সঙ্গে কেন নিলে?
গলায় গড়ি দিলেন বড়বাজারের ব্যবসায়ী বিজয় চ্যাটার্জি, তাঁর স্ত্রী রাণু, এবং তাঁদের মেয়ে ঐন্দ্রিলা। বাড়ির তিনটে ঘরে তিনটে ফ্যান থেকে তাঁদের ঝুলতে দেখা যায়। তিনজনেই একই রকমের দড়ি ব্যবহার করেছেন। বিজয়ের বয়স ৫৬, রাণুর বয়স ৪৬, আর তাঁদের সন্তান ঐন্দ্রিলার বয়স ২১। খবরটা খুব বিস্ময়কর নয়, কোভিড কত মানুষকে ভিত্তিচ্যুত করল, এখন আবার অর্থনৈতিক মন্দা, জানা যাচ্ছে বিজয় বহু রকমের ব্যবসার চেষ্টা করেছেন, কোনওটাই দাঁড়ায়নি, ধার হচ্ছিল বাজারে, বাড়িভাড়া বাকি পড়ছিল। হয়তো তাই এই সিদ্ধান্ত।
যে সমাজে একটি গোটা পরিবার খেতে না পাওয়ার ভয়ে এভাবে নিজেকে লুপ্ত করে দেয়, তা অভিশপ্ত ও অভিযোগযোগ্য তো বটেই, কিন্তু সে বৃহৎ যাচাই-কাণ্ডে না গিয়ে, আমরা ক্ষুদ্র প্রশ্নে মন দেব। ঠিক, ঐন্দ্রিলা এবং তার মা-বাবা একই ডুবন্ত নৌকোয় যাত্রী, কিন্তু সে যৌবনের বিশ্বাসধর্মেও ভাবেনি, আমি ঠিক টিকে যেতে পারব? বেঁচে থাকলে কিছু না কিছু ভাল ঘটে যাবেই? না কি ভেবেছিল, বাবা-মা বিহনে বেঁচে লাভ নেই? বা, বাবা-মা স্বেচ্ছায় পৃথিবী থেকে চলে গেলে, সেই স্মৃতির ভল্ল তার বাকি জীবন এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে? কিন্তু মা-বাবাও রাজি হলেন এই চুক্তিতে যে, ২১ বছর বয়সেই সে তার জীবনকে শেষ করে দেবে? যে কোনও মানুষের মৃত্যুই দুঃখের, তাঁর বয়স যতই হোক, ৮৬ বা ৯৪, আর এই যুগে তো একজন ৫৬ বছরের লোককে আদৌ বুড়ো ভাবা হয় না, ৪৬ বছরের মহিলাকেও, কিন্তু ২১-টা বড্ড কম না? দম্পতি হয়তো ভাবতে পারতেন, ওকে কোনও ছুতোয় বাইরে পাঠিয়ে (যা না, কদিন মামাবাড়ি থাকবি, বা আজকের দিনটা নিউমার্কেট সিনেমা রেস্তরাঁ ঘুরে আয়) নিজেরা এই কাণ্ড করবেন। না কি মেয়েই জেদ ধরেছিল, ওঁদের পরিকল্পনা জানতে পেরে? তাঁরা ফিসফিস করে পাশের ঘরে সর্বনাশা বাক্য বলছিলেন এবং সে শুনে ফেলেছিল? তাঁরা ডাইনিং টেবিলে হাউহাউ কাঁদছিলেন এবং সে কিছুক্ষণ কাঠের মতো বসে থেকে নিজেকেও তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল? অথবা সে-ই প্রথম কথাটা পাড়ে, মুখ থেকে কাঠকয়লার মতো ভয়াল সমাধানটা উগরে দেয় বেপরোয়া টোনে? বা, মা-বাবা আত্মহত্যা করেন এবং সে কিছুক্ষণ পরে সেই পথই বেছে নেয়? একইরকম দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করার মধ্যে একটা চুক্তির আভাস আছে। পরাজয়ের পর একই গর্ত বেছে নেওয়ার মধ্যে সহ-খেলোয়াড়োচিত কামারাদারি আছে। চলো, আমরা বাঁচলে একসঙ্গে বাঁচব, মরলেও একসঙ্গে— বলার মধ্যে ঐক্যের জোর রয়েছে। কিন্তু সেই হাওয়ার মহিমা পালে লাগিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হচ্ছে, তখন বেশিবয়সিদের কি দায়িত্ব বর্তায় না, কমবয়সিদের এই ফাঁস থেকে মুক্তি দেওয়ার? অন্তত গণিতের গৎ-এ ভাবার: ওর জীবনের অনেকটা সামনে পড়ে আছে, আমাদের তুলনায় ওর ভোগের মাত্রা বড্ড কম, ওর আখ্যান এখনই না মুড়িয়ে দেওয়া ভাল? একটা পরিবারের প্রধান দুজন— স্বামী ও স্ত্রী— যখন এই ভয়াল সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা নিজের সন্তানকে (বা সন্তানদের) কি শামিল করতে চান আঁধার-যাত্রায়? হয়তো প্রথমটায় না, পরে হয়তো ভাবেন, ওকে কে দেখবে? কী হবে ওর? তার চেয়ে ও-ও শেষ হয়ে যাক। জীবন্মৃত হয়ে থাকার চেয়ে, অশেষ অপমান ও নিগ্রহের জীবন যাপনের চেয়ে, সমাপ্তি ভাল। কিন্তু নিজের অবসান চাওয়ার অধিকার যেমন মানুষের আছে, অন্য কারও, বিশেষত সন্তানের প্রাণ মটকে দেওয়ার অধিকার তো নেই। তাহলে কি যখন সপরিবার আত্মহনন হচ্ছে, পরজন্মে একসঙ্গে নতুন জীবন শুরু করার একটা আশা ধকধক করছে? তিনটি আত্মা একত্রে থাকলে ঈশ্বর তাদের ফের আগামী অধ্যায়ে একত্রই করবেন, এই সমীকরণ কাজ করছে? নতুন করে শুরু করার এই অভিযানে কাউকে পিছনে ফেলে না যাওয়ার আঁট-বন্ধনই বিকিরিত হচ্ছে?
