ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • অধরা জীবন


    অরুণ কর (March 3, 2023)
     

    খোদনদা যে, ভাল আছ?’ পেছন ফিরে দেখি, একমুখ বিগলিত হাসি নিয়ে একজন বেঁটেখাটো লোক আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। কষ্টিপাথরের মতো আবলুশ কালো গায়ের রং, মাথায় কদমছাঁট চুলে পাক ধরেছে, বাটার মতো গোল মুখ, থ্যাবড়া নাক, কুতকুতে চোখ, পরনে একটা নোংরা জিন্‌স আর রংচটা হলদে গেঞ্জি, পায়ে হাওয়াই চটি, গলায় একখানা গামছা জড়ানো।

    ছোটবেলায় ওই নামে যাঁরা ডাকতেন, তাঁদের বেশির ভাগই ইহলোক ত্যাগ করেছেন, বাকিদের সঙ্গেও যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তা ছাড়া নতুন জায়গা, তাই প্রথমে একটু চমকে গিয়েছিলাম।

    আমার অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘আমারে চিনতি পাল্লে না? আমি জীবন!’

    রোদের মধ্যে বাজারের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ঘুরে বিস্তর দরদাম করে মিইয়ে আসা খানিকটা পুঁইডাঁটা আর তৃতীয়ার চাঁদের মতো একফালি কুমড়ো কিনেছি। দাম দিতে-দিতে অবশিষ্ট টাকার হিসেব করছিলাম। মগজখানা মানিব্যাগের ভেতরে ছিল বলে কি না জানি না, সত্যিই চিনতে পারলাম না। 

    ভাবলাম, ছোটবেলার নামে ডাকছে মানে নিশ্চয় আমাকে চেনে। তাই একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘জী-ব-ন? মানে…’

    সে আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ গো, আমি কাহারপাড়ার জীবন। আমার বাবার নাম ফেকু কাহার, গাজনের সুময় ধাঙড় সাজত, তুমার মনে নেই?’

    এবার মনে পড়ল। ছোটবেলা থেকেই ব্যাটা ডাকসাইটে চোর। কতবার যে ধরা পড়ে মারধর খেয়েছে, তার লেখাজোকা নেই। সে একবার রাতে দোকান বন্ধ হওয়ার আগে গাইনবাবুদের মুদিখানায় দোকানে ঢুকে লঙ্কার বস্তার আড়ালে লুকিয়ে ছিল। ভেবেছিল, বাবুরা দোকান বন্ধ করে চলে গেলে মালপত্র হাতিয়ে টিনের চাল আলগা করে সেখান থেকে বেরিয়ে যাবে। গাইনবাবু তালা বন্ধ করে সবে বেরোতে যাবেন, এমন সময় শুনলেন, ভেতর থেকে যেন হাঁচির শব্দ আসছে। সন্দেহ হতে ফের তালা খুলে দেখেন, লঙ্কার বস্তার পেছনে বসে ব্যাটা সমানে হেঁচে চলেছে। ধরা পড়েও ম্যানেজ করার জন্যে হাঁচতে-হাঁচতে বলে উঠেছিল, ‘বাবু টুকি।’ 

    ভাবখানা এমন, যেন সে বাবুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলার জন্যে লুকিয়ে ছিল।

    গাইনবাবু সাংঘাতিক রগচটা মানুষ, তার ওপরে দানবের মতো চেহারা। ওকে নেংটি ইঁদুরের মতো ঘাড় ধরে তুলে এমন আছাড় মেরেছিলেন, সকলেই ভেবেছিল, ব্যাটা নির্ঘাত মরে গেছে। টানা তিন মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিল।

    আরেকবার সে পয়মালের চায়ের দোকানের টিনের ঝাঁপের ফোঁকর গলে চুরি করতে ঢুকেছিল। পয়মালের এলাচ চায়ের বেজায় সুখ্যাতি, প্রচুর কাটতি। পরদিন সকালের চায়ের জন্যে সে এক ডেকচি দুধ ঘন করে জ্বাল দিয়ে রেখেছিল। জীবন লোভ সামলাতে না পেরে পেটভরে সেই দুধ খাওয়ার পর মালপত্র হাতিয়ে নিয়ে বেরোবার সময় দেখে, কিছুতেই বেরোতে পারছে না। বেরোবে কী করে, ততক্ষণে দুধ খেয়ে তো পেট ফুলে ঢোল হয়ে গেছে! পরদিন ভোরবেলা দোকান খুলে পয়মাল দেখে, জীবন ছোট্ট চৌকির ওপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে।

    আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে জীবন খুশিয়াল গলায় বলল, ‘উ! কত্তকাল পরে দেখা! তুমি কিন্তু বেশ রোগা হয়ে গেছ, খোদনদা। আগে কী সোন্দর কাত্তিক ঠাকুরির মতো চ্যায়রা ছেল তুমার!’

    ওর যেচে কুটুম্বিতা দেখানোয় পিত্তি জ্বলে গেল। তবু হাজার হোক গাঁয়ের ছেলে, তাই বললাম, ‘চিনব কী করে, বল? কত বড়ো হয়ে গেছিস, দাড়িগোঁফের জঙ্গলে মুখখানাই তো ভাল করে দেখা যাচ্ছে না!’ 

    জীবন কান এঁটো করা একগাল হেসে বলল, ‘বা রে! বয়েস হয়েছে না! দাড়িগোঁফ শুধু গজায়ইনি, ভাল করে দেখো, দু’এট্টা পাকতিও লেগেছে!’

    কথা ঘোরাবার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা তুই এখানে কী করছিস? এখন কি এখানেই থাকিস?’ 

    সে দুঃখী-দুঃখী মুখ করে বলল, ‘কী করব বলো, তুমরা তো সব চাগরিবাগরি পেয়ে শহরে এসে উঠেচ। ওদিকি গেরামের যে কী অবস্তা, কাজকম্ম নেইকো, তাই বাধ্য হয়ে চলে আসতি হল। পেট তো চালাতি হবে!’

    আমি হেসে বললাম, ‘ও, তুই তাহলে এখন কাজকম্ম করিস? চুরিচামারি কি একেবারে ছেড়ে দিয়েছিস?’

    জীবন আধ হাত জিভ করে বলল, ‘ছি ছি দাদা, তুমি এমুন কথা বলতি পাল্লে? ছোটবেলায় কোথায় কী এট্টু-আধটু নোকের বাগানের ফলপাকুড় পেড়ে খেয়িচি বই তো নয়! সে-কথা তুমি এখনও মনে রেখেচ? ওরে কি চুরি বলে না কি?’

    আমি বললাম, ‘তা তো বটেই। যাক গে, বাদ দে ওসব কথা। এখন কী করিস?’

    জীবন বলল, ‘ঝ্যাকন ঝা পাই, তাই করি। কাজের বাছবিচার কত্তি গেলি কি আমাদের চলে? কিছুদিন লরির খালাসিগিরি কল্লাম, তাপ্পর লোহালক্কড়ের দোকানে মাল মাপামাপি, রাজমিস্তিরির জোগাড়ে, গরুর দালালি, কিন্তু কোত্থাও সুবিদে কত্তি পাল্লাম না। এখন তাই সব ছেড়েছুড়ে ব্যবসা ধরিচি। স্বাধীন কাজ, ইচ্ছে হলি বেরুলাম, ইচ্ছে না হলি ঘরে নাক ডেকে ঘুমুলাম, কারুর হাঁকাহাঁকি নেই, গালমন্দ নেই। এখন বেশ আছি দাদা।’ 

    খুব অবাক হলাম। কী এমন স্বাধীন ব্যবসা আছে, যেটার জন্যে ঘর থেকে বেরুলেও চলে, না বেরুলেও চলে! নিতান্ত কৌতূহলের বশে জিজ্ঞেস করে ফেললাম সে-কথা। আর সেটাই আমার কাল হল।

    জীবন মহা খুশি হয়ে বলল, ‘পুরনো জিনসপত্তর কেনাবেচা করি, দাদা। যেমন ধরো পুরনো চেয়ার, টেবিল, বাসনপত্তর, ঘড়ি, মোবাইল ফোন, কালার টিবি, টেবিল ফ্যান, ব্যাগে-নেয়া পাদলা কম্পুটার, কী নেই! ফাসকেলাস সব জিনিস, তুমার কিছু লাগলি বোলো, জলের দরে এনে দোব।’

    বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল। তাই ওকে কাটাবার জন্যে বললাম, ‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে। আপাতত আমার কিছু লাগবে না।’

    আমাকে হাঁটতে দেখে জীবন পেছন-পেছন আসতে-আসতে বলল, ‘কী, বিশ্বাস হচ্ছে না, দাদা?’ 

    আমি বললাম, ‘বিশ্বাস না হওয়ার কী আছে? আজ আমার একটু তাড়া আছে, কিছু লাগলে পরে তোকে জানাব।’

    তারপর ভুলেই গিয়েছিলাম জীবনের কথা। হপ্তাখানেক পরে একদিন সকালে অফিসে বেরোবার জন্যে তৈরি হচ্ছি, এমন সময় মেয়ে বলল, ‘বাবা, তোমাকে কে ডাকছে!’

    কীভাবে ওকে বিদায় করব ভাবছিলাম, এমন সময় জীবন বলল, ‘ভাল কথা, শ্যামলদা বলছেল, তুমি নাকি সাইকেল কেনবা? আমার কাচে একখানা আছে, হারকিলিস কোম্পানির, একেবারে বেরান্ড নিউ। পুবপাড়ার মিন্টুবাবু আছে না, তুমি অবশ্যি লতুন এয়েচ, চেনবা না, তেনার থে কিনিচি। তেনার ছেলের শখ, রেসিং সাইকেল কেনবে, তাই জলের দরে ছেড়ে দেছে সাইকেলখানা।

    বাইরে বেরিয়ে দেখি, মুখে একগাল হাসি নিয়ে জীবন দাঁড়িয়ে। 

    আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কী রে তুই? ঠিকানা পেলি কী করে?’

    জীবন বিজ্ঞের মতো বলল, ‘ইচ্ছে থাকলি উপায় হয়, দাদা। নীলকণ্ঠ মাস্টারের ছেলে শ্যামলদার বাড়ি তো পেরায়ই যাই। যুগিপাড়ায় বাড়ি করেচে শ্যামলদা, তুমি লিচ্চয় দেখেচ! আমার কাছ থে নানা জিনিসপত্তর নেয়। সে-ই তুমার ঠিকানাডা দেলে।’

    মনে-মনে শ্যামলের ওপর খুব রাগ হল। কী দরকার ছিল এই উটকো ঝামেলাটাকে আমার বাড়ির ঠিকানা দেওয়ার! 

    কীভাবে ওকে বিদায় করব ভাবছিলাম, এমন সময় জীবন বলল, ‘ভাল কথা, শ্যামলদা বলছেল, তুমি নাকি সাইকেল কেনবা? আমার কাচে একখানা আছে, হারকিলিস কোম্পানির, একেবারে বেরান্ড নিউ। পুবপাড়ার মিন্টুবাবু আছে না, তুমি অবশ্যি লতুন এয়েচ, চেনবা না, তেনার থে কিনিচি। তেনার ছেলের শখ, রেসিং সাইকেল কেনবে, তাই জলের দরে ছেড়ে দেছে সাইকেলখানা। তুমি বলতি গেলি আমার নিজির দাদার মতো, নাহয় কেনা দামডাই দিও।’ 

    এবার নিজের ওপরেই রাগ হল। সেদিন স্টেশন থেকে ফেরবার জন্যে টোটোয় বসে আছি, ড্রাইভারের ধনুকভাঙা পণ, পাঁচজন প্যাসেঞ্জার না হলে ছাড়বে না। তাকিয়ে দেখি সাইকেল নিয়ে পাশ কাটিয়ে শ্যামল যাচ্ছে। 

    আমাকে দেখে বলল, ‘টোটোয় যাতায়াত করিস না কি? এইটুকু তো রাস্তা, সাইকেল নেই?’ 

