ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • পরশমণি : পর্ব ২


    সাগুফতা শারমীন তানিয়া (September 16, 2023)
     

    ৬.

    এমনিতে শিরোমণি ভূতের মতো খাটে, রান্না করতে এলে তার মাথাও খুব খেলে। কথাবার্তা কারও সঙ্গে বলে না, তার মাথায় খেলে ঠাকুরমার সঙ্গে তার সেই শৈশবের গল্প—  ইলিশ-বেগুন দিয়ে গাছতলায় জিরিয়ে বসে পান্তা খাচ্ছিল নাকি ঠাকুরদা, ইলিশের গন্ধে গাছ থেকে চড়চড় করে শাঁকচুন্নি নেমে এসেছিল মাছভাত খাবে বলে! সে নাকি ঠাকুরদার পিছু পিছু হেঁটে এসেছিল সংসার করবে বলে! তা ঝোলে কোন বেগুন? না সাদা সাদা জালি বেগুন, পোকা কিংবা হনুমানের হাতে পড়ার আগেই ছিঁড়ে আনতে হবে সেই বেগুন। ইলিশ না জুটলে চওড়া কোলের চাপিলা দিলেই চলবে…খুন্তির ডগায় পুঁচিয়ে পটপট করে মরিচফালি করতে করতে কইতো বুড়ি। ঠাকুরমার মায়ের নাম ছিল দুর্গামণি, সেই নাকি হাতে ধরে শিখিয়েছিল রাঁধতে। বুড়ি কইত, ‘কলাবতী আজকুন্যার মোতো দেখতে আছলো হামার মাও’…সেই রাজকন্যাকে রানিদের পাঁচটি সোনার রাজপুত্র হন্যে হয়ে খোঁজে; রাজপুত্রদের সুন্দর সুন্দর নাম, ‘হীরারাজ, মানিকরাজ, মোতিরাজ, শঙ্খরাজ আর কাঞ্চনরাজ’…একবার নাকি বুড়ির সেই দুর্গা-মা ভাবল, পৌষপার্বণের পিঠায় পাঁচরকম পুর হবে, নাম হবে হীরারাজ, মোতিরাজ…। ছোট্ট শিরোমণি বোকা হয়ে ভাবত, তাদের বংশে কবে পুষণা হত? তাও আবার পাঁচ পদের পুর। আবার হবে? এখনকার শিরোমণি ভুতকড়ই কাঠের আগুনে মাংস কষাতে কষাতে ভাবে, কাঠের আঁচে ভর্তার আলু পোড়ায়, আলুর দগ্ধ খোসার খুশবু মেশে মাখনের মতো আলুভর্তাতে। তার হাত চলিষ্ণু, মনে স্বপ্ন, কিন্তু সে নিরুদ্যোগ গ্রাম্য লোক, পরিবর্তন ডরায়। দয়াময়ী ভান্ডারের রেডিওর অন্ধকারের ভিতর থেকে অদেখা মধুবালা বিভোর চোখে চেয়ে মৃদুমুখে বলে—‘গাতা চলা চল, হাসতা চলা চল, জীবন কি নদীয়া কি পার…ইয়ে সামা ইয়ে জাহাঁ ফির কাহাঁ।’ তবু হেসে-গেয়ে যেন চলতে পারে না সে আর, তৈমুরের ব্যবসার পরিকল্পনার কথাটা সে চাপা দিয়ে রাখে, সেই ভার তার ফড়ফড়ানো স্বপ্নগুলোকে চাপা দিয়ে রাখে।

    অনির্দিষ্টকালের জন্য অবশ্য চাপা দিতে পারল না সে। ভারতে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরদিন বেড়ার হোটেলে কুত্তার গোশত খাওয়ানো হয় বলে গুজব রটল, বাজারের লোকেরা মিলে সীতুকাকার দোকানে আগুন লাগিয়ে দিল। পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এস আই) সাত্তার ভুঁইয়া পত্রিকার প্রতিবেদকদের জানালেন, ফেসবুকে গুজবের ভিত্তিতে সীতাব্রত হালদারের হোটেল দয়াময়ী ভান্ডারে অগ্নিসংযোগ করা হয়, প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান দয়াময়ী ভান্ডারের রান্নাঘরে শেয়াল কুকুরের কাটা মাথা পাওয়া গেছে। একদিনে সর্বস্বান্ত হয়ে গেল সীতাব্রত।

    যারা শিরোমণির হাতের রান্না খেতে বেড়ার হোটেলে ভিড় জমাত, তাদের হাতেই মাথা ভাঙল শিরোমণির, সেলাই পড়ল অনেকগুলো। তাও ভাল, হাত ভাঙেনি তার। বুড়ি কৃষ্ণমণি নাতির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলতে লাগল— ‘ভগোমান তুমি দেকো!’

    শিরোমণি অবশ্য সেসব ফরিয়াদ করতে গেল না। ভগবানের বিচারশালায়-ও অন্যায্য কিছু হবে না, এমনটা আর বিশ্বাস করে না সে। শুধু রতনের কাছে সে একবার মুখ খুলল, ‘কী এক জীবোন ভ্যাগন্যা। ছাগোলে সুত্তে খায়ে ফ্যালায়, চামচিকায় ল্যাত্থায়। হামার ওন্তরের হাতিকোনা গহীন জোঙ্গলত চ্যলে যাবা চায়!’

    ‘হাতি ক্যান মামা?’— রতন একটু অবাক হয়, মামাকে এমন কাব্য করে কথা কইতে সে কখনও শোনেনি।

    ‘মরোণ অ্যালেপালা হাতি যিংকা জোঙ্গলত চ্যলে যায়, তাক য্যান ম্যরবা সোময় কেউ না দ্যাকে!’—  

    শ্বাস ফেলে শিরোমণি।

           গ্রামজীবন শ্লথগতি, কাদাপায়ে সবজি বেচতে যায় চাষা, পাট জাগ দেয়, গাঙের জলে ডোবানো ডিঙি সেঁচে মাছ ধরে, মাথার ওপর বকের ঝাঁক ওড়াওড়ি করে। মাসকয়েক পরে ষোলআনি গ্রামে রাতের বাতাস মাত করে যখন ছাতিমফুল ফুটল আর দুর্গাপূজার ঢোলকের আওয়াজ এল, শরতের তিসিফুলি নীল আকাশে ভোরের আলো ফুটল, তখন এ গ্রামে সীতাব্রত নামের কাউকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। শিরোমণিরা অবশ্য চমকাল না। কুন্ডুরা এভাবে গেছে। চক্রবর্তীমশাই এভাবে গেছেন। একশো বিঘার আমবাগান ছিল যাদের, সেই সামন্তরা এভাবে গেছে। গ্রাম সীমান্তের জমিদারবাড়ি রানি সর্বমঙ্গলার ধাম, এভাবেই একদিন খালি হয়েছে। ওরা যে ছোটবেলায় পড়ত— ‘পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই’— ওদের গ্রামটা বন্দে আলি মিয়ার সেই আপনপর ভেদহীন গ্রাম নয়, আর সব গ্রামের মতোই সহিংস গ্রাম। তা সত্যযুগেও রাক্ষস ছিল, বুড়ি শিখিয়েছিল শিরোমণিকে, ব্রহ্মা ঘুম মারতে গিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ফেলেছে আর কী, কিলবিল করে রাক্ষস জন্মে গেছে! আর এ তো কলিকাল।

    ৭.
    ঘরে অন্ন নেই, গুগলি তুলতে গেছে পলারাণি, আকাশপাতাল এক করে কাঁদছে তাদের ছোট ছোট মেয়েরা, শিরোমণির মাথায় তবু রান্নার অবিশ্রান্ত কল্পনা ঘোরে, কেন ঘোরে! পাছপুকুরের কলাঝাড় থেকে পাতা কেটে আনে তপতীমাসিদের বাড়িতে আসা মুনিষরা, তাতে পড়ে মোটা চালের ভাত, মিঠাকুমড়ার ঘন্ট, পাতলা ডাল। শিরোমণি চেয়ে চেয়ে দেখে আর ভাবে— উনুনের আঁচে পোড়ানো তেঁতুল আর কাঁচা তেল- নুন- কাঁচাঝাঁল দিলেই কত তৃপ্তি করে খেত লোকগুলো। কিংবা বাঁদাড়ের বনকচুর হলুদ ফুল রসুন-কাঁচাঝাল দিয়ে ভেজে? রান্না করবার জন্য তার হাত নিশপিশ করে। ওইসব গেঁড়িগুগলির ঝোল-ভাত রাঁধতে নয়, শখ-মেটানো রান্না, কলাবতী রাজকন্যার জন্য যেমন হত, তেমন।  

           সাধের ভাগ্নে রতন ছিপ হাতে খালপাড় থেকে ফিরছিল, তাকে ধরল গিয়ে শিরোমণি। ‘সোংসারের এই হাল তো আর দেকপা পারোচি না। রান্দোন দ্যাকাপা হ্যলে তো বাজারসদাই ল্যাগবে, লিত্তিদিন ল্যাগবে। ক্যাংকা ক্যরে মাছ-মাংসো কিনমো?’

    ‘ক্যা? থাই কই দেখাইয়া কমিন বিলের তিনসন্যা কই। বর্মা দ্যাশের ইলিশক কমিন চানপুরের ইলিশ। চাষের মাগুর দ্যাখায়া কমিন হামাকেরে প্যকুরের। যারা দেকপে তারা শহোরের লোক, তারা কেছু চিনে না। বটগাছের ঝুরি দ্যাখায়া যুদি কন অটে থিনি কুশ্যার হয়, তারা সেডাই বিশ্বাস ক্যরবে। লিশ্চিন্ত থাকো।’

    – ‘অরে তর বুদ্দি! থাই কই আর বর্মী ইলিশ কিনার ট্যাকা দিব কে?’

    – ‘তোমাঘেরে কত্তা-মাক মাথাত তুলে ঝাঁকি দিলেই দেকমিন বরইগাছের মোতন ঝুরঝুর ক্যরা ট্যাকা ঝ্যরে পড়োচে। পুরান সন্নের কিছু তো থাকপেই বুড়ির, বুড়া সোয়াগ ক্যরে গ্যড়ে দিছলো দ্যাখো যায়ে।’ 

            সাতপাঁচ ভেবে শিরোমণি বৌয়ের কাছে কথাটা পাড়ল। অন্ধকারে পলারাণি ছোট মেয়েটাকে দুধ দিচ্ছিল। কাজ শেষে শিরোমণি বেঁচে যাওয়া ভাত-মাছমাংসের আলুভাঙা ঝোল নয়ত ঝিঙে-পটল-সীমের তরকারির শেষটা…এসব আনত। সীতাব্রত কিপ্‌টে লোক, ওর বেশি কিছু শিরোমণির জুটত না, কাজ নেই বলে সেই ঝোল-তরকারিটুকুও আসে না, ঘরে সামান্য ভাত যা ছিল পুঁইয়ের গোটা পেড়ে টিপেটুপে মেখে খেয়েছে বাড়ির লোকে, পলারাণির জন্য কিছু রাখেনি। কোলে রক্তচোষা শিশু, তদুপরি স্বামী টাকাপয়সা চাইছে, সে মেয়েটাকে ছাড়িয়ে দিয়ে রোগাটে হাতটা বাড়িয়ে তালপাখার ডাঁটার দুই ঘা কষিয়ে দিল তার পিঠে, তারপর দুজনের উদ্দেশ্যে অন্ধকারে জবাব করল, ‘হামার হাড্ডি মাংসো চুষে খা। মরোণ হয় না!’ পলার মেয়ের নাম মরুণি।

    ৮.
    কচি দুপুরের রোদ পড়ে পুকুরপাড়ের জঙ্গল থেকে সবুজ তিতকুটে ঘ্রাণ বেরিয়েছে। গরমকালের জারুলফুলে গাছটা বেগুনি হয়ে আছে, ভাতশালিকের বাসা হয়েছে পাশের কপিলা গাছে, আকাশ ফাটিয়ে চোপা করছে শালিকের সংসার। সেদিক থেকে ক্যামেরা সরে এল পলারাণির মুখের ওপর। মাথায় গহিন ঢেউখেলানো চুলের উদ্ধত বিন্যাস, সেটা একটু দেখা যায় মতো করে প্রিন্টের নতুন শাড়ির খাটো ঘোমটা টেনে ক্যামেরার সামনে মাটির দাওয়ায় মাছ কুটতে বসেছে পলা। পেছনে মশলা-ধোয়া জলের মতো ঘোলা জল মাছপুকুরের। তেলাপিয়া বুড়বুড়ি কাটছে। ডোবাপুকুরের মতো নিরুত্তাল মুখ পলার। গলার আওয়াজ মসৃণ। সে তার ভুবনভোলানো হাসিটি হেসে পরশমণির রান্নাঘরে সবাইকে স্বাগতম জানাল। তারপর কুটে-বেছে রাঁধল সর্ষেবাটা দিয়ে তেলাপিয়া মাছ, কুচো চিংড়ি দিয়ে কলমি শাকভাজা, ছোট আলু দিয়ে ডিম-বোঝাই রামটেংরার ঝোল। মাছ বাজারের, রতন গিয়ে কিনে এনেছে, কিন্তু শিরোমণির বউ বলল, বিলে জাল টেনে তোলা মাছ। মাটির দাওয়ায় এরপর কলাপাতা বিছিয়ে (পলা ভাল এনামেলের পাত আনতে গেছিল ঘরের ভেতর, তৈমুর ধমকে কলাপাতা কাটতে পাঠিয়েছে তাকে) পলারাণি আর শিরোমণি বাড়ির সকলকে নিয়ে খেতে বসল। শরমে ভাত গিলতে পারছিল না শিরোমণি, মিনমিনে লোকটার দিকে চেয়ে বিরক্তিতে ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছিল ওর বৌয়ের। বৌটা কিন্তু নির্বিকার, তৈমুর যা যা শিখিয়ে দিয়েছে অম্লানবদনে তাই তাই বলছে, ঘোমটা খসে গেলে আঁচল টেনে তুলে দিতে দিতে কেমন মিহিন গলায় শিরোমণিকে আপনাদের দাদা-আপনাদের দাদা করছে, যেন ট্রাইপডে বসানো ফোনের ক্যামেরাটা ওর রঙের দেওর। সাধে কী আর ঠাকুরমার ওরে দেখে যাত্রার নাচনির কথা মনে পড়েছিল! মরুণি দুধের শিশু, ছাড়া পেলেই পলার গায়ের জামা ধরে টানাটানি করতে আসে বলে বিরাজবালা তাকে পুরোটা সময় কোলে করে সামলাল, দুরন্ত বাছুরকে শাকের ক্ষেত থেকে টেনে ধরে রাখতে বেগ পেতে হল বটে। মরুণির বড়টার নাম যতুনি, সে রোদে বসে যত্ন করে সারা বেলা আখের ফালি চুষল আর পিটপিটিয়ে মায়ের রকমসকম দেখল।  

            ষোলআনির শিরোমণি দাসের বউ পলারাণিকে ফোন-ক্যামেরার স্নিগ্ধ চোখে কেমন নরম দেখাল, লাকড়ির ধোঁয়ায় ঢেকে গেল গালের মেচতার মেঘ, লাল নটেশাকের মতো ফিকে লাল ঘোমটার ঘেরে তার কপাল-নাক তেলতেলে, বড় বড় চোখে উৎসুক চাউনি, ১৯৪৬ যেন স্থির হয়ে আছে তার চেহারায়, চুলে যেন সেই হিমসাগর তৈল, সিঁথিতে বঙ্গলক্ষ্মী সিঁদুর। ভিডিও শেষ হলে তৈমুর আর রতন বসে গেল খেতে। খেতে খেতে একটা শান্ত আরাম ছড়িয়ে পড়ল তৈমুরের শরীরে, তার মন বলছে— একটা দারুণ কিছু হচ্ছে।

    হল-ও তাই। ওই গাঙে-ডোবানো ডিঙি ঠেলে তুলতেই যেমন ঝিকিমিকি দিয়ে ওঠে গাঙের মাছের দল, এক দুই তিন অগুন্তি, প্রথম দিকে শ’খানেক জমতে যা সময়, এরপর হাজার, দুই বছর ফিরতে না ফিরতে লাখ…শিরোমণি দাসের ‘পরশমণির রান্নাঘর’-এর রান্নার ভিডিও ইউটিউবে দলে দলে লোকে দেখতে জড়ো হয়ে গেল। মণিদাদা-বৌদিকে যে সার্কাসের রিংমাস্টারের মতো লোকে জড়ো হয়ে দেখছে, সেটা বোঝাতে একটু কসরত করতে হল, লোকটা এত গাড়ল! রতনই বোঝাল।   

    – ‘আরে সুধী দর্শক শ্রোতা কী জিনিস! কমিন, ভিউয়ার্স। ডিয়ার ভিউয়ার্স!’

    – ‘মাছ কোটা আফির দ্যাখার কি আচে?’

    – ‘শহোরের ম্যায়ারা কি আর এখোন জানে জালমাছের মাথা থ্যাকে বালুর পোটলা সাফ করে ক্যাংকা করে? ক্যাংকা করে ব্যাম মাছের চামড়া ছিলে? মাছ কোটা আফির দেখপে না মানে!’

    ৯.
    বাঁশের ধামা নিয়ে হেলেঞ্চা শাকের লকলকে ডগা তুলতে যায় পলারাণি, বলে ওদের ধানক্ষেতের ধারে হয়েছে। নিজের জমি, নিজের শাক, নিজেদের ঘানির তেলে রাঁধা। যুগীকাকিমার পুরানা ঢেঁকিশাল আর জুয়েলের মা তপতীমাসির গোয়াল নিজের বলে দেখায়, লোকে নাকি ওসব সমৃদ্ধ গ্রামের পুরানা চিহ্ন দেখতে ভালবাসে। ঝাঁকি জাল ফেললে আর মরা খালে কটা মাছই ওঠে, কিন্তু তৈমুরের ক্যামেরায় শিরোমণির মাজা বালতিতে দেখা যায় বাজারের আধ কিলো ডিমভরা দিশি পুঁটি ছটফট করছে। তাদের নিজেদের জমিজিরেত বলতে তেমন কিছু নেই, কিন্তু দেলজান বেওয়ার কাঠাখানেকের বেগুন ক্ষেতটাকে তারা নিজের বলে দেখায়, কাঁটার জ্বালা সয়ে পলারাণি সাদা সাদা উটপাখির ডিমের মতো বেগুন তোলে। বর্ধিষ্ণু পরিবার নীলমণি লস্কর, তার মাদারগাছের বেড়া দেয়া তকতকে আঙিনা, ওদিক দিয়ে ক্যামেরা ঘুরিয়ে নিয়ে যাবার পরে পলারাণি সুখের হাসি হেসে বলে, ‘এডা হামাকেরে ঘর, হামাকেরে সোংসারত হামরা সগলাক লিয়ে থাকতে ভালোবাসি।’ শিরোমণি অবাক হয়ে দেখে, মিছে কথা অবলীলায় বলা যায়, তার বউ বলে, সেও বলে আজকাল। বুড়ি ঠাকুরমার শলা শুনেই রাঁধে ওরা জামাই-বৌয়ে, কিন্তু ঠাকুরমাকে কে পোঁছে! শিরোমণি ওসব নিজের রেছিপি বলেই চালায়।

    ঝমঝম বৃষ্টির ভেতর সামন্তদের তালগাছে ছাওয়া সত্যিকারের তালপুকুরের ধারে চলে যায় শিরোমণি, সারি বেঁধে উজান বাওয়া কৈ-মাগুর মাছ ধরবে। সে তালঢ্যাঙা লোক, বাজ পড়লে তালগাছ ছেড়ে তার মাথায়ও পড়তে পারে, তবু ভিজতে ভিজতে রোমাঞ্চে গায়ে কাঁপন লাগে তার, ওবেলা বুড়ি বসে বসে ক্যামেরার সামনে জিয়লমাছে ছাই আর কুমড়োপাতা ঘষে মাছে। সিমেন্টের খালি বস্তার প্ল্যাস্টিক ব্যাগটা সেলাই করে রেনকোট বানিয়ে দিয়েছে কৃষ্ণমণি, সেটা মাথায় দিয়ে পাড়াগাঁয়ের বর্ষায় পলারাণি বাইরে আসে গাইয়ের জন্যে ঘাস কাটতে। ইটের ভাঁটা বন্ধ, ওরকম ভাঁটায় ভূত থাকে শুনেছে ষোলআনির লোকে, তা সেখান থেকে পোড়া ইটের গুঁড়ো কুড়িয়ে বৌ বাড়ি যাওয়ার কাদামাটির পথ ধরে, গোয়ালের মেঝেয় ওই গুঁড়ো ইট ফেলে রাখবে— তাতে কাদা হবে না, গরুর খুরা রোগ হবে না। ক্যামেরা বড় টানে তাদেরকে। যেন ওটা অন্ধকার খয়েরি মায়া-আয়না, ওখানে তাদের আরেক জীবন আছে একটা, সেখানে তাদের মাটির মটকায় সংসারের ধান-চাল-ডাল-গুড়, শিকায় শিকায় আম-কাসুন্দির হাঁড়ি, উঠান পার হতেই ভুঁইচাঁপার সারি দিয়ে লেখা নাম, একটা স্টিলের আলমারি (আলমারি সত্যিই কিনতে পেরেছে তারা, জমি কিনেছে, আটাল মাটির ঘর ভেঙে উঠেছে লাল সিমেন্টের পাকা বাড়িতে, আজকাল আর তাদের পরের জমি, পরের ঘর দেখিয়ে ভান করতে হয় না), গাঁদা-নয়নতারা-অতসীর ফুলবাগান। গোয়াল থেকে হাম্বা রব তোলে গাইটা— হয়তো তাজা ঘাস পেয়ে খুশি, হয়তো ইটের গুঁড়োয় শুকিয়ে তোলা গোয়ালের মেঝে পেয়ে খুশি, হয়তো সেও ক্যামেরার নেপথ্য কোলাহলে যোগ দিতে পেরে খুশি।

    ১০.
    তৈমুরের সঙ্গে থেকে থেকে রতনের কেমন হাত খুলেছে। রতন ক্যামেরায় চমৎকার ধরে— রাজফড়িং কেমন করে উজ্জ্বল দিনে বাতাসে ডিঙ্গি মেরে বোলতা ধরে খায়, ফড়িং-এর গায়ের রঙ লালচে সোনালি নইলে ফিরোজা নীল। জলের উপরিতল ছুঁয়ে উড়ে যায় সেই ফড়িং, খানিক পরে সেই পুকুরের ঘোলাজল থেকে চাষের বড় বড় সোনালি সরপুঁটি এনামেলের গামলায় করে তুলে ভেজা শাড়িতে উঠে আসে পলারাণি, ফ্যাসাদে কোকিলটা ডাকে সজনেগাছটা থেকে। অমনি কমেন্ট আসে— ‘বদনজর ইসলামে রয়েছে। এইজন্য হুজুরপাক সাহাবীকে সুরা নাস আর ফালাক শিখায়েছেন। আল্লা আপনাদিগকে বদনজর থেকে বাঁচাই রাখুক।’

    কেউ লেখে— ‘ইসলামের দাওয়াত দিয়ে গেলাম।’ কেউ প্রিমিয়াম কোয়ালিটি খেজুর বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে যায়।

    কেউ লেখে— ‘কেয়ামতের আগে সমস্ত মুসলমান মারা যাবে। কানা দজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। ইয়াজুজ মাজুজ সারা দুনিয়া তছনছ করবে। খালি কাফের থাকবে, তাদের উপরে কেয়ামত কায়েম হবে।’

    শুধু কি আর মোসলমানে হররোজ সেই— ‘মাশাল্লা ভাল রেসিপি’, ‘জুম্মা মোবারক!’ ‘মাংস-মাংস করবেন না, মাংসের চেয়ে গোশ শব্দটা ভাল শুনায়’ এসব বলে নাকি? হিন্দুতেও বলে— ‘রান্নার ভেডিও না করে পূজো আচ্চা কল্লে হয় না?’ অন্য হিন্দুতে ফোড়ন কাটে— ‘ইউটিউবের মালিক ওদের ভগবান, তারই কল্যাণে পোতিদিন আজ খাসীর টেংরি তো কাল গলদা চিংড়ির মালাইকারি খেতে পাচ্ছে। এজন্যই ওরা পোতিদিন তাকে পূজো দেয়।’

    আবার কেউ ভিডিওর নীচে ক্যান্সারের চিকিৎসার অর্থ চায়, কেউ এসে নিজের বনাজী ঔষধ বেচবার বিজ্ঞাপন দিয়ে যায়। ওই হাটুরে পরিবেশে পলারাণি কেমন করে অত হাসি-হাসি মুখে তাকায় (কত নিরুক্ত কথা ভাষা ধরে তার চোখে, বিউটি শীলও অত অভিনয় জানে না গো!)  আর বরের সঙ্গে ঠাট্টা জুড়ে দেয় আর দশ পদের রান্না করে দেখায়, তা সেই জানে। আমি আজক্যা রান্না ক্যরব মুরগির চামড়া দিয়ে মুগডালের খিচুড়ি, জাস্ট ওয়াও এট্টা রেছিপি, এট্টু পেঁয়াছ বেশি দিয়ে ইউনিক স্টাইলে রান্না করে দ্যাখাব। আপনেরা টাই ক্যরে দেকপার পারিন, পরিবারের সগলাই পছন্দো করবে। সো লেটস গো টু মাই কিসেন এ্যান্ড কুক। গড়গড় করে বলে যায় সে, যেমন তৈমুর শিখিয়ে দিয়েছে। শুধু কি আর রাঁধে সে, কত কী বেচবার বিজ্ঞাপন দেয়। সে আজকাল ক্যামেরার সামনে সিঁদুর দিয়ে বসে না, সিঁথির আড়ালে লুকিয়ে একটু মেটে-লাল ছোপ ছুঁইয়ে রাখে। অনায়াসে বলে, ‘পরশমুণির রান্নাঘরের পরশমুণি হ্যলো গা আমার বড়ো মেয়ে, ছুটু মেয়ের নাম চানমুণি।’ বলে না ওরা আসলে যতুনি আর মরুণি। ঠাকুরমার দৌড় তো ওই সজনে ফুল নয়তো আলুর ফুলের বড়া…‘যে কুনো জিনিস চটকে আটা-পিঁয়াজ রসুন মরিচ দিয়ে ড্যলে বড়া বানাবা পারমিন, মোনের দুঃকুও পিন্ডি পাকায়া বড়া ত্যয়ার করা যায়।’ চারমগজ বাটা কী সেটা বুড়িও জানে না, তার নাতবৌ-ও জানে না, বলে ‘চালমগজ’, চিনাবাদাম বাটাকে চারমগজবাটা বলে চালায়, তা কেউ তো আর শুঁকতে আসবে না, খেতেও আসবে না, খাবে তো সেই তার বাড়ির লোকে আর ক্যামেরাম্যান তৈমুর হোসেন।

    শিরোমণি তো পাতিহাঁস যেমন গলা খাটো করে আপনমনে পতিত পুকুরে ডুবে থাকে, তেমন করে শান্ত পল্লীজীবনে ভেসে ছিল। ক্যামেরার সামনে এখন ওদের এক আশ্চর্য দাম্পত্য, জামাইষষ্ঠী থেকে মকরসংক্রান্তি— শীতের রাতে কাটারিভোগ, চালের পোলাও আর দিশি মুরগির ঝোল দিয়ে পিকনিক-ঘুমটি নদীতে ভাসান-নিমাই পীরের আস্তানা দর্শন, সবকিছুই ওদের মানুষের চোখকে সাক্ষী রেখে করতে হয়— একেবারে ফার্মেসির কেমিস্ট উপেন থেকে সদরের দলিল লেখক চাঁদ গাজী, ছুতার নেপালকৃষ্ণ থেকে তিন গ্রাম পরের সখী খাতুন, সব্বাই সাক্ষী, অদেখা অচেনা আরও কত সাক্ষী কে জানে! চোখে পড়বার বিপদও আছে…পলারাণি একবার ছোলার ডাল দিয়ে খাসির মাংস রাঁধল, আঁচল তার কোনও দিনই সিধে হয়ে গায়ে রইতে চায় না। ভিডিওর নীচে সঙ্গে সঙ্গে কমেন্ট শুরু হল— ‘সুইট বৌদি, বুটের ডালের সঙ্গে গরু বা পাঁঠার বিচি, পোতা, ওলের ইয়াম্মি রেসিপি দেবেন প্লিজ’, ‘লাভ ইউ সোনাবৌদি, উত্তর দিও প্লিজ’, ‘ইস্‌স বৌদিমণি, তোমার মতো যদি একটা বৌ পেতাম, এখনি বিয়ে করতাম!’      

    (চলবে)

    ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook