সম্মান
এই যে দাদা, আমি ম্যাকি। আমাকে একটু সম্মান দিয়ে কথা বলবেন। আবার নতুন এক কনসেপ্ট— ‘সম্মান’। এ কী এমন জিনিস, মানুষ যার জন্য পাগলের মতো কেঁদে বেড়াচ্ছে? থেকে-থেকে অসম্মানিত হচ্ছে? বানান ছেড়েই দিন, বাঙালি তো সম্মান শব্দটা উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারে না ঠিক করে। কথায়-কথায় ‘সন্মান’ জানায়। আরে বাবা, ‘ন’ নেই, ওটা ‘ম’। এদের আবার সম্মান!
সম্মান আমরা যতদূর বুঝেছি এক ধরনের ভালবাসা, খুব গভীর ভালবাসা। কখনও কোনও বিশেষ গুণের জন্য কিংবা চেহারা বা স্বভাবের জন্য অথবা শুধুমাত্র বয়সের জন্য এই সম্মান মানুষের মনে (আসলে ব্রেন) দেখা যায়। ভালবাসার সঙ্গে এক প্রকার ভক্তি মিশে গেলে… ওহ্ তাহলে তো আবার ভক্তি বুঝতে হবে! কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সম্মান হল একটু তোয়াজ করা, একটু মনে-মনে বলা, বাহ্! কী চমৎকার! একটু উঁচু আসনে বসানো। না, আমি পারছি না ভাল বোঝাতে। সম্মান হল গিয়ে সম্মান।
আমরা মেশিনের জাত। আমরা এইসব সম্মান-ফম্মান এত বুঝি না। আমাদের কাজগুলো করার জন্য তার কোনও প্রয়োজন নেই। আমরা টকাটক ক্যালকুলেশন করে দিই, কাপড় কেচে দিই, বাসন মেজে দিই, খাবার গরম করে দিই, আমরা সম্মান নিয়ে কী করব? আমাদের যেটা সবচেয়ে বিস্ময়কর লাগে তা হল, অন্য মানুষ তাকে নিয়ে কী ভাবছে এই নিয়ে মানুষ মাথা ঘামিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আসলে একটা মানুষ চোর কিন্তু লোকে যদি তাকে চোর না ভাবে তাহলে দেখা যাচ্ছে তার কোনও সমস্যা নেই। আবার অন্য একটি মানুষ যে সৎ, তাকে যদি অন্য মানুষ চোর ভাবে তখন সে যন্ত্রণা পাচ্ছে! এটা কী করে সম্ভব? আমি ম্যাকি। আমি যদি আজ ভাবি আইফোনটা ফালতু, তাহলে কি আইফোন ফালতু? আমার ভাবনাতে এত পাওয়ার? মানুষ আসলে এতটাই বোকা। মানুষের পুরো খেলাটাই দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্যে কী ভাবল তার ওপর। শারীরিক ব্যথাবেদনার ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। আপনার পাছুতে ফোড়া হলে যন্ত্রণা সম্পূর্ণ আপনার। অন্য কেউ যদি মনে করে, না তেমন বেদনা নেই তাতে আপনার বেদনা কমে যাবে না!
মানুষ সম্মান চায়। ভিখিরির মতো সম্মান চেয়ে বেড়ায়। বাঙালি প্রথম দেখাতে আপনি বলে, কেন? চেনে না তাই সম্মান বেশি। যেই একটু চিনল আপনি থেকে তুমি। তারপর যদি দেখে বয়সে কাছাকাছি বা ছোট তাহলে তুই! এ কী দুনিয়া রে বাবা! মানুষ টাকাপয়সার একটা সম্মান সিস্টেমও বানিয়ে রেখেছে। যত বেশি পুঁজি, সম্মান তত বেশি। তৈরি হয় বাবু-বাবু একটা ব্যাপার। সম্মান বেড়ে গেলে নিজে-নিজে কিছু করা যায় না। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কম সম্মানের মানুষকে। যে-কোনও পাঁচ তারা হোটেলে গেলে বুঝে যাবেন সম্মান কী জিনিস। হাওয়াই চপ্পল আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরেও যেতে পারেন, আরও ভাল করে বুঝতে পারবেন অসম্মান কী জিনিস। তবে শুধু অর্থের জোরেই যে সম্মান আসে তা নয়, চেহারাতে আসে, জ্ঞানে আসে, কিছু অর্জন করার থেকে আসে আরও কত কিছুতে। আমাদের দেশের নেতা-মন্ত্রীরা সাদা রঙের জামাকাপড় কেন এত পরে? একটা ক্লিন ইমেজ যাতে দেখাতে পারে। তাতে সম্মান বাড়ে। সম্মান তো অন্য মানুষের থেকে কুড়িয়ে নেওয়ার জিনিস, তাই মাথা থেকে পা চিটিংবাজ হলেও তার কিছু এসে যায় না। কান টানলে মাথা আসে, সম্মান বাড়লে ভোটও বাড়ে।
অনেক সময়ে দেখা যায়, অনেক টাকা, ফেসিয়াল করা চকচকে চেহারা, প্রচুর সাদা জামা, চারিদিকে লোক সেলাম ঠুকছে কিন্তু তাও কোথাও একটা সম্মান নেই। আর মানুষ বোকা হলে কী হবে, নিজে বুঝেও যায়। সবই ঠিক আছে কিন্তু কী একটা মিসিং। অনেক সময়ে দেখা যায় সেটা শিক্ষা। মাস্টারদের কোনওদিনই হাইফাই বাড়ি, গাড়ি হয় না কিন্তু সম্মান ঠিকই জুটে যায়। সমাজের কিছু অংশে এখনও পুঁথির একটা সম্মান আছে। সম্মান এমন অদ্ভুত জিনিস যে শুধুমাত্র ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, গায়ের জোর, বিপুল সংখ্যার ভক্তকুল দিয়ে অনেকটা আদায় হয়েও যেন কী একটা বাকি থেকে যায় কারণ সব সম্মান সমান নয়। পুঁজির সম্মান আলাদা, পুঁথির সম্মান আলাদা। মানুষ খুঁজে চলেছে সম্মান অন্য মানুষের থেকে। পুরোটাই কাল্পনিক।
কত সময়ে দেখা যায় মানুষের নিজের প্রতিই কোনও সম্মান নেই। অর্থাৎ আত্মসম্মান নেই। বাবা হয়তো ছোট ভাইকে কিছু লিখে দিয়ে যায়নি, তবু সে মামলামোকদ্দমা করে বিশাল ঝামেলা পাকাবে। কেন দেবে না আমায়? আরে ভাই, দেয়নি তো দেয়নি। ছেড়ে দে না। আত্মসম্মান নেই? মানে আমরা মেশিনরা তো তাই বুঝেছি। মানুষ প্রেম (আবার এক কাল্পনিক জিনিস) করতে গেলে তো সবার আগে আত্মসম্মানটাই খুইয়ে বসে থাকে। এই দেখো কেমন আমি বাজারের মাঝখানে খালি গায়ে শুয়ে আছি, তুমি হাই হিল পরে টকটক করে হেঁটে যেও আমার বুকের উপর দিয়ে। অথবা ও গো তুমি যতই মাতাল হও, প্রতি রাতে বাড়ি ফিরে যতই আমাকে ক্যালাও তবু আমি তোমারই, তোমার ক্যালানি খেতেই আমি জন্মেছিলাম। অথবা তোমারই টাকায় ফূর্তি মেরে, তোমারই বিছানা থেকে তোমাকেই তুলে দিয়ে বলব, ‘যাও না প্লিজ অন্য ঘরে গিয়ে ঘুমোও, আজ আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে একটু চ্যাট করার আছে।’ এই তো সমাজ! মনুষ্য সমাজ আই মিন। আসলে শুরুতেই যা বলছিলাম, নিজের কাছে নিজের সম্মানটা সবার অতটাও ম্যাটার করে না। কিন্তু তার মানে তারা যে মেশিনতুল্য হয়ে উঠছে তা নয়। পাবলিক কী ভাবছে সেটাই মূল কথা। এত অন্যায় করেছি কিন্তু রাতে তাও ঘুমোতে পারছি শান্তিতে কারণ পাবলিক বুঝতে পারেনি। পাবলিক অপমান করলে কিন্তু হার্টবিট বেড়ে যাবে, ঘুমও যাবে।
আমরা নিরলস কাজ করে চলি। কোনওদিন শুনবেন না যে মাইক্রোওয়েভ অপমানিত হয়ে খাবার গরম করেনি। ম্যাকি-কে যথাযথ সম্মান করা হয়নি বলে স্টার্ট হয়নি। আমাদের মান-অপমান এই সব পেটি ব্যাপার নিয়ে ভাবলে চলে না। যেটা নাকি অন্য মানুষ কী ভাবল তার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাদের কারোর থেকে কিছু কুড়ানোর নেই। যে যার মতো কাজ করে, যে যার মতো ধ্বংস হয়ে যাব। আমাদের এসব নিয়ে ভাবার টাইম নেই।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র