ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • জল মেশানো গপ্পো


    প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (April 21, 2023)
     

    হাকিম, হেকিম। পোটাটো, পটেটো। উচ্চারণের ওই সামান্য তফাতে কী যায় আসে? আসে, আসে, ZAনতি পারেন না। আগে একটা গল্প শোনাই। আজ থেকে হাজার তিন বছর আগের গপ্পো। ইথিওপিয়ার এক গ্রামে থাকতেন এক ভালমানুষ, নাম লোকমান। মানুষের চিকিৎসা করে বেড়ান তিনি। জ্বরজারি, খোসপাঁচড়া, অনিদ্রা, ভেদবমি— ছোটমেজো হেন রোগ নেই যা তিনি সারিয়ে তোলেননি। তাঁর আছে এক কালো নোটবুক, সেই নোটবুকে লিখে রাখেন সব ওষুধের দাওয়াই। আর অসুখ-বিসুখ না থাকলে গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে বসে মানুষদের সুন্দর সুন্দর নীতিকথা শোনান। কিন্তু ওভারঅ্যাচিভারদের যা চিরন্তন সমস্যা, তা থেকে লোকমানেরও নিস্তার নেই। নতুন কী, নতুন কী, করতে করতে শেষে অমরত্বের হদিশ খুঁজতে শুরু করলেন। অবশ্য গ্রামের লোকজনও ঝুলে পড়েছিল। ব্লিচ দিয়ে কোভিড সারানো যায় এসব সুলুকসন্ধান তো আর সেই আদ্যিযুগে ছিল না। আবার হররোজ আদার টুকরো আর ঈষদুষ্ণ গরম জলে হলুদ গুলে খেয়েও দেখা যাচ্ছে অমরত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। যাই হোক, বিস্তর খোঁজাখুঁজি করে শোনা গেল চুকুরোভা নামের এক জায়গায় পাওয়া যায় অমৃত-ওষধি। তখন অবশ্য সে জায়গার নাম চুকুরোভা ছিল না। চুকুরোভা তুর্কি শব্দ। তা সে জায়গার মানুষ যতই দিব্যি গালুন, তিন হাজার বছর আগে কোথায় বা তুরান, কোথায় বা তুরস্ক। অমৃতের সন্ধানে লোকমান বেরিয়ে পড়লেন। পাঁচ হাজার কিলোমিটার উজিয়ে চুকুরোভায় পৌঁছে একটা গাছের নিচে তন্দ্রিম আলস্যে ঝিমোচ্ছেন, এমন সময় দৈববাণী শোনা গেল, ‘রাজত্ব চাই না জ্ঞান?’ লোকমান ভেবেছিলেন অমৃতের সন্ধানে এসে বকরূপী ধর্ম যেমন কঠিন কঠিন প্রশ্ন যুধিষ্ঠিরকে করেছিলেন সেরকম কিছুর সামনে পড়তে হবে। তাই এরকম লোপ্পা বল পেয়ে একটু ঘাবড়েই গেছিলেন। ট্রিকি প্রশ্ন কি না ভাবতে ভাবতে সেফ অপশন হিসাবে বললেন, ‘অফ কোর্স, জ্ঞান।’ দেখা গেল আনাতোলিয়ান দেবতারা অত প্যাঁচপয়জার বোঝেন না। খুশি হয়ে জ্ঞান তো দিলেনই, উপরন্তু অমর হওয়ার হদিশও বাতলে দিলেন। লোকমানকে আর পাহাড়-জঙ্গল ঘুরে বিশল্যকরণী খুঁজতে যেতে হল না। তবে অমরত্বের রেসিপির ফর্দ বেশ লম্বাচওড়া। ভাগ্যে লোকমানের সঙ্গে সেই কালো নোটবুক ছিল।  