    আমি হেসে বললাম, ‘সবে বাড়ি করেছি তো, প্রচুর ধারদেনা, এখনও কেনা হয়নি।’

    ব্যাস, শুধু এটুকুই কথা হয়েছিল। আর ব্যাটা ধরে নিয়েছে, আমি সাইকেল খোঁজ করছি! 

    আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছিল। বললাম, ‘এখন টাকা নেই, জীবন, দু’একমাস পরে কিনব।’

    জীবন অমায়িক হেসে বলল, ‘পরে কি আর এই সাইকেল এত সস্তায় পাবা দাদা? লতুন কিনতি গেলি হাজার পাঁচেক তো পড়বেই। একদম বেরান্ড নিউ মাল, দেড় হাজারে কিনিচি, তুমি না হয় তাই দিও। আমি কি তুমাদের পর দাদা! তুমাদের বাড়ি খেয়েমেখে বড়ো হইচি, সে-কথা ভুলে যাব, এমুন নেমকহারাম আমারে পাওনি।’

    আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তোকে তো বলেছি, এখন আমার কাছে টাকা নেই। এখন যা, পরে দরকার হলে খবর দেব।’

    জীবন কিন্তু নাছোড়বান্দা। বলল, ‘তুমি তো আটটা নাগাদ অফিসির থে ফেরো, তকন আমি সাইকেলখানা নে আসপো, দেকে ঝেদি তুমার পছন্দ হয় নেবা, নালি নিতি হবে নাকো।’

    আড়াল থেকে আমার স্ত্রী হয়তো এই কথোপকথন শুনে থাকবে। খাওয়ার সময় বলল, ‘এত করে সাধাসাধি করছে যখন একবার দেখোই না। সাইকেল তো সবসময়ে দরকার হয়। পছন্দ হলে নিয়ে নাও, আমার কাছে যা আছে, কুড়িয়ে-বাড়িয়ে হাজার দেড়েক হয়ে যাবে।’

    এরপর জীবন মাঝে মাঝেই আসতে লাগল। আমার স্ত্রী কখনও তার কাছ থেকে প্রায়-নতুন প্রেশার কুকার কেনে, কখনও-বা পুজোর বাসন। 

    হিসেব করে দেখলাম, ছোকরা খুব একটা বাড়িয়ে বলেনি। নানা মহার্ঘ জিনিস যাকে বলে একেবারে জলের দরে এনে দেয়।

    একদিন সকালে উঠে দেখি, বাড়ির টিউবওয়েলের সিলিন্ডারটা চুরি হয়ে গেছে। মাত্র মাস ছয়েক হল, অনেক টাকা খরচ করে টিউবওয়েলটা বসানো হয়েছিল। পুরো টাকা এখনও শোধ হয়নি। এখানে আবার সিলিন্ড্রিকাল টিউবওয়েল ছাড়া জল ওঠে না। এক লপ্তে অনেক টাকার ধাক্কা। আমার তো মাথায় হাত।

    গিন্নি বলল, ‘একবার জীবনকে বললে হয় না? সে যদি একটা সেকেন্ডহ্যান্ড সিলিন্ডার কম দামে এনে দিতে পারে!’

    বৃত্তান্ত শুনে জীবন বলল, ‘এডা কোন ব্যাপার হল বৌদি! এট্টা সিলিন্ডার আমার সন্ধানে আছে, আজকের রাতটা কোনওরকমে চালায়ে ন্যাও। কাল সকালে এট্টা ব্যবস্তা করে দোবানি। তুমি বরং এক কাজ করো। আমারে বালতি দ্যাও, রাস্তার কলের থে আজকে চালাবার মতো জল এনে দিয়ে যাই।’ 

    পরদিন সকালে জীবন সত্যি-সত্যি টিউবওয়েলের একটা সিলিন্ডার এনে হাজির করল। প্রায়-নতুন। সঙ্গে একজন মিস্ত্রিও। আধঘণ্টার মধ্যে কলে আবার আগের মতো কলকলিয়ে জল উঠতে শুরু করল। দাম দিতে গিয়ে বুঝলাম, পুরনো লোহালক্কড়ের চাইতেও সস্তায় পেয়ে গেছি সেটি।

