ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মূর্তিমান অপ্রত্যাশিত


    শান্তনু চক্রবর্তী (October 8, 2022)
     

    অনেক ছক্কা-পাঞ্জা, চুলচেরা হিসেব-নিকেশ করে, ২০১০ সালে আকাদেমি অফ মোশন পিকচার্স যখন সব ঠিক করেছে, এই এতদিনে জঁ লুক গোদার (বয়েস-টয়েস সবসুদ্ধ) একটা অস্কার পাওয়ার উপযুক্ত হয়েছেন— অতএব এইবার একটা লাইফটাইম খেতাব তাঁর নামে ঠুসে দেওয়া যায়— তক্ষুনি আমেরিকা জুড়ে ছিছিক্কার রব উঠল। মার্কিন মুলুকে অনেক ব্যাপারেই যাদের মৌরসিপাট্টা চলে, সেই প্রবল ‘প্রভাবশালী’ ইহুদি সমাজের একটা বড় অংশ বলতে লাগল— এ কী অনাসৃষ্টি কাণ্ড! গোদারের মতো একজন ঘোর ইহুদিবিদ্বেষীকে আকাদেমি খাতির করে ডেকে এনে অস্কার দেবে? নেহি চলেগা! দক্ষিণপন্থী সংগঠন জিওনিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকা লম্বা লিস্টি বানিয়ে ফেলল গোদারের সিনেমায় কোথায়-কোথায় ইহুদিবিদ্বেষের নমুনা আছে। সেইসঙ্গে এটাও জানাল, গোদার আমেরিকার মাটিতে পা রাখলে তারাও ছেড়ে কথা বলবে না! 

    গোদার অস্কার নিতে জীবনে  যাননি। জিওনবাদীদের ভয়ে নয়, হলিউডের প্রতি ঘেন্নায়। আর তাচ্ছিল্যে। কিন্তু ইহুদিবিদ্বেষের তকমাটা তাঁর গায়ে সেঁটেই থেকেছে। সেটাকেও অবশ্য পাত্তা দেননি। কারণ, তিনি জানতেন, তাঁর টার্গেট ইহুদিরা নন— তাঁদের তথাকথিত হোমল্যান্ড ইজরায়েল। যে-দেশের সরকার গত ৭৫ বছর ধরে প্যালেস্তাইন-এর জিনা হারাম করে রেখেছে। ‘আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি’ গোছের কোনও বিবৃতি না দিলেও, তিনি যে প্যালেস্তাইনের মুক্তিযুদ্ধ, পিএলও বা ইয়াসর আরাফতের পক্ষে, তা নিয়ে গোদারের কোনও ঢাকঢাক-গুরগুর ছিল না।

    ১৯৭৬-এর ছবি ‘হিয়ার অ্যান্ড এলসহোয়ার’-এও সেটা খোলাখুলি বলে দিয়েছেন। এখানে ‘জাক্সটাপোজিশন’ কাটে তিনি ইজরায়েলের তখনকার প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার আর হিটলারকে পাশাপাশি দেখিয়েছেন। বার্তাটা একদম পরিষ্কার— ইহুদি গণহত্যা বা হলোকাস্টের নাৎসি-নায়ক হিটলারের হাত থেকেই হিংসা-সন্ত্রাসের ব্যাটনটা নিয়েছেন গোল্ডা মেয়ার। আর জঙ্গি মারার নাম করে বোমা ফেলে, মিসাইল ছুঁড়ে, হাজার-হাজার ফিলিস্তিনি নারী-শিশু, সাধারণ মানুষকে খুন করছেন।