রাজস্থানের নর্মদা ক্যানালে একটি পরিবারের সাতজন ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করলেন, তাঁদের ছজনের হাত পরস্পরের হাতের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। মৃতেরা হলেন শঙ্করারাম (৩২), তাঁর স্ত্রী বদলি (৩০), তাঁদের সন্তান রমিলা (১২), প্রকাশ (১০), কেগি (৮), জানকী (৬) এবং হিতেশ (৩)। কেউ বলেছেন দম্পতির মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হত, কেউ বলেছেন কিছু মানুষ কদিন ধরে তাঁদের হ্যারাস করছিলেন, তা নিয়ে দুদিন আগের এক পঞ্চায়েত সভায় আলোচনা হলেও কোনও মীমাংসা হয়নি, তাই তাঁরা হয়তো এই কাণ্ড করেছেন। হতে পারে, কিন্তু আমাদের নজর পাঁচ সন্তানের দিকে, তাদের জ্যেষ্ঠাটির বয়স ১২, ফলে নিজেরা এ কাজে সচেতন সম্মতি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ৩২ ও ৩০ বছর বয়সি দুজন লোক ঠিক করলেন আর অশান্তি বা অত্যাচার সইতে পারছেন না, মরে যাবেন, তা বলে হাতগুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে ১২, ১০, ৮, ৬, ৩ বছরের সন্তানদের নিয়ে গেলেন? ওদের দেখার কেউ যদি না-ও থাকে, যদি লাথিঝ্যাঁটা খেয়েও বাঁচতে হয়, তা-ই নয় বাঁচবে। তিন বছরের একটা বাচ্চাকে তুমি মেরে ফ্যালো কোন প্রাণে? পাঁচটা শিশু অপার ভরসায় পরম নির্ভরতায় বাপ-মা’র সঙ্গে রাত্তিরবেলা একটা জায়গায় চলে গেল, হয়তো ভাবছে মেলায় যাচ্ছে বা নৈশ পিকনিক, আর আচমকা জলে পড়ে হাঁকপাঁক করতে করতে দম বন্ধ হয়ে হাবুডুবু খেয়ে মরে গেল? এখানে বাবা-মা অবিকল জল্লাদের ভূমিকা পালন করলেন না কি? আত্মহননের সময় একজনের (বা দুজনের) সমস্ত নীতি বিপর্যস্ত হয়ে যাবে, এমনকি নিজের সন্তানকে সে হত্যা করবে, আর সে নিজেও মরে গেল বলে তাকে অভিযুক্ত করা যাবে না, এ বিচার-ছাড় সে পেতে পারে? ধর্ম বা কাল্ট-এর কারণে অনেক সম্মিলিত আত্মনাশের কথা আমরা পড়েছি শুনেছি, সেখানে কোনও ধর্মগুরুর বা লালিত সংস্কারের সম্মোহনী শক্তির খেলা থাকে, পরজীবনে দুরন্ত প্রাপ্তির লোভও কাজ করে, কিন্তু জীবনের নাগাড় মার না সইতে পেরে যে লোকটা বিষ খাচ্ছে বা ঝাঁপ দিচ্ছে, সে কেন অন্যকে নিজের গিঁট্টুতে খাবলে আকচে থাবিয়ে নিচ্ছে? এমন হতে পারে জীবনসঙ্গীকে সে বলল, চলো, আমাদের সংসার ভেসে যাচ্ছে, কোনও ত্রাণ নেই, আমরা একটা কর্কশ দাঁড়ি টেনে দিই, আর তারা দুজন যেহেতু বহু সুখ বহু দুশ্চিন্তার ঝালাইয়ে একীভূত হয়েছে বলে মনে করছে, সিদ্ধান্তটা ব্যক্তিগত থেকে যুগল-বন্দোবস্তে পরিণত হল, কিন্তু কোন বিবেকহীন শিথিলবোধ বিবেচনায় সন্তানদের সে (বা তারা) দলে নিচ্ছে আর কোতল করছে? মগজ ধোলাই করে তাকে বিষ খেতে বা ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়তে প্রণোদিত করেই হোক, আর নড়া ধরে টানতে টানতে নিয়ে হড়াস করে আগুন বা জলে ঠেলে দিয়েই হোক, অন্যকে মেরেছ মানে তুমি হত্যাকারী। তোমার বিষাদের মাত্রা যতখানিই থাক, এই দায় তোমায় নিতে হবে।
