অস্তিত্ব
এই বাড়ি তো আমি চিনি। অনেক বছর আগে এসেছিলাম। মনে আছে। কলিং বেল বাজান হল। দরজা খুলল না। স্পিকার জিজ্ঞেস করল ‘কে?’ জানানোয় শুনলাম ‘ওয়েট।’ দরজার কেমন যেন কী হোলটা ডাইনে বাঁয়ে ঘুরে মাঝখানে স্থির হল। একটা ক্যামেরার ছোট্ট লেন্স। কেউ দেখছে ভেতর থেকে। কিছু পরে ‘খুট’ করে একটা আওয়াজ। দরজা খুলে গেল। অর্থাৎ ভেতরে আসতে পারি। ম্যানড্রেকের জানাডুর বাড়িতে এমন থাকে। ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে আবার একটা শব্দ। আর একটা দরজা। সেটাও খুলল। অটোম্যাটিক নয়। যে খুলেছে সে দরজার আড়ালে। ‘আপনি ভেতর আসুন, তুমি ভাই ওইখানে বসো।’
সিঙ্গল সোফাতে বসলাম। পাশে একটা ছোট অ্যাকোয়ারিয়াম, একটাই নীল গোল্ডফিশ। অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখছে ঘুরে ফিরে। যার সঙ্গে এসেছি সে ভেতরে চলে গেল। এর আগে বলা হয়েছিল, ‘একজনের বাড়িতে দু মিনিটের একটা কাজ সেরে তোর বাড়ি যাবো।’ আপত্তি করি নি। এই সেই বাড়ি। এত সিকিউরিটি কিসের জন্য? কার বাড়ি এটা? আমি যে ঘরে একা বসে আছি সেটা খুবই ছোট। একটা পার্টিশনের আড়ালে ওয়েটিং এরিয়া বোধ হয়। রিসেপসনিস্ট ওই মাছটা। দেওয়ালে যে ছবির প্রিন্ট ফ্রেম করে ঝোলানো, সেটা আমার চেনা। ‘দ্য লাস্ট সাপার।’ খুব জলদি কাজ মিটে যাওয়ায় আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। যার সঙ্গে দেখা করতে আসা হয়েছিল তাকে এবারেও দেখতে পেলাম না। গলা শুনলাম, ‘আর আসার দরকার নেই, দুপুরে ইউজুয়ালি ফোনে থাকি।’ রাস্তায় বেরিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই শুনলাম, ‘ইন্টারেষ্টিং না? এখন নয়,পরে সব বলব।’ আমি মুখ ঘুরিয়ে বাড়িটা দেখলাম। মোটামুটি বড়লোকের সাধারণ বাড়ি। ছাদে বোধ হয় বাগান।
একটু আগে অচেনা একজন আমাকে বলল,’সাহায্য চাইতে পারি?’ হয়ত টাকা চাইবে। না দিতে পারি। দিতেও পারি। অন্য কিছুও হতে পারে। মাথা নাড়লাম। ‘একটু সময় চাই, ঘন্টাখানেক।’ আমার ব্যাংক থেকে ফোন করে একই কথা বলে। বাড়িতে এসে ক্রেডিট কার্ড গছাতে চায়। বুঝতেই চায় না যে ধার করার জন্য একটু মুরোদ লাগে। তা আমার নেই। আগে রাগারাগি করতাম। এখন রোবটের মত বলি, ‘না থ্যাংকস, নট ইন্টারেস্টেড।’ সেও রোবট। চাকরির প্রয়োজনে এমন চাওয়াচাওয়ি। এদেরও কিছু একটা দরকার পড়েছে। এক ঘন্টা ধরে একজন মানুষ আমাকে নিয়ে কি করতে পারে? কি এমন ঘটতে পারে যাতে আমার ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যাবে? বললাম, ‘হ্যাঁ বলুন।’ ওর সঙ্গে আর একজন আছে, একটি মেয়ে। ধারালো ঠোঁট। সেও দেখলাম বেছে বেছে কিছু লোককে একই কথা বলছে। সবাই চলে যাচ্ছে। ‘দু এক জন হলেই চলবে। গেলেই বুঝতে পারবেন।’ মার্জিত কথাবার্তা। কাউকে চোখ বুজে বিশ্বাস করার কোনো মানে হয় না। করলে, কি আর হবে, ঠকাবে। মেরে কেটে পকেটে বারো টাকা আছে। ফোন নেই। চশমা নেই। জামায় বোতাম, প্যান্টে জিপ আছে। চটিটা নতুন। আর কিছু নেই। পাশের অন্ধকার গলিতে নিয়ে গিয়ে আমার কানে রিভলভার ঠেকিয়ে লাভ হবে না। জোর করে ড্রাগ ইনজেক্ট করেই বা কি সুবিধে হবে ওদের? মেয়েও নই। না আছে লাভ, না আছে আমার ক্ষতির সম্ভাবনা। এদিকে আমার মত আর একজন রাজি হয়েছেন বলে মনে হল। ভালো লাগল। ওনার বয়স আমার থেকে একটু বেশিই হবে। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। একটু পরে দেখি সেই বাড়ি। সেবারে গিয়েছিলাম সকালে। এবার এসেছি রাতে। নতুন রঙ হয়েছে কি? নিওনে, হ্যালোজেনে, এল.ই.ডিতে কার কেমন রঙ বোঝা দায়।
ছেলেটা বেল বাজাল না। ফোন করল। একজন দরজা খুলল। কাজের লোক। বিশ্বস্ত মুখ। ওরা নিশ্চয়ই এ বাড়িতে আগে এসেছে। চেনে বলে মনে হল। সেই সিঁড়ি। সেই ঘর। গোল্ডফিশ নেই। ছবিটা একই জায়গায়। ঘরটা এখন অন্যরকম। বড় হয়ে গেছে। পার্টিশনটা খুলে ফেলেছে। একটা মনমরা কুকুর একটু ঘুরে গেল। ছেলেটা আর মেয়েটা ভেতরে চলে গেল। গতবারে শেষ পর্যন্ত কিছু জানা হয় নি। এবারে অনেকগুলো কারণে বেশ উত্তেজনা হচ্ছিল। ঘরে অনেক কিছু রয়েছে। বড় সোফা, এল শেপ। আমরা দুজন সেখানে বসলাম। চোখাচোখি হল একবার। হাসলাম। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে নমস্কার করলেন। তখন আমিও। বললেন, ‘সবকিছু যেভাবে ভেঙে পড়ছে, সেসব নিয়ে ভেবে আর লাভ নেই।’ এই কথার অনেক রকম মানে হতে পারে। যোশীমঠের দুর্ঘটনা বা পোখরার প্লেন ক্র্যাশের কথা বলছেন কি? সামনের ছোট টেবিলে অনেকগুলো ইংরিজি পত্রিকা। একটা গীতা। ইংরিজিতে। সিলিঙে পাখা নেই। সিনেমা হলেও থাকে না। আলোর সোর্স খুঁজে পেলাম না। কিন্তু ঘরের মধ্যে অন্ধকার পকেট নেই। একটা আলো মরে যাওয়া গোধূলি ভাসছে। অনেকগুলো দরজা। বন্ধ। যাদের সঙ্গে এসেছি তারা এর একটার ভেতরে ঢুকেছে। আধ খোলা। টুকরো গলা শুনছি। এক দিকে আটখানা চেয়ার সহ ওভাল ডাইনিং টেবিল। অন্য দিকে দেওয়াল ঘেঁষে পেল্লায় কাঁচের শো-কেস। আমি উঠে গেলাম সেদিকে। কাছে পৌঁছতে তার মধ্যে আপনি আপনি আলো জ্বলে উঠল। কত কি বেরিয়েছে আজকাল। আলমারির মধ্যে কয়েকটা কাঁচের তাক। ছোট ছোট সুন্দর সুন্দর অনেক কিছুর কালেকশন। ম্যূরানো গ্লাসের বাটি। কাঠের ম্যুলা রুজ। লন্ডনের বিখ্যাত বাড়িগুলোর মিনিয়েচার রেপ্লিকা। অ্যামস্টার্ডাম লেখা সেরামিকের উইন্ডমিল। পুরোনো আমলের অনেকগুলো ডাই-কাস্ট ভিন্টেজ গাড়ি, পর পর। একটা বড় বুদ্ধমূর্তি ছাড়া আমাদের দেশের কিছু চোখে পড়ল না। থাইল্যান্ডেরও হতে পারে। অসভ্য ইনকা সেক্স ডল। একটা নীল মলাট মাইক্রো বাইবেল। এই সবকিছুর মধ্যে একটা বেমানান জিনিস। অতি সাধারণ ছ’খানা, একটার ওপর আর একটা রাখা মেটে রঙের চিনেমাটির