    জঁ লুক গোদার : মূর্তিমান অপ্রত্যাশিত

    ছবিটা মুক্তি পাওয়ার পর একটি জঙ্গি ইহুদি জিওনবাদী সংগঠন ‘অ্যান আই ফর অ্যান আই’-এর শো বানচাল করে দেওয়ার জন্যে প্যারিসের একটা সিনেমাঘরে দুর্গন্ধ গ্যাসবোমা ফাটিয়ে, ইঁদুর ছেড়ে দিয়েছিল। হলের ইহুদি মালিক ভয়ানক খেপে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা তো একেবারে নাৎসিদের মতো কাজ-কারবার!’ গোদার তখন দাঁতের ফাঁকে সিগার চিপে মুচকি হেসে বলতেই পারতেন, ‘আরে আমিও তো সিনেমায় এই কথাটাই প্রমাণ করতে চেয়েছি।’ তবে গোদার যে-কথাটা বলছেন, ঠিক সেটাই বিশ্বাস করেন কি না, বা এক্ষুনি যেটা তাঁর বিশ্বাস বলে মনে হচ্ছে বা ভাবা হচ্ছে, সিনেমায় সেই ভাবনাটা ঠিক ওভাবেই আসবে কি না, গোদার-ভক্তরাও সে-ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন না!

    গোদার নিজেও কি পারেন? নিজের চিন্তার স্ববিরোধিতাকেও তো তিনি সিনেমায় টেনে এনে বেমক্কা তর্ক জুড়ে দিতে পারেন। আজ এই মূর্তিমান অপ্রত্যাশিতের নামই তো জঁ লুক গোদার। তিনি নিজেই নিজেকে অবিরাম ভেঙে চলেন। নিজের অন্দরে কোনও প্রতিষ্ঠানের স্থাণু-স্থবির শিকড়-বাকড় গজিয়ে গেলে, নিজেই সেটাকে উপড়ে ফেলেন। এটাও একরকম ডায়ালেক্টিকস-ই তো। মগজে জমে ওঠা থিসিসটাকে পাল্টা অ্যান্টি-থিসিসের ধাক্কায় দুরস্ত করে নতুন রাস্তা খুঁজে নেওয়া। 

    তিনি ইহুদিবিদ্বেষী কি না, এই বিতর্কটাকেও গোদার তাই শেষ অবধি বাস্তবতা ও দৃশ্য বা ইমেজ-এর সম্পর্কের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারেন। গোদার তর্কটা তুলেছিলেন সিনেমার পর্দায় হলোকাস্ট-কে কীভাবে, কতটা দেখানো হবে তাই নিয়ে। ফরাসি ইহুদি পরিচালক ক্লদ লান্‌জম্যান তাঁর বিখ্যাত তথ্যচিত্র ‘শোহ্‌য়া’-য় আর্কাইভের ফুটেজ ব্যবহার করেননি। আবার গোদার মনে করতেন, ইতিহাসের ঘটনার পুনর্নির্মাণে নিউজ-রিল, আর্কাইভের ফুটেজ যে প্রামাণ্যতা তৈরি করতে পারবে, অন্য কোনও গোঁজামিল দিয়ে সেটা সম্ভব নয়। তাঁর ৮ পর্বের বিরাট টিভি সিরিজ ‘হিস্ট্রি অফ সিনেমা’-য় তিনি এই তর্কটাকে আবার খুঁচিয়ে তুলবেন। হলোকাস্ট নিয়ে তিনি বিভিন্ন সিনেমার মন্তাজ-কে ময়নাতদন্তের টেবিলে চাপিয়ে, কেটে-চিরে-ছিঁড়েখুঁড়ে বোঝবার চেষ্টা করবেন, ইতিহাসের যে গভীর ক্ষত, দুঃসহ যন্ত্রণা মানুষ সয়ে এসেছে, ইমেজ সেই সব রক্তপাত, আঘাতের চিহ্নকে সত্যি-সত্যি কতটা তুলে ধরতে পারে! বাস্তবের সেই সত্যিকে তুলে ধরার ক্ষমতা আদৌ কতটা ইমেজ-এর আছে। এভাবেই পুরো তর্কটা দৃশ্যের বাস্তব আর বাস্তবের দৃশ্যময়তায় একটা দার্শনিক আলোচনায় গড়িয়ে যায়। 

    ‘ব্রেথলেস’-এর একটি দৃশ্যে জঁ পল বেলমন্দো ও জিন সেবার্গ

    গোদারকে নিয়ে এটাই তো মুশকিল। পদ্য-গদ্যর পর্ব পেরিয়ে তিনি সেই সত্তরের দশক থেকেই পর্দায় প্রবন্ধ লেখেন। ফিচার রিপোর্টাজের মতো হালকা-ফুলকা ব্যাপারও নয়। একদম ভারী, গম্ভীর প্রবন্ধ। আর যতদিন তাঁর সিনেমায় গপ্প বা ন্যারেটিভের ল্যাজা-মুড়ো-ধড় ইত্যাদি থেকেছে, সেখানেও তো তার ক্রম বা অর্ডার-টাকে তিনি সজ্ঞানে, সচেতনভাবে এবং সগর্বে এদিক-ওদিক করে দিয়েছেন বার বার। সাহিত্য, সিনেমা এমনকী পপ-আর্টের দুনিয়া ঘেঁটে খুঁজে আনা বিভিন্ন টেক্সট-এর অনুষঙ্গ ঢুকে পড়েছে মূল আখ্যানের শরীরে। যে-ছবিটা দিয়ে দুনিয়া তাঁকে চিনল, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’-এর পরে ফরাসি ন্যুভেল ভাগ-এ অশ্বমেধের ঘোড়া আরও টগবগে, বলগাহীন হল; সেই ‘ব্রেথলেস’ থেকেই ব্যাপারটা ঘটে আসছে। ‘ব্রেথলেস’-এর জাম্পকাট এতকালের নিখুঁত, পেলব, গল্পবোনা এডিটিং-এর নরম-মসৃণ সেলাইয়ের ফোঁড় ধরে টান মারল— বা ট্রলি পেতে ট্র্যাকিং শট নেওয়ার বদলে সিনেমাটোগ্রাফারের হাতে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা ধরিয়ে, তাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে চেয়ারটা গোদার নিজেই ঠেললেন— এইসব ছকভাঙা কাণ্ডকারখানা তো ঘটেই চলেছিল। 

    পাশাপাশি একইসঙ্গে ‘ব্রেথলেস’-এর সিনেমা টেক্সটের শরীর ভরে কতরকম সাংস্কৃতিক চিহ্ন। এই ছবির নায়ক যেন উঠে আসছে হলিউডের গ্যাংস্টার জঁর-এর গর্ত থেকে। ‘কাহিয়ে দ্যু সিনেমা’ পত্রিকায় লেখার সময়, যে-হলিউড মেইনস্ট্রিমকে বুলডোজার চালিয়ে পিষে গেছেন, নিজের ছবিতে সেইসব ফর্মুলাকে তিনি রিভার্স গিয়ারে, বাজার আর পুঁজির উল্টোবাগে ব্যবহার করেছেন। ‘ব্রেথলেস’-এ হলিউড তারকা হামফ্রে বোগার্টের শেষ ছবি ‘দ্য হার্ডার দে ফল’-এর পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছবির নায়ক বেলমন্দো প্রাণপনে বোগার্টের স্টাইল, অভিব্যক্তি নকল করার চেষ্টা করেন। এ-ছবিতে যেমন আমেরিকার বি-গ্রেড সিনেমা বানানোর কারখানা মনোগ্রাম পিকচার্স-এর কথা আছে, তেমনই আবার বার্গম্যানের ছবির ভিসুয়ালও আছে। উইলিয়াম ফকনার বা লুই আরাগঁ-র গদ্য, কবিতার উদ্ধৃতি আসে। দৃশ্যে-শ্রাব্যে মিলেমিশে থাকেন পিকাসো, বাখ্‌, মোৎসার্টরা।

    এভাবেই গোদারের ছবির মূল টেক্সট-এর ফ্রেমে-ফ্রেমে পপ-আপ হাই আর্টের নানান ভেজাল, গা-ঘষাঘষি কাজ ছড়িয়ে থাকে। দর্শককে একটুও জিরোতে দেয় না। হৃদয় আর অনুভূতির চেয়েও তাকে অনেক বেশি করে মগজ আর মননের সব ক’টা দরজা খুলে, স্নায়ু টানটান করে বসে থাকতে হয়। সিনেমাঘর যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার-রুম, পর্দা যেন জ্যান্ত লাইব্রেরি আর গোদার যেন জ্ঞান-পাগল, মজাদার, দার্শনিক-অধ্যাপক। তাঁর পুরু চশমার কাচের আড়ালে ঝকঝকে চোখদুটোয় একইসঙ্গে মেধা আর কৌতুকের ঝলক। দর্শকের সঙ্গে এই মেধাবী কৌতুকের খেলাটা গোদার চিরকালই খেলে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘লাইফ ইজ এক্সটেনশন অফ সিনেমা।’ বা ‘সব কিছুই সিনেমা।’ তাই যতদিন তাঁর সিনেমার চরিত্ররা বা সেই চরিত্রদের ঘিরে কিছু কাহিনির টুকরো-টাকরা অবশিষ্ট থেকেছে, সেখানেও চরিত্ররা কখন যে কাহিনির বাস্তব পেরিয়ে সিনেমায় ঢুকে যাচ্ছে, আবার সিনেমার দুনিয়া ছেড়ে নিজেদের জীবনের বাস্তবে ফিরে আসছে, সেটা অনেক সময়ই গুলিয়ে যায়। ‘ব্রেথলেস’-এর শেষে পুলিশের গুলিতে নায়ক যেভাবে মারা যাচ্ছে, সেটা তো হলিউডি সি-গ্রেড সিনেমার মৃত্যুদৃশ্যের চেয়েও কাঁচা; যাচ্ছেতাই, অতিনাটকীয়। মানে বেলমন্দো সিনেমায় মারা গেলেন না বাস্তবে, সেই ধন্দটা থেকেই যাচ্ছে। গোদারের চরিত্ররা অন্যের লেখা গল্প-উপন্যাসের ঘটনাকে নিজের বলে চালিয়ে দিতে চায়। নিজের বাস্তবকে ‘কাহিনীর’ বাস্তবের মতো সাজিয়ে তুলতে চায়। ব্রেখট-এর এলিয়েনেশন তত্ত্বকে খোলাখুলি, বুক ফুলিয়ে সিনেমায় ব্যবহার করেছেন। ১৯৬৭-র ছবি ‘উইকএন্ড’ সম্বন্ধে একজন সমালোচক লিখেছেন, ‘ফিল্ম দ্যাট রিড্‌স ইটসেল্‌ফ, টেল্‌স দ্য ভিউয়ার, হোয়াট দ্যাট রিডিং শুড বি, অ্যান্ড অ্যাট সেম টাইম টেল্‌স দ্য ভিউয়ার দ্যাট রিডিং ইজ ইনঅ্যাকুরেট অ্যান্ড শুড বি ইগনোরড!’

    ‘ব্রেথলেস’-এর শেষ দৃশ্য

    এই পরিচালককে কে বিশ্বাস করবে বলুন তো? কোন ভরসাতেই বা করবে? তিনি কোন পক্ষে, সেটাই বা নিশ্চিত করে কে বলবে? ‘লা শিনোয়া’ ছবিটার কথাই ধরুন। ১৯৬৬-তে চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, সদর দপ্তরে কামান দাগার জন্য মাও-সে-তুঙের ডাক, আর সেই ডাকে সাড়া দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনজুড়ে কচি-টিনএজার রেডগার্ডদের দাপাদাপির পটভূমিতে ১৯৬৭-তে সেই ছবিটার পুরো ইংরেজি নাম ‘দ্য চাইনিজ অর র‍্যাদার ইন দ্য চাইনিজ ম্যানার : এ ফিল্ম ইন দ্য মেকিং’। ছবির নামেই গোদার এখানে একটা অনিশ্চয়তা রেখে দিতে চাইছেন। মাও-এর রেডবুক, সাংস্কৃতিক বিপ্লব, মাওবাদীদের ব্যক্তিপুজো বা নেতা-ভজনা নিয়ে গোদারীয় ভঙ্গিতে রং-তামাশাও আছে। তবে সমাজ বদলের পথ নিয়ে সে-সময়ে গোটা দুনিয়ার বামপন্থীদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব মতাদর্শের সংকটটা তিনি ছবিতে স্পষ্ট করে দিতে পারেন। ফলে সব রঙের বামেরাই ছবিটা দেখে তাঁর ওপর বেজায় খাপ্পা হয়ে যান। কিন্তু ‘ম্যাসকুলিন ফেমিনিন’-এ তিনি যে ‘কার্ল মার্কস আর কোকাকোলার সন্তান’দের কথা বলেছিলেন, ‘লা শিনোয়া’য় তিনি তাদের আরও ভাল করে চিনেছেন এবং দর্শকদের চিনিয়েছেন। কয়েক মাস পর এই ছেলেমেয়েরাই তো গোদারের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় সরবোন থেকে একটা অসমাপ্ত বিপ্লবের সূচনা করবে, যেটা ফ্রান্সের জবরদস্ত শাসক দ্য গলকে তাঁর চেয়ার থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তারপর সেই ছেলেমেয়েরা আবার তাদের সুখী-বুর্জোয়া-নিরাপদ-নিশ্চিন্ত গৃহকোণে ফিরে যাবে। কিন্তু গোদারের কী হবে?