    বলার অপেক্ষা রাখে না, এর পর জীবন যাকে বলে একেবারে ঘরের ছেলে হয়ে উঠল। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সে মাঝে মাঝে আসে, চা খায়, গিন্নি এবং মেয়ের সঙ্গে এটা-সেটা গল্প করে। আর কোনও জিনিসের দরকার আছে জানতে পারলে নিজে থেকেই অবিশ্বাস্য সস্তায় সেটি এনে হাজির করে।

    জামাইষষ্ঠীতে চটি পরে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছি দেখে শ্বশুরমশাই একজোড়া জুতো দিয়েছিলেন। নামী ব্র্যান্ডের দামি সু। এক সপ্তাও পরা হয়নি, রাতের বেলা ঘরে তুলতে ভুলে গিয়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি, জুতোজোড়া নেই। নেই তো নেইই!

    গিন্নি বলল, ‘নির্ঘাত কুকুরে নিয়ে গেছে। তোমার যেমন ভুলো মন!’

    আমি মানতে পারলাম না। খাঁটি চামড়ার জুতো হলেও না হয় একটা কথা ছিল, মাইক্রো লেদার কুকুরের মুখে রুচবে কেন? তন্নতন্ন করে বাড়ির চারপাশটা খুঁজছি দেখে পাশের বাড়ির বোসবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হারিয়েছে?’

    বললাম। তিনি বললেন, ইদানীং নাকি ছিঁচকে চোরের উপদ্রব খুব বেড়েছে। তাঁর বাড়ি থেকেও নাকি মাঝে মাঝে নানা জিনিস চুরি হয়ে যাচ্ছে।

    গিন্নির কয়েকটা জিনিস কেনার ছিল। অথচ বেশ কিছুদিন ধরে জীবনের দেখা নেই। মোবাইলও বন্ধ। অথচ তার ওপর শ্রীমতির এমন অটল আস্থা যে, ইদানীং সে দোকান-বাজারের ধার ধারে না। যা কিছু টুকিটাকি দরকার হয়, সবই জীবন ভরসা। 

    আমাকে প্রতিদিন তাগাদা দেয়, একবার ছেলেটার খোঁজ করো। আমিও ভাবছিলাম, ছুটির দিনে একবার শ্যামলের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেব।

    সেদিন ট্রেন থেকে নেমে সাইকেল নিয়ে ফিরছি, টোটোস্ট্যান্ডের কাছে আসতেই দেখি একটা টোটোর মধ্যে শ্যামল বসে। একটু অবাক হলাম। আমাকে সাইকেল কেনার উপদেশ দিয়ে এখন ব্যাটা নিজে টোটোয় চেপে বসে আছে!

    কাছে গিয়ে বললাম, ‘কীরে শ্যামল, টোটোয় কেন? সাইকেল কী হল?’

    শ্যামল টোটো থেকে নেমে এসে বলল, ‘আর বলিস নে, মাস দেড়েক হল, সাইকেলখানা চুরি হয়ে গেছে। জীবন বলেছিল, সস্তায় একখানা সেকেন্ড হ্যান্ড জোগাড় করে দেবে, কিন্তু সে হারামজাদা যে কোথায় গায়েব হয়ে গেল, মাসখানেক হল, তার দেখা নেই।’

    কথা বলতে-বলতে হঠাৎ ওর নজর পড়ল আমার সাইকেলের ওপর। অবাক হয়ে বলল, ‘এ সাইকেল তুই কোথায় পেলি?’

    চোখ নাচিয়ে বললাম, ‘জীবন এনে দিয়েছে, মাত্র দেড় হাজারে!’

    শ্যামল আঁতকে উঠে বলল, ‘বলিস কী? এ তো আমারই সেই চুরি যাওয়া সাইকেল। এই দেখ, হ্যান্ডেলের ওপর আমার নামের আদ্যক্ষর এমব্রস করা।’

    কী মনে করে শ্যামলের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, আমারই শ্বশুরমশাইয়ের দেওয়া জুতোজোড়া ওর পায়ে।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook