ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • দার্জিলিঙের বুকে স্কটিশ পর্বত


    সুস্নাত চৌধুরী (June 3, 2023)
     

    অষ্টমী রাতের সুরুচি সংঘ আর এই এপ্রিল-মে-জুনের দার্জিলিং চৌরাস্তা নাকি ইদানীং দৃশ্যত প্রায় একইরকম ঠেকে। ছ্যাঁকা-খাওয়া গরম থেকে বাঁচতে উত্তরে ভিড় জমায় সমতলের বাঙালি। পাহাড় হয়ে ওঠে তার দিন কয়েকের শান্তিনিকেতন। মলে ঘোরাঘুরি তো আছেই, তারপর একটু এগিয়ে মহাকাল মন্দির, চিড়িয়াখানা। ফুরসত মিললে ভোর থাকতে-থাকতে টাইগার হিল, কিংবা খানিক বেলায় বাতাসিয়া লুপ, টয়ট্রেনের মজা। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশদের স্বপ্নের যে-জনপদ, সেখানে আজ আরও নানা আকর্ষণ, ঘুরে দেখার মতো বিবিধ কিছুর আয়োজন। যত দিন যাচ্ছে, আশপাশের অপরিচিত জায়গাগুলির প্রতিও আগ্রহ বাড়ছে ভ্রমণপিপাসু মানুষের। আবার কত জায়গার ছাপ পাহাড়ের মানচিত্রে ক্রমে হয়ে পড়ছে আবছা, অস্পষ্টতর— অথচ অতীতের কোনো অধ্যায়ে সেসবই হয়তো ছিল এই পার্বত্যভূমির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

    যদি বলা হয়, একদা এই দার্জিলিঙেই অবস্থান করত স্কটল্যান্ডের একটি পর্বত— কথাটি খানিক আজগুবিই শোনাবে বটে! কিন্তু কাগজপত্র বলছে, ব্যাপার খানিক তা-ই। এবং দার্জিলিঙের ইতিহাসে তার অবদানও কম কিছু ছিল না। কালের নিয়মে সেসবের চিহ্ন প্রায় সাফ হয়ে গেলেও, স্মৃতিটুকু রয়ে গিয়েছে। ধরা যাক, আপনি মল চত্বর ছেড়ে সস্তায় কিছু কেনাকাটা করতে চকবাজারে এসেছেন। হিলকার্ট রোড বরাবর কয়েক কদম এগোলেই বাঁ-পাশে আপনার অলক্ষ্যে নেমে যাবে বেশ ঢালু একটি গলি। অপ্রশস্ত, ঘিঞ্জি। অনাকর্ষকও। চাইলে এখান দিয়ে পৌঁছোতে পারবেন দিব্যবাণী, লোরেটো কনভেন্ট কিংবা লয়েড সাহেবের বাগানেও। দোকানের সাইনবোর্ডে চোখ রাখলেই বুঝে যাবেন, রাস্তাটির নাম লোকনগর রোড। স্থানীয় লোকজন অবশ্য বলেন, লোচনগর। এবার নামতে হবে খানিক নীচে। কাহিনির সূত্রপাত এইখানেই।

    স্কটল্যান্ডের লকনাগার পর্বত

    সিকিমরাজের আওতা থেকে জঙ্গলে ভরা আদি দার্জিলিং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে আসে ১৮৩৫ নাগাদ। কিন্তু এর প্রায় তিন দশক আগে, ১৮০৭ সালে তরুণ কবি লর্ড বায়রন-এর যে-কাব্যসংকলনটি প্রকাশিত হয়, সেই ‘Hours of Idleness’-এর একটি কবিতার নাম ছিল— ‘Lachin Y Gair’। সে-লেখার প্রতি স্তবকে ঘুরে-ফিরে এসেছিল তাঁর অল্পবয়সের স্মৃতি, উচ্চারণভেদে ‘Loch na Garr’-এর কথা—

    Yet, Caledonia, belov’d are thy mountains,
    Round their white summits though elements war;
    Though cataracts foam ’stead of smooth-flowing fountains,
    I sigh for the valley of dark Loch na Garr…

