এক বেপরোয়া কবি
এই ৭ সেপ্টেম্বর ছিল সুনীলদা’র জন্মদিন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলা কবিতা ও গদ্যের সাম্রাজ্য যাঁর হাতে এক অন্য চেহারা ধারণ করেছিল। আমার নেহাত সৌভাগ্য যে দু’কলম লেখালেখির সুবাদে তাঁর সান্নিধ্য ও ঘনিষ্ঠতার আঁচ পেয়েছিলাম। আর পেয়েছিলাম নানা অভিজ্ঞতা, যা আমৃত্যু মনে না-রেখে আমার কোনও উপায় নেই।
এবারের এই মাঝ-সেপ্টেম্বরেও যখন নাছোড়বান্দা বর্ষা কিছুতেই কলকাতা ছেড়ে যেতে চাইছে না, তখন মনে পড়ে গেল এমনই এক বর্ষার দুপুরের কথা, যেদিন, সম্ভবত প্রথম ও শেষবারের জন্য সুনীলদাকে বিষণ্ণ হতে দেখেছিলাম। এমনিতে বাইরে থেকে দেখে তাঁর মনের অবস্থা বোঝার উপায় কারও ছিল না। ভিতরে যতই তোলপাড় চলতে থাকুক না কেন, বহিরঙ্গে তিনি সদা কর্মব্যস্ত, উদারহস্ত, হাস্যমুখ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়েই থাকতেন। কাজটা নেহাতই কঠিন হলেও, সুনীলদা সারাজীবন তাকে সুসম্পন্ন করেই এসেছেন। কেবল ওই এক ঘন বর্ষার দুপুরে হয়তো কিছুক্ষণের জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে থাকার শিরস্ত্রাণটুকু নামিয়ে রেখেছিলেন কোনও কারণে, আর তখনই আমি দেখেছিলাম তাঁর আশ্চর্য বিষণ্ণ মুখ। সে-কাহিনি বলি তবে।
তখন আমি এক সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করি, যার সম্পাদক রিনাদি, বা অপর্ণা সেন। আমাকে কবিতার পাতা করবার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি, ভারী স্বাধীন ভাবেই। স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, ‘এই একটি বিভাগ কিন্তু আমি একেবারেই দেখব না, তুই যেমন ভাল বুঝবি, নিজের মতো সাজাবি’। আমি সাধ্যমতো সেই স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করে গেছি, যতদিন পত্রিকাটি চালু ছিল। সাধারণ সংখ্যায় দু’পাতা মতো ধার্য ছিল কবিতার জন্য, পুজোসংখ্যায় সেটা বেড়ে আট কী দশ হতো, স্বাভাবিক ভাবেই। আর পুজোসংখ্যা মানেই একইসঙ্গে আমার সংশয় ও রোমাঞ্চ। যাঁদের কবিতা পড়ে বড় হয়েছি, আমার সম্পাদনার পাতায় তাঁরা কি লেখা দেবেন? এই নিয়ে সংশয় থাকতই। আর থাকত রোমাঞ্চ, যদি লেখা দেন তাঁরা, তবে তা প্রথমবার পড়বার। এ-জিনিস তো কারও সঙ্গে ভাগ করে নেবার নয়।
তা সেবার ভেবেই রেখেছি, সুনীলদার কাছে কবিতা চাইব। যদিও তাঁর বৈঠকখানার আড্ডার নিয়মিত সদস্য হবার সুবাদে বেশ ভালই জানি, কতজন কবিতাপ্রার্থী সম্পাদককে খালি হাতে ফেরাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি, হাতে একেবারে নতুন লেখা নেই বলে। তা সত্ত্বেও একদিন, একটু একলা পেয়ে তাঁর কাছে পুজোসংখ্যার জন্য লেখা চেয়ে বসলাম। যথারীতি আমাকেও সেই একই সত্যি বললেন, বাকিদের যা বলেছেন সে-বছর। আমি তবু ছাড়তে চাই না। বললাম, ‘একটা পুরনো লেখাই দিন নাহয়, আমি রিনাদি’র অনুমতি নিয়ে সেটাই ছাপাব। আমার চিরকালের স্বপ্ন এটা, তাই লোভ ছাড়তে পারছি না’। সামান্য হেসে, আমাকে বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখে কিছুক্ষণ পর একখানা পুরনো লেখাই এনে দিলেন, বছর দশেক আগেকার। সেই নিয়ে খুশি হয়ে বেরিয়ে এলাম।
