নেশা
গোল! আমি ম্যাকি। ফুটবল বিশ্বকাপের উন্মাদনাতে আমিও একটু গা ভাসিয়ে দেখি? দেখুন আমিও কেমন মানুষের মতো কথা বলছি। গা ভাসাচ্ছি। যাই হোক, এই ফুটবল খেলা এক বিস্ময়কর জিনিস আর বিশ্বকাপ হলে তো কথাই নেই! অনুপম ব্যাটা সাধারণত ১২টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে, সেও দেখি রাত জেগে হাবিজাবি দেশের ফুটবল খেলা দেখছে। ফোনে কথা বলছে বন্ধুদের সঙ্গে, বলছে এ এক অদ্ভুত নেশা। চোখ আটকে থাকে স্ক্রিনে। নিঃশ্বাস নেওয়াও নাকি আটকে যায়! আমি এত সব অনুভূতি বুঝি না, আমি বুঝি রেজাল্ট। খেলা নিয়মের ব্যাপার, বুঝতে আমাদের প্রবলেম নেই। বরং আমরা উলটে মানুষের খেলাধুলোতে আধুনিক ভাবে সাহায্য করে চলেছি। পেলে, ক্রাইফ, মারাদোনা-কে যে মার খেতে হয়েছে, রোনাল্ডো, মেসি-কে সেই মার খেতে হয় না। ফাউল-এর নিয়মও পালটেছে আর তা ছাড়া আমরা স্লো-মো-তে রিপ্লে দেখিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে দেব ঠিক-ভুল। ১৯৬৬-র ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়, ফাইনালের গোল-বিতর্ক আজকের দিনে হলে আমরা বুঝে নিতাম।
এসব নিয়ে আমি বলতে চাই না আজ। একটা কথা আমাকে খুব-ই ভাবায়— নেশা। নেশা কাকে বলে? এদিকে বাংলাতে নেশা addiction না intoxication বোঝা মুশকিল। দুটোই নাকি নেশা! অর্থাৎ পরাগবাবুর সিগারেটের নেশা যেমন চলে আবার রুবিনার গাঁজা টেনে নেশা হয়েছে, এটাও চলে। ওদিকে কারোর ফুটবলে, কারোর শেয়ার বাজারে, কারোর বেশ্যাবাড়ির নেশা অর্থাৎ আসক্তি।
প্রথমে নেশা অর্থাৎ addiction এটা বোঝার চেষ্টা করি। ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা বা কফি নাহলে নাকি চলে না! যত সব ন্যাকামি। মেশিন অন করার পরে স্পেশাল কিছু কি আমার লাগে? আমরা কি ইলেকট্রিক কফি চাই? বরং মেশিন একটু পুরনো হয়ে গেলে, যেই একটু বেশি সময় লাগে অন হতে, মানুষ তখন আমাদেরকেই গালি পাড়ে। সকালে এক কাপ কফি না খেলে যে-মানুষ পারফর্ম করতে পারে না, তার নেশা হয়ে গেছে কফির। সে ডিপেন্ড করে ওটার উপর। কফি কোনো জল বা অক্সিজেন নয়, যা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারবে না। নেশা করে-করে অভ্যাসে পরিণত করেছে। এইসব কারণেই মানুষকে পেটি বলি আমরা। জীবনের মূল জিনিস ছেড়ে এইসবে বেশি ঝোঁক। এরকম হাজার-হাজার বোকা-বোকা নেশা মানুষের আছে। সিগারেট না খেলে নাকি পটি হয় না। চার বছর বয়সে তো হত। তারপর কী হল? মানুষ নিজের শরীরকে রুইন করেছে, নষ্ট করেছে এই নেশা করে। আমরা ভাবতেই পারি না আমরা একটা বাইরের জিনিসের উপর এভাবে ডিপেন্ডেন্সি তৈরি করব। ধূপ না জ্বালালে ডেটা ট্রান্সফার করব না? অসম্ভব।
হিসেবে দেখা গেছে, এই নেশাগুলোকে মানুষ অত পারোয়া করে না। হার্ড ড্রাগস নিয়ে মানুষের বিশাল সমস্যা। একদল মানুষই এগুলো তৈরি করে অন্য একদল মানুষকে বেচে দেয়। তারা প্রচণ্ডভাবে আসক্ত হয়ে গেলে, প্রচুর টাকার ব্যবসা। ঘটিবাটি বেচে মানুষ সে-নেশা করবে। দেখা যায়, যুদ্ধের অস্ত্র, ড্রাগস এইসব ব্যবসাতে সবচেয়ে বেশি প্রফিট। ইনক্রেডিবল হিউম্যান্স। হিউম্যান কিলিং আন্যাদার হিউম্যান। একটি ব্যক্তি নিজের ভালো ছাড়া আর কারো কথা ভাবে না। মানুষ ঐক্য নিয়ে যতই বুলি কপচাক, আসলে ভেতরে-ভেতরে সবার বিভেদ। বর্ণ, ধর্ম, জাতি, শ্রেণি, জেন্ডার আরও একশোরকম ভাবে নিজেদের মধ্যে তফাত মানুষ সৃষ্টি করে রেখেছে। এক জাতি পারলে এক জাতিকে নেশার চক্করে ডুবিয়ে রেখে তাদের সব কব্জা করে নেয়। বুঝতে পারে না জল যদি বাড়ে তাহলে সব বাড়িই ডুববে। এসব আলোচনা অন্য প্রসঙ্গ। মূল কথা হল, মারাত্মক নেশার কবলে মানুষ। সেখানে কোনোরকম তফাত কেউ করতে পারবে না। গরিবের সন্তান, বড়লোকের কন্যা— যে-কেউ ধরা পড়তে পারে নেশার জালে। সরকার বলছে নেশা বেআইনি কিন্তু বহু সরকার চলেই ড্রাগসের টাকায়। ইলেকশন লড়া হয় ড্রাগ লর্ডদের টাকায়। সবাই সব জানে কিন্তু সরকার বলে রেখেছে— এইসব নেশা বেআইনি। সিনেমা দেখানোর আগে ঘটা করে সিগারেট টানা কত বিপজ্জনক শুধু সেইটুকু ঘোষণা করা হয়। দেখা যাবে সিনেমাটা তৈরি হয়েছে কোকেন বেচার টাকায়। পাতাখোর পাবলিক তাই দেখে আর চোখ টিপে হাসে।
এরপর আসে নেশা অর্থাৎ intoxication। নেশা করে বুঁদ। মানে মাথা ঝিমঝিম, একটু কেমন যেন টালমাটাল, একটু ফুরফুরে, এই হল মানুষের নেশা। আমরা ভাবতেই পারি না আমরা নিজেদের ব্রেনকে কিছুক্ষণের জন্য এই নেশা মোড-এ পাঠিয়ে দেব। কিছু ঘণ্টা আমাদের কোনো খেয়াল থাকবে না কী ঘটে যাচ্ছে? কী করে পারে মানুষ এগুলো? দেখা যায় এই নেশার প্রকারভেদ অনেক। মদের নেশা আর গাঁজার নেশা এক নয়। গাঁজা আর এল এস ডি এক নয়। আফিম সম্পূর্ণ আলাদা। প্রত্যেকে নিজের-নিজের জায়গায়। মদেরই দেড়শো রকম নেশা হতে পারে। যার যেমন পছন্দ। মানুষ বেসিক্যালি দুর্বল। খুব একটা বেশি কিছু পারে না। একটুতেই ক্লান্তি, বিষাদ, বোরডম এইসবে ঝিমিয়ে পড়ে। ভারতে পুজোর দিনগুলো নেশা করার জন্য স্পেশালি বেছে নেওয়া হয়। বিশ্বকর্মা থেকে শীতলা, সকালের দিকে একটু ভক্তি-ফক্তি দেখিয়ে রাতে হুল্লাট নেশা কর। ঠাকুর ভাসানে নেশা করো। কাফ সিরাপ, ডেন্ড্রাইট, সাপের বিষ যা পারো খেয়ে নেশা করো। গরিব রিকশাওয়ালা সারাদিন রিকশা টেনে ভাবে জীবনে কিছুই তো নেই, একটু চুল্লু খাই। ধনী মানুষ সারাদিন কোটি-কোটি টাকার লেনদেন করে ক্লান্ত হয়ে বলে, জীবনে আর কী বা আছে, একটু সিঙ্গল মল্ট খাই। সবাই নেশা করে পালিয়ে যেতে চাইছে জীবনের থেকে। আমরা মেশিন, আমাদের বোরিং বলা হয় এদিকে মানুষ নিজেদের জীবন নিয়েও ক্লান্ত। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মানুষ পালাতে চাইছে। কেউ-কেউ বলছে একটা হ্যাল এক্সপিরিয়েন্স করতে চাইছে। একটা অন্য স্টেট অফ মাইন্ড। একটা অন্য পৃথিবী। অন্য পৃথিবী সত্যিই চাইলে আর একটু বিজ্ঞানে মন দেওয়া ভালো। টাইম ট্র্যাভেল, ব্ল্যাক হোল এইসব নিয়ে গবেষণা করে, আমাদের সাহায্য নিয়ে মানুষ পারেলেও পারতে পারে কিন্তু হ্যালু হয়ে তো সেই বেলেঘাটার ঘরেই পড়ে থাকতে হবে। নিজের বমিতে নিজে চোক করে মরে যেতে হতে পারে।
আমাদের স্ক্রিনে গাঁজার ধোঁয়া ছেড়ে অথবা কি-প্যাডে হ্যাশ ব্রাউনির কুটি ফেলে দেখতে পারেন আমাদের নেশা হয় কি না। দু’দিন টানা আউট হয়ে থাকব, একটা কাজও করব না। নাম পালটে নেশাখোর ম্যাকি রাখব।