বাঙালি অতীতচারী বা বলা ভাল, মানুষ মাত্রই অতীতচারী। অতীতযাপনে তার বিশেষ আগ্রহ। চলতি কথায় আমরা যাকে নস্ট্যালজিয়া বলি, বাঙালির একটা বড় অংশের অন্তত তাহাই ভিত্তি। বর্তমান সে কোনও মতে অতিবাহিত করতে চায়, ভবিষ্যতের প্রতি তার হয় অনীহা নয় ঔদাসীন্য। ছোটবেলা কত ভাল ছিল— এই তার জীবনের থিম। রোদ্দুর ও আচারমাখা দুপুর থেকে কলেজক্যান্টিনের গান ও ডিমের ডেভিল তাকে মথিত করে রাখে। সে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বাবার বকুনি, জেঠিমার কানমোলা থেকে, শিক্ষকের কাছে বেত ও নীলডাউন, কলেজে ইউনিয়নের ছেলেদের কাছে মার, সিনিয়রের কাছে অপমান, বন্ধুর কাছ থেকে দাগা, একান্নবর্তী পরিবারের নিত্য অশান্তি— সব, সব কিছুকে ভুলে যায় বা ঘুম পাড়িয়ে রাখে বা সিলেক্টিভ মেমরির সাহায্য়ে মুছে ফেলে। ভুলে যাওয়া বা ক্ষমা একটা বড় গুণ। কিন্তু এই অতীতেই এমন কিছু কিছু আদর্শ, নীতি, উন্মাদনা, প্রবণতা আমাদের মনে, সত্তায়, মস্তিষ্কে প্রোথিত হয়ে যায়, যে ধরে নেওয়া যায় তাদরেই প্রভাবে আমাদের জীবনচর্যা চালিত হয়।
কিন্তু, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর জীবন চলতে চলতে অনেক সময় সেই সব বেসিক ব্যাপারস্যাপার, তার সঙ্গে জুড়ে থাকা স্মৃতি এবং চালিকা শক্তির মূল উপাদান বদল হয়ে যায়। এবং জীবন সেই নতুন খাতে বইতে থাকে। এই বয়ে চলার সময়, কিছুক্ষণের বিরতি দিয়ে, তাকে যদি ফিরে যেতে বলা হয়, নির্দিষ্ট কোনও এক আদর্শ, নীতি, ক্ষত, উন্মাদনা বা প্রবণতার কাছে, তা হলে বিষয়টা কেমন হবে? সহজ হবে না কঠিন, সুখের হবে না যন্ত্রণার? সততার হবে না অনুশোচনার? বলা মুশকিল। কারণ, এই ফিরে যাওয়া মায়ামাখা শৈশব-কৈশোর-যৌবনের দিন নয়, যা সে মনে রাখতে চেয়েছে। যত্ন করে তাতে কল্পনার প্রলেপ মাখিয়ে আর মায়াবী করে তুলেছে। যা নাড়াচাড়া করলে তার ব্যথাদাগ কান্নাকে সে উপভোগ করে। এ ফিরে যাওয়া এক রকম সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো। এই ফেরায়, সর্ব সমক্ষে না হোক, নিজের কাছে অনন্ত নিজের একটা পরিষ্কার প্রতিফলন দেখা যাবে। সেই দেখার মধ্যে পরবর্তী জীবনের পাথেয় নির্দেশিত থাকতে পারে, কোনও অপমানের থেকে মুক্তি থাকতে পারে, কোনও ক্ষমা থাকতে পারে, নিজেকে মার্জনা করা থাকতে পারে। এই পদ্ধতিকে এক ধরনের শুদ্ধিকরণ বললে অত্যুক্তি হবে না। কিংবা ইংরেজিতে যাকে বলে ক্লোজার, তা-ও হতে পারে। এ ছাড়াও বহু মিশ্র অনুভূতি হতে পারে, যা হয়তো নির্দিষ্ট ভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।
তবে, শুদ্ধিকরণ মানেই যে ভারলাঘব হয়ে যাবে কিংবা অতীতের সব ভুল ঠিক হয়ে যাবে কিংবা সব ঠিককে এখন ভুল মনে হবে, তা কিন্তু নয়। এই প্রক্রিয়া আত্মবিশ্লেষণের প্রক্রিয়া, নিজেকে একটু দূর থেকে দেখার চেষ্টা।
ডাকবাংলা.কম ১০০তম সংখ্যায় সেই ফিরে যাওয়া এবং সেই যাওয়ার পর ফিরে আসা—এই গতায়াতকে কুর্নিশ করতে চেয়েছে। এই সংখ্যায় লেখকরা কেউ ফিরে গেছেন একটি নির্দিষ্ট আদর্শের কাছে, কেউ ফিরে গেছেন একটি নির্দিষ্ট নীতির কাছে, কেউ ফিরেছেন গানের কাছে, কেউ-বা আবার বিশ্লেষণ করেছেন কবি মধুসূদন দত্তের ইংরেজি থেকে বাংলা সাহিত্য়ে প্রত্যাবর্তনের গতিপথটি, কেউ একটি কবিতার কাছে বার বার আশ্রয় খুঁজেছেন, কেউ মৃত্যুমুখ থেকে জীবন ফিরে পাওয়ার পথটি উপভোগ করতে চেয়েছেন। এমন নানা অভিজ্ঞতায় পূর্ণ করতে চেয়েছি আমাদের এই ডাকবাংলা সংখ্যা। ১০০ সংখ্যাটি যেহেতু পূর্ণতার একটি আশ্বাস দেয়, সঙ্গে দেয় একটা কোথায়ও পৌঁছে যাওয়ার ইঙ্গিত, সেই ইঙ্গিত ধরেই আমরাও ফিরে দেখার চেষ্টা করব।