অনেকে আত্মহত্যার সময় আক্রোশের বশে চারপাশে যতজনকে পারে মেরে ফ্যালে। যেমন বেঙ্গালুরুর ৩২ বছর বয়সি নগেন্দ্র আত্মহত্যা করার আগে (পারেনি, কব্জির শিরা কেটে ফেলে এবং গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েও নিজে মরতে ব্যর্থ হয়েছে) তার ২৭ বছর বয়সি স্ত্রী ও ক্লাস-টু এবং কেজি-তে পড়া দুই মেয়েকে খাবারে ইঁদুরের বিষ মিশিয়ে খুন করেছে। তার ক্যানসার হয়েছিল, সেই কষ্ট সহ্য না করতে পেরে সে, তার প্রতি যত্ন সেবা প্রেম নিয়ে যারা নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিল, তাদের নিকেশ করে দিল। ২০১৫ সালে এক কো-পাইলট প্লেনটা নিয়ে পাহাড়ে ঝাঁপ দিয়ে নিজে মরে গেল, প্লেনে থাকা সমস্ত লোককেও মেরে ফেলল। আমেরিকার স্কুলে নিরীহ ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের ওপর খামকা গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যার পর নিজের কপালে নল ঠেকিয়ে মরে যাওয়াকেও আমরা এই হনন-কাম-আত্মহননের তালিকায় ফেলতে পারি।কিন্তু সাধারণত পরিবারসুদ্ধু মরে যাওয়াকে হত্যা হিসেবে দেখা আমাদের স্বভাব নয়, কারণ সেখানে সকলের সায় আছে, নিরুপায় পরিস্থিতির সাদৃশ্য আছে। এতে কোনও সন্দেহই নেই যে সন্তানদেরও সঙ্গে নিয়ে মরার সিদ্ধান্ত যে নিচ্ছে তার প্রকাণ্ড কষ্ট ধারণাতীত, কারণ সে শুধু নিজেকে নয়, তার অতি প্রিয় ঘনিষ্ঠ এবং শরণাগতদেরও— যাদের জড়িয়ে স্বপ্ন দেখে এসেছে ও যাদের জন্য আত্মত্যাগ করেছে বহুকাল— শেষ করতে বাধ্য হচ্ছে, এ যেন নিজেকেই চারবার পাঁচবার মারা। এর সঙ্গে অপরিচিত ১৫০ প্যাসেঞ্জার বা ২৫০ পথচারীকে খুন কিংবা ৩৫০ গুরুভাইয়ের সঙ্গে একযোগে বিষপান কক্ষনও তুলনীয় নয়। কিন্তু নিজে ছাড়া অন্য যে কোনও লোককে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে দায়িত্ববোধের লঙ্ঘন আছে, আর অপ্রাপ্তবয়সিদের জীবন শেষ করতে বলা বা সে-কাজে সহায়তা করা তো প্রবল অপরাধ, কারণ সে তো সম্মতি দিতে পারে না, বা না-বুঝে সম্মতি দেয়। যদি আমি তিন বছর ছ’বছর আট বছরের বাচ্চাদের হাতগুলো এর-ওর সঙ্গে বেঁধে জলে ফেলি, যাতে কোনওভাবেই তারা বাঁচতে না পারে, আমি ডুবলে প্রত্যেকে ডোবে, তাহলে আমি অবশ্যই খুনি। যদি ২১ বছর বয়সি মেয়েকেও আমি বারবার স্বহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে বিরত না করার চেষ্টা করি (বিজয়বাবুদের ঘটনার ক্ষেত্রে এ বিষয়ে আমরা জানি না, হয়তো বাবা-মা তা করেছিলেন, সেক্ষেত্রে তাঁদের দায় থাকে না) তাহলেও আমি হত্যা-সহযোগী। আত্মহত্যা আমাদের চারপাশের বেঁচে থাকার ও বাঁচতে চাওয়ার অনন্ত স্রোতের মধ্যে এক দগদগে ব্যত্যয়, সে যখন একাধিক লোক মিলে হয়— তা বিশালতর ধাঁধা, কিন্তু গোটা পরিবার মিলে স্বেচ্ছায় মারা যাওয়ার মধ্যে গুরুজনদের তরফে বিশ্রী দায়-অস্বীকার আছে, ‘ধুর, জীবন থেকেই যখন বেরিয়ে যাচ্ছি, নীতির তোয়াক্কা কে করে!’ আলগা-পনা আছে, অন্যের চরম ক্ষতির প্রতি কুচ্ছিত অবহেলা আছে। সে লোকটা (বা লোক দুজন বা তিনজন) তুমুল ট্র্যাজেডির প্রজা হওয়া সত্ত্বেও, সমর্থনযোগ্য নয়।