রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। আর অমনি পূর্ব ইউরোপের নানা দেশে এক সময়কার সোভিয়েত রাশিয়ার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত মূর্তি ও স্থাপত্য ভাঙার হিড়িক পড়েছে। তার কিছু কিছু আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী আমলের। এ কেমন হল? যুদ্ধের সঙ্গে স্থাপত্যের কী সম্পর্ক? আর সোভিয়েত রাশিয়া তো অনেককাল আগের ব্যাপার, ৩০ বছর আগেই সেসব চুকেবুকে গিয়েছে। ভ্লাদিমির পুতিনের কুক্ষিগত আজকের রাশিয়ার রাষ্ট্রের সঙ্গে, ঠান্ডাযুদ্ধের সময়ে পূর্ব ইউরোপ দাপানো সোভিয়েত শাসনব্যবস্থার কোনও সরাসরি সম্পর্ক নেই। তাহলে লাটভিয়া, পোল্যান্ড, বা এস্তোনিয়াতে সুদূর অতীতে সোভিয়েত রাশিয়ার স্মৃতির সঙ্গে জড়িত মূর্তি বা স্থাপত্য ভাঙা কি শুধু ‘যুদ্ধবাজ’ রাশিয়ার প্রতি অন্ধ রাগের বহিঃপ্রকাশ?
যে কোনো একটা এলাকা জুড়ে কোনও এক সমাজ বা রাষ্ট্র যখন নানা রকম মূর্তি বা স্থাপত্য খাড়া করে, তার গোড়ায় থাকে সেই এলাকার সামাজিক পরিসরের সঙ্গে নিজের সত্তাকে জড়িয়ে ফেলার তাগিদ। চেনা উদাহরণ দিই। বাম আমলের কলকাতা শহরের সামাজিক পরিসর ভরা থাকত লাল পতাকা, মার্ক্স-লেনিনের মূর্তি, ‘দিকে দিকে বামফ্রন্ট প্রার্থীদের বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করুন’ ইত্যাদি দেওয়াল লিখনে। ২০১১ সালে বামফ্রন্টের সরকারকে হারিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস বাংলায় সরকার গড়ল। কিছুদিনের মধ্যেই সব সরকারি বাড়িঘর, থানা, পুরদফতর, মায় রাস্তার মাঝের ডিভাইডার— সবই নীল-সাদা রঙে সেজে উঠল। সায়েন্স সিটির মোড়ে শানু লাহিড়ীর গড়া ভাষ্কর্য সরিয়ে বহাল হল শাসকগোষ্ঠীর মস্তিষ্কজাত বিশ্ববাংলার ঘুরন্ত এক গ্লোব। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের সামনে খাড়া হল আখাম্বা নতুন মূর্তি, তার লম্বা দুটো মাংসল পা, আর কোমরের উপরে বাকি শরীরের বদলে বিশ্ববাংলার গোলক। ক্রমে ভোটের মরশুম এল, লাল পতাকার বদলে শহরের আনাচকানাচ ভরে উঠল শাসকের দলীয় পতাকা আর ভোটপ্রার্থীদের জোড়হাত করা ছবিতে। শহরটা একই থাকল, তবে তার সামাজিক পরিসরটা পালটে গেল, বোঝা গেল রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তর।
‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে, রাজ্যের পরিসরটাকে নিজের বলে জাহির করার জন্য রাজা নিজের এক বিরাট মূর্তি খাড়া করলেন। আবার গুপি-বাঘার কৌশলে যেই রাজার মগজধোলাই করা হল, অমনি রাজ্যের লোক ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান’ বলে টেনেটুনে সেই মূর্তি ভেঙে চুরমার করল। অর্থাৎ, যেই অত্যাচারী রাজার কুশাসন শেষ হল, অমনি রাজ্যের সামাজিক পরিসর জুড়ে তাঁর উপস্থিতিরও ইতি। এর পরে কী ঘটল, হীরক রাজ্য শাসনের দায়িত্বে কে এলেন, তিনিও আবার নিজের মূর্তি বানালেন কিনা, সেসব কথা অবশ্য মানিকবাবুর ছবিতে নেই।
আরেকটা উদাহরণ বামিয়ানের বুদ্ধ। চতুর্থ ও সপ্তম শতকের মাঝে পাহাড় কেটে তৈরি করা দুটো সুবিশাল মূর্তি। সে আমলে মধ্য এশিয়ার রেশম পথের উপর অবস্থিত আফগানিস্তানের এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম ছিল সুবিস্তৃত। এলাকার সামাজিক পরিসরকে বৌদ্ধ এক পরিসর হিসাবে গড়ে তোলার জন্য এই বিশালকায় মূর্তি দুটো বানানো হয়। গত প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে টিকে ছিল তারা। কিন্তু ২০০১ সালে তারা আফগানিস্তানের তালিবান শাসকদের রোষের মুখে পড়ল। গোঁড়া মুসলমান তালিবানের উদ্দেশ্য দেশটাতে ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা। মূর্তি-পুজোর বিরুদ্ধে রাগ দেখিয়ে, কামান দেগে, বোমা ফাটিয়ে যখন তারা মূর্তিদুটোকে ধ্বংস করল, তখন সেই এলাকার সামাজিক পরিসর থেকে বৌদ্ধ আমলের চিহ্ন মুছে গিয়ে তা ইসলামি হয়ে ওঠার দিকে এক পা বাড়াল।
ঠিক এই জিনিসই হয় পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরে। জার্মান নাৎসিদের খেদিয়ে রাশিয়ার লাল বাহিনী একের পর এক দেশ দখল করে। আস্তে আস্তে পূর্ব ইউরোপের প্রায় প্রতিটা দেশে তারা সোভিয়েত সরকারের প্রতি অনুগত সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠন করে। আর অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে। কিন্তু এই তাবৎ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল পুরনো দিনের হাজারো মূর্তি, যা আগের জমানার জাতীয়তাবাদী ও দক্ষিণপন্থী নানা সরকারের খাড়া করা। অতএব হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রুমেনিয়া ইত্যাদি দেশে শুরু হল আগের জমানার বিভিন্ন মূর্তি উপড়ে ফেলা। এই সময়কার সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ অনুযায়ী, জাতীয়তাবাদ জিনিসটা বুর্জোয়া, তাকে সরিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাইত সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ। ফলে পূর্ব ইউরোপের নানা দেশে যেসব মূর্তি জাতীয়তাবাদী মানুষ বা ভাবাদর্শকে তুলে ধরার জন্য বানানো হয়েছিল, তা ভাঙা শুরু। কিছু কিছু মূর্তি যুদ্ধের গোলাগুলিতে আগেই জখম হয়েছিল। তাতে কমিউনিস্ট সরকারগুলির সুবিধাই হল; তারা সেগুলো আর মেরামত করল না। যেগুলো অক্ষত ছিল, তার কিছু সরকার বা পুরসভা নামিয়ে ফেলল সরাসরি জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করে, আবার কখনও সমাজতান্ত্রিক ভাবাপন্ন জনতা নানা প্রকাশ্য স্থাপত্য ভেঙে চুরমার করল। আক্রান্ত মূর্তির সিংহভাগ মধ্যযুগের পাদ্রি, পূর্ববর্তী জমানার অন্য রাজনৈতিক দলের শাসক, বা জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের মূর্ত কল্পনার।
এর পাশাপাশি নতুন সরকার শুরু করল নতুন মূর্তি ও স্থাপত্য বানানো (এবং নতুন ধরনের বাড়িধর বানানো, শহরের নকশা বদলানো, রাস্তার নাম পাল্টানো)। বেশ কিছু জায়গায় নাৎসিবাহিনীর বিরুদ্ধে লালবাহিনীর জয়ের কথা ঘোষণা করার জন্য বিজয়ী রুশ সৈন্যের বিরাট মূর্তি গড়া হল, হাতে তার বন্দুক, পাশে অনেক সময়ে সেই দেশের উল্লসিত শ্রমিক, চাষি, বা নাগরিক। অনেক জায়গায় বিজয় বা মুক্তির মতো বিমূর্ত ধারণাকে মূর্ত রূপ দেওয়া হল। তবে সবচেয়ে ঘটা করে বিভিন্ন জায়গায় খাড়া করা হল সে সময়কার সোভিয়েত রাষ্ট্রের কর্ণধার জোসেফ স্তালিনের অবয়ব। চল্লিশের দশকের শেষে ও পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় স্তালিনের ব্যক্তিপুজোর ধারা তুঙ্গে। গোটা পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত তাঁর মূর্তি বিভিন্ন সামাজিক পরিসরকে সোভিয়েত পরিসরে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করল। মূর্তির মাধ্যমে সোভিয়েত নেতা যেন দেশের বিভিন্ন কোনায় হাজির, নাগরিকদের উপর নজর রাখছে তাঁর চোখজোড়া, উন্নততর এক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে তাঁর উঁচু করা হাত। বহু টাকা ও সময় খরচা করে, নকশার প্রতিযোগিতা করে, সবচেয়ে উপযোগী নকশাটি বেছে নিয়ে, কোথায় মূর্তিটি খাড়া করা হবে তা আলোচনা করে, তবে মূর্তি বানানো ও প্রতিষ্ঠা করা হত।
এর প্রায় বছর ৪০ পরে, ১৯৮৯-১৯৯০ সাল নাগাদ, সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতন হল। নিজেদের দেশের উপর রাশিয়ার শাসকগোষ্ঠীর ছড়ি ঘোরানোয় ক্লান্ত পূর্ব ইউরোপের মানুষ অবশেষে গণআন্দোলনের মাধ্যমে একের পর দেশে সমাজতান্ত্রিক সরকার ফেলে দিল। এই প্রতিটি দেশেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সমাজতান্ত্রিক সরকার গড়ে ওঠার পিছনে ছিল রুশ লাল বাহিনীর জবরদখল ও চোখরাঙানি। জনরোষ শেষে যখন ফেটে বেরোল, তখন তার লক্ষ্য একইসঙ্গে দুটো – রাশিয়ার দাদাগিরি এবং সমাজতন্ত্র। সামাজিক পরিসরে সমাজতান্ত্রিক এবং রুশ প্রাধান্য কমানোর জন্য একের পরে এক সমাজতান্ত্রিক আমলের মূর্তি ভেঙে ফেলা শুরু হয়।
এর একটা দৃশ্যায়ন আছে জার্মান চলচ্চিত্র ‘গুডবাই লেনিন’-এ। সমাজতান্ত্রিক শাসন শেষ হয়ে নতুন জার্মানি যে ধনতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক রাস্তায় হাঁটা শুরু করেছে, তা মূল চরিত্রের মা দেখে উঠতে পারেননি অসুস্থতার জন্য অন্তরিন থাকায়। একদিন হঠাৎ রাস্তায় বেরিয়ে দেখলেন, একটা হেলিকপ্টার দড়ি বেঁধে লেনিনের প্রকাণ্ড মূর্তি তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে, উপরের দিকে ওঠানো মূর্তির হাত যেন সেই মাকে বিদায় জানাচ্ছে। পূর্ব ইউরোপের কিছু জায়গায় বেশ কিছু মূর্তি এভাবে লোপাট করে দেওয়া হয়। আবার হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের মতো কিছু জায়গায় বড় বড় মূর্তি আর ভাস্কর্য শহরের এক কোনায় ‘মেমেন্টো পার্ক’ নামে একটা জায়গায় নিয়ে জড়ো করা হয়। এক্ষেত্রে মূর্তিগুলো রয়ে যায়, কিন্তু দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থেকে তারা সামাজিক পরিসরটাকে যেভাবে সমাজতান্ত্রিক পরিসর বলে চিহ্নিত করছিল, তার অবসান ঘটে।
এর পাশাপাশি নতুন গণতান্ত্রিক সরকার এসে নতুন ভাবে সামাজিক পরিসরকে গড়েপিটে নিল প্রতিটি দেশেই। এর মাধ্যমও নতুন রকমের মূর্তি, ভাস্কর্য, স্থাপত্য খাড়া করা, স্তালিন বা লেনিনের মতো রুশ সমাজতান্ত্রিক নেতাদের নামে নামাঙ্কিত রাস্তাঘাটের নাম বদলানো, নতুন রকমের বাড়িঘর তৈরি। ফলে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে, তা গ্রামশহরের পালটে যাওয়া পরিসরের দিকে তাকালেই বোঝা গেল। সোভিয়েত জমানার কিছু সমাজতান্ত্রিক মূর্তি ও স্থাপত্য তাও আনাচেকানাচে টিকে গেল দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসাবে। এখন হঠাৎ রাশিয়া ইউক্রেনকে আক্রমণ করায় পূর্ব ইউরোপের মানুষের মনে পড়ে এগুলোর কথা। আরে, এগুলো যে এখনো জানান দিচ্ছে যে সামাজিক পরিসরটা এক সময়ে রুশদের অধীনে ছিল! অতএব, ভাঙো, ভাঙো!
তবে ভাঙা মূর্তিও বাঙ্ময়। যেমন বুদাপেস্টের মেমেন্টো পার্কে ঢোকার মুখে রয়েছে এক সুউচ্চ বেদি, তার উপরে স্তালিনের প্রকাণ্ড দুই বুটজুতো। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় বুদাপেস্ট শহরে স্তালিনের সুবিশাল এক মূর্তি তৈরি হয়েছিল। ১৯৫৬ সালে দেশের সমাজতান্ত্রিক সরকার ও তাদের প্রভু রাশিয়ার সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষ বিদ্রোহ করেন। সেই সময়ে স্তালিনের মূর্তিটিকে রুশ অত্যাচারের প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত করে উপড়ে ফেলা হয়। কিন্তু ভাঙার সময়ে বেদির উপরে মূর্তিমান স্তালিনের বুটজোড়া রয়ে যায়। তারই প্রতিরূপ বসানো হয়েছে মেমেন্টো পার্ক তৈরি হওয়ার পরে। সেখানে দাঁড়িয়ে এই জুতোগুলো সামাজিক পরিসর দখলের দড়ি-টানাটানির গল্প বলে চলেছে।