কোয়ার্টার প্লেট। শুনেছি, অবিশ্বাসীরা এগুলো রাখত। খাবারে বিষ থাকলে এদের রঙ বদলায়। এই বাড়িতে কাদের সঙ্গে, কেন এসেছি জানি না। দেওয়ালের সুইস কুককু ক্লকটা বাজতে শুরু করল। ভেতর থেকে পাখির সঙ্গে পুতুল বেরিয়ে অল্প নেচে, বাজনা থামিয়ে, ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। কুকুরটা ফিরে এসে ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এখন আর কিছু হচ্ছে না। চলে গেল। ও কি প্রত্যেকবার আসে? আমি ফিরে এলাম শো’কেসে। নরম ডিসপ্লে লাইট গুলো আবার জ্বলে উঠল।
আলমারির দ্বিতীয় তাকে অনেকগুলো মডেল ট্রেনের ইঞ্জিন, কোচ, রোলিং স্টক। সিগন্যাল রুম। খুদে খুদে লোকজন। একেবারে টু দ্য স্কেল, রিয়ালিস্টিক ডিটেল। এর আলাদা ট্র্যাক রাখা আছে কোথাও, ইলেকট্রিকে চলে। এগুলোর ব্যাপারে আমি জানি। আমাদের এক আত্মীয়ার বাড়িতে দেখেছি। হাইফাই লোক। ছোটবেলায় ‘দূর থেকে দেখবে, টাচ করবে না,’ কথাটা শুনতে হয়েছে কয়েকবার। একটু বড় হবার পর ওদের বাড়ি যেতাম না আর। ছোট কষ্টগুলো ভোলা শক্ত। শুনেছিলাম ওদের একমাত্র ছেলে, ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, প্রেসিডেন্সি, নকশাল হয়েছিল। পুলিশ এসে তার বাবাকে বলে, ‘স্যার, ইমিডিয়েটলি আপনার ছেলেকে সরান।’ রাতারাতি তাকে অ্যামেরিকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আজও বুঝি না তা কি করে সম্ভব হয়েছিল। আন্দোলনের আগুন নিভে যাওয়ার পরেও সে কলকাতায় ফিরতে পারে নি। তার অনুপ্রেরণায় সাধারণ বাড়ির প্রচুর ছেলেপুলে এসেছিল বিপ্লব করতে। তাদের অনেকেই মরে গেছে পুলিশের গুলিতে। বা, পচেছে জেলে। কলকাতায় ঢুকলে তাকে ছিঁড়ে খেত অনেকে। মেম বিয়ে করে, ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়ে সে অ্যামেরিকান হয়ে যায়। একবার এসেছিল। চেহারা বদলে ফেলেছে। আমাদের বাড়ির সবাই হামলে পড়েছিল তাকে দেখতে। মটন কাটলেটের মত চেহারার, ডুমো ডুমো সুইচওয়ালা একটা যন্ত্র পকেট থেকে বের করে সবাইকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘ব্ল্যাকবেরি।’ বছরের পর বছর নিউ আলিপুরের নতুন বাড়িতে তার বুড়ো বাবা মা বসে থাকত বারান্দায়। দ্বিতীয় এবং শেষবার সে এসেছিল তারা মারা যাবার পর। বাড়ি বেচতে।
আমার মত আর একজন, তিনি নিশ্চিন্তে ম্যাগাজিন উল্টোচ্ছেন। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছি, ঘরে আর কি কি আছে। বা নেই। এই বাড়ির আসল বাসিন্দাদের দেখা পাওয়া যায় নি এখনও। ঘরদোর ঝকঝকে তকতকে। আসলে যে নেই-টা অসুবিধের কারণ হয়ে উঠেছে তা হল, অসহ্য নিস্তব্ধতা। সাউন্ডপ্রুফ পরিস্থিতি, রাস্তার শব্দ ঢুকতে পারে না। বেলটা বাজে নিশ্চয়ই। ক্লকটা ডাকে সময়মত, কেউ শোনে কি?। কুকুরটা কি বোবা? পুরো ব্যাপারটাই, আমাদের এসে পড়া সহ, একদম সাররিয়াল। অবাস্তব জগতে সাউন্ডট্র্যাক থাকে না? স্বপ্নে কিন্তু শুনেছি।
পিন ঠোকাঠুকির মত শব্দ করে বেল বাজল। কাজের লোক নিচে নেমে গেল বেড়ালের মত। মহা হৈ হল্লা করতে করতে ওপরে উঠে এল নানা বয়েসী কয়েকজন। সঙ্গে দুটি বাচ্চাও। বড়দের একজনের হাতে পেল্লায় কেকের বাক্স। অন্যদের হাতে ঝলমলে আরও অনেক কিছু। আমাদের চেনা দুজন বেরিয়ে এসে, ‘আরে তোমরা আসছো জানিই না। গ্রেট, গ্রেট, এই দেখো ওনারাও আসতে রাজি হয়েছেন’ বলে আমাদের দেখালো। ‘খুব, খুব ভালো করেছেন আপনারা এসেছেন, ইন ফ্যাক্ট আমরা আর একটু হলে ইভনিং ফ্লাইট মিস করতাম, বসুন বসুন, আসছি,’ বলে সবাই মিলে আগের ঘরে ঢুকে পড়ল। সামান্য কথাবার্তার আওয়াজ, হাসাহাসি। ভল্যুম বেড়েছে। কুকুরটা, একটু যেন সন্ত্রস্ত, দৌড়ে বেরিয়ে এসে আমার পায়ের মাঝখানে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল। ভয় পেয়েছে? সেও কি কানে আওয়াজ এলে ভালো থাকে? খাবারের গন্ধ ভেসে আসছে না? কারুর জন্মদিন ? আনন্দের কিছু? এই তো দেখলাম কেক ঢুকল। আমরা তাহলে কে? আমাদের কি খেতেও দেবে? যে ঘর থেকে হ্যা হ্যা শুনছিলাম, সেখান থেকে একটা প্লাস্টিকের বল গড়িয়ে এল। পরমুহূর্তে সেই বাচ্ছা দুটো। ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে বল দখলের লড়াই করে, সেটা ফেলে রেখে অন্য কোথাও চলে গেল। কাজের লোক ঢুকল। হাতে এক টাওয়ার প্লেট। খুব সাবধানে, একটুও আওয়াজ না করে, নামিয়ে রাখল ডাইনিং টেবিলে। ম্যাটের ওপর। কাঁটা, চামচ সাজিয়ে রাখল সন্তর্পনে। আমার কাউন্টার পার্ট এসেই ফোন খুলে ফেলেছেন। বললেন, ‘পাকিস্তান ইজ ফিনিশ্ড।’ আমিও বললাম, ‘সিভিল ওঅর?’ উনি বললেন, ‘শ্রীজাতর সিনেমাটা দেখা উচিত।’
পকেটে হাত দিলাম। অভ্যাসে। এই সময় ফোনটার খুব দরকার পড়ল। এভাবে বেকার বসে না থেকে কিছু একটা দেখা যেত। উঠে চুপচাপ কেটে পড়লে কেমন হয়? না, তা সম্ভব নয়। নাম্বার টু, তিনি আমার কেউ নন। তা সত্ত্বেও, ওনাকে বলে যাওয়াটা কেমন যেন একটা ব্যাপার হবে। দুই, সদর দরজা খুলতে না পারলে? সুড়সুড় করে ফিরে এসে বসে পড়তে হবে। আগে মনে হয় নি, এখন অস্বস্তি হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে একটা কিউরিওসিটি বাড়ছে সেটাও সত্যি। ঘরের ভেতরে সমস্বরে অনেকে বলে উঠল, ‘হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার।’ সংক্রান্তি পেরিয়ে ঠান্ডা নেমে গেছে। এখন আবার এসব কি? বড়লোকের খেয়াল হতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যে ‘হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার জুজু, হ্যাপ্পি বার্থডে টু ইউ,’ শুনে থাকতে না পেরে দু নম্বরের দিকে তাকালাম। উনি ক্যাজুয়ালি দরজার দিকে তাকালেন। ভাবিত, এমন মনে হল না। আমাদের মেয়েটা দুটো মাঝারি প্লেটে কেক, চামচ এনে আমাদের দিয়ে ফিরে যাওয়ার আগে হাসিমুখে বলে গেল, ‘আসছি।’ ছেলেটা একবার বেরিয়ে, ‘আর জাস্ট একটু, এরপর ডিনার’ বলে চলে গেল।
বুঝতে পারছিলাম ঘরের মধ্যে কেউ একজন আছেন, তাঁকে নিয়েই এইসব চলছে। কে তিনি? অনেক বছর আগে যিনি দুপুরে ফোনে থাকতেন? নিজে লুকিয়ে দরজা খুলতেন? নাকি একেবারে অন্য কেউ? কুকুরটা আবার বেরিয়ে পড়ল। আমার কাছে এলো না। অন্যদিকে চলে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ঘরের ভিড়টা এবারে বেরোবে বোধ হয়। কিছু একটা আন্দাজ করে উঠে দাঁড়ালাম। হাত দিয়ে নিজের জামাটা ইস্তিরি করে নিলাম। বেরোলো সবাই। বেজ রঙের ট্রাউজার আর সামান্য ঢোলা শার্ট পরা বয়স্ক একজন লম্বা মানুষকে নিয়ে। নিয়ারেস্ট ম্যাচ, পাহাড়ি সান্যাল, একটু রাফ ভার্সন। ধীরে ধীরে ওনাকে ডাইনিং টেবিলের এক দিকের সিঙ্গল চেয়ারে বসান হল। খাবারের পাত্রগুলো আগেই সাজানো ছিল। ক্যাসারোল দেখিয়ে ওনাকে বলা হল, ‘এতে তোমার রুমালি আছে।’ উনি বিশেষ উৎসাহ দেখালেন না। এদিক ওদিক তাকালেন, কাউকে যেন খুঁজছেন। কাজের লোক এসে কি একটা বলল। আমাদের দেখেন নি তা হতে পারে না। কিছু বললেন না। ওনাকে ঘিরে সবাই কথা বলে যাচ্ছিল নিজেদের মধ্যে। এদিকে আমি দাঁড়িয়ে আছি। নাম্বার টু আগের মতই বসে। খুব অড পরিস্থিতি। বসে পড়লাম। একজন ওনাকে জিজ্ঞেস করল, ‘লুচি না ফ্রাই, আগে কোনটা দেব?’ উনি কিছু না বলে আঙ্গুল দিয়ে প্লেটের মাঝখানটা দেখালেন। সব প্লেট সাজান আছে। কেউ বসে নি। ওনাকে আগে খাইয়ে দেওয়া হবে হয়ত। এই আর যারা রয়েছে, তারা না বসলে বা আমাদের না ডাকলে বসা যায় না। আমরা দুজন কি সত্যিই নিমন্ত্রিত? কেন? খুব কনফিউজিং ব্যাপার।
উনি বসে আছেন আমাদের দিকে মুখ করে। একবারও তাকাচ্ছেন না। বিশেষ কিছু খাচ্ছেন কি না, সোফায় বসে বুঝতে পারছি না। খাস বেয়ারা পাশেই আছে। কি একটা বললেন, সে পকেট থেকে রিমোট বের করল। আন্দাজ করলাম খুঁতখুঁতে লোক। সারাবছর, সবসময় ঘরের তাপমাত্রা ঠিক রাখা পছন্দ করেন। খুব যদি আমার চোখের ভুল না হয় তাহলে, দেখলাম ঘরের আলোর পরিবর্তন হচ্ছে খুব ধীরে ধীরে। ওনার ওপর অদৃশ্য কোনো সোর্স থেকে পড়া একটা টপলাইট। বাড়ছে। ছাই শাদা পাতলা চুল, কপাল, নাক উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। চোখ ঢুকে যাচ্ছে কোটরের ব্ল্যাক হোলে। নাম্বার টু-কে দেখে বুঝলাম, আমাদের ওপরেও বাড়ছে আলো, সামনে থেকে আসছে। এবারেও সোর্স খুঁজে পেলাম না। বাকি সব জায়গায় কমে গেছে। সেখানে তলিয়ে যাচ্ছে অন্যেরা। কেউ আর কোনো কথা বলছে না। পাশ থেকে চাপা স্বরে শুনলাম, ‘গডফাদারের ফার্স্ট সিনটা মনে আছে কি?’ উনি আমাদের ওপর নজর রাখছেন তাহলে। অল্প খাচ্ছেন, থামছেন, মাথার রগটা ফুলে উঠছে। বাচ্চা দুটো কোথায়?
কি মনে হল, উঠে দাঁড়ালাম। এজ ইফ কেউ নেই, কিছুই হচ্ছে না। সবার পাশ দিয়ে, ডাইনিং টেবিল পেরিয়ে হেঁটে গেলাম একমাত্র আধ খোলা দরজার দিকে। কি আর হবে? হাঁ হাঁ করে উঠবে সবাই? বা উনি নিজে? অন্যের প্রাইভেট স্পেসে ইন্ট্রুড করতে চলেছি বলে ? আমার দিকটা কেউ বুঝবে না? দুটো অচেনা মানুষের কথায় অকারণে এসেছি। কারণ যাই হোক, আমার কোনো দরকার ছিল না। ভালো মন্দ খাবারের লোভে, অবশ্যই নয়। আমাকে জানানোই হয় নি যে একজন পয়সাওয়ালা, খেয়ালি, টেক-স্যাভি, সম্ভবত একা থাকা প্রৌঢ়ের বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে কিছু লোকের। সঙ্গে আরও কিছু অচেনা লোকের কি দরকার, কে জানে। এত কথার দরকার নেই। এই মুহূর্তে আমাদের অস্তিত্বটুকু অস্বীকার করার এমন অভদ্রতা মেনে নেওয়া যায় না।
কেউ কিছুই বলল না আমাকে। হলোগ্রাফিক ইমেজের মত আমি ঢুকে পড়লাম অন্য ঘরে। একটা সিঙ্গল খাট ছাড়া কিছুই নেই। আছে, একটা মনিটর। তার মধ্যে অনেকগুলো জায়গার ছবি। একটায় সদর দরজার বাইরের রাস্তা দেখা যাচ্ছে। সামনের মেঝেতে পড়ে আছে বলটা। বাচ্চাদুটো খাটের ওপর, এক কোণে, পাশাপাশি। বসে আছে ভয়ার্ত মুখে। বলটা তুলে ইশারা করলাম, ‘খেলবে?’ একজন মাথা নাড়ল দুদিকে। একজন আঙুলের ইশারায় বুঝিয়ে দিল, ‘চুপ।’ আমার রোখ চেপে গেল। বলটা দমাস করে ছুড়ে দিলাম। ওদের মাথার ওপরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে সেটা ফিরে এলো আমার হাতে। ব্যূমেরাংয়ের মত। আমার পিছনে একটা চাপা গরগর শুনলাম। কুকুরটা। এই প্রথম। তাকেও বল ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করলাম। এক পা পিছিয়ে গেল। আমি চাইছিলাম একটা ধুন্ধুমার কান্ড করতে। কোথায় সেই লুকোনো কন্ট্রোলার যেখান থেকে সব আলো ফুল ফোর্সে জ্বেলে দেওয়া যায়? টেম্পারেচার কন্ট্রোল চটকে হয় অগ্নুৎপাত বা তুষার ঝড় ডেকে নেওয়া যায়? ইচ্ছে করছিল আলমারির কাঁচ ভেঙে ট্রেনগুলো মাটিতে ছড়িয়ে দিতে। ডিনার টেবিল লন্ডভন্ড করে দিতে। পয়জন টেস্টার একটা রেকাবি জিভ দিয়ে চেটে হিংস্রভাবে বলতে, ‘লুক, ইটস অল ফেক।’ বেরোলাম। হালকা প্লাস্টিক বল হাতে নিয়ে। ঘরে সবাই যে যার জায়গায়। পাথরের মত, ছবির মত নির্বাক। সেখানে আলোটা আগের মত। পিছন থেকে ওনার মুখ দেখতে পাচ্ছি না। আষ্টেপিষ্টে বন্ধ এই হাজারদুয়ারীর মধ্যে বলটা ওদের দিকে ছুঁড়ে মারলে তার ইম্প্যাক্ট হবে দলমাদন কামানের গোলার মত। আমাদের বসার জায়গা অন্ধকার। নাম্বার টু সেখানে নেই। মাটিতে ফেলে দিলাম বলটা। একটু গড়িয়ে থমকে গেল।
কোনো দিকে আর না তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম নিচে। ল্যাচ ঘোরাতে প্রথম দরজা খুলে গেল। নিচেরটাও। চটির তলায় ফুটপাথের স্পর্শ পেয়ে, রাস্তার চকমকি আলো মেখে মাথা ঠান্ডা হল। পকেটে হাত দিলাম অভ্যাস মত। ‘নিন, ধরান, চলবে এটা?’ নাম্বার টু এই মুহূর্তে আমার ঠিক পাশে। একটা খোলা প্যাকেট এগিয়ে দিয়েছেন। তার ভেতর থেকে আপনি আপনি এগিয়ে আসছে একটা সিগারেট। এর পিছনে অপেক্ষা করছে ধারালো নীল আগুন বেরোনো হিসহিসে গ্যাস লাইটার।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র