বাড়িটার দক্ষিণে রোদ লাগে না আর। নতুন দালান তুলেছে জ্যাঠার বড় ছেলে। শিউলি গাছটা বাড়ি তোলার সময় ইট-সিমেন্টের ধকলে মারা পড়ল। আমি কতবার ফোন করে বললাম সেবার, দাদা আর একটু জায়গা রেখে তুলিস কিন্তু বাড়ি! শুনল না সে-কথা। অথচ বড়দি লাগিয়েছিল ওটা। মানুষটা নেই দেখে তার রেখে যাওয়া সব কিছুর প্রতি এই অবহেলা মেনে নিতে পারিনি। সেই থেকে ওদের সাথে মনোমালিন্য।
তবু ছোটকাকা বেঁচে আছে এখনও তাই পুজোর ক’টা দিন হাজারটা কাজ ফেলে চলে আসি। দিনাজপুর থেকে বরিশাল আসা কম ঝক্কি না! সুভাষ আর আসতে চায় না। তাছাড়া ওদের পুজোর ক’টা দিন কাজের চাপ থাকে। আসবেই বা কী করে! এই ফাঁকে বেশ ক’বছর হল একা ঘোরার স্বাদ পাচ্ছি। প্রথমদিকে বাড়ির সবাই নিষেধ করত, কেউ-না-কেউ আসত বরিশাল থেকে আমাকে নিতে। জ্যাঠাও নেই, বাড়ির মেয়েদের আহ্লাদ দেখানোর কেউ নেই আর। বাবার অশক্ত শরীর, তাকে পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই।
তবু কাঠের দোতলাটা রক্ষা করা গেছে এটাই সান্ত্বনা। কী যে হচ্ছে আজকাল সবার মনে! পুরনো হয়ে গেছে মানেই বাতিল! গত বছর পুজোর আগে আমি আর ছোটকাকা মিলে ঘর ভাঙাটা আটকে দিলাম। ক’টা পয়সা খরচ হয়েছে কিন্তু একশো বছরের আদি কাঠামোটা ধরে রাখা গেল তো! বাপ রে! এখনও বুকের ভেতরটা কেমন করে মনে পড়লে।
বাবা আর কাকার জন্য কাটারিভোগ চাল নিলাম দেখে সুভাষ কেমন গাঁইগুঁই করল। আমি যেন বসে খাই আর কি! বরিশাল থেকে ফেরার সময় মা যে নারকেল, আমড়া, তেজপাতা, লেবু হ্যানাত্যানা কত কী ব্যাগে ঠেসে-ঠেসে দিয়ে দেয়, সে-বেলায় তো লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে দেখার জন্য।
দিনে-দিনে ওদের সত্যিকারের চেহারাটা প্রকাশ হচ্ছে যত, আমি তত একা হয়ে পড়ছি। মনে হয় এই ভাল হয়েছে। বাড়ির পুজোতে আগের সেই হইহল্লা কমেছে, ক’টা দিন হাত-পা ছড়িয়ে দোতলার বারান্দায় বারু পিসির মতো বসে থাকা যায়।
বারু পিসির কথা মনে এলে আজও কান্না পায়। বাবার তখন জমাট ব্যবসা। আজ ঢাকা যাচ্ছে তো কাল যশোর। বারু পিসির চুলের জটার মতো তেমাথার পাকুর গাছেও জটা নেমেছে। ঠিকমতো কথা বলতে পারত না পিসি, তবু খিদে পেলে মেজদা-মেজদা করে গোঙাত। মা স্নান করিয়ে তেল মাখিয়ে মন্দির-সিঁড়িতে সোনার জল ধোয়া রোদে বসিয়ে রাখত। জ্যাঠা নয়তো ছোটকাকা খাইয়ে দিত মুখে তুলে, জেদ করত ওর নিজের ভাষায়। ভাইদের হাত কামড়ে দিত পিসি, তবু আদরের সীমা ছিল না বোনের জন্য।
পিসি না বুঝেই কাঁদত বিসর্জনের দিন। আবার বলা যায় না, হয়তো ও বুঝেই কাঁদত; আমরাই পিসিকে বুঝতে পারতাম না। পেট খারাপ হলে বলতে পারত না দেখে কাকি ঘরে খিল দিয়ে রাখত পিসিকে, বাবা-কাকারা বাড়ি ফিরলে তবেই পিসিকে পরিষ্কার করে খাওয়ানো হত। মা রেগে গেলেই বলত, ‘কী ঘেন্নার কপাল আমার, বিয়ের পরই পাগল ননদের দেখাশুনা করতে-করতে মরে গেলাম!’
ছোটকাকি বাচ্চা নিতে চাইত না নাকি! যদি বারু পিসির মতো হয় ছেলেপুলে! পাগল বাচ্চা কোন বাবা-মা চায় জগতে? কিন্তু পিসির আমার সোনা কপাল! দেবতার মতো তিন ভাই, তারা বোনের জন্য যা করেছে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। মা আমার কত ভাল, তবু পিসির জন্য আলাদা পায়খানা, আলাদা বাসনপত্র। নাকে আঁচল চাপা দিয়েই তো ওর ঘরদোর ধুত। আর দাদার বেলায়, আমার বেলায় গু-শর্দি যাই হোক, মনে হত হাতে ননী-মাখন ছুঁয়ে নিচ্ছে।
জানলার ওপাশে শান্তাহার রেলস্টেশন। এখানে কিছুক্ষণ থাকলে মনে হয়, দিদার শাড়ির লাল পাড় বিছিয়ে আছে যেন। লোভী মানুষের চোখ এড়িয়ে বেঁচে আছে পুরনো দেওয়াল, সেটা শান্তাহার এলে বার বার মনে হয়। ব্রিটিশদের আমলের লাল ইটের হাজতখানা, ডাকঘর, রেলস্টেশন পাশাপাশি সহোদর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুভাষকে কত বলেছি, এখানে এসে একবার ঘুরে যাই শহরটা; কিন্তু কাজের অজুহাত প্রস্তুত করাই থাকে ওর। জীবনে কত কী দেখা হল না, নামা হল না পছন্দের রেলস্টেশনে!
বিয়েটা করেছিলাম রেলপথের জন্যই। সুভাষের বেলাতেও নাকি তাই ছিল! বিয়ের পর পর তো ওর কেবিন-রোমাঞ্চ অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এখন ওর ব্যবসা পুরনো হয়েছে, আমার শরীরটাও পুরনো হয়েছে। কিন্তু মন! সে কি পুরনো হয় কখননো? মন তো বারু পিসির চুলের জটা না, জড়াতে-জড়াতে ক্রমে নরম চুল শিলার মতো হয়ে যাবে। যায় কি মন?
বারু পিসি জীবনে প্রেম না পেয়ে চলে গেল। এ-কথা ভাবলে বুকটা খাঁ খাঁ করে রোদে তপ্ত এই ছোট্ট শহরটার মতো।
পুজো মানে উৎসব তো নয়, প্রচুর কাজও বটে। সকালে মা খুব চেঁচায়। সবাই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে। কার আশায় কে জানে? বেলা অবধি শুয়ে থাকা ধাতে নেই মা-র। কলতলা তপতপে চাই সবার, কিন্তু করবে কে? সাবিনার মা। পুকুরপাড়ে বাসি কাপড় নেবে কে? সাবিনার মা ছাড়া আর কে! তেজপাতা রোদে দেবে কে? মা-র গলা চেঁচিয়ে বসেনি, এমন দুর্গাপূজা এ-বাড়িতে আসেনি। আমি খুব মন দিয়ে দেখলাম, মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বাথরুম ধুচ্ছে। বারু পিসি বেঁচে না থাকলে কী হবে, অভ্যেস তো মরে না। বাবার ঘরে মেডিসিনের গন্ধ পুজোর ক’দিন মরে যায় ধূপের আধিপত্যে। মন তো চায় চিরদিনের জন্য মুছে যাক এই অসুখ-অসুখ ঘ্রাণ। মুছে যাক বাবার মুখে স্থায়ী হয়ে যাওয়া মৃত্যুর ছায়া। ঠাকুরকে কত বলি, বাবাকে ভালো করে দাও কিন্তু ঠাকুর তো আমার জন্য বসে নেই। হয়তো কোথাও আগুন লেগেছে, মা ডাকছে, হে ভগবান আমার বাচ্চাকে বাঁচাও! হয়তো ট্রাফিকে আটকে আছে রুগি, সেও তো প্রাণপণে ডাকছে। তবু দুর্গা মা এলে মনে কী এক ভরসা জাগে! ছোটকাকা আজ জ্যান্ত কই মাছ এনেছে সুগন্ধা নদীর। বাবার মেয়ে যতখানি, কাকার মেয়েও ততখানি আমি।
দোতলার বারান্দার কাঠের রেলিংটাতে কেউ যদি ভুলেও ভেজা কাপড় মেলে, কাকা ভীষণ চটে যান। যত্নে কী না টেকে! তাই বলে জেনেশুনে বাপ-দাদার জিনিস ধ্বংস করবে? সহ্য হয় না। কিন্তু ক’দিন? বাবা-কাকার শ্বাসের সাথে এই প্রশ্ন জড়িত যে!
সুভাষ একটিবারের জন্য ফোন করে না। বাবা দুপুরে গলা ভাত খাচ্ছিল আর দুর্বল স্বরে জানতে চাইছিল ওর কথা। অসুখ করেছে বাবা এই সম্পর্কের দেহে— কথাটা চোখের দৃষ্টিতে বোঝাতে চাইলাম। বাবা বুঝতে পারে খানিকটা।
এবার দাদা এল না, বৌদি এল না। মা রাগটা বাসনপত্রের সাথে করছে নয়তো সাবিনার মা-র সাথে। যে আসতে চায় না, ভালবাসতে চায় না— তাদের জন্য মন অবাধ্য হয় বেশি। অথচ একই রক্ত, দাদা তো ভালবাসল না বাবা যেমন পিসিকে বাসত। শুধু তো পুজোর জন্য আসি না অতটা পথ অত নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে, বাড়ির সবার জন্য আসি। দিনাজপুর তো আসিস না দেখতে শুধু জিনিস চাস। বোনকে দেখার জন্য তোদের চোখে ভালবাসা নেই। এই কাঠের দোতলারও জান আছে, তোদের সেটুকুও নেই? বিসর্জনে তো শুধু ঠাকুর ভাসান যায় না— ভালবাসা, মায়া, সব, যায়। কষ্ট থেকে যায়, মন্দিরের শানের মতো শীতল-কঠিন কষ্ট।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র