তারপর আরও এক হপ্তাখানেক চলে গেছে, কবিতার পাতা কম্পোজ করিয়ে ফেলেছি, অলংকরণ বসে গেছে তাতে। হঠাৎ সুনীলদা’র ফোন। ‘শোনো, আমার কবিতাটা ছেপো না’। কথাটা শুনে আমার বুক ধড়াস করে উঠল। কবিতার পাতার একেবারে শুরুতে তখন জ্বলজ্বল করছে সুনীলদা’র নাম, বিজ্ঞাপনে সকলের আগে বসে গেছে ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’, এইরকম সময়ে লেখা ফিরিয়ে নিলে আমার যে কী অবস্থা হবে, তা ভেবেই গলা শুকিয়ে গেল। তবু জিগ্যেস করলাম, ‘কেন সুনীলদা, অন্য কোনও অসুবিধে আছে? আমরা তো পাতায় বসিয়ে নিয়েছি’। রিসিভারের ওপার থেকে উনি বললেন, ‘আসলে কী জানো, তোমাকে পুরনো লেখা দেবার পর থেকে মনটা খচখচ করছে। আমি একটা নতুন কবিতা দিতে চাই। আর দিনতিনেক সময় হবে?’ এ-কথা শুনে আমার মধ্যে যে-আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল ফোয়ারার মতো, তার বিশেষণ আমি জানি না। হোন না যতই কাছের মানুষ, খোদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো! তিনি আমার কথা ভেবে নতুন কবিতা লিখতে চাইছেন? একজীবনে এ কি কম প্রাপ্তি? আমি আর দেরি না-করেই বললাম, ‘এ তো আমাদের অনেকখানি পাওয়া, আপনি লিখুন, আমি জায়গা ধরে রাখছি’। শুনে খুশি হয়ে বললেন, ‘শনিবার বেলার দিকে একবার এসো তাহলে, আমি নতুন লেখা তোমাকে দিয়ে দেবো’। ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম। একটা সময় ছিল যখন স্বপ্নেও কল্পনা করিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সামনে থেকে দেখতে পাবো। আর আজ তিনি ভালবেসে আমার জন্য নতুন কবিতা লিখে দিতে চাইছেন। জীবন যে কত সম্পদ লুকিয়ে রাখে অজান্তেই! যদিও তখনও জানি না, সেই শনিবারই প্রথম ও শেষবার দেখতে পাবো এমন এক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে, যাঁকে কেউ বড় একটা দেখেনি।
অফিসে বলেই রেখেছিলাম, শনিবার ঢুকতে দেরি হবে। কারণটা শুনে কেউ আর কোনও কথা বাড়াননি। সেপ্টেম্বর মাস, সদ্য সুনীলদা’র জন্মদিন গেছে। সেদিন সকাল থেকে আকাশভাঙা বৃষ্টি। কালো মেঘের চালচিত্রে ঝকঝকে হয়ে অপেক্ষা করছে সুনীলদা’র ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্স-এর দশতলা মিনার। অল্প ভিজে গেছি ততক্ষণে, বাইরের ঘরে দমচাপা অপেক্ষা নিয়ে বসলাম। এই প্রথমবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোনও কবিতার দ্বিতীয় পাঠক হব আমি, স্বয়ং তাঁর পরেই। এমন দিন জীবনে বারবার তো আসে না!
সাদা একখানা খামে ভাঁজ করা পাতা নিয়ে আমার হাতে তুলে দিলেন সুনীল’দা। নতুন কবিতার উষ্ণতা তখন আমার হাতের মুঠোয়। বসবার জো নেই, গিয়েই পাতায় এ-লেখা বসাতে হবে, তাই ছুটি চেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে তখনও অঝোর বৃষ্টি, দশ হাত দূরের ছবি ঝাপসা দেখাচ্ছে। ন’তলার দরজা থেকে বেরিয়ে লিফট নেবারই কথা, কিন্তু সে-দিনটা অন্য সব দিনের চেয়ে আলাদা। তাই দ্রুত পায়ে সিঁড়ি টপকে আরও দু’তলা নেমে এসে সাততলার ল্যান্ডিং-এ দাঁড়ালাম। গড়িয়াহাট থেকে আমার অফিস পাক্কা পৌনে এক ঘণ্টা, বৃষ্টিতে আরও বেশি। এতক্ষণ এই কবিতা না-পড়ে আমি থাকতেই পারব না। এ-অপেক্ষা আমার শরীরে বা মনে সইবে না কিছুতেই। তাই কাঁপা হাতে, ওই জলের ছাটে ভিজে ওঠা খোলা ল্যান্ডিং-এই খুললাম সেই সাদা খামের মুখ, আর হাতে তুলে নিলাম ছবির মতো হস্তাক্ষর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। পড়লাম কবিতাটা। একবার, দু’বার, তিনবার, দশবার।
পড়তে পড়তে কখন দু’চোখ ভিজে এসেছে, টের পাইনি। বৃষ্টিতে নয় যদিও। ভিজেছে, কেননা এ-কবিতা অন্য এক সুনীলের লেখা। এ-লেখার প্রতি লাইনে কেবল বিদায়ের কথা, চলে যাবার কথা, মৃত্যুর কথা। এমন লেখা আমি ওঁর আগে পড়িনি। সুনীল আমাদের প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি, জীবনের কবি। কিন্তু এ-লেখার সারা শরীরে এমন এক বিষাদ, যা সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে, সেদিনের বৃষ্টির মতোই।
তাড়াতাড়ি অফিস ফিরতে হবে, কিন্তু আমার পা ছুটল উল্টোমুখে, সিঁড়ি বেয়ে ফের ন’তলায়। জবাবদিহি চাই এই লেখার। না। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে নয়। সে-সাহস কই একজন পাঠকের? মানুষ সুনীলদা’র কাছে উত্তর চাই, কেন এমন লেখা লিখলেন তিনি? আজ বুঝতে পারি, তখন ওই আকস্মিক লেখার বিষাদের ধাক্কায় আমার সম্বিৎ বা বাহ্যজ্ঞান বিশেষ অবশিষ্ট ছিল না। কেবল মিথ্যে বলে বুঝতে চাইছিলাম সদ্য-পড়া কবিতাটাকে।
দরজা খুললেন বাড়ির পরিচারক, বহু বছর চিনি আমরা তাঁকে। দেখেই বুঝলেন, কার কাছে এসেছি, হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, লেখার ঘরের দিকে। সে-ঘরের দরজায় পৌঁছে দেখি, লেখার টেবিলের সামনে চুপ করে বসে আছেন সুনীলদা। লিখছেন না। তাকিয়ে আছেন দেয়ালজোড়া কাচের জানলার দিকে। যার ওপারে ভেসে যাচ্ছে শেষ বর্ষার কলকাতা। ধরা গলায় ডাকলাম একবার, চমকে উঠে ঘুরে তাকালেন। ‘কী ব্যাপার, ফিরে এলে যে? বানান ভুল আছে নাকি লেখায়?’ স্বভাবসিদ্ধ মজার ভঙ্গিমায় কথাটা বললেন তিনি, কিন্তু প্রত্যুত্তরে হেসে উঠতে পারলাম না। বরং বললাম, ‘না। আমি জানতে এসেছি, এইরকম একখানা কবিতা লিখলেন কেন আপনি? ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেছে পড়ে, তাই ফিরে এসেছি। এমন লিখলেন কেন?’
এই প্রশ্নের উত্তরে তাঁর যে-হাসিটা দেখলাম, তা আগে কখনও দেখিনি। ‘এদিকে এসো’, এইটুকু বলে কাছে ডাকলেন তিনি। গিয়ে দাঁড়ালাম পাশে। আবার তিনি তাকিয়েছেন বাইরের দিকে, বৃষ্টির দিকে। আমি তাকিয়ে আছি তাঁর কালো হয়ে আসা সিল্যুয়েটের দিকে, চেনা একজন মানুষের অচেনা ছায়ার দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর একটিই বাক্য বললেন। ‘আসলে কী জানো, শেষের শুরু হয়ে গেছে’। কথাটা বলবার সময়ে ওঁর গলার স্বরে এমন কিছু একটা ছিল, যার উপরে আর কথা চলে না, তর্ক চলে না, জোর চলে না। আর ওই একটিমাত্র দিন, বর্ষার ভেজা আয়না ভেঙে আমি বেরিয়ে আসতে দেখেছিলাম অন্য এক অবয়ব, সুনীলদা’র। যেন ঝমঝমে বৃষ্টিতে নিজেকেই চলে যেতে দেখছেন, শেষবারের মতো।
আর কোনও কথা বলতে পারিনি সেদিন। ভারী পায়ে নিজেকে অফিস পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়ে লেখাটা পাতায় বসিয়েছিলাম, যে-লেখা আগে থেকেই মনে বসে গেছে, জলছবির মতো। ঠিক তার পরের বছর পুজোয় সুনীলদা চলে গেলেন। কে জানে, দূরদ্রষ্টা হন তো সার্থক কবিরা, হয়তো অত আগে থাকতেই নিজের বিদায়ের পথটুকু চিনে নিতে পেরেছিলেন, আর তারই মানচিত্র সেদিন ফুটে উঠেছিল ওই কবিতায়। যা আমি দেখতে পাইনি। বা বলা ভাল, দেখতে চাইনি কিছুতেই। আজ দেখতে পাই, ভারী বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছেন এক বেপরোয়া কবি, যাঁকে আমরা চিনতাম অন্য এক নামে…