সুন্দরের মনখারাপ
একটা সময়ে শীতকাল মানেই ছিল পিকনিক। এমন নয় যে প্রতি হপ্তার শেষে একবার করে কোথাও-না-কোথাও বেরিয়ে পড়ছি, সেই সামর্থ্য বা অনুমতি, কোনওটাই ছিল না। কিন্তু এটুকু জানতাম, শীতের কলকাতা কুয়াশামোড়া থাকতে-থাকতে একদিন-না-একদিন অন্তত বন্ধুরা মিলে সময় কাটাব বাইরে কোথাও। পকেটে টাকা বলতে টিউশানির উপার্জন সকলেরই, তাই দূর-দূর যাওয়া বা বাইরে এলাহি ভাবে রাত কাটানো, এসব বিলাসিতার কথা ভাবতে পারতাম না কেউই। আর সত্যি বলতে কি, তেমন বড়সড়ো আয়োজনের দরকারও হত না। ওই যে চেনা চৌহদ্দির একটু হলেও বাইরে গিয়ে সারাটাদিন নিজেদের মতো করে হই হুল্লোড় করা, ওই যে শীতের টাটকা রোদ্দুরে গোল হয়ে বসে কমলালেবুর খোসা ছাড়ানোর সুগন্ধী আমেজ, ওই যে বাঁকাচোরা ব্যাডমিন্টন র্যাকেটের গা ঘেঁষে ঠান্ডা হাওয়ার কেটে বেরিয়ে যাওয়া, এসবের জন্যে অনেকদিনের একটা অপেক্ষা লুকিয়ে থাকত সকলের মধ্যেই। আর শীতকাল স্বয়ং হতো সেই ম্যাচের রেফারি।
যে-সময়ের কথা বলছি, সেটা নয়ের দশকের শেষাশেষি। কলেজ শেষ হব-হব আমাদের, সামনের দিনগুলোয় ঠিক কী করব, সেই সিদ্ধান্তও শীতের কুয়াশায় আড়াল হয়ে আছে, এইরকম একটা সময় তখন। আমরা কয়েকজন ছেলেমেয়ে মিলে একখানা পত্রিকা বার করি তখন। সম্পাদকের বাড়িতেই তার দফতর, প্রতি রোববার বিকেলবেলায় বৈঠক। এক হপ্তায় কে কী লিখেছে সেসব পড়ে শোনানো, সামনের সংখ্যায় কী কী বিষয় নিয়ে কাজ হবে তা ঠিক করা, কার ঘাড়ে কী দায়িত্ব সেই ভাগ-বাঁটোয়ারা এবং শেষমেশ কীভাবে টাকা জোগাড় করা হবে তার প্রাণান্তকর হিসেব। এই ছিল আমাদের সারা বছরের রুটিন। কাগজও নেহাত মন্দ হত না। আমরা নিজেরা তো লিখতামই, নানা তরুণের নতুন লেখায় ভরে উঠত তার পাতা, সেইসঙ্গে নামীদামি লেখক-কবিদের লেখাও পেতাম অল্পস্বল্প। তাই সে-কাগজ খুব কম সময়ে, একটু হলেও, নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছিল।
তা সে যা হোক, একবার এরকমই এক আবছা শীতকালে আমরা সকলে মিলে ঠিক করলাম, পিকনিক করতে হবে। প্রথমে ভাবা হচ্ছিল সম্পাদকের বাড়ির পাশের মাঠটাতেই করলে কেমন হয়, কিন্তু যে-পথ দিয়ে সারাক্ষণ যাতায়াত করছি, সেখানেই পিকনিক করার কোনও মানে হয় না, এই মর্মে স্পটটি বাতিল করা হল। তাহলে কি মাথাপিছু চাঁদা একটুখানি বাড়ানো যায়, সেক্ষেত্রে একটু দূরে যাবার কথা ভাবাও যেতে পারে। যার-যার পকেট হাতড়ে যা বোঝা গেল, খুব বেশি হলে আমরা বোট্যানিকাল গার্ডেন অবধি পৌঁছতে পারি। আমাদের কাছে তখন সে-ই অনেক বড় ব্যাপার। আমি নিজে তার আগে কখনও বোট্যানিকাল গার্ডেন যাইনি, শুনেছি সেখানে কয়েকশো বছর বয়সি মহীরুহেরা এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আর শীতের দুপুরবেলা সেইসব বৃক্ষরাজির আশেপাশে আমাদের অকেজো সম্মেলনও নেহাত মন্দ জমবে না। তাই মন আর পকেট, এই দুয়ের সম্মতিতে আমরা বোট্যানিকাল গার্ডেন যাওয়াই স্থির করলাম সে-যাত্রা।
কী কী রান্নাবান্না হবে, সেসব কীভাবে নিয়ে যাওয়া হবে, আর কী কী সরঞ্জাম থাকবে সঙ্গে, কে কোথায় কার সঙ্গে দেখা করে কীভাবে পৌঁছবে, সেসব ঠিক হতে লাগল এক হপ্তা মতো। জানুয়ারির এক রোববার পিকনিক। আর ঠিক হল, সেদিন কোনও কাজের কথা তোলা হবে না। খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, হইহুল্লোড়, আর ব্যাডমিন্টন। আমরা সকলেই অপেক্ষা করতে লাগলাম ওই একটি মহার্ঘ দিনের। এইখানে বলি, এই ‘সাবি’-এর মধ্যে একজন ভারি শান্ত আর মুখচোরা মেয়েও ছিল, যে কিছুই লিখত না। না কবিতা, না গল্প, না প্রবন্ধ। সম্পাদনার কাজেও জড়াত না কখনও। কিন্তু সে ছিল আমাদের দলের সামান্য দূরবর্তী এক সদস্য। কেননা সে যাকে ভালবাসত, সেই ছেলেটি আমাদের দলের সক্রিয় একজন কবি। তারই হাত ধরে কখনও-সখনও আমাদের আড্ডায় এসে বসত মেয়েটিও। তবে এতই নিঃশব্দ তার উপস্থিতি যে, আঙুল তুলে দেখিয়ে না দিলে বোঝাও যেত না, সে একই ঘরে আছে। লম্বা চুলের, শামলা ত্বকের, টানা চোখের রোগাসোগা একটি নির্জন মেয়ে। সে জুড়ে ছিল আমাদের সঙ্গে আশ্চর্য উপায়ে, যেভাবে মনের সঙ্গে জুড়ে থাকে স্মৃতি। দূরের, কিন্তু অনুপস্থিত নয়। আর সেই জুড়ে থাকার মধ্যে যে বিলক্ষণ এক আত্মীয়তা ছিল, তা সে বুঝিয়েছিল এই পিকনিকের আগের বছরেই। সেবার বড় একখানা সংখ্যার পরিকল্পনা হয়েছে, লেখাপত্র সব রেডি। শেষমেশ দেখা গেল এত বেশি খরচ পড়ে যাচ্ছে যে, সংখ্যা বার করবার উপায়ই নেই। তার ওপর প্রেসে এবং বাইন্ডারের কাছে প্রচুর টাকা বাকি আছে ইতিমধ্যেই। সে-টাকা শোধ না দিয়ে তাঁদেরই বা আবার কাজ করতে বলি কীভাবে! তাই একরকম মুষড়ে পড়া মন নিয়ে ধরেই নিয়েছিলাম যে, সংখ্যা আর বার করা যাবে না। কেননা নিজেরা চাঁদা তুলেও সে-টাকা উঠছে না কিছুতেই। এই ব্যর্থতার বৈঠকে হাজির ছিল সেই মেয়েটিও। আমরা সকলে যখন মুখ নীচু করে বেরিয়ে আসছি একে-একে সম্পাদকের বাড়ি ছেড়ে, তখন সে নিজের গলা থেকে সোনার চেন খুলে তুলে দিয়েছিল সম্পাদকের হাতে। আমরা বিস্ময়ে হতবাক। এমনটা কেউ কখনও করতে পারে নাকি? কিন্তু শান্ত সেই মেয়েটি করেছিল। তাকে বুঝিয়েও আমরা নিরস্ত করতে পারিনি। আর সেই চেন বিক্রি করে, ধার মিটিয়ে, আমরা হই হই করে বার করেছিলাম বার্ষিক সংখ্যা। সেদিন বুঝেছিলাম, আত্মীয়তা কাকে বলে।
পিকনিকে, আজও মনে পড়ে, আমরা দেদার মজা করেছিলাম। যে যার বাড়ি থেকে নানান মশলাদার সুস্বাদু খাবার নিয়ে গেছিলাম, সেসব উড়ে যেতে বেশিক্ষণ সময় লাগেনি। তখনও কলকাতায় মোটামুটি জম্পেশ একখানা শীতকাল জাঁকিয়ে বসত, আমরা তার সাক্ষী ছিলাম। অতরকম গাছ একসঙ্গে তার আগে কখনও দেখিনি, সত্যিই বোট্যানিকাল গার্ডেন এক বিস্ময়। কোনও গাছ প্রপিতামহ তো কোনও গাছ বন্ধু, কোনও গাছ অভিভাবক তো কোনও গাছ প্রেমিক। প্রত্যেকের চরিত্র আর ভূমিকা আলাদা। তার মাঝখানে আমরা কয়েকজন নেহাত ছোট ছেলেমেয়ে কেমন যেন শীতরোদ্দুরে মিশে গেছিলাম সেদিন। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব মিটিয়ে একটু এদিক-সেদিক আড্ডা সেরে ঠিক হল, এবার ব্যাডমিন্টন হবে। র্যাকেট আর ফেদার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, শুরু হল একের পর এক ম্যাচ। আমি তেমন দড় খেলোয়াড় নই, সহজেই গেম হেরে পাশে বসে খেলা দেখছিলাম। রোদ একটু একটু পড়ে আসছে তখন, হাওয়ায় শিরশিরানি বাড়ছে।
হঠাৎ খেয়াল করলাম, সেই শান্ত, রোগাসোগা, নির্জন মেয়েটি, সেই আশ্চর্য বান্ধবী আমাদের, কোথাও নেই। দল থেকে কখন যে সে স্বভাবসিদ্ধ ভাবে চোখের আড়াল হয়ে গেছে, আমরা কেউ খেয়াল করিনি। ও যখন থাকে আমাদের মধ্যে, তখনই কেউ খেয়াল করি কি? খেলা তখন জমে উঠেছে, আমি চুপচাপ পায়ে উঠে ওকে খুঁজতে শুরু করলাম। বোট্যানিকাল গার্ডেনের বিশালত্বের কোলে ওইটুকুনি এক মেয়েকে খুঁজে পাওয়াও ভারি দুষ্কর। কিন্তু বেশিক্ষণ লাগল না। কিছু দূরে, মস্ত এক ছায়াভরা ঠান্ডা ঝিলের পাশেই আবিষ্কার করলাম তাকে। সেদিন সে পরেছিল সাদা সালওয়ার আর সাদা কুর্তি। চুল নেমে এসেছিল পিঠ বেয়ে অনেকখানি। দেখি, সে মুখ নীচু করে বসে জলে নিজের ছায়া ভাঙছে। কিছুতেই নিজের মুখ থিতু হতে দিচ্ছে না ঝিলের ঠান্ডা জলের বুকে। এমন খেলা বুঝি তাকেই মানাত।
বললাম, ‘কী রে, এখানে একা-একা বসে যে?’ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল সে। তারপর ওই ঝিলের জলের চেয়েও ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল, ‘জানি না রে। ভাল লাগছে না কিছু।’ বুঝলাম, মনখারাপ তার। এ-সমস্ত সময়ে খুব কাছের বন্ধু না হলে পাশে বসাও যায় না। আমি তাই তাকে একলা ছেড়ে ফিরে এলাম দলের কাছে, খেলার কাছে, কোলাহলের কাছে।
সেই দল, সেই খেলা আজ বহু বছর হল ভেঙে গেছে। বয়সের রোদ্দুর লেগে খান খান হয়ে গেছে আমাদের সব শীতের দুপুর। সেই মেয়েটির সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখা হয়নি আমার। অনেকেরই হয়নি। দেখাও হয়ে যায়নি কখনও কোথাও। কেবল তাকে ভুলতে পারিনি কিছুতেই। অত নির্জনতা, অত নীরবতা সহজে ভোলা যায় না যে। কেবল এই কয়েকমাস আগে, কোন একটা দরকারে সেই সম্পাদক বন্ধুকে ফোন করে জানতে পারলাম, মেয়েটি নেই আর। কোথাও নেই। মনখারাপের রোগ তাকে এমন পেয়ে বসেছিল যে, গত বছর সে আত্মহত্যা করেছে। অভিভাবকদের রেখে, বর আর দুই সন্তানকে রেখে, ভারী দায়িত্বের চাকরি আর কবিতা পড়ার অদম্য নেশাকে রেখে সে সরে গেছে আড়ালে। হঠাৎ। খবরটা পেয়ে বিশ্বাস হচ্ছিল না। অস্থির লাগছিল খুব। কিছু কি করতে পারত না কেউ? এত-এত মনখারাপ কি সারিয়ে তোলা যেত না একবারও? পরে মনে পড়ল সেই পিকনিকের দুপুরের দৃশ্যটা। ওই একা-একা, মুখ নীচু, জলের গায়ে নিজের ছায়াভাঙা মেয়েটি সারা গায়ে পরে ছিল সাদা মনখারাপের পোশাক। আমরা কেউ চিনতে পারিনি। আর চিনতে পারিনি ওই শীতল গলার এক-বাক্যের মানে— ‘জানি না রে। ভাল লাগছে না কিছু।’
আমি এখন এই টুকরো কলকাতার মুছে আসা শীতের দুপুরে তার ভাঙা তরল মুখ জোড়া দিতে চেষ্টা করছি, পারছি না।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র