    এই ‘লকনাগার’ বা নামান্তরে ‘Lochnagar’ হল স্কটল্যান্ডের অ্যাবার্ডিনশায়ারের একটি বিখ্যাত পর্বত। প্রথম জীবনের কিছুটা সময় এখানেই কাটিয়েছিলেন বায়রন। স্কটল্যান্ডের ওই পাহাড়ের নামই কি তবে দার্জিলিঙে এসে ‘লোচনগর’ হয়ে গিয়েছে? হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। তবে পর্বত নয়, ওই নামে ছিল একটি বাড়ি। সে প্রায় দেড় শতাব্দী আগের ইতিহাস।

    ‘The Works of Lord Byron’ থেকে লর্ড বায়রনের ‘Lachin Y Gair’ কবিতাটি শুরুর পাতা

    ১৮৭০ সালের জুন মাসে স্কটিশ মিশনারি রেভারেন্ড উইলিয়াম ম্যাকফারলেন গয়া থেকে বদলি হয়ে দার্জিলিং চলে আসেন। তাঁর উপরে বর্তায় এখানে স্কটিশ মিশন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব। অতিতৎপরতার সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বে কাজ শুরু হয়। এই স্কচ মিশনের সবচেয়ে বড়ো অবদান ছিল যে, ইংরেজির বদলে তাঁরা স্থানীয় ভাষায় গুরুত্ব দিয়েছিলেন। নেপালি, লেপচা, তিব্বতি ও বাংলা ছাড়া হিন্দিতেও কাজ চলত। ইশকুল তৈরি করে সেখানে তাঁরা স্থানীয় ভাষায় পড়ানো শুরু করেন। মিশন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ছাপাখানার কাজও শুরু হয়। বছর চারেকের মধ্যে সেই স্কচ মিশন অরফ্যানেজ প্রেস বা SMOP থেকে একাধিক স্থানীয় ভাষায় বইপত্র বেরোতে থাকে। এটিই দার্জিলিঙের প্রথম ছাপাখানা যেখানে ইংরেজির বাইরে অন্য কোনো ভাষায় ছাপার কাজ শুরু হয়। তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম। এতগুলি স্থানীয় ভাষা এবং তার লিপির বৈচিত্র্য বিবেচনা করলে বলতেই হয় যে সেইসময়ে তা খুব সহজ কাজ ছিল না।

    দার্জিলিঙে স্কচ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা রেভারেন্ড উইলিয়াম ম্যাকফারলেন

    ধর্মগ্রন্থ ছাড়াও স্থানীয় ভাষার প্রাইমার, ব্যাকরণ ইত্যাদি জরুরি বইপত্র ছাপার দিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হত। মিশন প্রেস থেকে ছাপা রেভারেন্ড উইলিয়াম ম্যাকফারলেনের ‘Lepcha Primer’ (১৮৭৪), রেভারেন্ড আর্চিবল্ড টার্নবুলের ‘A Nepali Grammar’ (১৮৮৭) কিংবা ‘Notes on Tea in Darjeeling’ (১৮৮৮) ইত্যাদি বিবিধ বইয়ের নাম করা যায়। একাধিক পত্রিকাও এই সময়ে প্রকাশিত হয়েছে এই প্রেস থেকে। এ ছাড়াও নেপালি, ভুটিয়া প্রভৃতি ভাষায় নানা ছোটোখাটো ছাপার কাজও করা হত। বেশ বড়ো জায়গা নিয়ে চলা এই প্রেসটি তৎকালে যে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছিল, তা এদের মুদ্রণের বিস্তার ও আয়ের বহর থেকেই বুঝতে পারা যায়। প্রেসটি চালানোর ক্ষেত্রেও প্রধানত স্থানীয় খ্রিস্টানদের প্রশিক্ষিত করে নিয়ে কাজে লাগানো হত। এখানেই মুদ্রণে হাতেখড়ি হয় পাদরি গঙ্গাপ্রসাদ প্রধানের, পরবর্তীকালে যাঁর সুব্যাপ্ত কর্মকাণ্ডের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে দার্জিলিঙের উত্তরপ্রজন্মের আলোকপ্রাপ্ত মানুষজন।

    প্রেস-সহ মিশনের গোটা এলাকাটি ছিল চকবাজারের বেশ কিছুটা নীচে। সে-সময়ও বাইরে থেকে আসা মানুষজনের নজর চট করে ওই দিকে পড়ত না। স্কচ মিশনের নিরিবিলি চত্বরে মূল বাড়িটিরই নাম রাখা হয় ‘Lochnagar’। তারই একাংশে চলত চার্চের কাজ। এ থেকেই সংলগ্ন এলাকার নাম হয়ে যায় ‘লোকনগর’। সুদূর স্কটল্যান্ড ছেড়ে চলে আসা মিশনারিরা কীভাবে এখানে দিন কাটাতেন, তার বর্ণনা করতে গিয়ে রেভারেন্ড রবার্ট কিলগার দার্জিলিঙে বসে ভারি চমৎকার ঢঙে লিখছেন— এডিনবরা থেকে প্রকাশিত স্কটল্যান্ডের চার্চের ‘Home & Foreign Mission Record’-এর পাতায় সেটি বেরোচ্ছে ১৮৯০ সালের ১ এপ্রিল—

    I write from Lochnagar. Do you know where it is? “Oh yes,” you tell me, “a hill in Aberdeenshire.” So it is; but Lochnagar is also the name of your mission-house at Darjeeling, far away in India. There your missionaries live and carry on the mission for which you put your pennies into the Darjeeling Mission-Box. Would you like to hear about your own house, and what we do here?

    লোকনগর: স্কটিশ মিশনের সেই বাড়ি

    এই নিবন্ধ যখন লিখছেন কিলগার, তার মাস কয়েক পরই গভীর বিপদ ঘনিয়ে আসে লোকনগরের মাটিতে। কিছু সময় অন্তর নামতে থাকে একের পর এক ধস। মূল বাড়ি তো বটেই, প্রেস-সহ গোটা চত্বরটি প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়ে। পরিস্থিতি কোনো মতে ঠেকিয়ে রাখা হয়। একইসঙ্গে চলে নতুন জায়গার খোঁজ, তার জন্য অর্থ সংস্থানের প্রয়াস। বছর কয়েকের মধ্যেই বানস্টেড এলাকায় উঠে যায় স্কটিশ মিশন, গড়ে ওঠে পৃথক চার্চ ও নতুন ছাপাখানা। আগের প্রেসটি বিক্রি হয়ে যায়। ক্রমে দার্জিলিঙের ইতিহাসে এক বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায় হয়ে ওঠে উনিশ শতকের লোকনগর।

    এসবের ঠিক পরই, ১৮৯৪ সালে ‘শ্রীযুক্ত বাবু হরিনাথ চক্রবর্ত্তী মহোদয়’ সমীপে যখন ‘দার্জ্জিলিঙ্গ-প্রবাসীর পত্র’ লিখছেন শ্রীতারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, সেখানেও লোকনগর প্রসঙ্গে খুব আশাব্যঞ্জক কথা বলতে তাঁকে দেখা যায়নি— ‘লোকনগরের অবস্থা পূর্ব্বে জানিতে পারিলে প্রাণান্তেও তথায় যাইতাম না।’ তবু লোকনগর একেবারে মুছে হয়তো যায়নি; কিন্তু তা আজ এক অকিঞ্চিৎকর এলাকার নাম মাত্র। পার্বত্য দার্জিলিঙে সাক্ষরতা, শিক্ষা, সাংবাদিকতা, মুদ্রণ, এমনকী ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রসারেও একদা যার অবদান মাত্র দু-দশকের মধ্যে হয়ে উঠেছিল অতিগুরুত্বপূর্ণ।

    আজকের লোকনগর রোড

    পরের গ্রীষ্মে দার্জিলিং বেড়াতে গেলে মল রোডে ভিড় না বাড়িয়ে একটা সকাল অন্তত ইতিহাসের এই অপরিসর গলিটি দিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। ‘সাইট সিইং’ হবে না কিছুই, কিন্তু দেড়শো বছরের পুরোনো ঠাঁইনাড়া স্কটিশ পর্বতটির বিষয়ে নতুন কোনো তথ্যের হদিশ হয়তো মিলে যেতে পারে।

    ছবি সৌজন্যে : লেখক

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook