ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ইউক্রেনের বাজিমাত


    সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় (December 9, 2022)
     

    দুই বোন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। দুই বোন ফর্সা টুকটুকে। দুই বোন চ্যাম্পিয়ন। দুই বোন দাবা খেলুড়ে। দুই বোন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। দুই বোন ইউক্রনের বাসিন্দা। দুই বোন কান্না চেপে আছে। দুই বোন—আনা আর মারিয়া মুজিচুক। ইউক্রেনের বাসিন্দা। গ্র্যান্ডমান্টার তকমাধারী। 

    সম্প্রতি এই দুই বোন এসেছিলেন কলকাতায়। টাটা স্টিল চেস ইন্ডিয়া— ব়্যাপিড অ্যান্ড ব্লিৎজ, ২০২২ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। খেলার ফাঁকেই একদিন কথাবার্তা হল কিছুক্ষণ। 

    তবে আমরা যেহেতু মেয়েদের দাবা নিয়ে এখনও তেমন জানিনা, তাই এঁদের সম্পর্কে কিছু কথা আগে বলে নিই। 

    আনা ওলেহিভনা মুজিচুক—জন্ম ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ সালে ইউক্রেনে। আনা একজন গ্র্যান্ডমাস্টার। তিনি দাবার ইতিহাসে চতুর্থ মহিলা যিনি ২৬০০ ফাইড রেটিং অর্জন করেছেন৷ তিনি বিশ্বের ১৯৭ নম্বর এবং মহিলাদের মধ্যে ২ নম্বর স্থানে রয়েছেন৷ মুজিচুক ‘ব়্যাপিড’ ঘরানার দাবাতে তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, ২০১৪ সালে একবার মহিলাদের বিশ্ব ব়্যাপিড দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন এবং ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে দুবার মহিলাদের বিশ্ব ব্লিৎজ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন৷ ধ্রুপদী দাবাতে, তিনি ২০১৭ মহিলা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ রানার্স ছিলেন। 

    মারিয়া ওলেহিভনা মুজিচুক—জন্ম ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৯২, ইউক্রেনে।ছোট বোনও একজন ইউক্রেনীয় দাবা গ্র্যান্ডমাস্টার এবং এপ্রিল ২০১৫ থেকে মার্চ ২০১৬ পর্যন্ত মহিলা বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন। তিনি ২০১২ ও ২০১৩ সালে ইউক্রেনীয় মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। এবং ২০১৩ সালে বিশ্বটিম ও ইউরোপীয় টিম চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তিনি ২০২২ সালে মহিলা দাবা অলিম্পিয়াডে সোনা, ২০১৮ সালে রুপো এবং ২০১২, ২০১৪ ও ২০১৬ সালে ব্রোঞ্জ জিতেছেন।  

    এ তো গেল এঁদের গুণকীর্তির কথা। কিন্তু আসল জীবনটা কেমন কাটছে এই দুই মেয়ের। দেশে যুদ্ধ চলছে। মা-বাবা-দাদু-ঠাকুমা-আত্মীয়স্বজন, সবাই ইউক্রেনে যুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝছে। আর দুই বোন যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে দেশ ছেড়ে স্পেনে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। খেলা বাঁচাতে। খেলা বাঁচাতে গেলে প্রাণ বাঁচাতে হবে। আর প্রাণ বাঁচাতে গেলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে দূরে থাকতে হবে।কেউ কেউ বলবেন স্বার্থপর। কিন্তু খেলাই তো তাঁদের কাছে জীবন, বিপন্ন হলেও জীবন বাঁচানোর চেষ্টা তো করতেই হবে, তাই না? আর সত্যি কথা বলতে কী, দেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য হলেও, এই দুই বোনের মন-প্রাণ কিন্তু পড়ে রয়েছে দেশেই। 

    ‘কেউ যখন নিজের খেলার সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছয় এবং সেখানে নিজেকে ধরে রাখতে পারে, তখন তার আর কোনও ফেভারিট খেলোয়াড় থাকে না। সে তখন নিজের খেলার স্টাইল নিজে সৃষ্টি করে। সেটাই হয় তার ‘‘ওন গেম’’’। হ্যাঁ, এমন ঔদ্ধত্য বোধহয় এমন ক্ষুরধার বুদ্ধিমতীকেই মানায়। আনঅ্যাপোলোজেটিক। নিজের খেলার ব্যাপারে, নিজের আদর্শের ক্ষেত্রে এবং নিজেকে কনডাক্ট করার সময়। 

    দেশ ছেড়ে আসার পর থেকে মা-বাবা-আত্মীয়স্বজন কারো সঙ্গে দেখা হয়নি। কেবল ফোনে যোগাযোগ। কবে দেখা হবে তাঁরা জানেন না, কবে দেশে ফিরতে পারবেন, তা-ও জানেন না। কেবল উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত কোনও উপায় নেই। 

    অন্য সবার মতো আনা আর মারিয়াও ভেবেছিলেন, এই আধুনিক সময়ে নিশ্চয়ই আর তেমন করে যুদ্ধ বাধবে না। কিন্তু হল, আর যদি বা হল, এতদিন ধরে এই যুদ্ধ চলবে, এ ভাবে একটা আস্ত দেশকে রাশিয়া গুঁড়ো করে মানবসভ্যতা থেকে ইরেজার দিয়ে মোছার চেষ্টা করবে, — এ কথা তাঁদের বিশ্বাস হয়নি। 

    আনা বলছিলেন, ‘সবাই যখন টেলিভিশনে খবরে দেখে ইউক্রেনের একটা বিরাট অঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই, তখন তাঁদের খুব কষ্ট হয়, তাঁরা হয়তো দরদী মন নিয়ে ভাবেনও, কিন্তু যাঁরা ওখানে রয়েছে তাঁরা বুঝছেন আর আমরা বুঝছি, পরিস্থিতি কত কঠিন কত কষ্টের। বিদ্যুৎ নেই মানে এই শীতে কী করে মানুষ বেঁচে থাকবে, সেটাই ভাবাব বিষয়, ভয় পাওয়ার বিষয়।’

    দুই বোন প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘জানেন ট্রেনিংয়ে মন বসাতে পারি না। ট্রেনিং কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের। একে তো নতুন দেশ, সেখানকার নিয়মকানুন। তার ওপর আমরা তো আর ঘুরতে আসিনি, আপাতত থাকতে এসেছি। তাই যে কোনও রকম কাজ করতে গেলেই হাজারটা কাগজপত্র দেখাও। প্রতিটি কাগজপত্র তৈরি করে হাতের কাছে রাখা, এই সব করতে হচ্ছে। এই ধরনের ব্যাপারস্যাপার মনঃসংযোগে খুব ব্যাঘাত ঘটায়।’

    দুজনের মখচোখ দেখে বুঝতে পারলামস যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নিয়ে আর কথা বলতে ভাল লাগছে না তাঁদের। নিজেদের কষ্ট করে বার বার খুঁড়ে মিডিয়ার সামনে বর্ণনা দিতে খুব ভাল লাগছে না। লাগার কথাও নয়। দুজনের মন খারাপ হওয়ায়, প্রসঙ্গান্তরে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, বছর কয়েক আগে সৌদি আরবে খেলতে যেতে অস্বীকার করেছিলেন, হিজাব পরতে হবে বলে, মাথা ঢাকতে হবে বলে। আর খেলতে যেতে অস্বীকার করায় হাতছাড়া হয়েছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ, পদক, রেটিং। কেরিয়ারের শীর্ষে থাকার সময় এত বড় ঝুঁকি নিলেন কী করে?

    উত্তরে যেটা শুনলাম, তাতেই বোঝা যায় গ্রেটনেস যার মধ্যে থাকে, তার চিহ্ন সব ক্ষেত্রেই প্রতিভাত হয়। হ্যাঁ, ব্যতিক্রম থাকে বইকী! খেলায় গ্রেট হলেই যে অন্যত্রও একই গুণের ঝলকানি দেখা যাবে, তা না-ও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তা হয়নি। আনা বললেন, আসলে যখন আমরা খেলতে যেতে অস্বীকার করি, তখন আমরা মেয়েদের প্রতি, সংস্কৃতির প্রতি, শুভবুদ্ধি এবং যুক্তির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে করি। আমার মনে হয়েছিল, আমরা যদি সে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করি, এবং তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করি, তা হলে ওদের দেশে গিয়ে খেলছি বলেই আমার সংস্কৃতি ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে খর্ব করে ওদের আদেশ মেনে ব্যবহার করতে হবে, এই ডিমান্ডটা অন্য়ায়।  আমরা যে ফেমিনিস্ট হব বা ফেমাস হব, এ সব ভেবে কিছু করিনি। তখন যেটা আদর্শগত ভাবে ঠিক মনে হয়েছিল সেটাই করেছি। কিন্তু দেখলাম, এই প্রতিবাদের পর বহু মেয়ে বিশেষত বিভিন্ন খেলার সঙ্গে যুক্ত মহিলা খেলোয়াড়রা আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, আমাদের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হচ্ছেন। তখন মনে হয় ঠিক কাজই করেছি। 

    টাটা স্টিল চেস ইন্ডিয়া— ব়্যাপিড অ্যান্ড ব্লিৎজ, ২০২২ প্রতিযোগিতাযর শেষ দিনে মেয়ে দাবারুরা

    পরের প্রসঙ্গে ভারত। এই নিয়ে দু’বার ভারতে পা রাখলেন দুই বোন। প্রথমবার চেন্নাইয়ে, বিশ্বদাবা অলিম্পিয়াডে আর দ্বিতীয়বার কলকাতায়। চেন্নাইয়ের মশলাদার খাবার খুব পছন্দ না হলেও, ভারতকে চমৎকার লেগেছে। কলকাতার আতিথেয়তা তো বিশেষ করে মুগ্ধ করেছে তাঁদের। এমনকী এই প্রতিযোগিতার শেষ দিনে হ্যান্ডলুমের শাড়ি পরে মাতিয়ে দিয়েছেন বিদেশিনীরা। 

    কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, কার খেলা ভাললাগে। ছোটবেলা থেকে কার খেলা দেখে নিজেদের উদ্বুদ্ধ করেছেন? মারিয়া পরিচিত কয়েকটি নাম বললেন, ববি ফিশার, কারপভ এবং বরেণ্য একাধিক দাবা খেলোয়াড়। কিন্তু উত্তরে চমকে দিলেন আনা। বললেন, ‘কেউ যখন নিজের খেলার সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছয় এবং সেখানে নিজেকে ধরে রাখতে পারে, তখন তার আর কোনও ফেভারিট খেলোয়াড় থাকে না। সে তখন নিজের খেলার স্টাইল নিজে সৃষ্টি করে। সেটাই হয় তার ‘‘ওন গেম’’’। হ্যাঁ, এমন ঔদ্ধত্য বোধহয় এমন ক্ষুরধার বুদ্ধিমতীকেই মানায়। আনঅ্যাপোলোজেটিক। নিজের খেলার ব্যাপারে, নিজের আদর্শের ক্ষেত্রে এবং নিজেকে কনডাক্ট করার সময়। 

    এরপর কিছু এদিক সেদিকের কথা। কিন্তু একটা জিনিস বেশ ভাল বুঝতে পারলাম, তীক্ষ্ণতার শানে যখন আলো এসে পড়ে, তার ঝলকানি চোখ অন্ধ করে দিতে পারে। হ্যাঁ, তথাকথিত শাস্ত্রে এই সব মেয়েদের থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। সাধু সাবধান! কিন্তু এই মেয়েদেরই ধার,পথ কেটে নতুন পথ তৈরি করে নিতে পারে। সেই পথ ধরে পেছনের লোকেরা এগোক না! 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook