প্রাচ্যবাদী শিক্ষাবিদেরা শিবলিঙ্গকে পুরুষ যৌনাঙ্গের প্রতীক (Phallic symbol) হিসেবে বর্ণনা করতে সবিশেষ পছন্দ করেন, কারণ গোঁড়া হিন্দুদের তাতে বেজায় অসুবিধে হয়। এই হিন্দুরা তাঁদের পূজ্য দেবতাকে আধ্যাত্মিক রূপেই দেখতে চান, যৌন প্রতীক হিসেবে নয়। তাহলে প্রাচ্যবাদীদের (অর্থাৎ পাশ্চাত্য ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী শিক্ষাবিদদের) এহেন বর্ণনা পছন্দ কেন? কারণ, এই বর্ণনায়, একদিকে যেসব ধর্মীয় সংগঠন যৌনসংসর্গকে পাপ বলে মনে করে, তাদের নাকে ঝামা ঘষে দেওয়া যায়। আর অন্যদিকে সনাতন হিন্দুধর্মের পৌত্তলিক বহুঈশ্বরবাদী প্রকৃতির বিষয়টি আরও মান্যতা পায়।
ঔপনিবেশিক যুগে, প্রাচ্যবাদীদের এইরকম বর্ণনা শুনে হিন্দু সমাজসংস্কারকরা কানে আঙুল দিতেন ঠিকই। কিন্তু অগম শাস্ত্রে বর্ণিত শিবলিঙ্গের বিমূর্ত ব্যাখ্যা আর পুরাণে বর্ণিত শিবের কামোদ্দীপক কাহিনির মাঝখানে পড়ে তাঁদেরও ধাঁধা লাগবার জোগাড় হত। আসলে, শিবলিঙ্গ প্রকৃতপক্ষে কী, এই নিয়ে অনেকরকম ব্যখ্যা রয়েছে। যার যেটা পছন্দ বেছে নেওয়া যায়। বর্তমানে অবশ্য রাজনীতিবিদ আর তাদের বিপুলকায় ট্রোল বাহিনীর পছন্দের ব্যাখ্যা হল– শিবলিঙ্গই প্রমাণ করে যে মোগলদের বহু আগে থেকেই সারা ভারতের অবিসংবাদী চিরন্তন বিশ্বাস ছিল হিন্দুধর্মে। এদের সঙ্গে বিতণ্ডায় গিয়ে লাভ নেই। তবে যাঁরা সত্যিকারের তথ্যভিত্তিক ব্যাখ্যায় উৎসাহী, তাদের জন্য শিবলিঙ্গের একাধিক উৎস এবং বিবরণের দিকে তাকানো যেতে পারে।
লৌহ-যুগের শিবলিঙ্গ
উদাহরণ হিসেবে তিন হাজার বছর আগেকার দাক্ষিণাত্যের কথা ধরা যাক। সেটা ছিল লৌহ যুগ। বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম বা পৌরাণিক হিন্দুধর্মের উত্থানের আগেকার কথা। উত্তর গাঙ্গেয় অববাহিকায় তখন বৈদিক স্তোত্র সংকলিত করা চলছে, বৈদিক আচারবিচারের সঙ্গে। এদিকে দাক্ষিণাত্যে, এবং আরও দক্ষিণে তখন চলছে আদিবাসী সম্পদায়গুলির লোহার ব্যবহার। তারা মৃতদেহ লোহার পাত্রের মধ্যে পুরে মাটির তলায় কবর দিত আর তার উপরে বানাত পাথরের স্মৃতিসৌধ। এদেরকে ইংরিজিতে বলা হয় ডোলমেন (Dolmen)। কর্ণাটক, কেরালা, তামিলনাড়ুর বিস্তীর্ণ এলাকায় হাজার হাজার ডোলমেন দেখা যায়, এমনকী আজও। এই পাথরের সৌধগুলো (এদেরকে মেনহির-ও বলা হয়) মৃতদের স্মৃতি-উদযাপনের উদ্দেশেই বানানো। মধ্যযুগের ভারতে বীর যোদ্ধাদের স্মৃতির উদ্দেশে বানানো সৌধগুলির পূর্বপুরুষ বলা যায় এদেরকে। অনেকে বলেন, প্রাচীনকালের তামিল রাজাদের কবরের উপর বানানো থামগুলিই শিবলিঙ্গের প্রাচীনতম নিদর্শন। এভাবে নাকি তাদের শক্তি একজায়গায় সঞ্চিত থাকত নিজস্ব গোষ্ঠীর উপকারের জন্য। আর এইজন্যই নাকি শিবের সঙ্গে ভূতের এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক!
এই মেনহির খাড়া করে উক্ত রাজাকে এক নিরাকার দৈবশক্তি, ভূতেদের নেতা শিবের সঙ্গে একাত্ম করে দেওয়া হত। তামিল সঙ্গম কাব্য অনুসারে, তাঁর সঙ্গে থাকতেন এক হিংস্র দেবী কোত্রাভাই, যিনি গভীর রাতে যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে বেড়ান এবং মৃতদেহ দিয়ে ভোজ সারেন। তাঁর পুত্র, বীর্যবান যুবা মুরুগন, হলেন যুবরাজ, পরবর্তী রাজা। প্রায় দুহাজার বছরের পুরনো অতি প্রাচীন তামিল সঙ্গম কাব্যে এসবের উল্লেখ আছে। সেই সময় ক্রমে উত্তরের বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু ধর্মের সংস্পর্শে আসতে শুরু করেছে দক্ষিণ।
তামিলনাড়ুতে রাজাদের সম্মানে নির্মিত হত ‘পল্লিপড়াই’ নামক সৌধ। একে শিবমন্দির বলে ভুল করা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আদতে এগুলি ছিল রাজকীয় কবরস্থান বা অন্ত্যেষ্টিস্থল যেখানে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করা হত। পুরনো মেনহির পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে নতুন আকার নিত। সঙ্গে ছিল ব্রাহ্মণ অভিবাসীদের প্রভাব, যাঁরা অত্যুৎসাহে বৈদিক আচার আচরণ আমদানি করছিলেন স্থানীয়দের সুবিধার্থে। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রায় একহাজার বছর আগে তামিলনাড়ুর তাঞ্জাভুর এলাকার উদয়ালুর গ্রামে রাজা রাজরাজ চোলের কবর বা অন্ত্যেষ্টিস্থলের উপর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তিনি শৈব রাজা ছিলেন। উত্তর থেকে বহু শৈব পুরোহিতদের আহ্বান করে দাক্ষিণাত্যে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিশাল বিশাল শিবমন্দির বানানোর উদ্দেশে, যার মধ্যে অন্যতম হল বৃহদেশ্বর শিবের মন্দির। রাজা রাজরাজ চোল নিজের রাজনৈতিক প্রচারে ওডিশা এবং বাংলার ভৈরবমূর্তির আদল ব্যবহার করলেও স্থানীয়ভাবে, শিবের প্রভাব ছিল অপরিসীম।
অষ্টম শতকে, তামিলনাড়ুর বিখ্যাত ৬৩ জন নয়নার, শিবের প্রশস্তি গাইতে শুরু করেন এবং এর ফলেই জৈন সাধুদের জনপ্রিয়তা ক্রমে কমতে থাকে। জৈন ধর্মপ্রচারকদের মতো শিবও ছিলেন যোগী, তপস্বী পুরুষ। কিন্তু জৈনরা যেভাবে বস্তুবাদী সমাজকে উপেক্ষা করার নিদান দিতেন, শিব ছিলেন তার চেয়ে আলাদা। শিবের মধ্যে এক বীর্যবান পুরুষের শারীরিক সক্ষমতা ছিল, ছিল অন্তর্গূঢ় শক্তির আধার, যার বলে তাঁর রাজবংশীয় ভক্তেরা বস্তুবাদী জগতের মোহমায়া জয় করতে পারতেন। এর ফলে মধ্যযুগের রাজাদের মধ্যে শিব এবং তাঁর পূজারীরা প্রবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শুধু কি ভারতীয় রাজা? ব্রাহ্মণরা সমুদ্রযাত্রা বন্ধের নিদান দেবার আগেই সুদূর ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং ইন্দোনেশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে এই প্রভাব। এমনকী আজও, অধিকাংশ দক্ষিণ ভারতীয়, বিশেষত দ্রাবিড়ীয় আন্দোলনের নেতারা, সমাহিত হতেই পছন্দ করেন, এবং চান যেন তাঁদের অন্তিম আবাসসস্থলে পাথরের সৌধ নির্মাণ করা হয়। বৈদিক অন্ত্যেষ্টির যে নিয়মে মৃতের আত্মাকে কাল্পনিক বৈতরণী নদী পার করিয়ে সুদূর পিতৃলোকে পৌঁছে দেওয়া হয়, সেই আচার তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেন।
রাজা এবং বিদ্রোহীদের শিবলিঙ্গ
রাজা চোলের দুই শতক পরে কর্ণাটকে শিবলিঙ্গ এক নতুন আকার নেয়। একটি নতুন আন্দোলনের ধারা দেখা যায়, যা ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতপাতকে নস্যাৎ করে শিবকে আত্মার প্রতিমূর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। নিরাকার আত্মার আকার হয়ে ওঠে শিবলিঙ্গ। তাকে সম্মান করে, অর্চনা করে রুপোর তাবিজ হিসেবে গলায় বেঁধে ঘুরে বেড়ানোর চল হয়। বীরশৈব এবং লিঙ্গায়ত সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রচলন দেখা যায় এবং উল্লেখযোগ্য হল, এরাও মৃতদেহ সমাধিস্থ করায় বিশ্বাসী। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাসব নামে এক ব্যক্তি, যার নামের অর্থ ‘ষাঁড়’। পাঠক মনে করুন, শিবের বাহন নন্দীর কথা! রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপারে জৈনদের সঙ্গে এদের প্রতিযোগিতা শুরু হয় এবং ক্রমে শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এদের উত্থান ঘটে। একুশ শতকের যে রাজনীতির কারবারিরা কর্ণাটকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় আছে, তাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা ছিল এই আন্দোলনকারীরা।
ওডিশায়, ভুবনেশ্বরে প্রাপ্ত সপ্তম শতাব্দীর শিবমন্দিরগুলিই সম্ভবত ভারতের প্রাচীনতম শিবমন্দির। এগুলি কিন্তু রাজাদের তৈরি নয়, স্থানীয় নানা সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর তৈরি। আশ্চর্য হল, এখানকার স্মৃতিসৌধগুলিতে অপৌত্তলিক লিঙ্গের ছবি রয়েছে, যা আদতে নিরাকারের একরকম আকার। অথচ মন্দিরগুলিতে শিবের জীবনকাহিনি বিধৃত। এরমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবি হল, শিব সপরিবার একটি পর্বতের উপর আসীন, যাকে রাক্ষসরাজা রাবণ দক্ষিণে, লঙ্কার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছেন। দক্ষিণ হল মৃত্যুরাজ যমের দিক। শিবের এই ছবিতেও রাজকীয় ক্ষমতা, ঔদ্ধত্য এবং মৃত্যুর ইঙ্গিত রয়েছে। এ কি নিছকই সমাপতন নাকি গভীর ইঙ্গিতবাহী? এখানে শিবকে দেখা যায় উত্থিত লিঙ্গসহ। প্রসঙ্গতঃ লাকুলিশা নামে এক ব্যক্তিরও উল্লেখ করতে হয় যিনি শিবের হিংস্র রূপের পূজার প্রচলন করেন। রাজাদের খুবই পছন্দ ছিল এই রূপ। কথিত আছে, শিবকে বশ করতে পারতেন জনৈকা দেবী, যিনি তাঁকে খাবার পরিবেশন করতেন। আমাদের মনে পড়ে যায় বুদ্ধের বোধিলাভের পর তাঁর স্ত্রীয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা। তফাত এখানেই, যে বুদ্ধ গৃহী থেকে তপস্বী হয়েছিলেন, আর শিব তপস্বী থেকে গৃহী। তবে দেবীর সঙ্গে মিলনের পরও শিব বীর্যপাত করেন না। এই বীর্য এবং উত্থিত লিঙ্গকেই তান্ত্রিক রচনায় জাদুকরী শক্তির আধার হিসেবে দেখানো হয়।
শিবলিঙ্গের বহুবিধ দিক নিয়ে আসলে কেউ আলোচনাই করেন না। উনবিংশ শতক থেকে শিবলিঙ্গকে বেদান্তের সঙ্গে যুক্ত করে দেখার একটা প্রচলন শুরু হয়, যাকে মূলত নিয়ন্ত্রণ করত একরকমের সন্ন্যাসভিত্তিক হিন্দুত্ববাদ। অধিকাংশ গবেষকই শিবলিঙ্গকে অযৌন আধ্যাত্মিক প্রতিরূপ হিসেবে দেখতে ও দেখাতে চান। নিরাকার আত্মার আকার হিসেবে বর্ণনা করেন। শিবলিঙ্গ যে আদতে সংযত পৌরুষ এবং বীর্যবান শক্তির প্রতীক, মৃত এবং জীবিতের মধ্যে যোগসূত্র, রাজাদের সাম্রাজ্যবিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার, সেসব নিয়ে কেউ কথাই বলতে চান না। এই শক্তির গোড়াতেই সার-জল দিচ্ছেন আজকের হিন্দুত্ববাদীরা, তাকে কাজে লাগাচ্ছেন ভোটবাক্সের সম্মোহনী মায়াজাল সৃষ্টি করতে, যাতে ভোটারদের দৃষ্টি বেকারত্ব বা অর্থনীতির মতো ধর্মনিরপেক্ষ সমস্যাগুলি থেকে ক্রমশ সরে যায়।