মনের উপর একটা টসটসে পাকা ফোঁড়ার মতো ছিল মুখটা। অনেকদিন আগে একবার মাত্র দেখলেও চোখদুটো দেখেই বুঝে গিয়েছিলেন সুমনা। এই সে। ‘কেন করলেন?’ প্রশ্নটা ততক্ষণে জিভের ডগায়। আগ বাড়িয়ে তাই নিজে থেকেই বললেন, ‘দিদি, আপনি কি নতুন এলেন?’ তবে মহিলা উত্তর দিলেন না। ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন মাত্র। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এগিয়েই যাচ্ছিলেন সুমনা আর তখনই প্রশ্নটা এল, ‘আপনি কত দিন আছেন এখানে?’
‘পাঁচশো সাতাশ দিন’, বলতে গিয়েও থেমে গেলেন সুমনা। জীবনটা ছারখার হওয়ার পর থেকে দিন গোনাটা যেন একটা অভ্যাস। ‘বেশি নয়। ওই বছর দেড়েক।’ আলতো হেসে বললেন সুমনা।
‘এখানে সারাটা দিন কাটান কীভাবে?’ উদ্বেগের সাথে মহিলা জিজ্ঞেস করলে সুমনা বুঝেই গিয়েছিলেন, মহিলা সুমনাকে বোঝেননি।
‘দিন কাটাতেই তো এখানে আসা। তবে এখানে দিনগুলো বুঝতে পারবেন না। যন্ত্রণা, মানুষ, সুখ-অসুখ… এসব নিয়েই কেটে যায়।’
‘মনখারাপ করে না? মানে এই অপরিচিত…’
‘মেয়েমানুষের আবার অপরিচিত! অপরিচিতদের মাঝে থাকতেই তো জন্ম আমাদের! মানিয়ে নিতে-নিতেই তো শেষ হয়ে এল সময়।’
সমব্যথা মানুষকে কাছের করে দেয়। মহিলা যেন বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। ‘চলুন না, এই সামনের চেয়ারে একটু বসি। বসে একটু গল্প করি’, মহিলা বললেন। সুমনা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। এতদিন ধরে বয়ে বেড়ানো প্রশ্নটা ঠিক এই মুহূর্তটারই অপেক্ষা করছিল যেন। মহিলাকে অনেক খুঁজেছেন সুমনা। কিন্তু কোনওদিনও ধরতে পারেননি।
২.
সায়াহ্নে বৃদ্ধাশ্রমটা কেবলমাত্র মহিলাদেরই। বেশ সাজানো-গোছানো। সুমনার করা বাগানটাতেই চেয়ার টেনে বসলেন ওঁরা। মুখোমুখি। সেলাইয়ের রোজগারে ভাড়া করা বাড়ির বারান্দায় গাছ ঝোলালে রোদ আসে না। মেঝেতে টব রাখলে তার থেকে জল গড়িয়ে মেঝেতে পার্মানেন্ট দাগ বসে যায়। এসবের চক্করে গাছের শখটাও চুলোয় গিয়েছিল সুমনার। কিন্তু এই সায়াহ্নে আসার পর ঈশ্বর যেন পুষে রাখা ইচ্ছেটাকে হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। ‘বাহ, বাগানটা তো বেশ!’ মহিলা বললে সুমনা বেশ জোর গলাতেই বললেন, ‘এসব আমারই লাগানো। আমার ছেলেপুলে। আসলে বিশাল বাড়ি ছিল আমার। বিশাল বাগান। সেখান থেকেই এই অভ্যাস।’
‘এখন আর নেই?’ ভদ্রমহিলা ‘ছিল’ শব্দটাকে আঁকড়ে ধরে বললেন।
‘থাকবে না কেন? সব আছে।’
‘তাহলে এখানে?’
‘ইট-কাঠ-পাথর তো আর কথা বলে না। বোবা বনে গিয়েছিলাম। তাই জমানো সমস্ত কিছু দিয়ে এই জায়গাটাকেই ঘর ভেবে নিলাম।’
‘ওহ! ছেলেপুলে? হাজব্যান্ড?’
‘না! সেসব নেই।’
‘নে-ই? সরি!’
সুমনা এবারে মিথ্যাটা বেশ স্পষ্ট ভাবেই বললেন, ‘না, না। সরির কিছু নেই। সেসব কোনও কালেই ছিল না।’
‘সত্যি বলতে সেসব না থাকাই ভাল। থেকেও বা…’ বলতে-বলতে থেমে গেলেন মহিলা। সুমনাকেই তাই বলতে হল, ‘না দিদি। বয়সকালে খুঁটির দরকার। এই শেষটুকু বাদ দিলে অবসর বলে তো আর কিছু নেই জীবনে। আর অবসরে যদি কাছের লোকই না থাকল তাহলে আর কীসের জীবন!’
‘আপনি কোথাও ভুল করছেন।’
‘ওহ, ভুল করলাম! মাফ করবেন।’
‘না না। মাফ করার কিছু নেই। আমি আসলে ছেলে-বউয়ের সাথে আর পারছিলাম না। কথা বলা মানুষের থেকে বোবা ইট-কাঠ অনেক ভাল। বউটার মতো ছেলেটাও একটা জানোয়ার। জীবনে দাপিয়ে রোজগার করেছি। টাকাও জমিয়ে রেখেছি। কারও খাইও না, পরিও না। খামোখা কেন কথা শুনব বলুন তো?’ ভদ্রমহিলার একনাগাড়ে বলা কথাগুলো বেশ স্বস্তি দিল সুমনাকে। চোখ দিয়ে আজকাল আর জল পড়ে না। তবে পড়লে যেন আরও স্বস্তি হত। ‘সে তো বটেই।’ গলা ঝেড়ে সুমনা কিছুটা প্রশ্রয় দিয়ে বললেন, ‘তা আপনার উনি! মানে…’
‘আর উনি! যেমন ছেলে তার তেমন বাপ। পঞ্চাশ পেরোতে-না-পেরোতেই সুইসাইড।’
একটা অদ্ভুত শূন্যতা যেন গুঁতো মেরে গলার নীচে আটকে থাকা কান্নাটাকে ঠেলে দিচ্ছিল সুমনার। তবে সামলে নিলেন। মানুষটা যে নেই, সেটা আগেই জানতেন। কিন্তু এভাবে কেউ সামনাসামনি বলেনি। সিঁদুর না পরলেও ব্রোঞ্জের চুড়ির নীচে নোয়াটাকে হাতেই রাখতেন। সেটাতেই আঙুল ঘষতে-ঘষতে সুমনা বললেন, ‘চলে গিয়েছেন!’
মহিলা ততক্ষণে বেশ সাবলীল। ভেতর থেকে যেন অনেক কথা আপন ছন্দে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মহিলা আটকাচ্ছেনও না। ‘হ্যাঁ, চলে গিয়েছেন। তাতে অবশ্য আমার কোনও আক্ষেপ নেই।’
অস্বস্তি হলেও ভিতরের একটা তাগিদ যেন প্রাণপণে বলতে চাইছিল, আরও বলুক। বলতে দে। সুমনা তাই শুনতেই থাকলেন। ‘আর বলবেন না। সে ডিভোর্সি ছিল। একটা পয়সাওয়ালা কাপুরুষ। নিজে কী চায়, সেটাই জানত না! টাকার লোভে আমিও সেই সুযোগটাকে লুফে নিলাম। ওঁর বাবা-মার দেখে দেওয়া ঘোমটা ঢাকা বউটাকে ছাড়িয়ে বোকাটাকে হাতে করলাম।’
সুমনা মন দিয়ে শুনছিলেন দেখে ভদ্রমহিলা আরও বললেন, ‘আপনাকে একটা সত্যি কথা বলি, জানেন তো ছেলেটাও আমার নয়। উজবুকটার আগের পক্ষের। নিজের রক্ত হলে কি আর এভাবে ঘর থেকে তাড়াত? কত মিথ্যে যে বয়ে বেড়াব জীবনে কে জানে!’
ভীষণ হালকা লাগছিল সুমনার। ছেলের হাত ধরে বৃদ্ধাশ্রমে আসার থেকে নিজের পায়ে হেঁটে বৃদ্ধাশ্রমে আসাটা যেন অনেক স্বস্তির। অনেক আরামের। নিজের লোককে মিথ্যা বলার থেকে পরকে মিথ্যা বলা অনেক সোজা। ‘দিদি, অপ্রিয় সত্যের থেকে মিথ্যা তো অনেক হালকা। বয়ে বেড়াতে তো তেমন কষ্ট নেই। ভাবুন তো, যদি সত্যিটা বইয়ে বেড়াতে হত! যদি আপনারই ছেলে আপনাকে ঘর থেকে তাড়াত?’ স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বললেন সুমনা।
‘এটা আপনি একেবারে খাঁটি কথা বলেছেন। এই তো দেখুন না, উজবুকটাকে আমি কোনওদিনও জানতেই দিইনি যে মা হবার ক্ষমতাটাই ছিল না আমার। উলটে আমি আর সন্তান নেব না বলে ছেলেটাকে কেড়ে আনা করিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, নিজের মতো করে মানুষ করব। কিন্তু পারলাম আর কই! আসলে কী বলুন তো, রক্তের দোষ আর যাবে কোথা দিয়ে?’
শব্দগুলোর প্রত্যেকটা যেন এক একটা বিষাক্ত তির। জ্বালা করছিল সারা শরীর। প্রতিবাদ করেই বললেন সুমনা, ‘আহা এভাবে বলছেন কেন? মানুষটার সাথে তো আপনি ঘর করেছেন। তাছাড়া উনি তো আর এই পৃথিবীতে…’
একরাশ আক্ষেপ যেন মহিলার মুখটাকে জাপটে ধরল। ‘আসলে কী বলুন তো, আমি লোককে আমার স্বামী-ছেলের কথা বলি কিন্তু আমার মনটা জানে, এসব সব মিথ্যা। এরা কেউই আমার নয়। সবাই অন্যের। ভীষণ আফশোস হয়। মনে হয়, কেন করলাম?’
গোটা পৃথিবীটা যেন একটা জীবন। একপাশে দিন তো আরেক পাশে রাত্রি। জীবনের সমস্ত রাগ-ক্ষোভ এক লহমায় ভ্যানিশ হয়ে গেল। সম্পর্ক, জীবন তখন সব মিথ্যা। সত্যি শুধু কাউকে নিজের করে ভাবাটাই। ‘আমি আবার উল্টো’, কথাটা বলে সুমনা আরও বললেন, ‘মনের কথা মনে রাখাই ভাল। পরে আবার সত্যি-মিথ্যা গুলিয়ে না যায়।’
কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারলেন না মহিলা। তাই কথা ঘোরাতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দেখেছেন, কথা বলতে গিয়ে আপনার নামটাই জানা হয়নি। আমি পারমিতা। আপনি?’
পারমিতাকে এতদিন প্রতিপক্ষ-ই ভেবে এসেছেন সুমনা। কিন্তু সর্বহারা প্রতিপক্ষের সামনে নিজেকেই যেন মহিলার প্রতিপক্ষ মনে হল। যে কিছু জিততেই পারেনি, সে আর কী হারাবে! নিজের নামটাও বলতে ইচ্ছে করছিল না সুমনার। তবুও বললেন, ‘বুড়ো বয়সে আবার নাম! যাক গে, আমার নাম সুমনা।’
‘জানেন, ওঁর আগের স্ত্রী-র নামও ছিল সুমনা।’
সুমনা তার বার্ধক্যে সরু হয়ে যাওয়া হাতে ঢলঢলে ব্রোঞ্জের চুড়িটাকে শক্ত করে ধরে বললেন, ‘ওহ! তবে আমার কোনও কালেই কেউ ছিল না।’
ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎসামন্ত