    ‘লা শিনোয়া’ ছবির একটি দৃশ্য

    গোদারও তো রীতিমতো রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্টের ভূমিকায় ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকদের যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে পা মিলিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। কিন্তু ফ্রান্সে বা পশ্চিমি দুনিয়ার কোথাও তো বিপ্লব হল না। বাজার আর কনজিউমার-সংস্কৃতি বিপ্লবী আবেগ-উত্তেজনার স্মৃতিচিহ্নগুলোকেও ভাঙিয়ে মুনাফা করার রাস্তা খুঁজে নিল। তাহলে গোদার কী করবেন? ‘উইকএন্ড’-এর এন্ড-টাইটেলে তিনি ‘এন্ড অফ সিনেমা’ লেখা একটা কার্ড দেখিয়েছিলেন। তাঁর জীবনেও যেন সেটা মেটাফর হয়েই থেকে গেল। তথাকথিত গল্প বলা সিনেমার কাছে তিনি সেভাবে আর ফিরলেনই না। 

    তবে পর্দায় এবং পর্দার বাইরে কনজিউমারবাদ, পণ্য-ফেটিসিজম, বাজার ও ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যক্তিগত ক্রুসেড জারি থেকেছে। ‘ক্রুসেড’ শব্দটাও গোদার প্রসঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সঠিক হল কি না জানা নেই। তবে ভিয়েতনাম থেকে প্যালেস্তাইন— যেখানে যখন প্রতিবাদ করা জরুরি ও সঠিক মনে করেছেন, সরব এবং তীব্র হয়েছেন। কোনও কিছুর তোয়াক্কা করেননি। এই সময়ের মধ্যে গোদার ছবিতে আরও রগচটা, তিতকুটে, ঝগড়াটে এমনকী হিংসুটেও হয়েছেন। সেই সঙ্গে হয়তো আরও জটিল এবং আরও দুর্বোধ্য। আখ্যান, তথ্যচিত্র, নিউজ-রিলের সব সীমান্ত-কাঁটাতার সব উপড়ে ফেলে দিয়েছেন। তাঁর নিন্দুকের সংখ্যা বেড়েছে। দেশে-দেশে, আরও বেশি-বেশি করে মানুষ হয়তো বলেছেন, ‘গোদার আমার একদম ভাল লাগে না।’

    গোদারের তাতে কিছু যায় আসেনি। তাঁর সাই-ফাই ছবি ‘আলফাভিল’-এর সুপার কম্পিউটার ‘অযৌক্তিক’ ও ‘অদরকারি’ শব্দগুলো, অন্য গ্রহের সেই ডিকশনারি থেকে মুছে দিত। ছবির নায়িকা নাতাশা, পৃথিবী থেকে আসা সিক্রেট এজেন্টের কাছ থেকে দুটো শব্দ শিখেছিল— ‘বিবেক’ আর ‘ভালবাসা’। আমরা গোদারকে ভালবাসতে পারি বা না পারি, তিনি আমাদের বিবেককে জাগিয়ে রাখার জন্য চেষ্টায় কোনও কসুর করেননি। আমৃত্যু।             

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook