক ব্যাপার এই যে অজ্ঞানতার কারণে সচেতনভাবে যাকে অবজ্ঞা করছি, সেগুলিই কিন্তু দ্বিগুণ দামে কিনে আনছি আন্তর্জাতিক বাজারের সুপারিশে ‘এথনিক’ এবং ‘অরগানিক’ বলে। কংক্রিট-বসত বানাতে নির্বিচারে যখন উপড়ে ফেলছি লতা-পাতা-মূল-গুল্ম তখন আসলে কেটে ফেলে দিচ্ছি ওই ওষধি গুলিই। ঝোপে ঝাড়ে মাথা তুলে ফুটে থাকা হলুদ ফুলগুলিকে দেখে তখন আর চিনতেই পারছি না, নবপত্রিকার ওই ‘জয়ন্তী’ বলে। বাজারে না এলে আমরা চিনতে পারি না, কোনটা কি শাক। ওষুধ কিনতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছি ওষধির গুণাগুণ। ভুলে যাচ্ছি সংরক্ষণ, শুশ্রূষা এবং জীবন যাপনকে সময়োপযোগী করে বাঁচা। নিভৃতিকে ভয় পাচ্ছি নিঃসঙ্গতা ভেবে; আর উৎসবকে ভাবছি উল্লাস। রাগ-বাদ্য-তালের যে বিভিন্নতা সে সম্পর্কেও আমরা উদাসীন। লক্ষ্য করলে এও দেখা যাবে যে নবপত্রিকা স্নানের মধ্যে দিয়ে শুধু যে সৌন্দর্য বিধান করা হয় তা নয়; দূর করা হয় মায়ের ক্লান্তি এবং অবসাদ। অর্থাৎ দেহ ও মনকে একযোগে জাগিয়ে তোলার এক নিষ্ঠ প্রক্রিয়া। মা এখানে প্রকৃতির প্রতীক মাত্র। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, অবহেলিত প্রকৃতিকে শুশ্রূষা দিয়ে লাবণ্যম্যী করে না তুললে মানুষও কি বাঁচবে! হাতি থেকে শামুক, সাগরজল থেকে শিশির ফোঁটা , রাজদ্বার  থেকে পতিতার ভিটে – এ সব কিছুই সমানভাবে প্রয়োজনীয় ; জন-জীবনের সহায় ও সম্পদ । বহু বিচারে সম্পদকে এমন নির্বিচারে গ্রহণের সংস্কৃতি আর কোনও দেশে আছে কিনা জানা নেই। কিন্তু এ জেনেই বিস্মিত হই যে ভারতবর্ষে তা আছে , সমদর্শিতার নিরিখে।         

    মনে পড়ে বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের পর ঠাকুমা চোখ মুছতেন , তাঁর সাদা থানের খুঁটে; আর বলতেন, ‘পু’- মানে পুষ্প আর জল ও জপ বোঝাতেই—’জ’ । আজ লিখতে বসে মনে হচ্ছে নবপত্রিকার স্নানে ওই অত রকমের জলের সঙ্গে মিশে আছে আবেগ মথিত চোখের সেই সাবেক জলটুকুও । মনে হচ্ছে জপ বা মন্ত্রও বোধহয় আসলে প্রার্থনা; আর ফুল হল আমাদের শুদ্ধ মন। 

    এমনটার অভাবে আজকের এই মহার্ঘ সব প্যান্ডেল ও থিমের দাপটে পুরো পুজোটাই কি গৌণ এক আয়োজন মাত্র নয়! 

    ছবি এঁকেছেন দেবাশীষ দেব

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook