চেনা কবিতা, অচেনা মুহূর্ত
খুব বেশি রাত হয়নি তখনও। বড়জোর সাড়ে ন’টা। কিন্তু তখনই টিউব স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম খাঁ খাঁ করছে। সত্যি বলতে কী, অত নিঃঝুম প্ল্যাটফর্ম আমি আগে কখনও দেখিনি। তার অবশ্য কারণও আছে একটা। স্টেশনের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেই বিছিয়ে আছে রাতের ঝলমলে শিকাগো শহর। এমনিতে ঝলমলে ঠিকই, কিন্তু নভেম্বর মাসের ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা তাকে প্রায় অসহ করে তুলেছে, অন্তত আমার কাছে তো বটেই। এমনিতেই শীতকাতুরে মানুষ, প্রথমবার শিকাগোর ওই আসন্ন শীতের বাতাসই আমাকে হার মানানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। হয়তো অত ঠান্ডার কারণেই, আমাদের টিউব স্টেশনে অপেক্ষমান যাত্রী বিশেষ নেই। আমরা মানে, আমি, বাংলাদেশের এক ছোটগল্পকার, উরুগুয়ের এক ঔপন্যাসিক, আলজিরিয়ার এক নাট্যকার আর লেবাননের এক কবি। নানা বয়সের এই পাঁচজন পুরুষ আমরা অপেক্ষা করছি মেট্রো’র, যার আসতে তখনও বেশ খানিকটা দেরি। সেটা ২০০৬-এর নভেম্বর, অগাস্টে এসেছিলাম আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখক কর্মশালায় যোগ দিতে। সদ্যই শেষ হয়েছে সেসব, তারপর আমাদের কয়েকজনের এদিক-সেদিক ভ্রমণ, সেও বিশ্ববিদ্যালয়েরই উদ্যোগে। শিকাগোয় এক মার্কিন কবির বাড়িতে নৈশভোজের আমন্ত্রণ ছিল, সেটা সেরে এখন হোটেলমুখী আমরা ক’জন।
আমরা ছাড়া যাত্রী একজনও নেই, সে-কথা বললে যদিও ভুল বলা হবে। একটিমাত্র মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, লম্বা টানা প্ল্যাটফর্মের একেবারে অপর প্রান্তে। বয়স বছর ১৬ হবে, আলতো করে ঝুটি বাঁধা, স্কার্ট আর সোয়েটার পরা, পিঠে ব্যাগ ঝোলানো ফুটফুটে একটি মেয়ে। সেও অপেক্ষা করছে ট্রেনের। এমন সময়ে আমাদের উরুগুয়ান বন্ধুটি বলল, ‘চলো, ট্রেন আসার আগে একটা খেলা খেলা যাক।’ আমরা বেশ অবাক। কী খেলা, তবু জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, ‘এই যে কয়েক মাস আমরা একসঙ্গে কাটালাম, আমরা তো কেউ একে অপরের ভাষা শুনতে পেলাম না। পরস্পরের সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বললাম। আমরা বরং আজ যে-যার ভাষায় একটা করে কবিতা বলি এখানে। হয়তো মানে বুঝব না কেউই, কিন্তু নিজেদের ভাষা কেমন, সেটা শোনা অন্তত হবে। কী, রাজি?’
প্রস্তাব মন্দ নয়। সকলেই এক কথায় রাজি হলাম তাই। আমি আর বাংলাদেশী বন্ধুটি অবশ্য আলাদা দেশের হয়েও একে অপরের ভাষা বুঝি, সেটা বাকিদের কাছে কম বিস্ময়ের নয়। শুরু হলো খেলা। সময় অল্প, তাই ছোট আকারের কবিতাই বলছিল সকলে। মনে আছে, আমি বলেছিলাম শঙ্খ ঘোষের ‘যুবতী’ কবিতাটি। এইভাবে পাঁচজনেরই কবিতা বলা হয়ে গেল, কিন্তু ট্রেন আসতে তখনও কিছু দেরি। হঠাৎ, বলা নেই কওয়া নেই, আমাদের হোমরা-চোমরা উরুগুয়ান বন্ধুটি প্ল্যাটফর্মের এ-প্রান্ত থেকে ছুটে ও-প্রান্তের মেয়েটির কাছে পৌঁছে গেল।
কী ব্যাপার? আমরাও ছুটলাম পিছু-পিছু। গিয়ে দেখলাম, সে ওই মেয়েটিকেও কবিতা বলতে বলছে। সে বেচারি ওই অত রাতে অচেনা একজন মানুষের কাছ থেকে এমন প্রস্তাব পেয়ে রীতিমতো হকচকিয়ে গেছে। আমাদের বন্ধুটি তাকে তখন বোঝাচ্ছে, ‘তুমি যখন আমাদের সঙ্গে এখানে আছ, তখন তুমিও এই খেলার অংশীদার। ঝটপট করে একটা কবিতা বলে ফেলো দেখি!’ মেয়েটি মার্কিন, বোঝা যাচ্ছে। আর এও বোঝা যাচ্ছে, এমন বেমক্কা বিপদে সে এর আগে কখনও পড়েনি। সে যত বলছে, ‘আমাকে ছেড়ে দিন, আমি কোনও কবিতা জানি না’, আমাদের বন্ধুটি ততই চেপে ধরছে আর বলছে, ‘ওসব জানি না, কবিতা তোমাকে বলতেই হবে। একটা না একটা কবিতা নিশ্চয়ই জানো তুমি, মনে করে দ্যাখো, শিগগির!’
বন্ধুটিকে নিরস্ত করার চেষ্টায় আমরা ব্যর্থ হয়ে মেয়েটিকেই ইশারা করলাম, যা হোক কিছু একটা করে মেটাও এবার। সেও বুঝল, এই ফাঁদ থেকে রেহাই পাবার উপায় একটাই, কবিতা বলা। ট্রেন আসতে আর দু’মিনিট, প্ল্যাটফর্মে তখন একটা পিন পড়লেও শোনা যাবে, এমনই আমাদের অপেক্ষার স্তব্ধতা। সে কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভাবল, তারপর পিঠ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রাখল প্ল্যাটফর্মে, আস্তে করে ছেড়ে ফেলল তার জুতোজোড়া। আমরা তখনও বুঝিনি, কী ঘটতে যাচ্ছে। তারপর, আমাদের সকলকে অবাক করে দিয়ে, সে ওই রাতের প্ল্যাটফর্মে একটা এক মিনিটের ব্যালে পিস করে দেখাল। নাচ যখন শেষ হল তার, আমাদের দিকে লাজুক মুখ ফিরিয়ে সে বলল, ‘এইটাই আমার জানা একমাত্র কবিতা!’
তার এই কথার পর আমরা যখন পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছি, তখন চারপাশের স্তব্ধতা খান-খান করে ট্রেন ঢুকল স্টেশনে। মেয়েটি উঠে পড়ল কামরায়। আমরা ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতাম, যদি না আলজিরিয়ান বন্ধুটি সম্বিত ফিরে পেয়ে আমাদের সকলকে নিয়ে আরেকটা কামরায় উঠে পড়ত। সেদিন ফিরতি পথে আমরা কেউ কারও সঙ্গে একটাও কথা বলিনি। বলতে পারিনি। হোটেলে ফিরেও চুপচাপ যে-যার ঘরে ঢুকে দরজা দিয়েছি। আর পরদিন আমাদের সকাল হয়েছে অন্য এক পৃথিবীতে, যেখানে আমাদের এতদিনকার সমস্ত অর্জিত সংজ্ঞা, ধারণা, বিদ্যা, জ্ঞান, সব বাতাসে কাগজের টুকরো হয়ে মিলিয়ে গেছে। ওই একরত্তি একখানা মেয়ে, নিজের অজান্তেই, আমাদের সমূহ অস্তিত্বকে বিরাট এক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে ফিরে গেছে।
কবিতাকে জানার, বোঝার, লেখার চেষ্টা করছি সেই কবে থেকে। কবিতা নিয়ে কথা বলছি সভায়, কবিতার কর্মশালায় যাচ্ছি সাত সমুদ্র পেরিয়ে। যেন বেশ একটা ধারণা হয়েছে আমার, কবিতা কী, তা নিয়ে। যেন বেশ বুঝতে পারি, এই এই ব্যাপার পর পর হলে তবেই সে কবিতা, নইলে নয়। এত বছরের সেইসব ঠুনকো ধারণা আর সংজ্ঞার বুকে মেয়েটির নরম, খালি পায়ের দুটো পাতা পড়ল একবার, আর সবটুকু নিমেষে ভাঙচুর হয়ে গেল কেমন! সেইদিন বুঝতে পেরেছিলাম, কবিতা আসলে কী, তা আমি জানি না। কোনওদিন জানব না। কেননা কবিতা যে-কোনও কিছু হতে পারে, যে-কোনও মুহূর্তে হতে পারে। যেমন গতকাল হল। তাই তাকে কোনও ধারণা বা সংজ্ঞার বাক্সে বন্দি করার চেষ্টা নেহাত বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। নিজের সমস্ত সত্তাকে এত ব্যর্থ, এত ছোট মনে হয়েছিল সেদিন, আর শীতের সকালটাকে এত বেশি নতুন, যে আমি ভুলিনি তা। কক্ষনও ভুলব না।
এই ঘটনার পর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, বেশ কয়েকখানা শীত পার করে নিজের মাঝবয়সে এসে পৌঁছেছি। আমন্ত্রণ এল কবিতা পড়বার, কলকাতারই এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দুপুর-দুপুর পৌঁছে দেখি, তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থীদের ঝলমলে মুখচোখে প্রেক্ষাগৃহ আলো হয়ে আছে। এসব জায়গায় গেলে মন ভাল হয়ে যায় আমার, কম বয়সের ছোঁয়াচ পেলে নিজেকেও ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে। পড়লাম অনেকক্ষণ, নিজের কবিতা। পড়ার সময়েই খেয়াল করছিলাম, শ্রোতাদের মধ্যে বেশ কিছু দৃষ্টিহীন ছাত্রীছাত্রও আছেন। তাঁদের চোখের কালো চশমা, তাঁদের শোনবার ভঙ্গি দেখে বুঝে নিতে অসুবিধে হচ্ছিল না, তাঁরা চোখে দেখতে পান না।
অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবার পর সইসাবুদ আর সেলফি’র পালা চলল অনেকক্ষণ। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের আন্তরিক আবদারে ভরে উঠল আমার সামান্য বিকেল। তারপর, যখন সব শেষ করে ক্লান্ত আমি বেরিয়ে আসতে যাচ্ছি প্রেক্ষাগৃহ থেকে, দেখি, সেসব দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে অপেক্ষা করছেন দরজায়। সত্যি, এতক্ষণ সময় গেল, এঁদের সঙ্গে তো কথা হল না আমার! ওই দরজায় দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ কথা বলা হল। তাঁরা জানালেন, আমার অনেক-অনেক কবিতা ব্রেইলে অনূদিত হয়েছে, তাঁরা সেসব পড়েই জেনেছেন আমাকে, আজ শুনতে এসেছেন আমার কবিতা। শুনে ভাল লাগল নিশ্চিত।
তারপর যখন এক পা এগিয়ে বললাম, ‘এবার তাহলে আসি?’ তখন তাঁদেরই মধ্যে থেকে একজন ছাত্র বলে উঠলেন, ‘স্যার, আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে পারি? আমাদের খুব ইচ্ছে!’ কথাটা, আবারও আমাকে, ওই বহু বছর আগেকার রাতটার মতোই, পাথরের মূর্তি করে দাঁড় করিয়ে দিল। ততক্ষণে সেইসব পড়ুয়ারা আমার চারপাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে পড়েছেন, আর তাঁদের এক শিক্ষক নিজের ফোনে তুলে রাখছেন সেই ছবি। আর আমি, দৃষ্টিহীন ওই তরুণ-তরুণীদের মাঝখানে প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে থাকা আমি কেবল ভাবছি, কী অর্থ এই ঘটনার? তাঁরা তো কোনওদিন দেখতে পাবেন না এই ছবি, জানবেন না আমি কেমন আর আমার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিজেদের হাসিমুখই বা কেমন! তাহলে তাঁদের কাছে এই ছবির তাৎপর্য কী? মুহূর্তকে ফিরে দেখবার যে-তাগিদ থেকে আমরা তাদের ফ্রেমবন্দি করি, সেই ‘দেখবার’ সুযোগ তো তাঁদের হবে না কখনও! তবু তাঁরা চাইলেন, তাঁদের সঙ্গে আমার একটা অন্তত ছবি থাকুক। এই অলীক আবদারের সামনে নিজেকে কেমন অচেনা মনে হল, আবারও, নিজের চৌহদ্দিকে জানার যে এক ধরনের নিশ্চিন্ততা, তা ভেঙে গেল লহমায়। আমার কবিতা আজ আমাকে নিয়ে এল অন্ধদের ছবি তোলার আকাঙ্ক্ষার কাছে। এখান থেকে পথ চিনে বাড়ি ফিরতে পারব তো? নেমে এলাম ক্যাম্পাসে। বাইরে তখন বিকেলের হাওয়া গাছেদের গায়ে-গায়ে নিজের কথা বলছে, শান্ত চায়ের পেয়ালার মতোই পড়ে এসেছে রোদ। গাড়িতে উঠতে যাব, হঠাৎ কী মনে হতে একজন শিক্ষককে বললাম, ‘আমার লেখা কোনও কবিতা ব্রেইলে পাওয়া যাবে? একবার দেখাতে পারেন?’ তিনি সম্মত হয়ে ছুটে গেলেন ভিতরে, মিনিটখানেক পর হাজির হলেন একটা সাদা পাতা নিয়ে। আমি তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ, তারপর হাত রাখলাম অসংখ্য ছিদ্রে ভরা সেই সাদা পাতার উপর। এই তাহলে আমার কবিতা? কত-কত মানুষের কাছে আমার লেখার চেহারা তাহলে এই? অথচ তার শরীর স্পর্শ করেও তাকে আমি চিনতে পারছি না, বুঝতে পারছি না। প্রতিবন্ধী তাহলে কে? ওই ছাত্রীছাত্ররা, না আমি নিজেই? এই প্রশ্ন আর ভারী একটা সন্ধে কাঁধে সেদিন ফিরেছিলাম বাড়ি। আজও সে-প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র