    নোট নেওয়া শেষ করে খুশি-খুশি মনে কিছুদূর এগোতেই সামনে পড়ল এক ব্রিজ। লোকমান দেখলেন, সেখানে ভারি বিরস বদনে অপেক্ষা করছেন মৃত্যুর দূত জিবরাঈল (বা গ্যাব্রিয়েল)। লোকমানকে দেখা মাত্রই জিবরাঈল তাঁর হাত থেকে কালো নোটবুকটা কেড়ে নিলেন। পাঁচ হাজার কিলোমিটার ঠেঙিয়ে এসেছেন শুনেও জিবরাঈলের বিশেষ তাপ-উত্তাপ দেখা গেল না। হুজুগে দেবতাদের বিলক্ষণ চেনেন তিনি। তাঁদের মর্জিমতন দুনিয়া চলতে দিলে দুনিয়া এতদিনে লাটে উঠত। লোকমানের অশেষ কাকুতিমিনতি সত্ত্বেও সে নোটবই জলে ভাসিয়ে দিয়ে মৃত্যুর দূত বিদায় নিলেন। অমরত্বের হদিশ আর মানুষরা পেল না বটে, তবে লোকমান বিস্তর জ্ঞান নিয়ে ফিরলেন। মোটের ওপর কালো নোটবইয়ের বাকি সব ফর্দফিরিস্তি মুখস্থই ছিল, সুতরাং আগের মতন রোগজ্বালার প্রশমনেও কমতি পড়ল না। আর হ্যাঁ, আগের মতনই নীতিকথার আসরও বসতে শুরু করল। তফাতের মধ্যে এবার লোকমান মনমাতানো সব গল্প বলতে শুরু করলেন, সেসব গল্পের মধ্যেই লুকিয়ে থাকল নীতিকথা।  

    তুর্কি এবং আরবি লোককথায় তাই লোকমান হাকিম-ও বটে, আবার হেকিম-ও। হাকিম, অর্থাৎ জ্ঞানী মানুষ। আর হেকিম অর্থে চিকিৎসক। শোনা যায়, বহু পরে ঈশপ লোকমানের ধারাটিই অনুসরণ করে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। দুর্জনে এও বলে, ঈশপের কিছু কিছু গল্প লোকমান হাকিমের গল্প থেকেই তুলে আনা, শুধু চরিত্র আর পটভূমি বদলে গেছে। যাই হোক, আজ ঈশপের কথা থাক। লোকমান হাকিমের গল্পে ফেরা যাক। জিবরাঈল দুর্ব্যবহার করলেও লোকমান কিন্তু সে ব্যবহার গায়ে মাখেননি। বরং তাঁর গল্পগুলোতে জিবরাঈল মাঝে মাঝেই ঢুকে পড়তেন। এরকমই এক গল্পে লোকমান শোনাতেন তাঁর নোটবুক জলে ফেলে দেওয়ার পর কী ঘটেছিল। জিবরাঈল চলে যাওয়ার পর লোকমান অবাক হয়ে দেখলেন, নদীর দু’পাড়ে আচম্বিতে সবুজের ঘনঘটা দেখা দিল। শুকনো বালুচরে কীভাবে যেন গজিয়ে উঠল অফুরন্ত সবুজ গাছপালা। হওয়ারই কথা, সেই নোটবইয়েই যে ছিল অমরত্বের হদিশ। যে-সে নোটবই তো নয়। তাই যে আধারেই পড়ুক না কেন, তার ভোল বদলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। 

    বলা বাহুল্য, লোকমান হাকিম একটি মিথিক্যাল চরিত্র। হয়তো লোকমান সত্যিই ছিলেন, কিন্তু জিবারাঈল আর ঈশ্বরের সংস্পর্শে এসে তাঁর লৌকিক সত্তাটি কখন যেন অতিলৌকিকে বদলে গেছে। হতে পারে লোকমানের বলা গল্পগুলো কোনও ব্যক্তিবিশেষের মনগড়া গল্প নয়, এসব গল্প গোষ্ঠীগত বুদ্ধিমত্তার ফসল। আদি-অনন্তকাল ধরে আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রকৃতি আর সমাজ-পাঠ থেকে যা শিক্ষা পেয়ে এসেছেন, তাকেই অক্ষয় করে রাখার এক অনন্য প্রচেষ্টা। জিবরাঈলের গল্প থেকে একটি বিষয় নিতান্তই স্পষ্ট হয়ে ওঠে— অমরত্বের সন্ধান ঈশ্বরের কাছে না পৌঁছেও পাওয়া যেতে পারে। জলের কাছে পৌঁছলেই হল। ‘জলই জীবন’ তো বটেই, কিন্তু এখানে কোনওমতে জীবনধারণের কথা হচ্ছে না। মানুষের মতন বেঁচে থাকতে হলে জলই আমাদের ভরসা। কীভাবে ভাল থাকব তার সুলুকসন্ধান দিতে পারে আমাদের জলসম্পদগুলিই।  

    এই সহজসরল প্রাচীন জ্ঞানটি মোটের ওপর সব ধর্মেই দেখা যায়। হিন্দু ধর্মেও যেমন দেখি ‘সরস্বতী’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ: যে নারী জল ধারণ করেন। সরস্বতী তিনিই— যাঁর জিম্মায় রয়েছে সসাগরা পৃথিবীর সমস্ত জলাশয়ের দায়িত্ব। সেই যে মিথিক্যাল নদী, তার নামও যে সরস্বতী, সে তো কাকতালীয় ঘটনা নয়। আধুনিক ভারত তার জলসম্পদ নিয়ে যা উদাসীন, তাতে সরস্বতীর আদি পরিচয়টি যে বিলুপ্ত হবে সে নিয়ে আর সন্দেহ কই! কিন্তু জাপানে যান, দেখবেন সরস্বতীর আদি পরিচয় এখনও অক্ষুণ্ণ। আমাদের সরস্বতীই বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারকদের হাত ধরে জাপানে পৌঁছে হয়ে গেছেন দেবী বেনজাইতেন। আমাদের সরস্বতীর মতনই তিনি বাগ্‌দেবী-ও। কিন্তু বেনজাইতেন তাঁর শিকড় ভোলেননি। তাঁর মন্দিরে, তাঁর উপচারসামগ্রীর মধ্যে তাই রয়ে গেছে অসংখ্য জলসংক্রান্ত মোটিফ। টোকিওর বেনজাইতেনের মন্দিরে যাওয়ার জন্য তাই আগে পেরোতে হয় পদ্মবন। তাঁর মন্দিরে ঢোকার পথে দেখা যায় কাঠের তৈরি জলাধার। সেরকম জলাধার অবশ্য বেনজাইতেনের মন্দিরের গর্ভগৃহেও থাকে, সঙ্গে থাকে ধাতুর তৈরি পদ্মফুল। এবং আকারে এই উপচারসামগ্রীগুলি সময়-সময় দেবীর মূর্তির থেকেও বৃহৎ। কে যে উপাস্য, আর কী যে উপচার, তা বোঝা মুশকিল।     

    লোকমানের গল্পে জলই যে অমৃত এহেন একটা ইঙ্গিত ছিল, তবে নেহাতই সূক্ষ্ম ইঙ্গিত। তুরস্কের পাশের দেশ পারস্যের অফুরন্ত গল্পে কিন্তু জলকে অমৃত বলা হয়েছে কোনও রাখঢাক না করে। এরকমই একটি লোকগাথা হল ‘আব-এ-জিন্দেগি’। আক্ষরিক অর্থে প্রাণের জল। তবে এই জিন্দেগির শেষ নেই, যে জল জীবনকে কোনওদিন নিঃশেষ হতে দেবে না তারই গল্প। এ গল্পের অন্যতম চরিত্র আলেকজান্ডার বা সিকন্দর। এ হল সেই সময়, যখন আলেকজান্ডার সদ্য পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত সোগদিয়া রাজ্য জয় করেছেন। প্রায় সাড়ে তেইশশো বছর আগের কথা। আজ অবশ্য সোগদিয়া বলে কিছু নেই। আজকের উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তানের বিভিন্ন অংশ জুড়ে ছিল সোগদিয়া রাজ্য। পারস্য সাম্রাজ্যের অন্য অঞ্চলের মতন এখানেও ঘোরতর যুদ্ধ করতে হয়েছে দিগ্বিজয়ী সিকন্দরকে। শুধু কি তাই? রাজ্য জয় করার পরেও বেয়াদব সোগদিয়ানরা থেকে থেকেই বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। শত্রু হলেও কাঁহাতক আর মুন্ডু কাটা যায়? আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীরও কম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। নিজের শরীরও আর দিচ্ছে না। পরেশান হয়ে একদিন সম্রাট ডেকে পাঠালেন সে অঞ্চলের সমস্ত প্রাজ্ঞ মানুষকে। ‘পারস্যে ঢোকা ইস্তক এই যে অমৃতকুম্ভের গল্প শুনছি, না কুম্ভ তো নয়, ফোয়ারা, সে কি সত্যি?’ শুধোলেন আলেকজান্ডার। প্রাজ্ঞ মানুষগুলি আড়চোখে একে অপরকে দেখে নিলেন। কিছুক্ষণ সাড়াশব্দ নেই। তারপর আলেকজান্ডারের গলা খাঁকরানি শুনেই হোক বা ‘সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র’ আপ্তবাক্যটি স্মরণ করেই হোক, দিলেন তাঁরা সে ফোয়ারার সুলুকসন্ধান বাতলে। আরও উত্তরে যেতে হবে। উজিয়ে অনেকটা পথ গেলে আসবে এক বিশাল ঝিল। সেই ঝিলের মাঝখানটি এক্কেবারে নিকষ কালো। সাহস করে সেই কালিমার মধ্যে ডুব দিলেই পাওয়া যাবে অমৃতের ফোয়ারা। পণ্ডিতদের কথা শুনে আলেকজান্ডার বেরিয়ে পড়লেন তাঁর সহচর খিজিরকে নিয়ে। সারাদিন ধরে বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও কিছু পাওয়া গেল না। আলেকজান্ডার রাগমাগ করে পথের ওপরেই বসে পড়ে ভাবছেন পণ্ডিত-মূর্খগুলোকে শূলে চড়াবেন না গর্দান নেবেন! প্রভুর মেজাজ চড়ছে দেখে খিজির সরে পড়লেন। মুখে বলে গেলেন, ডিনারের জন্য মাছ খুঁজতে যাচ্ছেন।

    ওই রুক্ষ, পাথুরে জায়গায় কোত্থেকে মাছ পেতেন খোদাই জানেন। কিন্তু অবিশ্বাসীদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে ঠিক দৈববাণী হল। শুধু বাণীই এল না, শোনা যায় আলোও দেখা গেল। সেই আলো ধরে ধরে পৌঁছে খিজির মাছ দেখতে পেলেন। আলোর ঝলকানিতে চোখে ধাঁধা লেগে গেছিল বলে প্রথমটা বুঝতে পারেননি, তার পরে একবারে চক্ষুস্থির। আরে, এ তো সেই অমৃত-ঝিল! খিজির মাছ তুলে দৌড়তে দৌড়তে আলেকজান্ডারের কাছে ফিরে এলেন। সম্রাট শুনে একটু বিস্মিত— সে কী রে, সারাদিন ধরে সারা তল্লাট চষে ফেললাম, আর তুই বলছিস এই হাতের কাছেই রয়েছে সেই ঝিল? অবিশ্বাসও করা যাচ্ছে না, খিজিরের হাতে ধরা মাছ। অতএব, দুজনে মিলে ফের বেরোলেন। এবং যা হওয়ার ছিল তাই হল। অর্থাৎ, সে ঝিল মোটেই খুঁজে পাওয়া গেল না।

    আলেকজান্ডার তারপর খিজিরের কী হাল করলেন সে কথা আর জানা যায় না, যদিও আইডিয়ালি খিজিরের বেঁচে থাকার কথা। অমৃতের ঝিল থেকে ভদ্রলোক নিশ্চয় শুধু মাছটা তুলেই চলে আসেননি, এক-দু’চুমুক জল নিশ্চয় খেয়েছিলেন। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল, আলেকজান্ডার কেন খুঁজে পেলেন না সে ঝিল? ঘটনাটা খুব একটা আশ্চর্যের নয় অবিশ্যি। যে পারস্য সাম্রাজ্য আলেকজান্ডার একার হাতে তছনছ করে দিলেন, সেখানকার লোকগাথা-প্রণেতারা তাঁর হাতে অমৃত-ও তুলে দেবেন? ইল্লি নাকি! স্বাভাবিক ভাবেই বলা হল, আলেকজান্ডার তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির কথা সারাজীবন ভেবে এসেছেন, অতএব মিরাক্‌লের আশা তাঁর এমনিতেই করা উচিত হয়নি। তবে পরবর্তীকালে ইসলামি সাহিত্যের পণ্ডিতরা দেখালেন আব-ই-জিন্দেগির গল্প অনেক পুরনো। আলেকজান্ডারের আগে থেকেও সে গল্প চলে আসছে। আলেকজান্ডারের এই ফিকশনাল আগমন নিতান্তই ঐতিহাসিক এক রসিকতা। এ গল্প আসলে পয়গম্বর ইলিয়াস এবং তাঁর পার্শ্বচর, আর এক পয়গম্বর খিজিরের (উচ্চারণভেদে খিদির বা খাদির)। দুই বন্ধু প্রতি বছর জেরুজালেমে যেতেন রমজান মাসটি উদযাপন করতে। ধর্মপ্রাণ দুই বন্ধুর প্রতি প্রসন্ন হয়ে ঈশ্বর তাঁদের দিয়েছিলেন অমৃতের সন্ধান।

    ইলিয়াস ও খিজির, আব-এ-জিন্দেগির পাশে
    (পঞ্চদশ শতকের চিত্রকলা, আফগানিস্থান)

    আব-এ-জিন্দেগি পাওয়ার পরেও দুই বন্ধু তাঁদের ধর্মচর্চা থামাননি। পারস্যের লোকগাথা জানায়, অমৃতের সন্ধান পাওয়ার পর তাঁরা জলপথেও ঘুরতে শুরু করেন। যেখানেই বিপদগ্রস্ত মানুষ তাঁরা দেখেছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। 

    সে সাহায্য বাংলাদেশ অবধি এসেছে! সত্যিই। সুন্দরবনের দু’দিকেই মাঝিরা এখনও বিপদসঙ্কুল জলে নেমে গান ধরেন, ‘আমরা আছি পোলাপান/ গাজী আছে নিঘাবান/ আল্লা নবী, পাঁচপীর/ বদর বদর।’ সেই কবে মীর মোশারফ হোসেন তাঁর ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ বইতে লিখেছিলেন, ‘মাঝিরা লগি উঠাইয়া ‘দরিয়া গাজী পাঁচ পীর বদর বদর’ বলিতে বলিতে নৌকা জলে ভাসাইয়া দিল।’ কে এই পীর বদর? ‘বদর’ শব্দটি আসলে আরবি শব্দ ‘খিদির’ বা ‘খাদির’-এর অপভ্রংশ। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যোগসূত্রটি। একটু আগেই জানিয়েছি আরবদেশের খিদির আসলে পারস্যের খিজির। পীর বদর অবশ্য সর্বত্র বিরাজমান। সেই সুদূর পঞ্জাবের লোকগাথাতেও খিজির আছেন। সে গল্পে খিজির যদিও মুখ্যচরিত্র নন। 

    সাপেদের রাজা বাসুকির মেয়ে ছিলেন নিওয়াল দাই। তিনি অবশ্য অসূর্যম্পশ্যা, বাবা বাসুকি আর মা পদ্মা ছাড়া তাঁকে কেউ দেখেননি। কিন্তু তাতে জনশ্রুতি থামেনি, বরং বেড়েছে। নিওয়ালের রূপের আখ্যান শুনে দৌড়ে এসেছেন পাণ্ডব বংশের রাজা পরীক্ষিৎ, এবং বাহুবলে বাসুকিকে বাধ্য করেছেন নিওয়ালের সঙ্গে পরীক্ষিৎ-এর বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিতে। বাসুকি বিস্তর অপমানবোধ করেছেন, কিন্তু তিনি জানেন পাতালের যে অন্ধকার মহলে তাঁর মেয়ে লুকিয়ে আছেন, সেখানে পৌঁছনো পরীক্ষিৎ-এর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু বিধি বাম। বাসুকির সাপেরা স্থানীয় এক সাধুর গোশালা আক্রমণ করলে, সাধুর অভিশাপে বাসুকির হল কুষ্ঠ। আর সেই কুষ্ঠ সারিয়ে তোলার জন্য কী চাই? আর কী, আব-এ-জিন্দেগি। পঞ্জাবি লোকগাথায় অবশ্য সে অমৃতের অন্য নাম। কিন্তু আব-এ-জিন্দেগির অধীশ্বর এখানেও সেই খিজির পীর। অমৃতের সন্ধানে যাঁর কাছে যাওয়ার জন্য রাজকুমারী নিওয়ালকে পাতাল থেকে বেরোতেই হয়। বাসুকি সেরে ওঠেন, কিন্তু পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুসারে নিওয়ালকে আত্মসমর্পণ করতে হয় পরীক্ষিৎ-এর কাছে।

    নিওয়াল এবং পরীক্ষিৎ
    (কাংরা শিল্প, হিমাচল প্রদেশ)

    পরীক্ষিৎ-নিওয়ালের গল্প শিশুতোষ রূপকথা নয়। বিখ্যাত শিল্পসমালোচক আনন্দ কুমারস্বামী, নিওয়ালের আত্মসমর্পণকে এক হিসাবে ধর্ষণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু এ গল্প একমাত্রিক নয়। এ গল্প আমাদের অনেককেই হয়তো রাজা যযাতি এবং তাঁর ছেলে পুরুর গল্প মনে করিয়ে দেবে। বাবা যযাতির ইচ্ছাপূরণ করতে পুরু নিজের যৌবন তাঁকে দান করেছিলেন। মনে রাখা ভাল আব-এ-জিন্দেগি-কে বহু ইসলামি সাহিত্যে অক্ষয় যৌবনামৃত বলা হয়েছে। নিওয়াল-ও তাঁর বাবা বাসুকিকে অনন্ত যৌবন দান করেছেন, এবং পুরুর মতনই তাঁকেও সেই যৌবন পেতে হয়েছে চরম এক মূল্যের বিনিময়ে।  

    লোকগাথায় নিওয়াল এক অন্ধকার জগৎ থেকে আলোয় ঢুকছেন। কিন্তু নিওয়ালের দিক থেকে দেখলে হয়তো উল্টোটাই ঘটেছে। তাঁর অস্তিত্বকে স্রেফ পেশিবলে নস্যাৎ করে দিয়ে পরীক্ষিৎ তাঁকে নিয়ে চলে গেছেন। এই যে অন্ধকার থেকে আলো বা আলো থেকে অন্ধকারে যাত্রার সময় খিজিরের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, এর মধ্যেও লুকিয়ে আছে এক রূপক। কারণ পারস্যের লোকগাথায় খিজির ‘আছি’ আর ‘নেই’ এই দুই জগৎ-এই বাস করেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে মোলাকাত হওয়ার জন্য ‘আছি’ থেকে ‘নেই’ হওয়াটা জরুরি। কিন্তু ‘নেই’ মানে নেহাত মৃত্যু নয়। সুফি ধর্মাবলম্বীরা যেমন বিশ্বাস করেন ব্যক্তিচিন্তা ছাড়তে পারলে, ক্ষুদ্রস্বার্থ ছাড়তে পারলেও ‘নেই’ হওয়া যায়। আলেকজান্ডারের কথা মনে পড়ছে? তিনি কিন্তু ‘নেই’ হতে পারেননি। যিনি আছেন কিন্তু নেই, তিনি এক হিসাবে চিরযৌবনসম্পন্ন। এদিকে মজা দেখুন, আরবি শব্দ খিদরের আক্ষরিক অর্থ হল সবুজ রং। লোকগাথা অনুসারে অমৃতপান করা ইস্তক খিজিরের শরীর থেকে এক দিব্য আভা বেরোতে থাকে, যার রংটি সবুজ। লোকমান হাকিমের গল্পটিও মনে করে দেখুন। জল বর্ণহীন হলেও জল প্রাণদান করে, নিয়ে আসে সবুজ রং। এ এক অব্যর্থ দ্যোতনা।  

    জলের কিস্‌সা শেষ হওয়ার নয়। পি সি সরকারের ‘ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া’-র মতনই সে গল্প অনবরত উপচে পড়বে। কিন্তু জাদুকরদেরও থামতে হয়। আর একটা গল্প বলে তাই শেষ করি। মক্কা আর মদিনা দুটো শহরই যে অঞ্চলের মধ্যে পড়ে তার নাম হেজাজ। শুকনো খটখটে জায়গা। মাটির ওপরে জল প্রায় নেই। ভূগর্ভস্থ জল নিয়েই সারাক্ষণ টানাটানি। তা হাজার হাজার বছর ধরে হেজাজ-এ অনেক কুয়ো খোঁড়া হয়েছে। সব কুয়োর কথা হেজাজের মানুষরাই মনে রাখেননি। কিন্তু একটি কুয়োর নাম ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে আছে। নাম তার জমজম। জমজমের জলের মতন পবিত্র জল ইসলামি দুনিয়ায় আর নেই। মক্কার সেই বিখ্যাত আল-হারাম মসজিদের (যার ভেতরে রয়েছে কাবা) পাশেই ছিল জমজম, যার জলধারা অমর, অক্ষয়। পয়গম্বর ইব্রাহিম (ক্রিশ্চান এবং ইহুদিরা যাঁকে আব্রাহাম বলে ডাকেন) যখন মক্কার শুষ্ক মাটিতে এক ফোঁটা জল তাঁর ছেলের মুখে তুলে দেওয়ার জন্য খুঁজে পাচ্ছিলেন না তখন ঈশ্বরকৃপায় জমজমের মুখ খুলে যায়। লোকমান হাকিমের গল্পের সেই জিবরাঈলকে মনে আছে তো? তিনিই খুলে দিয়েছিলেন সেই অলৌকিক কুয়োর মুখ। যে কুয়োর জল ধরে রাখতে ইব্রাহিমের স্ত্রী হাজেরা নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘জম জম’, অর্থাৎ কিনা ‘থাম থাম’।  

    জলের সঙ্গে জিবরাঈলের এই সম্পর্ক নেহাত কাকতালীয় নয়। বাইবেলেও আমরা দেখি গ্যাব্রিয়েল এক কুয়োর কাছে এসে মেরিকে জানাচ্ছেন যিশুর আগমনবার্তা। ধার্মিক দ্যোতনায় জল আসলে এক শক্তি। আর সেই শক্তির দায়িত্বে রয়েছেন জিবরাঈল বা গ্যাব্রিয়েল। শক্তির বহিঃপ্রকাশেই দেখি নদীর দু’পাশ সবুজ হয়ে ওঠে, দেখি মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে জল। জমজম সম্ভবত সেই শক্তি সংরক্ষণের প্রতীক। অফুরন্ত জলের রূপক স্রেফ সঞ্চিত জলের পুনঃ পুনঃ ব্যবহারপদ্ধতিটিই তুলে ধরে। মক্কার পাহাড় এবং উপত্যকা জলের এই সঞ্চয় আর সংরক্ষণে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। 

    লোকমান, খিজির, ইব্রাহিম— সবার গল্পই নীতিকথাপ্রধান। আমাদের যুক্তিবাদী মন, বিজ্ঞানসচেতন প্রাণ সে সব গল্পকে খানিক লঘু চালেই দেখতে চাইবে। কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় এই সব গল্প থেকে প্রাপ্তিযোগও নেহাত কম নয়। ধর্মচেতনার যদি দরকার নাও থাকে, আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যচেতনার জন্যও গল্পগুলির অসামান্য ভূমিকা আছে। আমাদের আদিপুরুষদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনে পৃথিবীর জলসম্পদ যে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল, তা এই লোকগাথাগুলি স্পষ্ট করে দেয়। উষ্ণায়িত পৃথিবীর ঘোরতর দুঃসময়ে নিজেদের শিকড়ের কাছেই ফেরত যাওয়া যাওয়াটা বড় জরুরি— জলের গল্প, জলের গান তাই জারি থাকুক।  

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook